প্রযুক্তির স্মার্ট ফাঁদ: এক ক্লিকেই ডেকে আনতে পারে বিপদ

প্রযুক্তি ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১৫ ১২:০৭:৩৪
প্রযুক্তির স্মার্ট ফাঁদ: এক ক্লিকেই ডেকে আনতে পারে বিপদ

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে বহুবার উঠে এসেছে এক চিরচেনা থিম প্রযুক্তি যখন মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। কখনো রোবট বিদ্রোহ করে, কখনো বিজ্ঞানীরা ল্যাবে তৈরি করে বসেন এমন কিছু যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। যদিও এগুলো কাল্পনিক কাহিনি, তবুও বাস্তব জীবনেও এই গল্পগুলোর একটি সূক্ষ্ম প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। প্রযুক্তি যখন অতি উন্নত হয়, তখন তা যতটা না ভয়ংকর, তার চেয়েও বড় ঝুঁকি হয়ে ওঠে মানুষের ভুল ব্যবহার, অতি নির্ভরতা এবং দায়িত্বহীনতা।

প্রযুক্তি মানুষের জীবনে অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনেছে। উড়োজাহাজ আমাদের পৃথিবীকে ছোট করেছে, ইন্টারনেট পাল্টে দিয়েছে জ্ঞান ও যোগাযোগের গতি, আর জিপিএস দিয়ে আমরা দিশাহীনতা দূর করতে পেরেছি সহজেই। কিন্তু প্রযুক্তির এই উপকারিতা তখনই হুমকিতে রূপ নেয়, যখন আমরা দায়িত্বহীন হয়ে পড়ি।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা, যা প্রযুক্তির “স্মার্ট” পরিচয়ের বিপরীত দিক তুলে ধরে। মহামারির সময় ঘরে থাকা এক শিশু এবং তার মা মজা করে অ্যামাজনের ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট ‘অ্যালেক্সা’কে একটি চ্যালেঞ্জ দিতে বলেন। কিন্তু ‘অ্যালেক্সা’ যে নির্দেশ দেয়, তাতে শিউরে ওঠেন মা। অ্যাসিস্ট্যান্টটি জানায়, একটি ফোন চার্জার আউটলেটে অর্ধেক ঢুকিয়ে তার সঙ্গে একটি ধাতব কয়েন ছোঁয়াতে। এ এক ভয়াবহ বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার আশঙ্কা, যেটি শিশু এবং তার মায়ের সচেতনতা না থাকলে প্রাণঘাতীও হতে পারত। প্রযুক্তি এখানে শুধু তথ্য দিয়েছে, কিন্তু তার বুদ্ধি ছিল না বিপদের মাত্রা বোঝার।

প্রযুক্তির ভুল সিদ্ধান্ত আরও মারাত্মকভাবে দেখা গেছে ইতিহাসে। ১৯৭৯ সালে ফোর্ড মোটর কোম্পানির কর্মী রবার্ট উইলিয়ামস একটি রোবটচালিত গুদামে কাজ করছিলেন। যন্ত্রাংশ আনতে গিয়ে রোবটের বাহুর এক আঘাতে তিনি প্রাণ হারান। এটিই ইতিহাসে রোবটঘটিত প্রথম প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা হিসেবে নথিভুক্ত। এ ঘটনা প্রশ্ন তোলে যন্ত্র সত্যিই আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে তো? না কি কিছু প্রযুক্তি এতটাই স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠছে যে আমাদের জীবনের উপর প্রভাব ফেলে দিতে পারছে মুহূর্তেই?

আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে কানাডায়, ২০১৬ সালে। প্রচণ্ড ঝড় ও ঘন কুয়াশার রাতে এক নারী সম্পূর্ণভাবে জিপিএসের ওপর নির্ভর করে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। জিপিএসের নির্দেশনা অনুসরণ করে তিনি গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যান সোজা হ্রদের ভেতর। সৌভাগ্যক্রমে তিনি জানালা ভেঙে বের হয়ে প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, প্রযুক্তির উপরে পুরোপুরি নির্ভরতা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

প্রযুক্তির ভয়াবহ বিভ্রান্তির সবচেয়ে আশঙ্কাজনক উদাহরণও ১৯৭৯ সালেই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় হঠাৎ করে একটি বার্তা আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে হাজার হাজার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ধেয়ে আসছে। জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা প্রেসিডেন্টকে পালটা আক্রমণের পরামর্শ দিতে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে আবিষ্কৃত হয়, এটি ছিল একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ভিডিও যা ভুলবশত মূল সিস্টেমে চালু হয়েছিল। এই একটি ভুল যদি মুহূর্তকাল আগে ধরা না পড়ত, তাহলে মানবসভ্যতা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের দিকে চলে যেতে পারত।

এই ঘটনাগুলো নিছক বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা নয়। এগুলো এক ভয়ংকর বাস্তবতার বার্তা দেয়—প্রযুক্তি নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না, কিন্তু মানুষ যদি প্রযুক্তিকে ভুলভাবে ব্যবহার করে, অন্ধভাবে নির্ভর করে, কিংবা নৈতিকতা বিবর্জিত উদ্দেশ্যে প্রযুক্তিকে কাজে লাগায়, তখনই তা ভয়ংকর হয়ে ওঠে।

আজ আমরা এক স্মার্ট যুগে বাস করছি। আমাদের ঘরে, হাতে, অফিসে, এমনকি দেহেও প্রযুক্তির নেটওয়ার্ক জাল বোনা। কিন্তু আমরা যদি এই প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো জ্ঞান, সতর্কতা ও নৈতিক শক্তি না রাখি, তাহলে এক ক্লিকেই ঘটতে পারে সর্বনাশ। একমাত্র সমাধান হলো দায়িত্বশীল ব্যবহার, সচেতন ডিজাইন, এবং প্রযুক্তি নিয়ে অতিরিক্ত মোহ থেকে বের হয়ে বাস্তবতা উপলব্ধি করা।

আমাদের হাতে তলোয়ার তুলে দিয়েছে। এখন সেই তলোয়ার দিয়ে সমাজ রক্ষা করব না আত্মঘাতী হব, সিদ্ধান্ত আমাদেরই।

পাঠকের মতামত:

ট্যাগ: প্রযুক্তি

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ