মুসলমান সন্দেহে ভারতের ৮ কোটি ভোটার অনিশ্চয়তায়:ভারতের গণতন্ত্র কি এক নতুন সংকটে?

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১১ ১২:১২:৩২
মুসলমান সন্দেহে ভারতের ৮ কোটি ভোটার অনিশ্চয়তায়:ভারতের গণতন্ত্র কি এক নতুন সংকটে?

বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতে সম্প্রতি ভোটাধিকার নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ভারতীয় নির্বাচন কমিশন (ECI) ২০২৪ সালের ২৪ জুন ঘোষণা করেছে যে, পূর্ব ভারতের বিহার রাজ্যের প্রায় ৮ কোটি ভোটারকে ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে নতুন করে নিবন্ধন করতে হবে। যারা এই সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় নথি জমা দিয়ে পুনঃনিবন্ধন করতে ব্যর্থ হবেন, তাদের নাম ‘সন্দেহভাজন বিদেশি নাগরিক’ হিসেবে রিপোর্ট করা হতে পারে। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে জেল বা নির্বাসনের ব্যবস্থাও নেওয়া হতে পারে।

এই সিদ্ধান্ত ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংবিধানিক বাস্তবতায় গভীর প্রশ্ন তোলে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি শুধু একটি ভোটার তালিকা সংশোধন নয়, বরং জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন বা এনআরসি বাস্তবায়নের একটি গোপন পথ। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাভাষী মুসলিমসহ বহু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছেন। ইতোমধ্যে বিহারে হাজার হাজার মুসলিমকে আটক করে বাংলাদেশি অভিবাসী হিসেবে দেশছাড়া করার অভিযোগ উঠেছে।

নির্বাচন কমিশনের ঘোষণায় বলা হয়েছে, ভোটার তালিকা থেকে অযোগ্য বা অবৈধ ব্যক্তিদের বাদ দেওয়ার লক্ষ্যেই এই বিশাল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। কমিশন জানিয়েছে, ২০০৩ সালের পর থেকে যাদের ভোটার তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে, তাদের জন্মস্থান, পিতামাতার পরিচয় এবং সরকারি দলিলপত্র দেখাতে হবে। অথচ বিহারে জন্মনিবন্ধনের হার এখনো অনেক কম এবং সাক্ষরতার হার দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই বাস্তবতায় লক্ষ লক্ষ বৈধ ভারতীয় নাগরিক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় নথি জোগাড় করতে পারবেন না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

এই ঘটনার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিহার ভারতের তৃতীয় সর্বাধিক জনবহুল রাজ্য এবং রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এক নির্বাচনী ক্ষেত্র। অক্টোবরে সেখানে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ঠিক তার আগমুহূর্তে এই ভোটার যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলায় সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে। বিরোধী দল কংগ্রেস ও রাষ্ট্রীয় জনতা দল ইতোমধ্যে বিহার বন্ধের ডাক দিয়েছে এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্টে এই সিদ্ধান্ত বাতিলের আবেদন জানিয়েছে।

এই প্রক্রিয়া নিয়ে শিক্ষাবিদ ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক অপূর্বানন্দ একটি সরাসরি ও গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তাঁর ভাষায়, “এই প্রক্রিয়া আসলে এনআরসি-রই ছায়াপ্রতিবিম্ব। নির্বাচন কমিশন এই মাধ্যমে নাগরিকদের তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণে বাধ্য করছে।” এই প্রক্রিয়াকে তিনি গণতন্ত্রের ন্যূনতম ন্যায্যতা ও মানবিকতা থেকে বিচ্যুত একটি ভয়ানক ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করেন।

একই সুরে কথা বলেছেন অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (ADR)-এর জগদীপ ছোকর, যিনি এই প্রক্রিয়া বাতিলের দাবিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে প্রথম আবেদন করেছিলেন। তিনি সরাসরি সতর্ক করে বলেছেন, “এই সংশোধনের ফল হবে ভয়াবহ।” তাঁর আশঙ্কা, “এর ফলে এমন একটি ভোটার তালিকা তৈরি হতে পারে, যেখানে বিহারের অর্ধেক জনসংখ্যা ভোটাধিকার হারাবে।” এটি শুধু নির্বাচন নয়, গণতান্ত্রিক কাঠামো ও নাগরিক অধিকার ব্যবস্থাকে চরমভাবে দুর্বল করে তুলবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হবেন বাংলাভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠী। বিহারে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি ৭৬ লাখ, যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ। তাদের একটি বড় অংশ দরিদ্র, প্রান্তিক এবং যথাযথ সরকারি নথিপত্রের বাইরে। এই শ্রেণির মানুষের ওপর এমন দায় চাপানো তাদের নাগরিক অধিকার হরণ ছাড়া আর কিছুই নয়।

নির্বাচনী সংস্কার পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ADR-এর তরফেও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ২০০৩ সালের পর যুক্ত হওয়া সব ভোটার যদি এখন যাচাইয়ের মুখে পড়েন, তাহলে বিগত দুই দশকের সমস্ত নির্বাচন কি তাহলে অনৈতিক বা অবৈধ ছিল? নির্বাচন কমিশন এখনো এর কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।

এই কর্মকাণ্ড এমন এক সময়ে পরিচালিত হচ্ছে, যখন বিহারে বর্ষাকাল চলছে এবং রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা বন্যাপ্রবণ। গত বছরই প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে নথিপত্র সংগ্রহের চাপ সাধারণ মানুষের জন্য আরেকটি বৈধতার পরীক্ষা হয়ে উঠেছে।

এদিকে বিজেপি তাদের ঐতিহ্যগত অবস্থানে অটল থেকে এই যাচাই প্রক্রিয়াকে সমর্থন জানিয়ে সারা দেশে তা চালুর আহ্বান জানিয়েছে। তাদের ভাষায়, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে আগত মুসলিম অভিবাসীরা ভারতের জনসংখ্যাগত কাঠামো পরিবর্তন করছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়াই নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এমন একটি পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ।

অবশেষে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে যে প্রকল্প শুরু হয়েছে, তা শুধুই একটি প্রশাসনিক তৎপরতা নয়। এটি নাগরিকত্ব, পরিচয় এবং গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে রাষ্ট্রের গভীর ও ঝুঁকিপূর্ণ সামাজিক প্রকল্পের অংশ হয়ে উঠতে চলেছে।

এই পরিস্থিতিতে নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের উচিত গভীরভাবে নজর রাখা এবং নিশ্চিত করা যে নাগরিক অধিকার, সংবিধান ও গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলো ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। যদি এই প্রক্রিয়া বাধাহীনভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে শুধু বিহারের নির্বাচন নয়, পুরো ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিই দুর্বল হয়ে পড়বে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ