কোন দ্বন্দ্বের আগুনে পুড়ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিএনপি

রাজনীতি ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১৩ ১০:২৯:২২
কোন দ্বন্দ্বের আগুনে পুড়ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিএনপি

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বিএনপি বর্তমানে তীব্র গ্রুপিং, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও নেতৃত্বসংকটে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। পদ-পদবি কেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব, সমন্বয়হীনতা, এবং জেলা-উপজেলায় বলয়ভিত্তিক রাজনীতির ফলে দলটির সাংগঠনিক কাঠামো কার্যত ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। মাঠপর্যায়ে একাধিক বলয় সক্রিয় থাকলেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে দলটির স্থানীয় সংগঠনে সৃষ্টি হয়েছে নেতৃত্বশূন্যতা, অসন্তোষ ও দ্বন্দ্বময় পরিবেশ।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম জাকারিয়াকে আহ্বায়ক এবং রফিকুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে গঠিত ওই কমিটিতে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পান অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম টিপু। তবে এই কমিটি গঠনের সময় জেলার প্রভাবশালী তিন এমপি— হারুনুর রশীদ, অধ্যাপক শাহজাহান মিঞা ও আমিনুল ইসলামের মতামত উপেক্ষিত ছিল। ফলাফলস্বরূপ, তাদের অনুসারীরা জেলা বিএনপির কমিটির প্রতি সহযোগিতা না করে প্রতিরোধের অবস্থান নেয়।

এর ধারাবাহিকতায় চার বছরেও জেলার ইউনিয়ন ও থানা ইউনিটগুলোতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন সম্ভব হয়নি। জেলা বিএনপির পাঁচটি উপজেলা, চারটি পৌরসভা ও ৪৫টি ইউনিয়নের অধিকাংশেই কার্যকর কমিটি না থাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিএনপিতে বর্তমানে ত্রিমুখী বলয় রাজনীতি স্পষ্ট। একদিকে জেলা আহ্বায়ক গোলাম জাকারিয়া অধ্যাপক শাহজাহান মিঞার সঙ্গে সমন্বয়ে রাজনৈতিক বলয় পরিচালনা করছেন, অন্যদিকে সদস্য সচিব রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে চলছে ভিন্ন বলয়, যার পেছনে রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ শাহীন শওকতের সক্রিয় মদদ রয়েছে। আর তৃতীয় বলয়টি গড়ে উঠেছে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হারুনুর রশীদের নেতৃত্বে, যিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনে সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতাদের একজন।

জেলা কমিটির ভেতরে অবস্থানগত এ বিভাজনের কারণে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিও আলাদা আলাদাভাবে পালিত হচ্ছে। আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব এক টেবিলে বসতে রাজি নন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এমনকি জেলা কমিটির অনেক সভা আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের স্বাক্ষরহীন অবস্থায় হয়েছে।=

২০২4 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও নির্বাচনী রোডম্যাপ ইস্যুতে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, যখন শিবগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আশরাফুল হককে বক্তব্য রাখতে না দেওয়ায় দুই পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনার পর দলীয় ভিত আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।

এরপর শিবগঞ্জ, নাচোল, গোমস্তাপুরসহ বেশ কয়েকটি উপজেলা ও পৌর বিএনপির কমিটি গঠন নিয়ে দেখা দেয় সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা। একাধিক ক্ষেত্রে সদস্য সচিব রফিকুল ইসলামের স্বাক্ষর ছাড়া আহ্বায়ক গোলাম জাকারিয়া কমিটি ঘোষণা করেছেন। আবার সদ্য ঘোষিত নাচোল ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর বিএনপির কমিটিতে আহ্বায়ক জাকারিয়ার স্বাক্ষর নেই, অথচ তাতে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের স্বাক্ষর রয়েছে। এসব কমিটি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালামের মৌখিক নির্দেশনায় গঠিত হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে, যা দলীয় রীতি ও গঠনতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

দলীয় ভেতরে গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে একক বলয় নিয়ন্ত্রণের এই প্রবণতা স্থানীয় নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, তিন নেতার যৌথ স্বাক্ষরে ইউনিট কমিটি গঠন করতে হবে। কিন্তু বারবার এই নির্দেশ লঙ্ঘিত হওয়ায় সাংগঠনিক শৃঙ্খলা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, “আহ্বায়ক গোলাম জাকারিয়া আমার স্বাক্ষর ছাড়া পাঁচটি ইউনিট কমিটি অনুমোদন দিয়েছেন। এটাই দলে বিশৃঙ্খলার মূল কারণ। কেন্দ্রীয় নেতাদের জানিয়ে আমরা ত্যাগী ও দক্ষ নেতাদের দিয়ে কিছু নতুন কমিটি দিয়েছি।”

অন্যদিকে আহ্বায়ক গোলাম জাকারিয়া বলেন, “আমার স্বাক্ষর ছাড়া গঠিত কোনো কমিটির সাংগঠনিক ভিত্তি নেই। ঢাকা মিটিংয়ে আবদুস সালামও স্পষ্ট বলেছেন, আহ্বায়ক স্বাক্ষর না থাকলে কমিটি বৈধ নয়। অথচ আমার নাম ব্যবহার করে কমিটি দেওয়া হয়েছে।”

চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাজনীতিতে অধ্যাপক শাহজাহান মিঞার জনপ্রিয়তা ও মাঠের সক্রিয়তা তুলনামূলক বেশি। তার বলয়ের নেতারা নিয়মিতভাবে কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী মাঠে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। ক্লিন ইমেজ, রাজপথে উপস্থিতি এবং তৃণমূলের সঙ্গে সংযোগের কারণে তিনি বিএনপির কর্মীসমর্থকদের মধ্যে আস্থা অর্জন করেছেন।

অন্যদিকে সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ শাহীন শওকতের নেতৃত্বে পৃথক বলয়ের নেতারা আগামী নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্রিয়। ফলে দলীয় নেতৃত্বে আরও ঘনীভূত হয়েছে বিভাজন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

জেলা বিএনপির নেতাদের মতে, এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দলকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করছে এবং রাজপথে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ব্যাহত করছে। যদিও আহ্বায়ক গোলাম জাকারিয়া দাবি করেছেন, নির্বাচনের আগেই কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দ্বন্দ্ব নিরসন সম্ভব; তবে সাবেক এমপি হারুনুর রশীদের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া তা বাস্তবায়ন কঠিন হবে।

রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ শাহীন শওকতও দ্বন্দ্বের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, “বিএনপি একটি বড় দল হিসেবে প্রতিযোগিতা থাকবেই। তবে সংকটগুলো নির্বাচনের আগেই মিটে যাবে বলে আমি আশাবাদী।”

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যদি দ্রুত সাংগঠনিক ঐক্য ফেরানো না যায়, তাহলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বিএনপি আগামী জাতীয় নির্বাচনে কার্যকর কোনো অবস্থান নিতে পারবে না। বরং ভেতরের কোন্দলই হবে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ