রেলওয়ের আয় ১ টাকা, খরচ ২.৫! নৈপথ্যে কারন? 

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ১৬ ০৭:৪৭:৩৯
রেলওয়ের আয় ১ টাকা, খরচ ২.৫! নৈপথ্যে কারন? 

সত্য নিউজ: বাংলাদেশ রেলওয়ে বর্তমানে আর্থিক সংকটে জর্জরিত একটি রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা, যা প্রতি ১ টাকা আয় করতে ব্যয় করছে প্রায় আড়াই টাকা। বছরের পর বছর ধরে লোকসান গুনতে থাকা এই গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত সেবাখাতকে লাভজনক করতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করছে একগুচ্ছ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। লক্ষ্য, দ্রুত সময়ের মধ্যে অপারেটিং রেশিও ২-এর নিচে নামিয়ে আনা এবং দীর্ঘ মেয়াদে রেলকে টেকসই ও মুনাফাযোগ্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা।

আয় ও ব্যয়ের অসম সাম্য: পরিসংখ্যান যা ভাবায়

রেলওয়ের সর্বশেষ হিসাব বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংস্থাটি পরিচালনা খাতে ব্যয় করেছে ৩,৫৪৮ কোটি টাকা, যেখানে আয় ছিল মাত্র ৮৩৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি ১ টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় ছিল প্রায় ২ টাকা ৫৭ পয়সা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপারেটিং রেশিও যত বেশি, একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালন দক্ষতা ততটাই দুর্বল।

রেলওয়ে ২০০৫ সালে প্রতি ১ টাকা আয় করতে ব্যয় করত ১ টাকা ৪৬ পয়সা। অথচ স্বাধীনতার পর একমাত্র ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরেই লাভের মুখ দেখেছিল প্রতিষ্ঠানটি।

আয় বাড়াতে ও ব্যয় কমাতে বাস্তবায়নাধীন কর্মপরিকল্পনা

রেলওয়ে ব্যয়ের প্রধান খাতগুলো হলো: বেতন-ভাতা, অবসরপ্রাপ্তদের পেনশন, জ্বালানি, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রশাসনিক ব্যয়। এর মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পেনশন বাবদ ব্যয় হয়েছে ৯৪৬ কোটি টাকা, যা কমানোর সুযোগ নেই। তবে এই ব্যয় যেন অর্থ মন্ত্রণালয় বহন করে, সেই দাবি জানিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ।

অন্যদিকে, রেল এখন অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা, প্রকল্প ব্যয় ও গাড়ি ব্যবহারে কঠোরতা আনছে। মেরামত খাতে ব্যয় যৌক্তিক করা, দেশ–বিদেশে ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ এবং অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ বন্ধের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

ভূমি, মালামাল ও যাত্রী পরিবহনে নতুন কৌশল

সরকারি হিসাব অনুযায়ী রেলওয়ের আছে প্রায় ৬২ হাজার একর জমি, যার মধ্যে প্রায় ৩,৬১৪ একর জমি বেদখল। ভূমি পুনরুদ্ধার করে তা ইজারা দিয়ে আয়ের উৎস বাড়াতে চায় রেলওয়ে। অপটিক্যাল ফাইবার এবং স্টেশন-ভিত্তিক বিজ্ঞাপন থেকেও আয় বাড়ানোর চিন্তা করছে সংস্থাটি।

মালামাল পরিবহন, বিশেষত খাদ্যপণ্য, সার, জ্বালানি পরিবহন বাড়াতে নেওয়া হচ্ছে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা। যমুনা রেলসেতু চালুর ফলে উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকার দিকে পণ্য পরিবহনের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এ জন্য টঙ্গী, তেজগাঁও, মির্জাপুর, নিমতলীতে মালামাল পরিবহনের কেন্দ্র গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

আন্তনগর ট্রেনে পরিবর্তন ও কমিউটার ট্রেনের প্রসার

ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথে যাত্রী চাহিদা বেশি। রেলপথ মন্ত্রণালয় বলছে, সেখানে নতুন ট্রেন চালু করলে আয় বাড়বে। বর্তমানে অধিকাংশ আন্তনগর ট্রেনে ১০-১৪টি কোচ ব্যবহার করা হলেও, ১৮-২০টি কোচ চালুর মাধ্যমে একই ইঞ্জিন ও জ্বালানিতে বেশি যাত্রী বহন সম্ভব। এতে ব্যয় বাড়বে না, বরং আয় বাড়বে।

শহরকেন্দ্রিক গণপরিবহনে রেলের ব্যবহার বাড়াতে কমিউটার ও সার্কুলার ট্রেন চালুর সুপারিশ এসেছে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। মাসিক টিকিট চালু হলে আগাম আয় নিশ্চিত করা যাবে।

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা: রেলের রূপান্তরের পথে

রেলওয়ে দীর্ঘমেয়াদি ৯টি উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-

নতুন ইঞ্জিন ও কোচ: ৮০টি মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন, ৫০০টি কোচ ও ২০০টি কনটেইনার সংগ্রহ।

বাণিজ্যিক স্থাপনা: রেলের অপ্রয়োজনীয় জমিতে বিপণিবিতান, হোটেল, অফিস নির্মাণ করে ভাড়া দেওয়া।

নতুন রেললাইন: ঢাকা-লাকসাম-চট্টগ্রাম নতুন রেললাইন নির্মাণ, যা দূরত্ব প্রায় ৯০ কিমি কমাবে। ফৌজদারহাট-লাকসাম শুধুমাত্র মালবাহী রেলপথ নির্মাণ।

আন্তর্জাতিক তুলনা ও শিক্ষণীয় দিক

বিশ্বের অনেক দেশেই রেল লাভজনকভাবে পরিচালিত হয়। কানাডায় প্রতি ১ ডলার আয় করতে খরচ হয় ৬৩ সেন্ট। ভারতের রেলওয়ের অপারেটিং রেশিও মাত্র ৯৮.৩২, অর্থাৎ তারা লাভে আছে। যুক্তরাষ্ট্রে বেসরকারি খাতে রেল পরিচালিত হয়, এবং কোম্পানিগুলো আয়ের তুলনায় ৩০–৪০ শতাংশ কম খরচে রেল চালায়।

বিশেষজ্ঞ মত

বুয়েটের পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, “রেলের আয় বাড়াতে হলে কনটেইনার ও মালামাল পরিবহন বাড়াতে হবে। জমি থেকে প্রকৃত আয় নিশ্চিত করতে হবে। কেনাকাটায় স্বচ্ছতা, অপচয় রোধ ও দুর্নীতি বন্ধ করলেই দৃশ্যমান পরিবর্তন সম্ভব।” তিনি শহরকেন্দ্রিক ট্রেন সেবা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার দ্রুত বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দেন।

বাংলাদেশ রেলওয়ের এই অর্থনৈতিক সংকট শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের নয়, বরং জাতীয় সম্পদের সুরক্ষার প্রশ্ন। সরকার, রেল কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সুসংহত, স্বচ্ছ ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের মাধ্যমে একসময় লাভজনক রেলব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব—যা হবে দেশের পরিবহন অবকাঠামোয় এক নবযাত্রার সূচনা।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।... বিস্তারিত