বিশেষ অনুসন্ধান মূলক প্রতিবেদন
এক কিডনির গ্রাম: বাংলাদেশ-ভারত জুড়ে দারিদ্র্যের ফাঁদে অঙ্গপাচার

মৃদু বিকেলের রোদে, বাংলাদেশে জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার বৈগুনী গ্রামে নিজের অপূর্ণ ইটের দেওয়ালের ঘরের সামনে বসে আছেন ৪৫ বছর বয়সী সফিরউদ্দিন। পাঁজরের একপাশে ধীরে ধীরে পোড়া ব্যথা জানান দিচ্ছে অস্ত্রোপচারের চিহ্ন।
২০২৪ সালের গ্রীষ্মে, তিনি ভারতের এক হাসপাতালে নিজের একটি কিডনি বিক্রি করেন ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা (প্রায় ২,৮৫০ ডলার) মূল্যে। আশা ছিল এই টাকায় দারিদ্র্যের জাঁতাকল থেকে পরিবারকে টেনে তুলবেন, দুই কন্যা ও এক পুত্রকে নিয়ে একটি পাকাবাড়ি তুলবেন। কিন্তু সেই টাকা এখন ইতিহাস, বাড়ির কাজ থমকে আছে, আর শরীরের যন্ত্রণাই যেন সারাক্ষণের সতর্কবার্তা—কি মূল্য দিয়েছেন তিনি।
এখন তিনি কাজ করছেন একটি কোল্ডস্টোরেজে দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক হিসেবে। কিন্তু দিনদিন তার স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে। শরীরের স্থায়ী ব্যথা ও দুর্বলতা তাকে সাধারণ কাজ করতেও কষ্টে ফেলে।
“আমি আমার কিডনি দিয়েছি শুধুমাত্র পরিবারের জন্য। আমার স্ত্রী আর সন্তানদের ভালো রাখার জন্য সব করেছি,” বলছিলেন সফিরউদ্দিন।
তাকে যখন দালালরা প্রথম প্রস্তাব দেয়, তখন বিষয়টি খুব ভয়াবহ বলে মনে হয়নি। বরং দালালদের কথায় এটি যেন ছিল এক ‘সুযোগ’—ঝুঁকির কিছু নয়। প্রথমে তিনি সন্দিহান ছিলেন, কিন্তু দারিদ্র্যের তীব্রতা শেষ পর্যন্ত তার সংশয়কে জয় করে।
তাকে ভারতে নেওয়া হয় মেডিকেল ভিসায়। সব আয়োজন—ভিসা, বিমানভাড়া, নথিপত্র ও হাসপাতালের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা—দালালরাই সামাল দেয়। ভারতে গিয়ে যদিও তিনি নিজের আসল বাংলাদেশি পাসপোর্টে ভ্রমণ করেন, তবুও বাকি কাগজপত্র—যেমন একজন রোগীর সঙ্গে তার ভুয়া আত্মীয়তার প্রমাণ হিসেবে তৈরি করা হয় নকল সনদ ও পরিচয়পত্র।
তার পরিচয়ই পরিবর্তন করে ফেলা হয়। তার কিডনি যে ব্যক্তিকে প্রতিস্থাপন করা হয়, তাকে তিনি কখনও দেখেননি। “আমি জানি না আমার কিডনি কে পেয়েছে। দালালরা কিছুই বলেনি,” জানান সফিরউদ্দিন।
ভারতের আইনে কেবলমাত্র নিকট আত্মীয়দের মধ্যেই অঙ্গদান অনুমোদিত, অথবা সরকার অনুমোদিত বিশেষ অনুমতির ভিত্তিতে। কিন্তু পাচারকারীরা দস্তাবেজ, পরিবারের তথ্য, এমনকি ডিএনএ রিপোর্ট পর্যন্ত জাল করে আইনি সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে।
“সাধারণত বিক্রেতার নাম পরিবর্তন করা হয়, তারপর একজন আইনজীবীর সীল দেওয়া নোটারী সনদ দিয়ে প্রমাণ দেখানো হয় যে, দাতা ও গ্রহীতা আত্মীয়। ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে এমন দেখা যায় যেন বোন, কন্যা বা কোনো আত্মীয় ‘মানবিক কারণে’ কিডনি দিচ্ছে,” বলেন মনির মনিরুজ্জামান, মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অঙ্গ প্রতিস্থাপন বিষয়ক টাস্কফোর্সের সদস্য।
সফিরউদ্দিনের ঘটনা ব্যতিক্রম নয়। কিডনি বিক্রি এতো বেশি এই বৈগুনী গ্রামে, যে মাত্র ৬,০০০ জনসংখ্যার এই এলাকাকে সবাই চেনে “এক কিডনির গ্রাম” নামে। ২০২৩ সালে BMJ Global Health-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, কালাই উপজেলায় প্রতি ৩৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন কিডনি বিক্রি করেছেন।
কালাই উপজেলা বাংলাদেশের অন্যতম দরিদ্র এলাকা। অধিকাংশ দাতা ৩০ বছরের আশপাশের পুরুষ, যাদের কাছে এই কিডনি বিক্রি মানে হঠাৎ করে একটা ‘বাঁচার পথ’। ৮৩ শতাংশ দাতা বলেছেন, কিডনি বিক্রির প্রধান কারণ দারিদ্র্য। বাকিরা বলেছে ঋণ শোধ, মাদকাসক্তি বা জুয়াসহ অন্যান্য চাপ।
সফিরউদ্দিন বলেন, তার পাসপোর্ট দালালরাই নিয়ে নিয়েছিল, আর তা ফেরত পায়নি। এমনকি অস্ত্রোপচারের পর ডাক্তার যে ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন, তাও পায়নি। “ওরা সব নিয়ে গেছে,” বলেন তিনি।
অস্ত্রোপচারের পর দালালরা প্রায়ই দাতাদের পাসপোর্ট ও প্রেসক্রিপশন রেখে দেয়, যাতে অপারেশনের কোনো প্রমাণ না থাকে এবং চিকিৎসার পরবর্তী সেবা থেকেও তারা বঞ্চিত হন।
এই কিডনিগুলো বিক্রি হয় ধনী রোগীদের কাছে—বাংলাদেশ বা ভারতে—যারা দীর্ঘ অপেক্ষা ও আইনি সীমাবদ্ধতা এড়াতে চায়। ভারতে ২০২৩ সালে কেবল ১৩,৬০০ কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে, অথচ প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ মানুষ শেষ পর্যায়ের কিডনি ব্যর্থতায় ভোগে।
আল জাজিরা এক ডজনের বেশি কিডনি দাতার সঙ্গে কথা বলেছে—তারা সবাই দারিদ্র্যকে দায়ী করেছেন। এই পাচারের সরল কিন্তু নিষ্ঠুর হিসাব হলো: দারিদ্র্য সরবরাহ তৈরি করে, আর বিত্তবানদের চাহিদা ও দুর্বল আইন প্রয়োগ ব্যবস্থা সেই চাহিদাকে থামতে দেয় না।
ছবি: সফিরউদ্দিন কিডনি প্রতিস্থাপনের পর তার অস্ত্রোপচারের দাগ দেখাচ্ছেন
এক ভুল সিদ্ধান্তের ফলাফল
৪৫ বছর বয়সী জোসনা বেগম, কালাই উপজেলার বিনাই গ্রামের বিধবা। ২০১২ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই মেয়েকে নিয়ে চরম সংকটে পড়েন। ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করতে গিয়ে বেলাল নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে হয় তার। তারপর দুজনকেই দালালরা প্রলুব্ধ করে ভারতে কিডনি বিক্রি করতে।
“এটা ছিল একটা ভুল,” বলেন জোসনা। শুরুতে ৫ লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিলেও পরে তা ৭ লাখ বলে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু অস্ত্রোপচারের পর হাতে পান মাত্র ৩ লাখ টাকা।
জোসনা ও বেলালকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিয়াক সায়েন্স হাসপাতালে। তাদেরকে বেনাপোল দিয়ে বাসে করে সীমান্ত পার করানো হয়, হাসপাতালের পাশে একটি ভাড়াবাড়িতে রাখা হয়।
দালালরা কাগজপত্রে জোসনার সঙ্গে গ্রহীতার আত্মীয়তা জাল করে। “আমার পাসপোর্ট, প্রেসক্রিপশন—সব তাদের হাতে। আমি শুধু পাসপোর্ট চেয়েছিলাম, তাও দেয়নি।”
ভারতে প্রায় দুই মাস থেকে ফিরে আসেন তিনি—তবে দালালের অনুগ্রহে, প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও তারা আর যোগাযোগ রাখেনি। কিছু টুকরো টাকা ঈদের সময় দেওয়া হলেও, এরপর তারা হাওয়া হয়ে যায়।
অপারেশনের পর বেলাল তাকে ছেড়ে অন্য নারীকে বিয়ে করে। “আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে,” বলেন জোসনা।
চিরস্থায়ী ব্যথা আর ওষুধের খরচ সামাল দিতে না পেরে এখন কোনো ভারী কাজই করতে পারেন না। “সারাক্ষণ ওষুধ লাগে,” কাঁপা কণ্ঠে বলেন তিনি।
দাতা থেকে দালাল—একটা দারিদ্র্যচক্র
মোহাম্মদ সাজল (ছদ্মনাম), একসময় ঢাকায় ইভ্যালির মাধ্যমে হাউজহোল্ড সামগ্রী বিক্রি করতেন। ২০২১ সালে ইভ্যালি কেলেঙ্কারিতে তার সব সঞ্চয় শেষ হয়ে যায়। দেনা শোধে তিনি ২০২২ সালে নয়াদিল্লির ভেঙ্কটেশ্বর হাসপাতালে নিজের কিডনি বিক্রি করেন। প্রলোভন ছিল ১০ লাখ টাকা, কিন্তু পান মাত্র ৩ লাখ ৫০ হাজার।
তার ভাষায়, “ওরা আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে।” এরপর একসময় নিজেই হয়ে যান দালাল—বাংলাদেশি দাতাদের ভারতীয় হাসপাতালে অপারেশনের ব্যবস্থা করে দেন। পরে দালালচক্রের সঙ্গে আর্থিক বিরোধে জড়িয়ে পড়লে, জীবন রক্ষার ভয়ে পিছু হটেন।
“আমি এখন এই গ্যাংয়ের বন্দুকের সামনে,” বলেন তিনি। তার দাবি, এই চক্র বাংলাদেশ ও ভারতের হাসপাতাল পর্যন্ত বিস্তৃত। “ডাক্তার, রোগী, দালাল—সব একসঙ্গে কাজ করে।”
বর্তমানে তিনি ঢাকায় রাইডশেয়ার ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেন। অতীত ভুলে সামনে এগোতে চান। “কেউ শখে কিডনি দেয় না। এটা কেবল বাঁচার হিসাব।”
অস্ত্রোপচারের ছাপ রেখে নিখোঁজ হয়ে যায় দালালেরা
সফিরউদ্দিন নিজের শরীরের ক্ষত দেখিয়ে বলেন, “ওরা আমার কিডনি নিয়ে উধাও হয়ে গেছে।” যেমন তাঁর কথা, তেমনি আরও বহু দাতার—যাদের কাছে অপারেশনের পরে থাকেনি কোনো কাগজপত্র, নেই ফলোআপ চিকিৎসার সুবিধা।
অনেকে যেমন নিজের কিডনির গ্রহীতার নাম পর্যন্ত জানেন না। আইনত ভারত বা বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় দান শুধুমাত্র নিকট আত্মীয়ের মধ্যে হতে পারে, অথচ কাগজপত্র জাল করে এই নিয়মকে ঠেকানো যায় না। দালালদের কাছে এটা এখন রীতিমতো কৌশলগত ব্যবসা। জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে শুরু করে নোটারী সনদ, সবই ভুয়া। এমনকি প্রয়োজনে ডিএনএ রিপোর্টও জাল করা হয়।
মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও WHO-র অঙ্গ প্রতিস্থাপন টাস্কফোর্সের সদস্য মনির মনিরুজ্জামান বলেন, “এই ভুয়া পরিচয়ের কাগজপত্র খুব সহজেই তৈরি করা যায়। এতে সময় লাগে কম, খরচও খুব কম।”
এভাবে তৈরি হওয়া নকল আত্মীয়তার ভিত্তিতে যখন অপারেশন হয়, তখন তা যেন আইনগতভাবেই বৈধ। হাসপাতালগুলো নিজেদের দায় অস্বীকার করে বলে, “কাগজপত্র তো ঠিক ছিল।”
বাংলাদেশ ও ভারতের কর্তৃপক্ষ কী বলছে?
বাংলাদেশ পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) এনামুল হক সাগর বলেন, এই পাচার রোধে গোপন তদন্ত ও নিয়মিত অভিযানে নামা হয়েছে। “এই বিষয়টি আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি, এবং যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছি।” তিনি জানান, ইতোমধ্যে কয়েকজন দালাল ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অন্যদিকে ভারতে পুলিশ একাধিক ঘটনায় চিকিৎসকদের জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে দিল্লি পুলিশ গ্রেপ্তার করে ৫০ বছর বয়সী কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন ডা. বিজয়া রাজকুমারীকে। তদন্তে জানা যায়, ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তিনি ভারতের একটি বেসরকারি হাসপাতালে কমপক্ষে ১৫ জন বাংলাদেশির কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন বিচ্ছিন্ন গ্রেপ্তার কোনো কাজে আসছে না। কারণ, পুরো ব্যবস্থাটির ভিত্তিই গড়ে উঠেছে নিয়মের ফাঁক গলে গোপনে চলা লাভজনক বাণিজ্যের ওপর।
বিশেষত ভারতে ‘মেডিকেল ট্যুরিজম’ বা চিকিৎসা-ভ্রমণ শিল্পটি ২০২৪ সালে প্রায় ৭.৬ বিলিয়ন ডলারের বাজারে পরিণত হয়। ফলে সরকার একদিকে আইনি বাধ্যবাধকতা বজায় রাখার চেষ্টা করে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রোগী আনতে আগ্রহী হাসপাতালগুলোর ব্যবসায়িক স্বার্থকেও প্রশ্রয় দেয়।
মনিরুজ্জামান বলেন, “যখন জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ্যে আসে, হাসপাতালগুলো বলে—আমরা তো কাগজ দেখে কাজ করেছি। কিন্তু এই কাগজগুলো যে তৈরি করাই হয় দালালের সুবিধার্থে, সেটা তারা বোঝে না— এমন দাবি বিশ্বাসযোগ্য নয়। আসলে বেশি ট্রান্সপ্লান্ট মানে বেশি আয়। তাই চোখ বন্ধ করে রাখাই সুবিধাজনক।”
ছবি:ভারতে কিডনি প্রতিস্থাপন ব্যবসা দীর্ঘদিন ধরেই লাভজনক হিসেবে পরিচিত। ২০০৮ সালে নেপালের পুলিশ গ্রেপ্তার করে অমিত কুমার নামের ৪০ বছর বয়সী এক ভারতীয়কে, যাকে ভারতের একটি অবৈধ কিডনি পাচার চক্রের মূলহোতা হিসেবে সন্দেহ করা হয়।
দালাল ও চিকিৎসকদের গোপন যোগসাজশ
বাংলাদেশের এক দালাল মিজানুর রহমান জানান, এই ব্যবসায় হাসপাতাল বোর্ড থেকে শুরু করে চিকিৎসকরাও যুক্ত। অনেক সময় দালালরা সরাসরি চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের একটি বড় অংশ মুনাফার প্রতিশ্রুতি দেয়। তিনি বলেন, “ভারতে আমাদের পার্টনারদের মাধ্যমেই এসব ডাক্তারদের ঠিক করা হয়।”
ভারতের জাতীয় অঙ্গ ও টিস্যু প্রতিস্থাপন সংস্থার (NOTTO) পরিচালক ডা. অনিল কুমার এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে NOTTO-র সাবেক এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) স্বীকার করেছেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রায়শই ধনী রোগী ও নকল কাগজ নিয়ে আসা দাতা–দু’পক্ষের চাপের মুখে পড়ে যান। “যদি বোর্ড অনুমোদন না দেয়, রোগী আদালতে যায়, উচ্চ পর্যায়ে চাপ সৃষ্টি করে। তাই হাসপাতালগুলো অযথা ঝামেলা এড়াতে ট্রান্সপ্লান্ট করিয়েই ফেলে।”
পুলিশের নজর এড়াতে হাসপাতাল বদল
মনিরুজ্জামান বলেন, “এই ট্রান্সপ্লান্টগুলোর জন্য কোনো একটি নির্দিষ্ট হাসপাতাল নির্ধারিত নয়। যখন কোনো স্থানে পুলিশি অভিযান হয়, তখন দালালরা স্থান পরিবর্তন করে।”
তিনি জানান, বাংলাদেশ ও ভারতের দালালরা একত্রে কাজ করে। একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তারা ঠিক করে কখন কোন হাসপাতালে, কোন রোগীর জন্য দাতা পাঠানো হবে।
বাণিজ্যের হিসাব: ধনী পায় ২৬,০০০ ডলারে, গরিব পায় ৩ লাখ টাকা
ভারতে একজন কিডনির রোগী যদি লাইনে দাঁড়িয়ে আইনি পদ্ধতিতে অঙ্গপ্রাপ্তির চেষ্টা করে, তাহলে তার জন্য অপেক্ষা কয়েক বছর। এই দীর্ঘ অপেক্ষা ও কঠিন প্রক্রিয়া এড়িয়ে অনেকেই সরাসরি ২২,০০০–২৬,০০০ ডলার দিয়ে কিডনি কেনে।
আর সেই কিডনির জন্য দাতাকে দেওয়া হয় মাত্র ৩–৫ লাখ টাকা (২,৫০০–৪,০০০ ডলার)। বাকি অর্থ চলে যায় দালাল, ভুয়া কাগজ প্রস্তুতকারী, হাসপাতাল স্টাফ ও কখনো কখনো চিকিৎসকের পকেটে।
আরও ভীতিকর ঘটনা হলো—সব দাতা যে জানে তারা কিডনি দিচ্ছে, তা নয়। কেউ কেউ চাকরির প্রলোভনে ভারতে গিয়ে অপারেশনের পর বুঝে ওঠেন কী হয়েছে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের একটি চক্র বাংলাদেশি তরুণদের “চাকরি” দেওয়ার নামে জিম্মি করে কিডনি নিয়েছিল। ঢাকায় এই চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা অন্তত ১০ জনকে এই কৌশলে দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে অপারেশন করিয়েছিল।
বের হতে না পারা এক দারিদ্র্য-শোষণের চক্র
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, “কেউ কেউ দারিদ্র্যের কারণে কিডনি বিক্রি করে, কিন্তু একটা বড় অংশ সম্পূর্ণভাবে প্রতারিত হয়।”
তিনি বলেন, “ভারতের কোনো ধনী রোগী কিডনি চায়, মধ্যস্বত্বভোগী একজন দরিদ্র বাংলাদেশিকে খুঁজে আনে, চাকরি বা দ্রুত আয় দেখিয়ে প্রলুব্ধ করে। তারপর শুরু হয় দালালের খেলা।”
ভবিষ্যতের ভাবনা: নিয়ন্ত্রণ নাকি ন্যায্যতা?
ভারতের কিডনি ওয়ারিয়রস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী বাসুন্ধরা রঘুবন বলেন, “কিডনি রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, কিন্তু আইনি দাতার অভাব এই সমস্যাকে ভয়াবহ করে তুলেছে।”
তিনি বলেন, “আইনের চোখে অঙ্গ বেচাকেনা অপরাধ হলেও বাস্তবে তা চলে আসছে। সম্পূর্ণ নির্মূল সম্ভব না হলে, অন্তত একটি নিয়মতান্ত্রিক ও মানবিক পদ্ধতি নিয়ে ভাবা দরকার।”
তার প্রস্তাব অনুযায়ী, আইনি ব্যবস্থা আরও মানবিক হওয়া উচিত। দাতাদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা, অস্ত্রোপচারের পর দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা সুবিধা, এবং আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা ভাবতে হবে।
একটি অপূর্ণ বাড়ি, এক পিতার বোবা যন্ত্রণা
সফিরউদ্দিন এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না। তার দেহ দুর্বল, প্রতিদিনের কাজ করাও কষ্টকর। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, চোখে ভাসে অপারেশনের কথা, দালালদের প্রতিশ্রুতি, আর অপূর্ণ স্বপ্নের ছবি।
“আমি ভেবেছিলাম, টাকা পাবো, বাড়ি শেষ করবো। এখন আমার সন্তানদের জন্য শুধু অসুস্থ এক বাবা রয়ে গেছে,” বলেন তিনি।
এই ছিল ‘এক কিডনির গ্রাম’-এর ভিতরকার সত্য। এখানে প্রতিটি দাতা একেকটি ভাঙা স্বপ্ন, প্রতিটি অপারেশন একেকটি প্রতারণার দলিল। দারিদ্র্য, দুর্বল আইন, এবং লোভের মোড়কে গড়ে ওঠা এই মানবিক সংকট আজ আমাদের সামনে এক ভয়ঙ্কর প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়—আমরা কি মানুষের অঙ্গকেও পণ্য বানিয়ে ফেলেছি?
লেখক: জ্যোতি ঠাকুর, আমিনুল ইসলাম মিঠু ও হানান জাফর
মূল উৎস: আল জাজিরা, ৪ জুলাই ২০২৫
পাঠকের মতামত:
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- সরদার ফজলুল করিম: এক নিঃস্বার্থ চিন্তাবিদের রাজনৈতিক পুনর্পাঠ
- বাংলাদেশে কারাগার/হেফাজতে আত্মহত্যা: একটি উপেক্ষিত সংকট
- ভারতবিরোধী ফেসবুক পোস্টে ক্ষিপ্ত হয়ে সাইমুম সাজিদের বাড়িতে হামলা, আ.লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ
- আদানিকে সব বকেয়া পরিশোধ করল বাংলাদেশ
- বেকিং সোডা ও পাউডার: রান্নার সফলতার দুই গোপন যোদ্ধা
- রাতে বিছানায় ত্বক চুলকানি? জানুন কারণ ও প্রতিকার
- শেয়ারবাজারে ঝড় তুলেছে যে ১০টি শেয়ার! দেখে নিন তালিকা
- একটি ব্যালকনি, তিনটি জীবন—যশোরে নির্মাণ বিভীষিকা!
- তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের দিনক্ষণ ঠিক, প্রস্তুত হচ্ছে বুলেটপ্রুফ নিরাপত্তা ও সাংগঠনিক কাঠামো
- ম্যাক্স ভেবারের দৃষ্টিতে প্রোটেস্ট্যান্টিজম: ধর্ম থেকে পুঁজিবাদের উত্থান
- মুরাদনগরে হিন্দু নারী নির্যাতন নিয়ে মির্জা ফখরুলের কঠোর বিবৃতি
- ৩০ জুনদরপতনের শীর্ষে যারা
- বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা কার হাতে, তা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে
- ইন্টারভিউয়ে সফল হওয়ার ছয়টি চাবিকাঠি
- সপ্তাহের শেষ দিনে যেসব শেয়ারে প্রবল সাড়া
- এক কিডনির গ্রাম: বাংলাদেশ-ভারত জুড়ে দারিদ্র্যের ফাঁদে অঙ্গপাচার
- চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটির হস্তান্তর সম্পন্ন, পরিচালনায় ড্রাইডক
- আশিয়ান সিটির মাসব্যাপী আবাসন মেলায় থাকছে আকর্ষনীয় অফার
- খনিজ সম্পদে শক্তি সঞ্চয়, বৈদেশিক মিত্রতা গড়ছে আফগানিস্তান
- দাদাদের বাহাদুরির দিন শেষ: নাহিদ ইসলাম
- বরগুনায় ট্রাফিক মামলায় ক্ষুব্ধ চালক নিজের মোটরসাইকেলে আগুন দিলেন
- ৯ জুলাইয়ের পর কী হবে? শুল্ক আতঙ্কে কাঁপছে বাজার
- মোটা হলেই কি অসুস্থ? বাস্তবতা, বিজ্ঞান ও ভুল বোঝাবুঝির অনুসন্ধানে
- রাঙ্গুনিয়ায় ভাঙা সড়ক নিজেরা মেরামত করলেন ছাত্রদল কর্মীরা
- হিজাব, রামমন্দির ও কঙ্গনা: মামদানির প্রাইমারি জয়ে হিন্দুত্বের ছোবল
- কর্মমুখী উদ্যোগে বিএনপি নেতা, খুলনার নারীরা পেলেন সেলাই মেশিন
- রহস্য-অ্যাকশনে ভরপুর 'ধুরন্ধর' নিয়ে হাজির রণবীর সিং
- যুগ যুগ ধরে জামায়াত জনগণের মনোভাব বুঝতে চায়নি: রিজভী
- এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছড়ানো হয়েছে তাসনিম জারার বিকৃত ছবি
- “আমগাছে বেঁধে বিচার করা হবে” — শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মন্তব্য এনসিপি নেতার
- ২০২৫ করবর্ষে করদাতাদের জন্য ৫ স্বস্তির বার্তা
- চাঁদপুরে যুবক হত্যার বিচারে মরদেহ নিয়ে থানার সামনে এলাকাবাসীর বিক্ষোভ
- উখিয়ায় বাবার হাতে চার বছরের শিশুকন্যা খুন, লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় খালে
- নতুন বাংলাদেশের রূপরেখা দিলেন নাহিদ ইসলাম, দুর্নীতি নির্মূলের প্রত্যয়
- ফেসবুক প্রেম, গুগল ট্রান্সলেটর আর ভালোবাসায় খুলনায় চীনা জামাই
- রাজধানীর খিলগাঁও ও বাড্ডায় দুই নারীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
- গাজার অবরোধিত এলাকায় খাবারের জন্য বের হওয়া ৭৪৩ ফিলিস্তিনিকে হত্যা
- জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদ নারী ও শিশুদের স্মৃতি ভুলে যাওয়া যাবে না: উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ
- ঢাবি সূর্যসেন হলে ছাত্রলীগ নেতাকে আটকের পর পুলিশের কাছে সোপর্দ
- দুধ কমাচ্ছে গরম: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে খামারে
- সরদার ফজলুল করিম: এক নিঃস্বার্থ চিন্তাবিদের রাজনৈতিক পুনর্পাঠ
- বাংলাদেশে কারাগার/হেফাজতে আত্মহত্যা: একটি উপেক্ষিত সংকট
- ভারতবিরোধী ফেসবুক পোস্টে ক্ষিপ্ত হয়ে সাইমুম সাজিদের বাড়িতে হামলা, আ.লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ
- আদানিকে সব বকেয়া পরিশোধ করল বাংলাদেশ
- বেকিং সোডা ও পাউডার: রান্নার সফলতার দুই গোপন যোদ্ধা
- রাতে বিছানায় ত্বক চুলকানি? জানুন কারণ ও প্রতিকার
- শেয়ারবাজারে ঝড় তুলেছে যে ১০টি শেয়ার! দেখে নিন তালিকা
- একটি ব্যালকনি, তিনটি জীবন—যশোরে নির্মাণ বিভীষিকা!
- তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের দিনক্ষণ ঠিক, প্রস্তুত হচ্ছে বুলেটপ্রুফ নিরাপত্তা ও সাংগঠনিক কাঠামো
- ম্যাক্স ভেবারের দৃষ্টিতে প্রোটেস্ট্যান্টিজম: ধর্ম থেকে পুঁজিবাদের উত্থান
- মুরাদনগরে হিন্দু নারী নির্যাতন নিয়ে মির্জা ফখরুলের কঠোর বিবৃতি
- ৩০ জুন দরপতনের শীর্ষে যারা
- বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা কার হাতে, তা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে
- ইন্টারভিউয়ে সফল হওয়ার ছয়টি চাবিকাঠি
- সপ্তাহের শেষ দিনে যেসব শেয়ারে প্রবল সাড়া