বাংলাদেশের বায়ু দূষণ: জীবনকাল কমানোর নেপথ্যে ভয়াবহ বাস্তবতা

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ২৭ ০৯:৪৫:৫৫
বাংলাদেশের বায়ু দূষণ: জীবনকাল কমানোর নেপথ্যে ভয়াবহ বাস্তবতা

বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদী বায়ু দূষণ মানুষের গড় আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে। দ্রুত নগরায়ণ, অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ এবং জলবায়ু পরিবর্তন এই সংকটকে আরও তীব্র করে তুলেছে, যা শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত রোগ বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ু বাংলাদেশে বলে সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা গেছে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের ২০২৩ সালের এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স অনুসারে, দেশের বায়ুতে PM 2.5 মাত্রা গড়ে ৭৪ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটার, যা ভারতের ৫৮.৭, চীনের ৩০.২ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ৭.৮ মাইক্রোগ্রামের তুলনায় অনেক বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২১ সালের এয়ার কোয়ালিটি গাইডলাইনের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশি নাগরিকরা গড়ে প্রায় ৬.৮ বছর আয়ু হারাচ্ছেন।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরের পরিচালক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, বায়ুতে থাকা ভারী ধাতু রক্তের সঙ্গে মিশে নানা সংক্রামক রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যদিও মৃত্যুর পরিসংখ্যান নেই, তিনি নিশ্চিত করেছেন, দূষিত বায়ুজনিত রোগে ভুগছে অনেক রোগী।

ঢাকার পরিবেশ অধিদফতরের বায়ু মান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ জিয়াউল হক জানান, ঢাকার বায়ুর মান প্রতি বছরই খারাপ হচ্ছে। বর্ষাকালে বায়ুর গুণগত মান উন্নত হওয়ার কথা হলেও, বিলম্বিত বর্ষার কারণে এ বছর পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। দূষণের প্রধান উৎস হিসেবে পুরনো যানবাহন, ইটভাটা, বৃহৎ নির্মাণকাজ ও জীবাশ্ম জ্বালানি দহনকে দায়ী করা হচ্ছে।

২০২১ ও ২০২২ সালে ঢাকা ও গাজীপুরের কোন মাসেই "ভাল" মানের বায়ু নেই। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স অনুযায়ী, ০ থেকে ৫০ পর্যন্ত স্কোর ভালো, ১৫১-২০০ "অস্বাস্থ্যকর" ও ২৩৪ স্কোর "খুব অস্বাস্থ্যকর" হিসেবে বিবেচিত হয়।

সরকারের নির্মাণ শিল্পে ইটভাটার দূষণ কমানোর জন্য ২০১৭ সালে জাতীয় টেকসই উন্নয়ন কৌশল গৃহীত হলেও, এটি বাস্তবায়নে অগ্রগতি কম। সরকার ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে সরকারি প্রকল্পে ইটের ব্যবহার বন্ধ করার পরিকল্পনা করেছিল, তবে মহামারীসহ নানা কারণে সময়সীমা পিছিয়ে ২০২৯ ধার্য করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম মনে করেন, সরকারি প্রকল্পসমূহ নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়টি খুবই শিথিল। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, বড় বড় প্রকল্পগুলোতে কতোটা নিয়ম মানা হচ্ছে।

সেপ্টেম্বর ২০২৩-এ প্রকাশিত “স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার: সাউথ এশিয়া” প্রতিবেদন জানায়, ঢাকার বাতাসে নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইডের (NO2) ঘনত্ব বিশ্বব্যাপী প্রবণতার বিপরীতভাবে বাড়ছে। NO2 শ্বাসনালীর প্রদাহ ঘটায়, শ্বাসকষ্ট বাড়ায় ও হাঁপানির ঝুঁকি বাড়ায়, পাশাপাশি ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত করে।

সরকার ২০২৩ সালের আগস্টে বাণিজ্যিক বাস ও লরির বয়স্ক সীমা ২০ ও ২৫ বছর করার নির্দেশ বাতিল করে। ফলে, বহু পুরনো যানবাহন রাস্তায় চলতে থাকবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০২২ সালের জানুয়ারির তুলনায় ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার গাড়ির রোড ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই, মোটের উপর ৫৬৮,০০০ গাড়িরই ফিটনেস নেই।

অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বায়ু দূষণের প্রভাবে বাড়তি শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে আসা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ফুসফুস রোগ ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, ২০২০ সালে ১১,৭৮৩ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল, যা ২০২২ সালে বেড়ে ১৫,৯৪২ জনে উন্নীত হয়েছে।

দেশের ৭৭ শতাংশ গ্রামীণ পরিবার রান্নার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে, যা বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশব্যাপী পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করতে ব্যাপক সময় ও প্রচেষ্টা লাগবে।

এছাড়া, প্রতিবেশী দেশ ভারত ও নেপাল থেকেও দূষণ বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে, যার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তান ২০৩০ সালের মধ্যে জাতীয় গড় PM 2.5 মাত্রা ৩৫ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটার পর্যন্ত কমানোর জন্য ঐক্যমত হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সাহায্যও বাংলাদেশের দূষণ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। ২০১৫-২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৪০ কোটি ডলারের আন্তর্জাতিক তহবিল। সরকার একটি উচ্চ পর্যায়ের বায়ু দূষণ মোকাবেলা কমিটি গঠন করেছে এবং ২০২২ সালে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা প্রণয়ন করেছে।

তবে, বাস্তবায়নে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দেশের মাত্র কয়েকটি স্থানে বায়ু দূষণ মনিটরিং স্টেশন আছে যা শুধু PM 2.5 মাত্রা পরিমাপ করতে সক্ষম, দূষণ উৎস শনাক্ত করতে পারে না।

সুতরাং, বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে জোরদার পদক্ষেপ না নিলে দেশের জনগণের স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ