বিশেষ প্রতিবেদন

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ভবিষ্যৎ কী?

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২৭ ২০:২৮:৪১
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ভবিষ্যৎ কী?

টানা বারো দিন ধরে চলা ভয়াবহ সংঘর্ষের পর ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে অবশেষে কার্যকর হয়েছে যুদ্ধবিরতি। তবে এই যুদ্ধবিরতির মধ্যেও রয়েছ অনিশ্চয়তার গভীর ছায়া। প্রশ্ন উঠছে, এই সংঘাতের মূলে যে বিষয়টি ছিল—ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস—তা কি আদৌ অর্জিত হয়েছে? নাকি এই যুদ্ধ ইরানকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রের পথে?

একপক্ষের বিজয় দাবি, অন্যপক্ষের প্রত্যাখ্যান

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় আক্রমণ চালিয়ে তারা কর্মসূচি “ধ্বংস” করে দিয়েছেন। তাঁর দাবি অনুযায়ী, নাতাঞ্জ, ইসফাহান ও ফোর্দোতে মার্কিন হামলায় বড় ধরনের সাফল্য এসেছে। তবে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি একেবারেই ভিন্ন সুরে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র “উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জন করতে পারেনি।” তিনি এটিকে ইরানবিরোধী প্রচারণার অংশ হিসেবে অভিহিত করেন এবং জানান, ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাবে।

পাল্টা জবাবে ইরানের কৌশল

মার্কিন হামলার জবাবে ইরান কাতারে অবস্থিত একটি মার্কিন ঘাঁটিতে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। যদিও এতে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি, তবুও এটি ছিল প্রতীকী শক্তি প্রদর্শনের একটি চেষ্টা। এরপরই আচমকা যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন ট্রাম্প, কিন্তু এই বিরতি কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে তা নিয়ে তীব্র সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির তথ্য অজানা, প্রশ্নবিদ্ধ ‘ধ্বংস’ দাবি

পেন্টাগনের ঘনিষ্ঠ সূত্র ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন হামলায় ইরানের কিছু অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও “সম্পূর্ণ ধ্বংস” হয়েছে এমন কোনো তথ্য নিশ্চিত নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফোর্দো ও নাতাঞ্জের মতো স্থাপনাগুলি বহুস্তর বিশিষ্ট এবং গভীরভাবে ভূগর্ভস্থ, যা সহজে ধ্বংসযোগ্য নয়। ফলে ‘ধ্বংস’ দাবি অনেকটাই রাজনৈতিক প্রচারণামূলক।

ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা কি শেষ হয়ে গেছে? বিশ্লেষকরা যা বলছেন

বিশ্বরাজনীতির বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। তাদের মতে:

প্রথমত, ইরানের কেবল তিনটি স্থাপনাই নয়, বরং সারা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে একাধিক পারমাণবিক কেন্দ্র ও গবেষণা ইউনিট।

দ্বিতীয়ত, ইরান ইতোমধ্যেই পারমাণবিক প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জন করেছে, যা বোমার মতো কোনো বস্তু নয় যে একবার ভেঙে ফেললে আর ফিরে পাওয়া যাবে না।

তৃতীয়ত, ইরানের গোপন কর্মসূচি থাকতেও পারে, যা এখনো আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের বাইরে।

দ্য গার্ডিয়ানের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জুলিয়ান বার্গারের মতে, “ইরানের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে তাদের টিকে থাকা। তারা হয়তো আঘাত পেয়েছে, কিন্তু পরমাণু অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা হারায়নি।”

তিনি আরও বলেন, ইরান ইতোমধ্যে ৪০০ কেজিরও বেশি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম নিরাপদে সরিয়ে ফেলেছে, যা দিয়ে প্রায় ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি সম্ভব। উত্তর কোরিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ইরানও মনে করতে পারে, কেবল পারমাণবিক অস্ত্র থাকলেই এমন ভবিষ্যতের আক্রমণ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।

আন্তর্জাতিক চাপের নতুন অধ্যায়: চুক্তি না অস্ত্র?

এই যুদ্ধবিরতির ফলে ইরানের সামনে সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হবে—ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধে পশ্চিমা বিশ্বের চাপ মোকাবিলা করা। পরমাণু চুক্তি পুনঃআলোচনার সম্ভাবনা থাকলেও ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট শীর্ষ নেতৃত্ব এখন ‘জবাব’ চাইছে, সমঝোতা নয়।

থেমেছে যুদ্ধ, শুরু হয়েছে নতুন খেলা

ইরান-ইসরাইলের এই সাম্প্রতিক যুদ্ধ কেবল সামরিক সংঘর্ষ নয়, বরং তা ছিল একটি কৌশলগত ও পারমাণবিক শক্তি প্রদর্শনের মঞ্চ। যুদ্ধবিরতি আপাতত পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল রাখলেও, এর নিচে জ্বলছে নতুন উত্তেজনার আগুন। ইরান এখন সিদ্ধান্ত নেবে—পরমাণু কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে নিজেকে উত্তর কোরিয়ার মতো পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রে রূপান্তর করবে, নাকি আন্তর্জাতিক চাপে মাথা নত করবে।

বিশ্ববাসী আপাতত অপেক্ষায়—ইরানের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে? পরমাণু অস্ত্র, না কূটনীতি? সময়ই দেবে উত্তর।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ