ভারতজুড়ে হিন্দির প্রচারে মোদি সরকারের আসল উদ্দেশ্য কী?

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১৫ ১৬:০৩:০৮
ভারতজুড়ে হিন্দির প্রচারে মোদি সরকারের আসল উদ্দেশ্য কী?

ভারতের বহুভাষিক সমাজব্যবস্থায় ভাষা বরাবরই এক সংবেদনশীল ইস্যু। রাজনৈতিকভাবে বিস্ফোরক এই বিষয়টি দেশটির ঐক্য ও বিভেদের দুই প্রান্তে অবস্থান করে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দি ভাষার প্রসার ঘটানোর যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা ঘিরে আবারও উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশটির রাজনীতি। বিশেষ করে দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের কয়েকটি রাজ্যে এই হিন্দিকেন্দ্রিক শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে দেখা দিয়েছে প্রবল প্রতিক্রিয়া।

ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রে বিজেপি সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হিন্দি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু রাজ্যজুড়ে তীব্র জনমত গড়ে উঠলে সরকারের পক্ষ থেকে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হয়। স্থানীয় বাসিন্দা, বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সমাজকর্মীরা এটিকে মারাঠি ভাষার ওপর আগ্রাসন হিসেবে দেখেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, এটা সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা।

আর দক্ষিণের তামিলনাড়ু রাজ্য—যেখানে ভাষাগত পরিচয় অত্যন্ত শক্তিশালী—সেখানেও মোদি সরকারের নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে তীব্র বিরোধিতা শুরু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্টালিন অভিযোগ করেছেন, শিক্ষানীতির আড়ালে কেন্দ্র সরকার শিক্ষার্থীদের হিন্দি ভাষা শেখাতে বাধ্য করছে। তামিলনাড়ুর মতে, হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া মানে তাদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করার চেষ্টা।

এই ভাষাকেন্দ্রিক উত্তেজনা একদিনে তৈরি হয়নি। ১৯৬০-এর দশকে তামিলনাড়ুতে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় যে দাঙ্গা হয়েছিল, তার স্মৃতি এখনো অনেকের মনে টাটকা। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে—তামিলনাড়ু নতুন শিক্ষানীতি মানতে না চাইলে শিক্ষা খাতে কেন্দ্রীয় সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। এই অবস্থান আরও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে, যার ফলে মে মাসে রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাষাগত বৈচিত্র্যই ভারতের সবচেয়ে বড় শক্তি। মানবাধিকার ও শিক্ষাবিষয়ক কর্মী নিরঞ্জনারাধ্য ভি পি মন্তব্য করেছেন, একটি নির্দিষ্ট ভাষা চাপিয়ে দিলে তা দেশের জাতীয় ঐক্যকেই হুমকির মুখে ফেলতে পারে। তাঁর মতে, ভাষা শিক্ষার বিষয়টি স্বেচ্ছায় নির্ধারণ করার সুযোগ থাকা উচিত, চাপিয়ে দেওয়ার নয়।

সাহিত্য ও ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ভারতের হিন্দি ও ইংরেজি দুইটি সরকারি ভাষা হলেও দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে হাজারেরও বেশি ভাষা ও উপভাষায় মানুষ কথা বলে। বিশেষত দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে স্থানীয় ভাষার প্রতি আবেগ অত্যন্ত প্রবল। যেমন, তামিল ভাষা শুধু একটি মাধ্যম নয়, এটি একটি সংস্কৃতি, একটি গর্বের বিষয়। লেখিকা নির্মলা লক্ষ্মণ বলেন, তামিল ভাষা সাহিত্যে ও কবিতায় যে সমৃদ্ধতা অর্জন করেছে, সেটি সহজে বিলুপ্ত করার নয়।

কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুধু সামাজিক মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ নয়। মহারাষ্ট্রে বিনিয়োগকারী সুশীল কেদিয়ার একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে তাঁর অফিসে হামলা পর্যন্ত হয়েছে। কেদিয়া বলেছিলেন, তিনি দীর্ঘদিন রাজ্যে থেকেও মারাঠি ভাষা শিখতে পারেননি। এই মন্তব্যের পর তাঁকে ব্যাপক ট্রলের শিকার হতে হয় এবং শেষে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন।

এই ইস্যু রাজনৈতিক সমীকরণেও বড় পরিবর্তন আনছে। প্রায় দুই দশক আগে যে দুই চাচাতো ভাই রাজ ও উদ্ধব ঠাকরে আলাদা হয়ে রাজনৈতিক দল গড়েছিলেন, তারা আবার একসঙ্গে মঞ্চে এসেছেন মারাঠি ভাষার স্বার্থে। এই ঐক্য ইঙ্গিত দেয়, ভাষার প্রশ্নে রাজনীতির বিভেদও পিছিয়ে যেতে পারে।

মোদি সরকারের একাধিক প্রকল্প—হোক সেটা শিক্ষা, কৃষি কিংবা উন্নয়ন সংক্রান্ত—যেভাবে হিন্দি ভাষায় নামকরণ ও প্রচার করা হচ্ছে, তাতে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, ভারতকে একটি হিন্দি-ভিত্তিক হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে রূপান্তরের চেষ্টাই এর পেছনে কাজ করছে।

ভারতের বৈচিত্র্যের শিকড় অনেক গভীরে। হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে তা জাতীয় ঐক্যকে সুদূরপ্রসারী ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ