বিচার না দেখে মরতে চাই না- শহীদ আবু সাঈদের বাবার হাহাকার

সারাদেশ ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১৬ ১০:৪৯:২৫
বিচার না দেখে মরতে চাই না- শহীদ আবু সাঈদের বাবার হাহাকার

১৬ জুলাই ২০২৪, দুপুর দেড়টা। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ১ নম্বর গেটে জড়ো হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। তাদের স্লোগানে মুখর হতে থাকে পরিবেশ। ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ শুরু করে লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ। পাশে যুক্ত হয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী কর্মীরা। শত শত শিক্ষার্থী দিকবিদিক ছুটে পালায়, কিন্তু একজন দাঁড়িয়ে থাকেন বুক টান করে, দুই হাত প্রসারিত করে। তার নাম আবু সাঈদ।

ঘড়ির কাঁটায় তখন ২টা ১৭ মিনিট। বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে পুলিশ। মুহূর্তেই তিনি রাস্তার পাশে ঢলে পড়েন। বিকেল ৩টা ৫ মিনিটে রংপুর মেডিকেলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। সেই মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ লেখে, “এটাই তো সাহস! সে মাথা নিচু করেনি।”

এক বছর পর, এক বিপ্লবী উত্তরাধিকার

আবু সাঈদের শাহাদাতের পরবর্তী ৩৬৫ দিনে বাংলাদেশে বদলে যায় অনেক কিছু। তার রক্তের বিনিময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। ৫ আগস্ট স্বৈরশাসনের পতন ঘটে। নতুন বাংলাদেশ গঠনের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু বিচার এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। গ্রেপ্তার হয় মাত্র কয়েকজন। মূল হোতারা এখনো বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে।

আবু সাঈদ: মেধাবী ছাত্র, দায়িত্বশীল সন্তান, প্রতিবাদের মুখ

২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়া আবু সাঈদ ছিলেন ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিপ্রাপ্ত, গোল্ডেন জিপিএধারী শিক্ষার্থী। তার বাড়ি পীরগঞ্জের বাবনপুর গ্রামে। দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া সাঈদের স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার হয়ে দেশের সেবা করা। আন্দোলনে যুক্ত হন যাতে কোটার নামে মেধাবীরা বঞ্চিত না হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি ও উত্তীর্ণ হওয়া সাঈদ ছিলেন আন্দোলনের রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বয়ক। হত্যার আগে অনার্স পরীক্ষায় সিজিপিএ ৩.৩০ পেয়ে ১৪তম স্থান অর্জন করেন।

বিচারহীনতার অভিযোগ ও মামলার অগ্রগতি

১৮ আগস্ট তার ভাই রমজান আলী মামলা করেন। তাতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, উপাচার্য, প্রক্টর, ১১ জন পুলিশ, ছাত্রলীগ নেতাদের আসামি করা হয়। এখন পর্যন্ত মাত্র ৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। গত ২৪ জুন তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পিবিআই। ৩০ জুন ট্রাইব্যুনাল-২ মামলাটি গ্রহণ করে এবং ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।

গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক এএসআই আমির হোসেন, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম ও ছাত্রলীগ নেতা ইমরান আকাশ। ২৪ জন পলাতক আসামিকে ২২ জুলাইয়ের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা ও স্মরণ

ঘটনার পর ৭ শিক্ষক ও কর্মচারী সাময়িক বরখাস্ত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। উপাচার্য ড. শওকত আলী আবু সাঈদকে “বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব” হিসেবে উল্লেখ করে তার স্মৃতি সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

১৬ জুলাই ২০২৫-এ শহীদ দিবস উপলক্ষে বেরোবিতে দিনব্যাপী কর্মসূচি পালিত হচ্ছে—শ্রদ্ধা নিবেদন, শোক র‍্যালি, স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, আলোচনাসভা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও দোয়া মাহফিল। উপস্থিত থাকবেন চারজন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, ইউজিসি চেয়ারম্যান ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা।

প্রতিক্রিয়া: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিবাদ

আবু সাঈদের মৃত্যুর পর প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগরসহ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের বিক্ষোভ হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, টিআইবি তদন্ত ও বিচার দাবি করে। রংপুর পিবিআই মামলার তদন্ত দায়িত্ব পায়। শহীদ পরিবার ও সহযোদ্ধারা এখনো বিচার প্রত্যাশায় অপেক্ষায় রয়েছেন।

মা-বাবার শোক ও দেশের প্রত্যাশা

আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন বলেন, “ছেলের স্বপ্ন ছিল প্রশাসনে ঢুকে মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আমি বিচার না দেখে মরতে চাই না।” মা মনোয়ারা বেগম বলেন, “ছেলে বলেছিল—‘মা, কষ্ট করবি না। আমি চাকরি করব।’ আজ কিছু নেই, শুধু বিচার চাই।”

শিক্ষার্থীদের ভাষায়, আবু সাঈদ শুধু শহীদ নন, সাহসের অনুপ্রেরণা। তার ত্যাগ ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। তার রক্তে লেখা হয়েছে নতুন বাংলাদেশের প্রথম অধ্যায়।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ