ঋণের পাহাড়ে ঢাকা: নির্বাচনের পর সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ

অর্থনীতি ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১২ ১০:১০:০৫
ঋণের পাহাড়ে ঢাকা: নির্বাচনের পর সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ

২০২৫-২৬ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট পরিমাণ পৌঁছাতে চলেছে প্রায় ২৩ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকায়। এই ঋণ প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় বোঝা যাচ্ছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন শেষেই যেই সরকারই দায়িত্ব নিক না কেন, তাকে শুরুতেই সম্মুখীন হতে হবে বিপুল ঋণচাপের।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান অর্থবছর শেষে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১৩ লাখ ২৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের অঙ্ক পৌঁছাবে ১০ লাখ ১৫ হাজার ২০০ কোটি টাকায়। এটি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে তিন বছর মেয়াদি মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি-বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ২০২৬-২৭ অর্থবছরে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ বাড়বে ২৬ লাখ ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকায় এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছরে তা গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ২৮ লাখ ৯৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকায়। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার মতো ঋণ যোগ হচ্ছে।

তবে ঋণের এই ক্রমাগত বৃদ্ধি তখন আরও জটিল আকার ধারণ করবে, যখন ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবে। তখন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে এখনকার মতো সহজ শর্তে এবং কম সুদে ঋণ পাওয়া যাবে না। ঋণের সুদের হার বেড়ে যাবে এবং সময়সীমাও কমে আসবে।

অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ঋণ ছিল ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। প্রাথমিকভাবে এটির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২২ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, যা পরে অন্তর্বর্তী সরকার সংশোধন করে কমিয়ে এনেছে ২১ লাখ ১১ হাজার ৯০০ কোটি টাকায়।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, আগের সরকারের রেখে যাওয়া আর্থিক অস্থিরতা ও সংকট মোকাবিলা করতে হবে ধীরে সুস্থে, আর সেজন্য বৈদেশিক ঋণ সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা চলছে।

তবে সরকারের বিভিন্ন নীতিপত্র বলছে ভিন্ন কথা। ঋণ-জিডিপির অনুপাত এখন ৩৭ শতাংশের ঘরে রয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তা ৩৭.৫ শতাংশে উন্নীত হবে এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছরে পৌঁছাবে ৩৭.৭২ শতাংশে। যদিও সংখ্যাগুলো সহনীয় দেখালেও বিপদের বার্তা লুকিয়ে রয়েছে বৈদেশিক ঋণ ও রপ্তানি আয়ের অনুপাতে। বর্তমানে এ অনুপাত দাঁড়িয়েছে ১৪০ শতাংশে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

নতুন ঋণের বোঝা যুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের দায়ও বাড়ছে। অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের আসল পরিশোধ করতে হয়েছে ২০২ কোটি মার্কিন ডলার। সেটি চলতি অর্থবছরে বাড়বে ২৬১ কোটি ডলারে। আর পরবর্তী তিন অর্থবছরে সেই অঙ্ক দাঁড়াবে যথাক্রমে ২৯০, ৩১২ ও ৩৩৪ কোটি ডলার। এতে সুদসহ মোট পরিশোধের অঙ্ক আরও ব্যাপক হবে।

সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, ঋণ-জিডিপির অনুপাত উদ্বেগজনক উচ্চতায় পৌঁছেছে। বিশেষ করে ভবিষ্যতে বড় অঙ্কের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ আসবে হঠাৎ করে, যা দেশের অর্থনীতিকে বিপদে ফেলতে পারে। তার মতে, এখন সময় এসেছে ঋণ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা দেখানোর, দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়ানোর এবং রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থাকে সংস্কার করার।

তিনি আরও বলেন, আগের সরকার ঋণ ব্যবস্থাপনায় অনেক সময় শুধু আইএমএফের ‘সহনীয়তার পরিসংখ্যান’ দেখে নির্ভার থেকেছে, বাস্তব অর্থনৈতিক ভিত্তি কতটা শক্ত ছিল, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়নি। যা অনেকটা “অন্ধকারে শিস দিয়ে সাহস জোগানো”-র মতো।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কর সংগ্রহ বাড়ানো, ব্যয় কমানো এবং সুশাসনের ভিত্তিতে ঋণ ব্যবস্থাপনায় কৌশলী সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। নইলে নির্বাচনের পর যেই সরকারই আসুক না কেন, শুরুতেই তাদের মুখোমুখি হতে হবে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—অত্যধিক ঋণের বোঝা।

সত্য প্রতিবেদন/আশিক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ