আল জাজিরার প্রতিবেদন

ভারত-পাকিস্তান সংঘাত: কে কতটা লাভ করল, কে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হলো?

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ১৬ ১৬:০৪:০৩
ভারত-পাকিস্তান সংঘাত: কে কতটা লাভ করল, কে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হলো?

সত্য নিউজ:

চার দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শেষে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছেছে, কিন্তু এই সংঘাতে কে বিজয়ী—তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো চিত্র নেই। উভয় দেশই নিজেদের জয়ের দাবি করলেও বিশ্লেষকেরা বলছেন, দুই পক্ষই যেমন কিছু অর্জন করেছে, তেমনি বড় রকমের ক্ষতির মুখেও পড়েছে।

সংঘাতের সূত্রপাত

২২ এপ্রিল ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ভারত ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’কে (TRF) পাকিস্তান-সমর্থিত বলে অভিযোগ করে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান অভিযোগ অস্বীকার করলেও প্রধানমন্ত্রী মোদি কঠোর জবাব দেওয়ার হুমকি দেন।

৭ মে ভারত পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর ও পাঞ্জাবের চারটি 'জঙ্গিঘাঁটি'তে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। পরবর্তী দিনগুলোতে ড্রোন হামলা, পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় উত্তেজনা চূড়ান্তে পৌঁছায়। ১০ মে পরস্পরের সামরিক ঘাঁটিতে হামলার পর যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় দুই দেশ।

আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও মধ্যস্থতা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন এবং দাবি করেন, তার মধ্যস্থতায়ই সমঝোতা হয়েছে। পাকিস্তান এ প্রচেষ্টার প্রশংসা করলেও ভারত বলছে, তারা বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে।

পাকিস্তানের অর্জন: কাশ্মীর ইস্যুকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরা

* পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, কাশ্মীর ইস্যু আবার আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে।

* যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু দেশ এবার স্পষ্টভাবে মধ্যস্থতায় এগিয়ে এসেছে, যা ভারতের দীর্ঘদিনের ‘কোনো তৃতীয় পক্ষ নয়’ নীতিকে চাপের মুখে ফেলেছে।

* কিংস কলেজের অধ্যাপক ওয়াল্টার ল্যাডউইগ বলেন, ইসলামাবাদ সংঘাতকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করে কাশ্মীর ইস্যুকে নতুন করে বিশ্বে তুলে ধরেছে।

ভারতের অর্জন: সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন

* পেহেলগামের হামলার জেরে ভারত ফের বিশ্বের মনোযোগ টেনেছে পাকিস্তানের ভূমিতে সক্রিয় ‘জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর’ দিকে।

* ভারত আন্তর্জাতিক মহলে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ নেওয়ার চাপ বাড়াতে সক্ষম হয়েছে।

* বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারতীয় কূটনৈতিক প্রচারণা পাকিস্তানকে কঠিন অবস্থানে ফেলেছে। এখন ইসলামাবাদকে প্রমাণ করতে হচ্ছে, তারা এই সহিংসতার জন্য দায়ী নয়।

সামরিক সফলতা: কে কাকে কতটা ভেদ করতে পেরেছে?

ভারতের দিক থেকে:

* ভারতের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য হলো পাকিস্তানের অভ্যন্তরে, বিশেষ করে পাঞ্জাব প্রদেশের গভীরে হামলা চালানো।

* ১৯৭১ সালের পর এই প্রথম ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এই মাত্রায় হামলা চালাতে সক্ষম হলো।

* ভারত দাবি করেছে, তাদের হামলায় ১০০-এর বেশি সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে।

পাকিস্তানের দিক থেকে:

* পাকিস্তান দাবি করেছে, তারা অন্তত দুটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে।

* ফরাসি ও মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রেও ভারতের দুটি যুদ্ধবিমান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য মিলেছে।

* তবে এই ‘সাফল্য’ ভারত স্বীকার করেনি এবং কিছু বিশ্লেষক এটিকে ‘প্রতীকী জয়’ হিসেবেই দেখছেন।

ক্ষয়ক্ষতি: দুই দেশেরই মূল্য চোকাতে হয়েছে

* ভারতের হামলায় পাকিস্তানে অন্তত ৪০ জন বেসামরিক নাগরিক ও ১১ জন সেনা নিহত হয়েছেন বলে দাবি ইসলামাবাদের।

* পাকিস্তানের পাল্টা হামলায় ভারতের চারটি সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানে বলে জানানো হয়।

* উভয় দেশই যুদ্ধবিমান, ড্রোন, ও সামরিক স্থাপনা হারিয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য সামরিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বড় ধাক্কা।

অভ্যন্তরীণ রাজনীতি: মোদি সরকারের চ্যালেঞ্জ

* মোদি সরকারের জাতীয়তাবাদী ঘাঁটিকে শক্তিশালী করেছে সংঘাতের জবাব, কিন্তু যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তে কট্টর সমর্থকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

* বিশ্লেষক সুধা রামচন্দ্রন বলেন, এই সংঘাত বিজেপির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে ভূমিকা রাখলেও তা টেকসই রাজনৈতিক সাফল্যে রূপ নিতে পারবে কি না, তা নির্ভর করছে পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর।

যুদ্ধবিরতি কি স্থায়ী হবে?

* দুই দেশের সামরিক কর্মকর্তারা ফোনে আলোচনা করে যুদ্ধবিরতি বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং সীমান্তে সেনাসংখ্যা কমানোর বিষয়েও কাজ করছে।

* স্টিমসন সেন্টারের আসফান্দিয়ার মির বলেন, যুদ্ধবিরতির পরিসর এখন পর্যন্ত স্থিতিশীল, তবে তা টিকে থাকবে কি না, তা নির্ভর করছে ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির পরবর্তী সিদ্ধান্তের ওপর।

এই সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংঘাত কাউকে স্পষ্ট বিজয় এনে দেয়নি। বরং দুই দেশই সামরিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে কিছু অর্জনের পাশাপাশি বড় ধরনের রাজনৈতিক ও মানবিক মূল্য দিয়েছে।বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণরেখার বাইরে’ সংঘাতের নতুন ধারা নির্দেশ করছে—যেখানে ভবিষ্যতের প্রতিটি সংঘর্ষ আরও ভয়াবহ হতে পারে, যদি না দুই দেশ কূটনৈতিকভাবে কার্যকর সমাধানে পৌঁছায়।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ