ব্যক্তিত্ব গঠনে সূরা হুজুরাতের ৯টি মৌলিক নীতিমালা

ধর্ম ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১৩ ১৭:২৩:৫০
ব্যক্তিত্ব গঠনে সূরা হুজুরাতের ৯টি মৌলিক নীতিমালা

একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব শুধু বাহ্যিক গুণাবলীতে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং তার অন্তরের গুণাবলী, চরিত্র ও নৈতিকতা তার প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করে। মানবজীবনে সুষ্ঠু সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং নিজেকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে নানামুখী নির্দেশনা দিয়েছেন। এ সকল নির্দেশনার মধ্যে বিশেষভাবে আলোচিত একটি সূরা হলো সূরা হুজুরাত, যা আমাদের জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে আচরণগত নীতি ও মূল্যবোধের জন্য আদর্শ উপদেশ বহন করে।

সূরা হুজুরাত মূলত নবীজির ঘরবাড়ির অনুগ্রহ ও মর্যাদার ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়ে শুরু হলেও এর অন্তর্গত আয়াতগুলোতে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক দিক তুলে ধরা হয়েছে, যা মানব ব্যক্তিত্ব বিকাশে অপরিহার্য। সূরাটির নির্দেশনাগুলো সামাজিক ন্যায়বিচার, সম্মানবোধ, বিশ্বাস ও সম্পর্ক রক্ষায় গভীর ভূমিকা রাখে।

১. উপহাস থেকে বিরত থাকা [আয়াত ১১]

সূরা হুজুরাতের প্রথম উল্লেখযোগ্য উপদেশ হলো একে অপরকে উপহাস না করা। আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিচ্ছেন, কেউ যেন অন্যজনকে ছোট করে বা কটাক্ষ করে না। কারণ, উপহাস মানুষের আত্মসম্মান ক্ষুণ্ন করে এবং সামাজিক সমন্বয় নষ্ট করে। এমনকি কুরআনে বলা হয়েছে, হতে পারে যাকে তুমি ছোট বলো, সে আল্লাহর কাছে তোমার চেয়ে উত্তম। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যেন আমরা কাউকে তার অবহেলা করি না, বরং সবাইকে সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে দেখতে শিখি।

উপহাস একটি সহজাত অহংকার ও অহঙ্কারের প্রকাশ; এটি মানুষকে গুণাবলীর পরিবর্তে তুচ্ছতায় ফেলে দেয়, যা প্রকৃত মনুষ্যত্বের বিরোধী। একজন পরিপূর্ণ মানুষ সবসময় নম্রতা ও সদয়তা প্রদর্শন করে।

২. দোষারোপ থেকে বিরত থাকা [আয়াত ১১]

আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের সতর্ক করেছেন, যেন তারা একে অপরকে অযথা দোষারোপ না করে। দোষারোপের মাধ্যমে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি হয়, সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং সমাজে অবিশ্বাসের বীজ বোনা হয়। পরিবর্তে আমাদের উচিত ভুল ধরিয়ে দেওয়া হলেও ভদ্র ও সম্মানজনক ভাষায় করা।

একজন সুচিন্তিত ব্যক্তি ভুলের প্রতি সহানুভূতিশীল হয় এবং সংশোধনের সুযোগ দেয়; কিন্তু দোষারোপ একটি নেতিবাচক মনোভাব যা সম্পর্ক ভাঙ্গার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

৩. মন্দ নামে ডাকা থেকে বিরত থাকা [আয়াত ১১]

ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে মন্দ নাম ধরে ডাকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটি অন্যের সম্মান ক্ষুণ্ন করে এবং মানবসমাজে বিভাজন ঘটায়। ইসলামে প্রত্যেক মানুষ মর্যাদাবান এবং তাদের সৎ নাম বা গুণের মাধ্যমে সম্বোধন করাই উত্তম। নামের মাধ্যমে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করা মানে ঈমানের ক্ষতি।

শুধু বাহ্যিক নাম নয়, ব্যক্তি সম্পর্কে মন্দ ধারণা তৈরি করাও এ ধারা বিরোধী। তাই আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছেন।

৪. পশ্চাতে নিন্দা থেকে বিরত থাকা [আয়াত ১২]

গীবত বা পশ্চাতে নিন্দা কুরআনে এমন এক ভয়াবহ অপরাধ হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে, যা মৃত ব্যক্তির মাংস খাওয়ার তুলনায় জঘন্য। এটি শুধুমাত্র অন্যের খারাপ গুণাবলীর প্রচার নয়, বরং একটি সামাজিক পীড়া ও অপমান।

গীবত সমাজে অবিশ্বাস ও শত্রুতা সৃষ্টি করে এবং মানুষকে একে অপরের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এজন্য এই আচরণ পরিহার করা ইসলামের অন্যতম মৌলিক শিক্ষা।

৫. সন্দেহ ও ধারণা থেকে বিরত থাকা [আয়াত ১২ ও ১৫]

কুরআন মুমিনদের সতর্ক করেছে, যেন তারা অতিরিক্ত সন্দেহ করে না এবং অপ্রমাণিত ধারণার ওপর ভিত্তি করে বিচার না করে। সন্দেহ ও অনুমান অনেক সময় সত্যকে বিকৃত করে এবং ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করে।

সমাজে ন্যায়বিচারের জন্য স্পষ্ট প্রমাণ ও সঠিক তথ্য অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি সিদ্ধান্ত ও মতামত যাচাই-বাছাই ও বিবেচনার ভিত্তিতে হওয়া উচিত।

৬. গোপন বিষয় অনুসন্ধান না করা [আয়াত ১২]

অন্যের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা একটি গুরুতর নিন্দনীয় কাজ। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তারা একে অপরের গোপনীয়তা রক্ষা করে।

গোপনীয়তার সম্মান রাখা ব্যক্তিত্বের অন্যতম লক্ষণ এবং এটি সমাজে আস্থার সেতুবন্ধন ঘটায়। গোপন তথ্য খোঁজা ও প্রচার সামাজিক বিভেদ সৃষ্টি করে এবং কলহের কারণ হয়।

৭. ফাসিকদের কথা যাচাই করা [আয়াত ৬]

ফাসিক বা পাপাচারী ব্যক্তিদের বক্তব্য যাচাই না করে গ্রহণ করা কঠিন ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া, গুজব বা গঠনমূলক তথ্যবহির্ভূত যেকোনো খবরের ক্ষেত্রে সত্যতা যাচাই অপরিহার্য।

এই নির্দেশনা আমাদেরকে সতর্ক করে যে, অজানা বা অসত্য তথ্য ছড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সর্বদা যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে সত্য খুঁজে বের করতে হবে।

৮. বিবাদময় বিষয় ন্যায়সঙ্গতভাবে মীমাংসা করা [আয়াত ৯]

বিবাদময় বা সংঘর্ষপূর্ণ পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ ও ন্যায়সঙ্গত সালিশী অত্যন্ত জরুরি। সূরা হুজুরাত আমাদের শেখায়, যেন আমরা ব্যক্তিগত আবেগে না ভোগে, বরং সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করি।

একজন পরিপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবেও নিজেকে আবেগের আওতায় না নিয়ে যুক্তি ও ন্যায়বিচারে অবিচল থাকতে হয়।

৯. সর্বাবস্থায় ইনসাফ করা [আয়াত ৮]

ইনসাফ বা ন্যায়পরায়ণতা ইসলামের মুল ভিত্তি। প্রতিটি পরিস্থিতিতে, ব্যক্তিগত অথবা সামাজিক ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখা আবশ্যক। সূরায় উল্লেখিত হয়েছে, যে ব্যক্তি ইনসাফ করবে, আল্লাহ তাকে ভালোবাসবেন।

এই শিক্ষা ব্যক্তিগত সম্পর্কের মসৃণতা ও সামাজিক শান্তি রক্ষায় অতি গুরুত্বপূর্ণ।

সূরা হুজুরাত শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় নির্দেশিকা নয়; এটি ব্যক্তিত্ব নির্মাণের পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা, যা মানুষের মন ও সমাজের মধ্যে সুশৃঙ্খলতা, সম্মানবোধ ও প্রেমবোধ প্রতিষ্ঠা করে। উপরের নির্দেশনাগুলো মেনে চললে ব্যক্তির মধ্যে বিনয়, দয়া, ন্যায্যতা ও সততা গড়ে উঠবে, যা তার আত্মিক বিকাশ ও সামাজিক সম্মান নিশ্চিত করবে।

সমাজ ও পরিবারের শান্তি, মানবতাবোধ ও একতার জন্য এই সূরার শিক্ষা অনুসরণ করা অপরিহার্য। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সূরা হুজুরাতের শিক্ষাগুলো হৃদয়ে প্রতিষ্ঠার তাওফিক দিন এবং জীবনে তাদের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের ব্যক্তিত্ব ও সমাজকে সমৃদ্ধ করুন, এই দোয়া করি।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ