ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১ মে ২০২৫, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২

পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনার মুখে ভারতের সামরিক শক্তির কঠিন পরীক্ষা: নিউইয়র্ক টাইমস

২০২৫ এপ্রিল ২৮ ১১:৫৪:১৪
পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনার মুখে ভারতের সামরিক শক্তির কঠিন পরীক্ষা: নিউইয়র্ক টাইমস

সত্য নিউজ: কাশ্মীরে সাম্প্রতিক প্রাণঘাতী হামলার পর পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন করে সামরিক উত্তেজনার মধ্যে পড়েছে ভারত। নিউইয়র্ক টাইমসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতি ভারতের বিশাল সামরিক বাহিনীর বাস্তব সক্ষমতার কঠিন পরীক্ষায় পরিণত হতে পারে। ২০১৯ সালে পাকিস্তানের হাতে ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনার পর ভারত তার সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা উপলব্ধি করে। এর পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছেন। নতুন আন্তর্জাতিক মিত্র খুঁজে অস্ত্র ক্রয়, দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উন্নয়নে জোর দিয়েছেন। তবে এই সমস্ত উদ্যোগের ফল কতটুকু এসেছে, তা বর্তমান উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে যাচাই হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

যুদ্ধের আশঙ্কা ও অভ্যন্তরীণ চাপ

কাশ্মীরের এক উপত্যকায় ২২ এপ্রিল পর্যটকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলায় ২০ জনের বেশি নিহত হয়। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে এবং প্রতিশোধের অঙ্গীকার করেছে। উত্তেজনা এতটাই বেড়েছে যে ভারত পাকিস্তানের প্রবাহিত নদীগুলোর পানিপ্রবাহ আটকে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছে, যা অতীতে সরাসরি যুদ্ধকালেও দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হামলার জন্য ভারতীয় জনমত প্রবল চাপ সৃষ্টি করছে প্রধানমন্ত্রী মোদির ওপর। তবে পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে সীমিত সংঘাতও ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। কূটনৈতিক সম্পর্কও অনেকটাই স্তব্ধ থাকায় দ্বিপক্ষীয় সংকট দ্রুত নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।

আধুনিকায়নের অগ্রগতি ও সীমাবদ্ধতা

ভারতের সামরিক বাহিনী এখনো আধুনিকায়নের মধ্যেই রয়েছে। ২০১৮ সালের এক সংসদীয় প্রতিবেদনে বলা হয়, বাহিনীর ৬৮ শতাংশ সামরিক সরঞ্জাম ‘সেকেলে’, ২৪ শতাংশ আধুনিক এবং মাত্র ৮ শতাংশ সর্বাধুনিক ছিল। ২০২৩ সালের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বাধুনিক সরঞ্জামের সংখ্যা দ্বিগুণ হলেও অর্ধেকের বেশি সরঞ্জাম এখনো পুরোনো। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এ সীমাবদ্ধতার কারণে ভারত সংযত এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক প্রতিশোধ নিতে পারে—যেমন সীমিত বিমান হামলা বা সীমান্তে বিশেষ বাহিনীর অভিযান। এতে জনমত শান্ত হবে এবং বড় ধরনের যুদ্ধের ঝুঁকি কমানো যাবে।

পাকিস্তান ও চীন—দুই ফ্রন্টের সম্ভাবনা

বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছেন, যদি ভারতের সামরিক সক্ষমতা পরীক্ষা হয়, তবে প্রতিবেশী চীন নিবিড়ভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। ২০২০ সালে লাদাখ অঞ্চলে ভারত ও চীনের সেনাদের প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর ভারত চীনকেও বড় হুমকি হিসেবে দেখছে। ফলে ভারতের সামরিক নেতৃত্বকে এখন দুই ফ্রন্টে লড়াইয়ের সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে, যা বাহিনীর উপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে।

সামরিক বিনিয়োগ ও প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি

২০১৯ সালের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনার পর থেকে ভারতীয় সামরিক বাহিনী বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। ভারত রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংগ্রহ করেছে, ফ্রান্স থেকে রাফাল যুদ্ধবিমান আমদানি করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল থেকে ড্রোন ও হেলিকপ্টার কিনেছে। পাশাপাশি দেশীয় প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তুলতে বড় বিনিয়োগও করেছে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে রাশিয়ার সরবরাহে বাধা এবং বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তার কারণে ভারত এখনো সরঞ্জাম সরবরাহে সমস্যায় ভুগছে। ২০২০ সালে চীনের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনার কারণে হাজার হাজার সেনা সীমান্তে মোতায়েন রাখতে বাধ্য হওয়ায় বাজেটের একটি বড় অংশ সামরিক উপস্থিতিতে ব্যয় হয়েছে, যা আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়াকে কিছুটা থামিয়ে দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক মিত্রতা ও প্রতিরক্ষা বাজারে পরিবর্তন

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ ভারত এখন রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকছে। বর্তমানে সব রাফাল যুদ্ধবিমান ভারতের বিমানবাহিনীতে যুক্ত করা হয়েছে এবং আরও ২৬টি রাফাল সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে। নয়াদিল্লিভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লা বলেন, রাফাল যুদ্ধবিমানের অন্তর্ভুক্তি ভারতের সামরিক সক্ষমতায় উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন এনেছে। তবে তিনি সতর্ক করেন, আধুনিক সরঞ্জাম থাকলেও তা দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহারের সক্ষমতা অর্জন না হলে সেই সরঞ্জাম যুদ্ধক্ষেত্রে কার্যকর হবে না।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বর্তমান উত্তপ্ত পরিস্থিতি ভারতের সামরিক আধুনিকায়নের বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতাকে সামনে নিয়ে আসবে। সীমিত আকারের, কৌশলগত হামলা মোদি সরকারের জন্য রাজনীতিকভাবে লাভজনক হতে পারে, তবে দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে উত্তেজনা যদি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে, তবে তা গোটা অঞ্চলের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।