মতামত

তারকা পরিচিতি: রক্ষাকবচ না কি সমাজবিমুখ অব্যাহতি?

রাফসান জানী খান

রাফসান জানী খান

সাবেক শিক্ষার্থী,গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

২০২৫ মে ২৫ ০২:০১:৫৩
তারকা পরিচিতি: রক্ষাকবচ না কি সমাজবিমুখ অব্যাহতি?

সত্য নিউজ:তারকা পরিচিতির আড়ালে দায় এড়ানোর প্রবণতা—একটি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পাঠনোবেলকে ঘিরে সাম্প্রতিক ধর্ষণ ও গৃহবন্দি করে রাখার অভিযোগ নিছক ব্যক্তিগত কোনো ঘটনা নয়—এটি বহুমাত্রিক, যেখানে মিশে আছে তারকা পরিচিতির বলয়, পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার অপপ্রয়োগ, নারী-পুরুষ সম্পর্কের অসমতা, এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করার ঐতিহাসিক প্রবণতা। এই ঘটনা প্রশ্ন তোলে—একজন জনপ্রিয় মানুষ কি সমাজ ও আইনের চোখে অপর সাধারণ নাগরিকদের মতোই বিচারযোগ্য?

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তারকাদের একটি অলিখিত ‘সামাজিক ইমিউনিটি’ থাকে। তারা জনপ্রিয়তা, মিডিয়া-সাহচর্য ও ভক্তসমাজের সহানুভূতির কারণে অনেক সময় নিজেকে নৈতিক কাঠগড়ায় দাঁড়ানো থেকে রক্ষা করতে পারেন। এমনকি গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রেও তারকা পরিচিতি আদালতের বাইরের জনমত গঠনে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

নোবেলও এই একই কৌশল অবলম্বন করেছেন। অভিযোগ উঠার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি অভিযোগকারী নারীকে 'স্ত্রী' হিসেবে চিহ্নিত করে তার কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে চেয়েছেন—যা অত্যন্ত চেনা একটি প্রতিরক্ষা পদ্ধতি। কিন্তু আদালতে বৈধ কাবিননামা বা বিয়ের প্রমাণ হাজির করতে না পারায় তার এই দাবি নৈতিক ও আইনগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।

নারীর নিরাপত্তা বনাম সমাজের সহানুভূতি বিভাজনএকজন নারী যদি নির্যাতনের শিকার হন এবং অভিযুক্ত হয় একজন পরিচিত পুরুষ, তবে সমাজ দুইভাগে বিভক্ত হয়: একদিকে থাকে ‘ভিকটিম-ব্লেমিং’ মানসিকতা, অন্যদিকে ‘তারকা-ভক্তদের’ অন্ধ সহানুভূতি। অনেকেই প্রশ্ন তোলে, "একজন জনপ্রিয় শিল্পীর কী প্রয়োজন কাউকে জোর করে কিছু করতে?" অথচ এভাবেই অপরাধীর চরিত্র বিচার করে অপরাধকে আড়াল করার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।

বিশেষ করে নারীর কণ্ঠ তখনই বিশ্বাসযোগ্য হয়, যখন তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ‘পারফেক্ট ভিকটিম’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়—অথচ বাস্তবতা অনেক জটিল। নির্যাতনের শিকার হওয়া মানে সবসময় শারীরিক ক্ষত নিয়ে হাজির হওয়া নয়; কখনো তা হয় মানসিক, সামাজিক, এমনকি ডিজিটাল নির্যাতনের মাধ্যমে। নোবেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করার অভিযোগ সেই নতুন মাত্রারই প্রতিচ্ছবি।

বিচারপ্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতা ও তারকাদের আইনি দায়এটি শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির নৈতিক বিচ্যুতি নয়, বরং পুরো একটি বিচার কাঠামো ও সামাজিক বিবেকের পরীক্ষা। যদি ন্যায়বিচার শুধু প্রভাবশালীদের এড়িয়ে চলে যায়, তবে সাধারণ নারীর জন্য প্রতিকার পাওয়ার পথ আরও কঠিন হয়ে পড়ে।

বিচারপ্রক্রিয়ার উপর আস্থা তখনই গড়ে ওঠে, যখন তা সমাজে বার্তা দেয়—আইন সবার জন্য সমান। কিন্তু যদি নোবেলের মতো তারকাদের ক্ষেত্রে অভিযোগগুলোকে ‘বক্তিগত বিষয়’, ‘স্ত্রীর ঝগড়া’ কিংবা ‘ভুল বোঝাবুঝি’ বলে চিহ্নিত করে আপাতভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়, তবে সেটা কেবল নির্যাতনের সংস্কৃতিকে স্বাভাবিক করে তোলে না, বরং ভবিষ্যতের নির্যাতকদের জন্য একটি আশ্রয়ও তৈরি করে।

তারকারাও সমাজের দায়বদ্ধ নাগরিকএকজন শিল্পী কিংবা তারকা শুধুমাত্র বিনোদনদাতা নন, তারা সমাজে নীতিগত ও আদর্শগত প্রতিচ্ছবিও তৈরি করেন। যখন একজন তারকা নিজ ক্ষমতার অপব্যবহার করেন এবং নারী নির্যাতনের মতো ঘৃণ্য অভিযোগের মুখোমুখি হন, তখন তা সামাজিক প্রতিচ্ছবিকে নষ্ট করে এবং সমাজে নারীর নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এই ধরনের ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জনপ্রিয়তা, পরিচিতি কিংবা ‘ফ্যান ফলোয়ার’ দিয়ে অপরাধ ঢেকে রাখা যায় না, এবং তারকাদেরও বিচার ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা আবশ্যক।

নোবেলের মামলাটি বাংলাদেশের নারী নিরাপত্তা, তারকা সংস্কৃতি, এবং বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে যে আলোচনা তৈরি করেছে, তা দীর্ঘমেয়াদে আরও গভীরভাবে ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। সমাজ হিসেবে আমাদের দাঁড়াতে হবে নির্যাতনের বিরুদ্ধে, পরিচিতি বা প্রতিপত্তি নয়—ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার পক্ষে।

লেখক:

সাবেক শিক্ষার্থী,গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।... বিস্তারিত