সুলতানি আমলের সাক্ষী, মুন্সীগঞ্জের গর্ব- মুন্সীগঞ্জের বাবা আদম শহীদ মসজিদ

ধর্ম ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১১ ১০:১০:৫৬
সুলতানি আমলের সাক্ষী, মুন্সীগঞ্জের গর্ব- মুন্সীগঞ্জের বাবা আদম শহীদ মসজিদ

ঢাকার অদূরে মুন্সীগঞ্জ জেলার রামপালের দরগাবাড়ীতে অবস্থিত ‘বাবা আদম শহীদ (রহ.) মসজিদ’ কেবল একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বরং এটি সুলতানি আমলের ইতিহাস, উপমহাদেশে ইসলামের প্রসার এবং ধর্মীয় স্থাপত্যশৈলীর এক অতুলনীয় নিদর্শন। এই মসজিদ পঞ্চদশ শতকের ইসলামী আন্দোলনের প্রতীক হয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

মসজিদটি নির্মিত হয় ১৪৮৩ সালে, বাংলার সুলতান জালালউদ্দিন ফতেহ শাহর শাসনামলে। সেসময় বিক্রমপুরের শাসক ছিলেন মালিক কাফুর। ইতিহাসবিদদের মতে, হজরত বাবা আদম শহীদ (রহ.)-এর স্মৃতি রক্ষার্থেই মালিক কাফুর এই মসজিদ নির্মাণ করেন। ১৯৪৮ সালে মসজিদটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় আসে। এরপর থেকে এটি একটি সংরক্ষিত ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

শহীদ ধর্মপ্রচারক ও বিক্রমপুরে ইসলামের সংগ্রামী ইতিহাস

হজরত আদম শহীদ (রহ.) ছিলেন একজন ধর্মপ্রচারক, যিনি পঞ্চদশ শতকে বিক্রমপুর অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ঐতিহাসিক সূত্রমতে, তিনি স্থানীয় অত্যাচারী হিন্দু শাসক বল্লাল সেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শাহাদাতবরণ করেন। এই যুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দেন মুসলমানদের পক্ষ থেকে এবং অবশেষে মুসলমানদের বিজয় হয়। মুসলিম বিজয়ের এই ঘটনাকেই স্মরণীয় করে রাখতে এবং ইসলাম প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতেই গঠিত হয় বাবা আদম শহীদ (রহ.) মসজিদ।

মসজিদের বর্তমান ইমাম মাওলানা সানাউল্লাহ জানান, কেবল একটি ইবাদতখানা হিসেবেই নয়, এই মসজিদ ছিল দ্বীনের জ্ঞান, আত্মশুদ্ধি (তাজকিয়া) ও আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণের কেন্দ্র। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুসারে, হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর একজন খলিফা এ অঞ্চল সফরে এসে ইসলাম প্রচারের কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

স্থাপত্যশৈলীর দ্যুতিময়তা: সুলতানি রীতি ও অলঙ্করণ

মসজিদটি আয়তাকার ভিত্তির উপর গড়ে উঠেছে। উত্তর-দক্ষিণে ৪৩ ফুট ও পূর্ব-পশ্চিমে ৩৬ ফুট পরিমাপের এই মসজিদে রয়েছে ছয়টি গম্বুজ, যা ছাদের ওপর সুশৃঙ্খলভাবে স্থাপিত। প্রতিটি গম্বুজ নিপুণ কারিগরিতে তৈরি। চার কোণায় রয়েছে অষ্টকোণাকৃতির মিনার, যা ছাদের কার্নিশ পর্যন্ত না পৌঁছলেও স্থাপত্যে ভারসাম্য এনেছে।

মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে তিনটি অর্ধবৃত্তাকার মেহরাব। প্রধান মেহরাবটি বাইরের দিকে কিছুটা উদগত এবং অভ্যন্তরের দেয়ালে স্তরের পর স্তর সূক্ষ্ম নকশায় খচিত। দেয়ালজুড়ে জ্যামিতিক অলংকরণ, লতাপাতা, গোলাপ ফুল ও ঝুলন্ত প্রদীপের কারুকার্য এখনও দর্শনার্থীদের বিমোহিত করে।

প্রবেশপথে রয়েছে খাঁজকাটা অলংকরণ, ঝুলন্ত শিকলে ঘন্টার মতো শোভা—যা মুসলিম স্থাপত্যে সাধারণত দেখা যায় না এবং এটিকে বিশেষ করে তোলে। মূল ফটকের ওপরে আরবি ক্যালিগ্রাফিতে খচিত শিলালিপি নিপুণতার নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে।

ভেতরের কাঠামো ও নান্দনিক বিন্যাস

মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে দুটি গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভ, যা ছয়টি ভাগে বিভক্ত ছাদকে ধারণ করে। স্তম্ভ দুটি মধ্যভাগ থেকে অষ্টকোণ ও পরবর্তী অংশে ষোলো কোণাকৃতি, যা সুলতানি নির্মাণশৈলীর অনন্য বৈশিষ্ট্য বহন করে। মসজিদের কোনো অংশে বারান্দা না থাকলেও ভিতরের স্থাপত্যকৌশল একে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে।

মসজিদের বাইরের দেয়াল পুরু এবং তা পোড়ামাটির চিত্রফলকে অলংকৃত। মূল প্রবেশপথের পাশে এখনও সেসব শৈল্পিক কাজ দৃশ্যমান। এটি শুধু স্থাপত্যের নয়, শিল্প ও সংস্কৃতির এক মূল্যবান দলিল।

ঐতিহ্যের গুরুত্ব ও সংরক্ষণের প্রশ্ন

এই মসজিদ শুধু মুন্সীগঞ্জ নয়, গোটা দেশেরই একটি ঐতিহ্যবাহী সম্পদ। ৬ টাকার ডাকটিকিটেও এই মসজিদকে স্থান দেওয়া হয়েছে, যা তার জাতীয় মর্যাদার প্রমাণ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, সময়ের পরিক্রমায় এই মূল্যবান স্থাপনাটি আজ সংস্কারের অভাবে ঝুঁকির মুখে।

স্থানীয়দের দাবি, সরকার ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এই মসজিদের পূর্ণাঙ্গ সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণ ও পর্যটন সুবিধা বাড়ানোর জন্য পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

বাবা আদম শহীদ (রহ.) মসজিদ বাংলাদেশের ইসলামী ইতিহাস, স্থাপত্য ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের এক সমন্বিত স্মারক। এটি শুধু ইবাদতের স্থান নয়, বরং একটি সংগ্রামী অতীতের সাক্ষ্য, যেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতা, আত্মত্যাগ এবং সাংস্কৃতিক গৌরব একসূত্রে বাঁধা। এই ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করা আমাদের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক দায়িত্ব।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ