আওয়ামী সিন্ডিকেটের ছায়া কাটছে না পাঠ্যবই ছাপার কাজ থেকে

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১৫ ১০:০৬:১১
আওয়ামী সিন্ডিকেটের ছায়া কাটছে না পাঠ্যবই ছাপার কাজ থেকে

সরকারের বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ছাপার কাজে ফের শক্তভাবে প্রভাব বিস্তার করছে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। মুদ্রণশিল্প সমিতিতে প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে পুরনো নেতৃত্বকে সরিয়ে দেওয়া হলেও কার্যত ছাপার বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ থেকে সরে যাচ্ছে না এই প্রভাবশালী চক্র।

সম্প্রতি প্রায় ১,৪০০ কোটি টাকার টেন্ডার শেষ হওয়া বই ছাপার কাজের ৩৫ শতাংশই পেয়েছে মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে রয়েছে ‘আনন্দ প্রিন্টার্স’ ও ‘অগ্রণী প্রিন্টার্স’, যারা দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার ঘনিষ্ঠতার সুবিধা নিয়ে এই খাতে আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। জানা গেছে, সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের ছোট ভাই রাব্বানি জব্বার ও তার সহযোগী কাউসার-উজ-জামান (রুবেল)। তারা বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির সদ্য বিদায়ী সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

প্রকাশ্য অনিয়মের কারণে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মুদ্রণশিল্প সমিতিতে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। উপসচিব সন্দ্বীপ কুমার সরকারকে এ দায়িত্ব দেওয়া হলেও তিনি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদান করেননি। এরই মধ্যে সমিতির কার্যালয়ে তালা ঝুলছে, সাবেক নেতারা গা ঢাকা দিয়েছেন। অফিস সহকারীসহ কেউ সেখানে উপস্থিত নেই।

এদিকে সমিতির একাধিক সদস্য অভিযোগ করেছেন, টেন্ডার প্রক্রিয়াতেও প্রভাব বিস্তার করে এই চক্র একচেটিয়া কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে। তাদের দাবি, অনেক ক্ষমতাধর প্রেস কাজ পাওয়ার পরও তা শেষ করতে পারছে না, কারণ তারা সক্ষমতার তুলনায় বেশি কাজ নিচ্ছে। এর ফলে যথাসময়ে বই বিতরণ নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

চক্রের বিরুদ্ধে তদন্তে দুদক, তবু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অব্যাহত

এ বছর পাঠ্যবই ছাপাতে বিলম্ব, ছাপার মান নিয়ে অভিযোগ এবং বইয়ের অপ্রতুলতা সরকারের জন্য সমালোচনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর জেরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সিন্ডিকেটে থাকা ৩৬টি প্রেস মালিকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। তদন্ত চলাকালেই সিন্ডিকেটের সদস্যরা ফের বড় পরিসরে কাজ পেয়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ সাধারণ প্রেস মালিকরা।

মুদ্রণশিল্প সমিতির সদস্য মোহাম্মদ আলী (রিমিনি ইন্টারন্যাশনাল) বলেন, “এই চক্র অলরেডি টেন্ডারে সিন্ডিকেট করে ফেলেছে। এখন এনসিটিবি বা মন্ত্রণালয় যদি এই অনিয়ম বাতিল না করে, তাহলে আমাদের মত ছোট ও মধ্যম প্রেস মালিকদের ভবিষ্যৎ কোথায়?”

তিনি আরও বলেন, “আমরা প্রশাসক নিয়োগের জন্য আবেদন করেছিলাম এই অনিয়ম থামাতে। এখন চাই, সরকার যেন নীতিগতভাবে এই চক্রের দখলদারিত্ব বন্ধ করে।”

সরকারি প্রতিক্রিয়া ও নীতিগত দিক

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর সচিব অধ্যাপক সাহতাব উদ্দিন বলেন, “টেন্ডার প্রক্রিয়ায় কে কাজ পাবে আর কে পাবে না, তা নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট কমিটি। তবে অনিয়মের বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।”

সূত্র জানায়, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক স্তরে প্রায় ৯ কোটি এবং মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ২১ কোটি বই ছাপানো হবে। প্রাথমিকের জন্য বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৪২৩ কোটি টাকা, আর মাধ্যমিকের জন্য ১,৫৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ১,৪০০ কোটি টাকার টেন্ডার ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে। আজ মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বইয়ের দরপত্র উন্মুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে।

সার্বিক পরিস্থিতি ও শঙ্কা

যদিও প্রশাসক নিয়োগকে একটি আশার আলো হিসেবে দেখছেন অনেক প্রেস মালিক, তবে তাদের আশঙ্কা নিয়ন্ত্রণহীন সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ না হলে এই পদক্ষেপও ব্যর্থ হতে পারে। বছরের পর বছর ধরে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ এই চক্রের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের ফলে মুদ্রণশিল্পে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, মানহীন বই এবং সময়মতো সরবরাহ না হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বারবার।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ