পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে পুলিশের ভূমিকায় প্রশ্নবাণ

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১৪ ০৯:০৩:১৩
পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে পুলিশের ভূমিকায় প্রশ্নবাণ

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশজুড়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে সহিংসতা ও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড। গণপিটুনি, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা, রাজনৈতিক শত্রুতার জের, আধিপত্য বিস্তার কিংবা পারিবারিক দ্বন্দ্ব প্রতিদিনই কোনো না কোনো প্রেক্ষাপটে ঘটছে হত্যার নির্মমতা। এর পেছনে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাঠামোগত দুর্বলতা, পুলিশের মানসিক ট্রমা, অপরাধীদের বেপরোয়া মনোবৃত্তি এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, চলতি বছরের প্রথম সাড়ে ৬ মাসে দেশজুড়ে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৯৪ জন। শুধু রাজধানী ঢাকায় এ সময়ের মধ্যে খুন হয়েছেন ১৯০ জন। আর এসব সংখ্যাই শুধু সরকারি নথিভুক্ত। আসল চিত্র আরও ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

মিটফোর্ডে নির্মমতা, চারদিকে নিরব দর্শক

গত ১০ জুলাই মিটফোর্ড হাসপাতালে ৩ নম্বর গেটের সামনে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে হত্যা করে একদল দুর্বৃত্ত। আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ কেবল দেখেছেন, কেউ ভিডিও করেছেন, কিন্তু কেউ তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেননি। এই নিষ্ঠুর দৃশ্য দেশজুড়ে চরম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।

এর আগে কুমিল্লার মুরাদনগরে একদিনে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা, চাঁদপুরে মসজিদের ভেতরে জুমার নামাজ শেষে ইমামকে কুপিয়ে জখম এবং খুলনায় যুবদল নেতাকে গুলি করে হত্যা এসব ঘটনাও সমাজে ভয়, হিংসা ও নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি বাড়িয়ে তুলছে।

ভেঙে পড়ছে পুলিশের মনোবল, টহল সীমিত

বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বৈরশাসক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলীয় বাহিনীতে পরিণত হওয়া পুলিশের কাঠামো এক ধাক্কায় ভেঙে পড়ে ৫ আগস্টের পর। নতুন বাস্তবতায় পুলিশ বাহিনী কার্যত এক রকম ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। অভিযানে গেলে হামলার শিকার হচ্ছে, রাতের টহল দিতে দ্বিধান্বিত। এতে অপরাধীরা দমনের সুযোগ নিচ্ছে।

একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, রাতে আগে যেখানে ৭–৮ জন পুলিশ সদস্য মিলে নিয়মিত টহল দিত, এখন সেই সংখ্যা অনেক কম। মামলার তদন্তে আগে যেসব কর্মকর্তা সরেজমিনে যেতেন, এখন তারা অনুপস্থিত থাকেন। পুলিশ এখন শুধু ঘটনার পরে কাগজে কলমে ব্যবস্থা নিতে ব্যস্ত, কিন্তু বাস্তবতায় সেই হস্তক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।

অপরাধী ধরতেও দ্বিধা, রাজনৈতিক পরিচয় বড় বাধা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “পুলিশ অপরাধীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে পারছে না। অপরাধী রাজনৈতিক পরিচয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়াটা আরও জটিল হয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো পুলিশ নিজেরাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, আবার ব্যবস্থা নিতে গিয়ে রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়ছে।”

অপরাধ বাড়লেও পুলিশ বলছে ‘সর্বোচ্চ চেষ্টা’ চলছে

তবে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর বলেন, “অপরাধ প্রতিরোধে আমাদের কোনো কার্পণ্য নেই। সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, প্রয়োজনে পরিবার ও সমাজের সচেতন অংশেরও এগিয়ে আসা দরকার।” তিনি অনুরোধ জানান, “যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে আইন নিজের হাতে না তুলে পুলিশকে জানাতে হবে। আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নিচ্ছি।”

‘ডেভিল হান্ট’ অপারেশনেও নেই বাস্তব সুফল

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ চালু করলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন নাগরিক সমাজ। বিভিন্ন থানায় মতবিনিময় এবং নির্দেশনার পরও মাঠপর্যায়ে কোনো দৃশ্যমান উন্নতি চোখে পড়ছে না। অপরাধীরা আজও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বিশেষত রাতের বেলায় তারা আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠছে।

গণপিটুনির মতো ঘটনায় সাধারণ জনগণই বিচারকের ভূমিকা নিচ্ছে। সমাজে ক্রমেই ভাঙছে আইন ও মানবতা। কেউ এগিয়ে এসে বাধা দিচ্ছে না, বরং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হত্যার ভিডিও ছড়িয়ে দিচ্ছে। এটি সমাজে অসহনশীলতা, বিচারহীনতা এবং মানসিক বিকৃতিরই পরিচায়ক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ