মিটফোর্ডে ভাঙারি ব্যবসায়ীর  হত্যাকাণ্ডে নতুন মোড়

অপরাধ ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১৪ ১০:২১:৩১
মিটফোর্ডে ভাঙারি ব্যবসায়ীর  হত্যাকাণ্ডে নতুন মোড়

পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ (৩৯) কে পিটিয়ে, ইট-পাথর ছুঁড়ে এবং নির্মম ভাবে হত্যার ঘটনাটি শুধু একটি নৃশংস হত্যা না, বরং এলাকার ব্যবসায়িক স্বার্থ ও চাঁদাবাজির এক ভয়াবহ সংকটের প্রতিফলন। হত্যাকাণ্ডের সূত্র ধরে জানা যায়, সোহাগ দীর্ঘদিন ধরে মহিন নামের এক চাঁদাবাজ গ্রুপের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। মহিন গ্রুপ মাসিক ফিক্সড চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে মিটফোর্ড এলাকা ও আশপাশের ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। সোহাগের দোকান ‘সোহানা মেটাল’ ছিল ভাঙারি ব্যবসার জন্য সুপরিচিত।

তবে সোহাগ চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং মহিন গ্রুপের নির্দিষ্ট চাঁদার হার মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এ কারণে দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ এবং হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানায়, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব সাময়িক মিটমাট হয়, কিন্তু মহিন গ্রুপ সোহাগকে বাজার থেকে সরিয়ে দিতে পরিকল্পনা শুরু করে।

৭ জুলাই সন্ধ্যায়, সোহাগ দোকানে আসার মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে সাতটি মোটরসাইকেলে প্রায় ১৯ জন হামলাকারী রজনী বোস লেনে প্রবেশ করে এবং সোহাগকে ধরে নিয়ে যেয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের গেটের সামনে নির্মমভাবে ইট-পাথর ও অন্যান্য কঠিন বস্তু দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের পর মৃতদেহ টেনে এনে গেটের বাইরে উল্লাস করা হয়, যা স্থানীয় ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসীর মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করে।

তদন্তে জানা গেছে, মহিন ও টিটন নামে দুই খুনির মধ্যে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বও ছিল সোহাগের সঙ্গে। সোহাগ পুরোনো সময়ে তাদের মারধর করায় তাদের মধ্যে শত্রুতার সূত্রপাত হয়। এছাড়া হত্যাকাণ্ডে রাজনীতির প্রভাবও রয়েছে বলে পুলিশ ধারণা করছে। হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের যুবদল ও অন্য গোষ্ঠীর লোকজন রয়েছে।

এ ঘটনার পর থেকে মিটফোর্ড এলাকার ভাঙারি ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ভয়ে ভুগছেন। মহিন গ্রুপের মতো আরও কয়েকটি চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এলাকায় প্রভাব বিস্তার করছে। গ্রেফতার হওয়া মহিন গ্রুপের অনুসারীরা এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্কের কারণ। অনেক ব্যবসায়ী আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, মহিন গ্রুপের কেউ গ্রেফতার হলেও, অন্য গোষ্ঠীগুলো প্রতিশোধ নিতে পারে।

পুলিশ এখন পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেফতার করেছে, যাদের মধ্যে একজন স্বীকারোক্তি দিয়েছে। তদন্ত চলছে বাকি আসামিদের ধরতে। ডিবির যুগ্ম কমিশনার জানিয়েছেন, ডিবি মামলাটি ছায়া তদন্ত করছে এবং দ্রুত আসামিদের আইনের আওতায় আনার জন্য কাজ করছে।

এদিকে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছিলেন, হত্যাকাণ্ড দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। একই সাথে সুপ্রিম কোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়েছে, যাতে এই হত্যা মামলার তদন্তের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিচারিক কমিশন গঠন করার দাবি করা হয়েছে, যাতে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করা যায়।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ বলেছেন, হাসপাতালের সামনে এই ঘটনার সময় আনসার সদস্যরা দায়িত্বে ছিলেন না এবং তাদের পক্ষ থেকে কোনো অবহেলা ঘটেনি।

স্থানীয় অ্যাম্বুলেন্স চালক ও ব্যবসায়ীরা জানান, মহিন গ্রুপ মিটফোর্ডে অ্যাম্বুলেন্স চালকদের কাছ থেকে মাসে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাঁদা নিত এবং যারা তাদের কথা না শুনত তাদের ওপর হামলা চালানো হত। অনেকেই চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের ভয়ে ব্যবসায় নাম রাখা থেকে বিরত থাকছেন।

মোটের উপর, এই ঘটনা মিটফোর্ড এলাকা এবং পুরান ঢাকার অপরাধ, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির সমস্যা কতটা গভীর এবং জটিল তা প্রমাণ করে। সুষ্ঠু বিচার ও কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া এ ধরনের নৃশংসতা বন্ধ হওয়া কঠিন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এলাকাবাসী ও ব্যবসায়ী সমাজ দ্রুত কার্যকর ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছেন, যাতে পুনরায় এমন অবস্থা সৃষ্টি না হয় এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ