মঙ্গল গ্রহ নিয়ে গবেষণায় নতুন চমকপ্রদ তথ্য!

প্রযুক্তি ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ০৭ ১০:৩৭:১২
মঙ্গল গ্রহ নিয়ে গবেষণায় নতুন চমকপ্রদ তথ্য!

মঙ্গল গ্রহ নিয়ে মানবজাতির কৌতূহল প্রাচীন হলেও, বিজ্ঞানসম্মত অনুসন্ধানের গতি গত কয়েক দশকে বহুগুণে বেড়েছে। নানা মহাকাশ অভিযানের মাধ্যমে মানুষ জানতে পেরেছে পৃথিবীর মতোই এই গ্রহের পৃষ্ঠে ছিল নদী, হ্রদ, এমনকি বিস্তৃত পানি প্রবাহের সম্ভাবনাও। কিন্তু তারপর হঠাৎ কী ঘটল? কেন শুকিয়ে গেল মঙ্গলের জলাধার, থেমে গেল সম্ভাব্য প্রাণের ইতিহাস? এসব প্রশ্নের খোঁজে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার রোভারগুলো।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায়, যার নেতৃত্ব দিয়েছেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূবিজ্ঞানী ও নাসার কিউরিয়োসিটি দলের সদস্য এডউইন কাইট, নতুন করে আলোচনায় এসেছে মঙ্গলের অতীতে ‘স্বল্পমেয়াদি বাসযোগ্য সময়’ থাকার তত্ত্ব। এই গবেষণার ফলাফল চলতি মাসে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী Nature-এ প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় মূল ভূমিকা রেখেছে নাসার ‘কিউরিয়োসিটি’ রোভার, যা মঙ্গলের গেইল ক্র্যাটারে অবতরণ করে বহু বছর ধরে পাথর, মাটি এবং জলবায়ুসংক্রান্ত উপাত্ত পাঠিয়ে আসছে।

মঙ্গলে ‘কার্বনেট শিলা’র সন্ধান: কী এর তাৎপর্য?

গবেষণায় পাওয়া গেছে, মঙ্গলের পৃষ্ঠে বিস্তৃতভাবে রয়েছে কার্বনেট জাতীয় শিলা। পৃথিবীতে এসব খনিজ যেমন চুনাপাথর, তা বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে ভূস্তরে ধরে রাখে। অর্থাৎ, এরা আবহাওয়ার পরিবর্তনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং দীর্ঘমেয়াদে গ্রহের উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে রাখে।

কাইটের মতে, “পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইড কার্বনেট শিলায় আটকে যাওয়ার পর অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে আবার ফিরে আসে বায়ুমণ্ডলে এই চক্রটাই পৃথিবীতে দীর্ঘকাল ধরে জলবায়ু ও প্রাণের জন্য অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখতে সাহায্য করেছে। কিন্তু মঙ্গলে এমন কোন কার্যকর পুনর্ব্যবহার হয়নি।”

এ কারণেই বিজ্ঞানীদের ধারণা, মঙ্গলে অল্প সময়ের জন্য হয়তো পানি প্রবাহ ছিল এবং সেই সময়টুকুতে সৃষ্টি হয়েছিল কিছুটা প্রাণবান্ধব পরিস্থিতি। কিন্তু চক্রটি ব্যাহত হওয়ায়, ধীরে ধীরে মঙ্গল পরিণত হয় শুষ্ক, ঠান্ডা ও অনুর্বর এক মরুভূমিতে।

পুরনো নদী ও হ্রদের চিহ্ন, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী বাসযোগ্যতা নেই

রোভারগুলোর পাঠানো ছবি ও স্যাটেলাইট ডেটায় মঙ্গলের ভূপ্রকৃতিতে স্পষ্ট নদীখাত, হ্রদের খাত এবং ভূমিক্ষয় দেখা যায়। ফলে অনেক আগে মঙ্গলে জল প্রবাহ ছিল, এই দাবিকে সমর্থন করছে ভূতাত্ত্বিক প্রমাণ। ২০২১ সালে নাসার পার্সিভারেন্স রোভারও জেজেরো ক্র্যাটারে এমন একটি ‘শুকিয়ে যাওয়া হ্রদের’ কিনারায় কার্বনেট খনিজের প্রমাণ পেয়েছিল।

তবে কাইট ও তাঁর দল বলছেন, এসব জলপ্রবাহ ছিল “ব্যতিক্রম” স্বল্পমেয়াদি, সীমিত পরিসরে এবং হয়তো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডেই সীমাবদ্ধ। সেটি বৃহৎ মাত্রার কোনো বাসযোগ্য যুগ নয়।

কেন মঙ্গল এখন বাসযোগ্য নয়?

পৃথিবীর ভূবিজ্ঞানে যেমন বলা হয় কার্বন সঞ্চালন ও পুনঃবিকিরণ হলো এক সুস্থ জলবায়ুর পূর্বশর্ত, তেমনি মঙ্গলের কার্বনচক্রে ছিল ভারসাম্যের ঘাটতি। কারণ, মঙ্গলে ভূ-আভ্যন্তর থেকে কার্বন পুনরায় মুক্ত করে দেওয়ার মতো সক্রিয় অগ্ন্যুৎপাত বা প্লেট টেকটনিকস ছিল না। ফলে একবার যদি কার্বন আটকে যায়, সেটি আর ফিরে আসে না। এই দীর্ঘমেয়াদি শীতলতার ফলেই বায়ুমণ্ডল দুর্বল হয়ে পড়ে, পানি বাষ্পীভূত হয় বা হিমায়িত হয়, এবং মঙ্গল হয় ক্রমশ অনুপযোগী।

কাইটের ভাষায়, “যদি আমাদের ধারণা ঠিক হয়, তবে মঙ্গলগ্রহ কয়েক কোটি বছর আগে একটি ছোট সময়ের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ পায় তবে তা খুব দ্রুত বিলুপ্ত হয় এবং অন্তত ১০ কোটি বছর ধরে সে এক শীতল মরুভূমিতেই রূপ নেয়।”

গভীর ভূস্তরে এখনও জল?

গবেষণা থেকে এই ধারণাও উঠে এসেছে যে, মঙ্গলের ভূপৃষ্ঠের নিচে হয়তো এখনও বরফ বা তরল অবস্থায় পানি থাকতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত এমন কোনো নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ভূগর্ভস্থ পানির উপস্থিতি পাওয়া গেলে, প্রাণের সম্ভাবনা নিয়ে জোরালো জবাব পাওয়া যেতে পারে।

সামনে কী করণীয়?

বিজ্ঞানীরা এখন চেষ্টা করছেন মঙ্গলের পৃষ্ঠ থেকে পৃথিবীতে সরাসরি পাথরের নমুনা পাঠানোর, যার মাধ্যমে এই শিলায় বন্দি কার্বনের রূপ বিশ্লেষণ করে আরও সুনির্দিষ্ট উপসংহারে পৌঁছানো যাবে। বর্তমানে নাসা ও ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ESA) যৌথভাবে এই ‘স্যাম্পল রিটার্ন মিশন’ পরিকল্পনা করছে।

এই গবেষণা একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে: মঙ্গল একসময় আংশিকভাবে বাসযোগ্য হতে পারত, কিন্তু সেই সম্ভাবনা ছিল হঠাৎ উদয় হওয়া, সংক্ষিপ্ত এবং অসম্পূর্ণ। তবুও, কার্বনেট শিলার মতো খনিজ ও ভূতাত্ত্বিক তথ্য মানবজাতিকে গ্রহটির জলবায়ু ও সম্ভাব্য প্রাণের ইতিহাসের একটি জটিল কিন্তু উত্তেজনাপূর্ণ চিত্র উপস্থাপন করছে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ