পবিত্র হজ: এক আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের ইতিহাস

জীবনয়াপন ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ১৫ ২১:৫১:৩৭
পবিত্র হজ: এক আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের ইতিহাস

সত্য নিউজইসলাম ডেস্ক: প্রতি বছর যখন লাখো মুসলমান সাদা কাপড়ে জড়ানো অবস্থায় কাবার উদ্দেশে যাত্রা করেন, তখন সেই দৃশ্য শুধু একটি ইবাদতের প্রতিফলন নয়, বরং হাজার বছরের এক ঐতিহাসিক ধারার অংশ হয়ে ওঠে। হজ ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি, যা কেবল শারীরিক কর্ম নয়, বরং আত্মিক, ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। এই ইবাদতের পেছনে আছে বিস্ময়কর সব কাহিনি—আদি মানব থেকে শুরু করে নবী ইবরাহিম (আ.) এবং সর্বশেষে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমে পূর্ণতা পাওয়া এক ঐশী সফর।

আদি সূচনা: ফেরেশতাদের নির্মিত কাবা ও আদম (আ.)-এর ইবাদত

ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, কাবা পৃথিবীর প্রথম ঘর যা মানুষের ইবাদতের জন্য নির্ধারিত হয়েছিল। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “নিঃসন্দেহে প্রথম ঘর যা মানুষের জন্য স্থাপন করা হয়েছিল, তা মক্কায়।” হাদিস ও কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী, কাবা ঘর প্রথম নির্মাণ করেছিলেন ফেরেশতারা, আল্লাহর নির্দেশে। পরে হজরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে মিলিত হওয়ার পর, আদম (আ.) আল্লাহর নিকট ইবাদতের স্থান কামনা করেন। তখন ফেরেশতারাই তাঁকে পথ দেখান এবং একটি ঘর নির্মাণের নির্দেশ দেন, যা ছিল স্বর্গীয় ঘর ‘বাইতুল মামুর’-এর প্রতিরূপ। সেখানে তিনি আল্লাহর ইবাদত শুরু করেন, আর সেটিই ছিল হজের প্রাথমিক রূপ।

ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.): হজের রূপকার

পরে নূহ (আ.)-এর সময় এক মহাপ্লাবনে কাবা ঘর বিলীন হয়ে যায়। বহু বছর পর, আল্লাহর আদেশে ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.) মক্কায় সেই পুরাতন জায়গায় কাবাঘর পুনরায় নির্মাণ করেন। আল্লাহ তাঁদের মাধ্যমে হজের নিয়মাবলি নির্ধারণ করেন। ইবরাহিম (আ.)-কে হজের রীতি শেখানো হয় ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে। তাঁরা কাবার তাওয়াফ করেন, জমজম কূপ আবিষ্কৃত হয়, হাজেরা (আ.)-এর সাফা-মারওয়ার মধ্যকার দৌড় সংযোজন হয় এবং শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ ও কোরবানির রীতি চালু হয়। এসব ঘটনাই আজকের হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে বিবেচিত হয়।

প্রাক-ইসলামি যুগে হজ: বিকৃতি ও বিভ্রান্তি

ইবরাহিম (আ.)-এর মৃত্যুর বহু বছর পর হজের প্রকৃত রূপ বিকৃত হয়ে পড়ে। আরবের কুরাইশসহ বিভিন্ন গোত্র কাবা ঘরকে কেন্দ্র করে মূর্তি পূজায় লিপ্ত হয়। হজের সময় মানুষ নগ্ন হয়ে তাওয়াফ করত এই বিশ্বাসে যে, পোশাক তাদের গুনাহর স্মারক। হজ পরিণত হয় সামাজিক উৎসবে— মদ, গান, জুয়া ও অশ্লীলতায় ভরে যায় এই পবিত্র সময়। কোরবানির মাংস কাবার সামনে ফেলে রেখে বলা হতো— এটি আল্লাহর জন্য। এভাবে আত্মশুদ্ধির ইবাদত হজ এক বিভ্রান্ত সংস্কারে পরিণত হয়।

ইসলামি যুগে নবজাগরণ: হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পুনঃপ্রবর্তন

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আবির্ভাবের পর ইসলাম আবার ইবরাহিম (আ.)-এর প্রকৃত পথকে ফিরিয়ে আনে। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পর তিনি কাবাঘরকে মূর্তিমুক্ত করেন এবং ঘোষণা দেন— হজ হবে শুধু আল্লাহর নামে। নবম হিজরিতে হজ ফরজ করা হয় এবং পরের বছর রাসুল (সা.) আবু বকর (রা.)-কে পাঠান হজ পরিচালনার জন্য। সেই হজে মুশরিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়, নগ্ন হয়ে তাওয়াফের রীতি বাতিল করা হয় এবং ইসলামী বিধি অনুযায়ী হজ আদায়ের নতুন যুগ শুরু হয়।

বিদায় হজ: একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত

দশম হিজরিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে হজে অংশগ্রহণ করেন— এটিই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র হজ এবং মুসলমানদের জন্য চিরন্তন আদর্শ। প্রায় এক লক্ষেরও বেশি সাহাবি সেই হজে অংশ নেন। আর এই হজেই তিনি প্রদান করেন ‘বিদায় হজের ভাষণ’— যা আজও মানবজাতির জন্য এক মহা-ঘোষণা। সেখানে তিনি বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ কারো রক্ত ও সম্পদ নষ্ট করতে পারবে না। সুদ চিরতরে হারাম। নারীজাতির অধিকার রক্ষা করো। তোমরা সবাই এক, কোনো আরব অ-আরবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়।” এই ভাষণে কেবল হজের শিক্ষা নয়, বরং এক সমতাভিত্তিক সমাজব্যবস্থার দিকনির্দেশনাও পাওয়া যায়।

হজ কেবল শারীরিক ও অর্থনৈতিক সামর্থ্যের ইবাদত নয়, এটি ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় একজন ঈমানদারকে আত্মত্যাগ, ভ্রাতৃত্ব ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের এক মহা-সংকল্পে নিয়ে যায়। আদম (আ.) থেকে শুরু করে ইবরাহিম (আ.) ও শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর হাতে পূর্ণতা পাওয়া এই হজ আজও কোটি কোটি মানুষের অন্তর ছুঁয়ে যায়। প্রতিটি আনুষ্ঠানিকতায় রয়েছে এক গহীন আধ্যাত্মিক অর্থ— যা হজকে শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং একটি জীবন্ত ঐতিহাসিক অধ্যায়ে পরিণত করেছে।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।... বিস্তারিত