ভাষান্তর

শতাব্দীর প্রভাবশালী দলিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র—চতুর্থ তথা শেষ পর্বের শেষাংশ

২০২৫ জুলাই ১৯ ০০:৫৭:৪৫
শতাব্দীর প্রভাবশালী দলিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র—চতুর্থ তথা শেষ পর্বের শেষাংশ

রাজনৈতিক দর্শনের ইতিহাসে এক অনন্য দলিল হলো কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। জার্মান ভাষায় এর মূল নাম “Manifesto der KommunistischenPartei”, অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার। বিখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালে এটি লিখেন, যা প্রথম প্রকাশিত হয় লন্ডনে। ১৮৪৮ সালে যখন এটি ইউরোপে প্রকাশিত হয়, তখনকার বিপ্লবাত্মক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি ছিল এক যুগান্তকারী লেখা। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-কে আজও বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলিলগুলোর অন্যতম বলে বিবেচনা করা হয়।

এই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির চারটি অধ্যায় রয়েছে। ধারাবাহিক ভাবে আমরা এর ভাবানুনাদ পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি। আজ আমরা চতুর্থ তথা শেষ পর্বের শেষাংশে কমিউনিজমের নীতিমালার ১৯ থেকে ২৫ প্রশ্নোত্তর পর্ব-এর সরল, পরিশীলিত ও ব্যাখ্যামূলক ভাষান্তর পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করছি। পাশাপাশি“জার্মানিতে কমিউনিস্ট পার্টির দাবিসমূহ” (১৮৪৮) ওপ্যারিস কমিউন ও মে ১৮৭১-এর ভাষণ (The Civil War in France) পাঠকদের কাছে সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করেছি।আশাকরি পাঠকরা সহজভাবে এর মূল ভাবনা ও তাৎপর্য বুঝতে পারবেন।

১৯। এই বিপ্লব কি একটি মাত্র দেশে সংঘটিত হওয়া সম্ভব?

না, সম্ভব নয়। বৃহৎ শিল্প এমন একটি বিশ্ববাজার সৃষ্টি করেছে, যা পৃথিবীর সমস্ত জাতিকেবিশেষত সভ্য জাতিগুলোকেএমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যুক্ত করেছে যে, একটির ভাগ্য অন্যটির থেকে আলাদা হয়ে থাকতে পারে না।

বৃহৎ শিল্প একই সঙ্গে সভ্য দেশগুলোর সামাজিক বিকাশকে এতটাই সমন্বিত করেছে যে, প্রতিটি দেশেই বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত শ্রেণি সমাজের নির্ধারক শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে এবং এই দুই শ্রেণির মধ্যকার সংগ্রামই হয়ে উঠেছে যুগের প্রধান সংগ্রাম।

এর ফলাফল হলো, কমিউনিস্ট বিপ্লব কোনো একটি দেশে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, বরং এটি সমস্ত সভ্য দেশে একইসঙ্গে সংঘটিত হতে হবেঅন্তত ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স এবং জার্মানিতে।এই বিপ্লব প্রতিটি দেশে বিভিন্ন গতিতে অগ্রসর হবে, নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট দেশের শিল্পের বিকাশ, সম্পদের পরিমাণ এবং উৎপাদনশীল শক্তির পরিসরের ওপর। এই বিপ্লব জার্মানিতে সবচেয়ে ধীরে ও সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হবে, আর ইংল্যান্ডে সবচেয়ে দ্রুত ও সবচেয়ে কম বাধার মধ্যে দিয়ে সফল হবে।

এই বিপ্লব পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ওপরও শক্তিশালী প্রভাব ফেলবে এবং তাদের এতদিনের অনুসৃত বিকাশপথকে পুরোপুরি পাল্টে দেবে, সেইসঙ্গে সেই বিকাশের গতি আরও বহুগুণে বাড়াবে।এটি একটি সর্বজনীন বিপ্লব হবে এবং এর প্রভাবও হবে সর্বজনীন।

২০। ব্যক্তিগত সম্পত্তির চূড়ান্ত বিলুপ্তির ফলে কী কী পরিণতি হবে?

সমাজ তখন সমস্ত উৎপাদনশক্তি ও বাণিজ্য মাধ্যমঅর্থাৎ পণ্য বিনিময় ও বণ্টনের উপায়ব্যক্তিগত পুঁজিপতিদের হাত থেকে নিজেদের হাতে তুলে নেবে এবং সেগুলো পরিচালনা করবে একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনার আলোকে, সম্পদের প্রাপ্যতা ও সমগ্র সমাজের প্রয়োজন অনুসারে।

এইভাবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পরিবর্তনটি ঘটবে তা হলোবর্তমানে বৃহৎ শিল্পের পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে সমস্ত অকল্যাণকর পরিণতি রয়েছে, তা সম্পূর্ণরূপে দূর হয়ে যাবে।

আর কোনো বাণিজ্যিক মন্দা (crisis) থাকবে না; বর্তমানে যে ব্যাপক উৎপাদন সমাজব্যবস্থার চোখে ‘অতিরিক্ত উৎপাদন’ হিসেবে দুঃখ-কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, ভবিষ্যতের সমাজে সেটাই পরিণত হবে একটি অপর্যাপ্ত পরিমাণে, যা আরও সম্প্রসারণের প্রয়োজন হবে।

এভাবে, ‘অতিরিক্ত উৎপাদন’ তখন আর দুঃখ-কষ্টের কারণ হবে না, বরং তা সমাজের মৌলিক প্রয়োজনের বাইরেও সব সদস্যের চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে; এটি সৃষ্টি করবে নতুন চাহিদা এবং সেই চাহিদা পূরণের উপায়ও। এটি তখন নতুন অগ্রগতির উৎস ও প্রেরণা হয়ে উঠবেএমন অগ্রগতি, যা অতীতের মতো সমাজকে বিশৃঙ্খলায় ফেলবে না।

ব্যক্তিগত মালিকানা থেকে মুক্ত বৃহৎ শিল্প তখন এমন মাত্রায় বিস্তার লাভ করবে যে, বর্তমান সময়ের শিল্পকারখানা তার তুলনায় নগণ্য বলে মনে হবে, যেমনভাবে অতীতের হস্তশিল্প বর্তমানের শিল্পের তুলনায় নগণ্য।

এই শিল্পোন্নয়ন সমাজকে এমন বিপুল পরিমাণ পণ্য সরবরাহ করতে পারবে, যা প্রত্যেক সদস্যের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হবে।

এটাই কৃষিক্ষেত্রেও ঘটবে, যা ব্যক্তিগত মালিকানার চাপে আটকে রয়েছে এবং জমির খণ্ডায়ণের (fragmentation) ফলে দমবন্ধ হয়ে আছে। সেখানে বিদ্যমান প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে এক বিশাল অগ্রগতি সম্ভব হবে, যা সমাজকে সমস্ত প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য সরবরাহ করতে পারবে।এভাবে, সমাজের প্রতিটি সদস্যের চাহিদা পূরণের মতো পণ্যের প্রাচুর্য সৃষ্টি হবে।

সমাজের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ শ্রেণীগুলোর বিভাজন তখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। বরং এটি শুধু অপ্রয়োজনীয়ই নয়, বরং নতুন সমাজব্যবস্থায় তা সম্পূর্ণরূপে অসহনীয় হবে।শ্রেণী ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে শ্রম বিভাজন থেকে, এবং যে ধরনের শ্রম বিভাজন আমরা আজ পর্যন্ত দেখেছি, তা সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যাবে। কারণ, শুধুমাত্র যান্ত্রিক বা রাসায়নিক প্রক্রিয়া যথেষ্ট নয়শিল্প ও কৃষিজ উৎপাদনের উন্নয়ন ঘটাতে হলে মানুষের ক্ষমতা ও দক্ষতাও সমানভাবে বিকশিত হতে হবে।

যেমনভাবে কৃষক ও কারিগররা গত শতাব্দীতে বৃহৎ শিল্পের অংশে পরিণত হয়ে সম্পূর্ণভাবে তাদের জীবনধারা পরিবর্তন করেছে এবং একদম নতুন মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে, তেমনি, যখন সমাজ-সমগ্রের হাতে উৎপাদনের উপর নিয়ন্ত্রণ চলে আসবে এবং তার ফলে যে নতুন উন্নয়ন ঘটবে, তা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের মানুষের প্রয়োজন তৈরি করবে।মানুষ তখন আর আজকের মতো একটি নির্দিষ্ট উৎপাদনশাখার দাস হয়ে থাকবে না, বরং তারা আর শোষিত হবে না, নিজেদের একটি ক্ষমতা বিকাশের বিনিময়ে অন্য সব ক্ষমতা উপেক্ষিত হবে না। তারা আর কোনো একটি পেশা বা কোনো একটি শাখার উপশাখা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে না। এমনকি আজকের শিল্পও এমন এক ধরনের একপাক্ষিক মানুষের আর প্রয়োজন অনুভব করছে না।

সমগ্র সমাজের হাতে নিয়ন্ত্রিত শিল্প এবং পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত উৎপাদনব্যবস্থা কেবল তখনই কার্যকর হতে পারে যখন সামগ্রিকভাবে বিকশিত দক্ষতার অধিকারী সর্বাঙ্গীণ মানুষ থাকবে, যারা উৎপাদন ব্যবস্থাকে একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া হিসেবে বুঝতে ও পরিচালনা করতে পারবে।এইভাবে, যে শ্রম বিভাজন মানুষকে কৃষক, মুচি, শ্রমিক বা স্টক মার্কেটের দালালে পরিণত করেছে, তা ইতোমধ্যে যন্ত্রায়নের মাধ্যমে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে এবং অচিরেই সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

শিক্ষাব্যবস্থা তখন মানুষকে দ্রুত সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে পরিচিত করে তুলবে এবং সমাজের প্রয়োজন কিংবা ব্যক্তিগত আগ্রহ অনুসারে এক শাখা থেকে অন্য শাখায় কাজ পরিবর্তনের সুযোগ দেবে। এইভাবে, বর্তমানের একপাক্ষিকতা থেকে মানুষ মুক্ত হবে। এবং কমিউনিস্ট সমাজ তাদের সমগ্ররূপে বিকশিত ক্ষমতাগুলোকে পূর্ণভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ দেবে। আর একবার তা সম্ভব হলে, শ্রেণী ব্যবস্থার বিলুপ্তি অনিবার্য। অর্থাৎ, কমিউনিজমের ভিত্তিতে সংগঠিত সমাজব্যবস্থার সাথে শ্রেণীবিভাজন কখনোই মানানসই নয়, আবার সেই সমাজব্যবস্থার গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই শ্রেণীবিভেদ বিলুপ্তির সমস্ত উপাদান প্রস্তুত হবে।

সমাজের সব সদস্যের যৌথ প্রচেষ্টা দ্বারা উৎপাদনশক্তির পরিকল্পিত ব্যবহার, উৎপাদনের এমন মাত্রায় সম্প্রসারণ যা সকলের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়, কিছু মানুষের প্রয়োজন মেটাতে অন্যদের প্রয়োজন উপেক্ষার সংস্কৃতির বিলুপ্তি, শ্রেণী ও তাদের সংঘাতের পূর্ণ অবসান, এবং সমাজের প্রত্যেক সদস্যের ক্ষমতার সর্বাঙ্গীণ বিকাশএই সবই ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তির প্রধান প্রধান পরিণতি।

২১। কমিউনিস্ট সমাজের পরিবার ব্যবস্থা ও নারীর অবস্থান কীভাবে পরিবর্তিত হবে?

কমিউনিস্ট সমাজ লিঙ্গসম্পর্ককে একটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়ে রূপান্তর করবে, যা কেবল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যকার বিষয় থাকবেসমাজ সেখানে হস্তক্ষেপ করবে না।এই রূপান্তর সম্ভব হবে কারণ এই সমাজ ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তি ঘটাবে এবং সন্তানদের জাতীয় খরচে, জাতীয় প্রতিষ্ঠানে গড়ে তুলবে।ফলে ঐতিহ্যবাহী বিবাহ ব্যবস্থার দুইটি ভিত্তিনারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব এবং সন্তানের উপর পিতামাতার নির্ভরতাএই উভয়ই লুপ্ত হবে।এখানেই উত্তর মেলে সেই তথাকথিত "নারী সমাজভুক্তির" বিরুদ্ধে তথাকথিত উচ্চ নৈতিকতা সম্পন্ন ধনিক শ্রেণির চিৎকারের।

আসলে নারী সমাজভুক্তি বা নারী ভাগাভাগির সংস্কৃতি পুরোপুরি ধনিক সমাজের অবদান, যার চূড়ান্ত রূপ আজকের বেশ্যাবৃত্তি।আর বেশ্যাবৃত্তি ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে এবং এই ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তির সাথেই এর পতন ঘটে। অতএব, কমিউনিস্ট সমাজ নারী সমাজভুক্তিকে প্রবর্তন করবে না, বরং তা বিলুপ্ত করে দেবে।

২২। বিদ্যমান জাতীয়তাগুলোর প্রতি কমিউনিজমের মনোভাব কী?

কমিউনিজমে ঐক্যবদ্ধভাবে যে জাতিগুলো একত্রিত হবে, তারা পারস্পরিক সংমিশ্রণে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে এবং নিজেদের জাতীয় সত্তা হারাবে, যেমনভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তির মাধ্যমে শ্রেণী ও বর্ণবিভাজন বিলুপ্ত হবে।

২৩। ধর্ম নিয়ে কমিউনিজমের দৃষ্টিভঙ্গি কী?

সব ধর্মই বিভিন্ন জাতি বা গোষ্ঠীর ঐতিহাসিক বিকাশপর্বের প্রতিফলন। কিন্তু কমিউনিজম এমন একটি ঐতিহাসিক বিকাশপর্যায়, যা সব বিদ্যমান ধর্মকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলে এবং তা ধীরে ধীরে নির্মূল করে দেয়।

২৪। সমাজতন্ত্রীদের থেকে কমিউনিস্টদের পার্থক্য কী?

সমাজতন্ত্রী নামে পরিচিতরা মূলত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত:

১। প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রী:

এই শ্রেণিটি হল সেইসব সমাজতন্ত্রী যারা একটি পুরনো সামন্তবাদী এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রতি অনুগত, যা বৃহৎ শিল্প এবং বিশ্ববাণিজ্যের মাধ্যমে প্রতিদিনই ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে, এবং যা ধনিক সমাজ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে।এই শ্রেণির লোকেরা বর্তমান সমাজের দুর্দশা দেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, আগের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ফিরে যেতে হবে, কারণ তা ছিল এসব সমস্যামুক্ত। তাদের সব প্রস্তাবের উদ্দেশ্য এই প্রতিক্রিয়াশীল লক্ষ্যই।

কমিউনিস্টরা এই শ্রেণির সমাজতন্ত্রীদের বিরোধিতা করে তিনটি কারণে:

(i) তারা এমন কিছুর জন্য সংগ্রাম করে যা একেবারেই অসম্ভব।

(ii) তারা এমন একটি সমাজ গঠন করতে চায়, যেখানে শাসন করবে জমিদার, গিল্ডমাস্টার, ক্ষুদ্র উৎপাদক, রাজা, পুরোহিত, এবং সৈনিকদের নেতৃত্বাধীন পুরাতন ব্যবস্থাযা আজকের সমাজের মতোই বিপদজনক এবং শ্রমজীবী শ্রেণির মুক্তির কোনো পথও সেখানে নেই।

(iii) এবং অবশেষে, যখনই শ্রমিক শ্রেণি বিদ্রোহী ও কমিউনিস্ট হয়ে ওঠে, তখন এই প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রীরা মুখোশ খুলে ফেলেন এবং ধনিক শ্রেণির পাশে গিয়ে দাঁড়ান।

ধনিক সমাজতন্ত্রী:

এইশ্রেণিটি গঠিত হয়েছে বর্তমান ধনিক সমাজেরই সমর্থকদের দ্বারা, যারা সমাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন।তাদের উদ্দেশ্য হল: এই ধনিক সমাজকে টিকিয়ে রাখা, কিন্তু তার ভেতরের সমস্যাগুলোকে কোনওভাবে মেরামত করা।এজন্য কেউ কেউ সামান্য দান-অনুদানের প্রস্তাব দেন, আবার কেউ কেউ জাঁকজমকপূর্ণ সমাজ সংস্কার পরিকল্পনা পেশ করেনযার লক্ষ্য সমাজকে নতুন রূপ দেওয়া নয়, বরং পুরনো ধনিক সমাজকেই টিকিয়ে রাখা।

কমিউনিস্টদের অবশ্যই এই ধনিক সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করতে হবে, কারণ তারা তাদের আসল শত্রুদের সেবায় নিয়োজিত এবং সেই সমাজকেই রক্ষা করে, যেটিকে কমিউনিস্টরা ধ্বংস করতে চায়।

গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী:

তৃতীয় শ্রেণিটি হল গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী, যারা কমিউনিস্টদের মতোই অনেক প্রস্তাব সমর্থন করেন (যেমন প্রশ্ন ১৮-তে বর্ণিত হয়েছে)।কিন্তু এই প্রস্তাবগুলোকে তারা মনে করেনচলমান সমাজব্যবস্থার সমস্যাগুলো দূর করতে যথেষ্ট, অথচ এগুলোকে কমিউনিজমে রূপান্তরের ধাপ হিসেবে বিবেচনা করেন না।এই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ হলেন শ্রমজীবী মানুষ, যারা নিজেদের মুক্তির পথ এখনও স্পষ্টভাবে বুঝে উঠতে পারেননি।

আবার কেউ কেউ হলেন ক্ষুদ্র ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধি, যারা গণতন্ত্র অর্জনের আগে পর্যন্ত শ্রমজীবী শ্রেণির সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে মিল রাখেন।এই কারণে, কমিউনিস্টদের উচিত হবে যেকোনও কার্যক্রমে এই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা, যতক্ষণ না তারা ধনিক সমাজের সেবায় নিয়োজিত হয়ে কমিউনিস্টদের আক্রমণ করেন।এই ধরণের কৌশলগত সহযোগিতা কোনওভাবে দর্শনীয় পার্থক্যের আলোচনা এবং সমালোচনার বাধা নয়।

২৫। সমসাময়িক রাজনৈতিক দল গুলোর প্রতি কমিউনিস্টদের মনোভাব কী?

এই মনোভাব দেশ ভেদে ভিন্ন। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, এবং বেলজিয়ামে, যেখানে ধনিক শ্রেণি শাসন করছে, সেখানে কমিউনিস্টদের এখনো বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে কিছু সাধারণ স্বার্থ আছে—বিশেষত যখন তারা শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ তুলে ধরে এবং কমিউনিস্টদের লক্ষ্যের কাছাকাছি আসে। উদাহরণস্বরূপ, ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণির চার্টিস্টরা কমিউনিস্টদের অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ, যেকোনও তথাকথিত গণতান্ত্রিক ক্ষুদ্র ধনিক শ্রেণি বা তথাকথিত র‍্যাডিক্যালদের তুলনায়।

আমেরিকায়, যেখানে ইতিমধ্যেই গণতান্ত্রিক সংবিধান চালু আছে, সেখানে কমিউনিস্টদের উচিত এমন একটি দলের সঙ্গে একযোগে কাজ করা, যারা এই সংবিধানকে ধনিক শ্রেণির বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চায়—অর্থাৎ এগ্রেরিয়ান ন্যাশনাল রিফর্মারদের সঙ্গে। সুইজারল্যান্ডে, যদিও র‍্যাডিক্যালরা একটি মিশ্র দল, তারপরও কমিউনিস্টদের একমাত্র বাস্তব অংশীদার তারাই, বিশেষত ভডুয়া ও জেনেভার র‍্যাডিক্যালরা সবচেয়ে অগ্রসর।

জার্মানিতে, এখনো ধনিক শ্রেণি এবং একনায়ক রাজতন্ত্রের মধ্যকার মূল লড়াই চলছে। যেহেতু ধনিক শ্রেণিকে ক্ষমতাচ্যুত না করা পর্যন্ত কমিউনিস্টদের প্রকৃত সংগ্রাম শুরু হতে পারে না, তাই তাদের উচিত প্রথমে ধনিক শ্রেণিকে ক্ষমতায় আনার সহায়তা করা, যেন পরবর্তী ধাপে তাদেরকে উৎখাত করা যায়। এই ক্ষেত্রে, কমিউনিস্টদের উচিত র‍্যাডিক্যাল লিবারেল পার্টির প্রতি সমর্থন জানানো, কিন্তু সেই সাথে ধনিক শ্রেণির মায়াকাজে প্রতারিত না হওয়া এবং তাদের প্রতিশ্রুত সুবিধা থেকে সতর্ক থাকা।

কমিউনিস্টরা জানে, ধনিক শ্রেণির বিজয়ের একমাত্র লাভ:

(i) শ্রমজীবী শ্রেণিকে সংগঠিত করে একটি যুদ্ধপ্রস্তুত শ্রেণিতে রূপান্তরিত করার সুযোগ;

(ii) ধনিক একনায়কত্বের পতনের দিন থেকেই, শ্রমিক শ্রেণি এবং ধনিক শ্রেণির মধ্যে সত্যিকারের সংগ্রাম শুরু হবে।

এই সময় থেকেই, কমিউনিস্টদের নীতি হবে সেই একই যা আজ কার্যকর দেশগুলোতে গ্রহণ করা হয়েছে, যেখানে ধনিক শ্রেণি ইতিমধ্যেই ক্ষমতায় আছে।

“জার্মানিতে কমিউনিস্ট পার্টির দাবিসমূহ” (১৮৪৮):

“সকল দেশের শ্রমিকরা, এক হও!”—এই ঐতিহাসিক আহ্বানের মাধ্যমে কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালের মার্চ মাসে ইউরোপজুড়ে চলমান বিপ্লবের প্রেক্ষিতে একটি ১৭-দফা রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রস্তাব করেন, যা কমিউনিস্ট লীগের আনুষ্ঠানিক ইশতেহার হিসেবে বিবেচিত। এতে তাঁরা জার্মানিকে একটি একক ও অবিভাজ্য প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরের আহ্বান জানান এবং সার্বজনীন ভোটাধিকার, কৃষকদের উপর আরোপিত সামন্তীয় খাজনা ও কর বাতিল, প্রিন্সলি ও জমিদার শ্রেণির ভূসম্পত্তি, খনি ও ব্যাংক রাষ্ট্রীয়করণের দাবি তোলেন। তারা শ্রমজীবী জনগণের জন্য বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা, সমান বেতনভুক্ত নাগরিক সেবা, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা এবং ‘জাতীয় কর্মশালা’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার প্রস্তাব দেন। এই দাবিসমূহ আদর্শবাদী কল্পনা নয়, বরং সামাজিক বাস্তবতায় ভিত্তি করে গঠিত এমন এক রূপান্তরপর্বের রূপরেখা, যা কৃষক ও শ্রমজীবী শ্রেণির উপর আরোপিত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষণের কাঠামো ভেঙে নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে একটি সচেতন পদক্ষেপ।

প্যারিস কমিউন ও মে ১৮৭১-এর ভাষণ (The Civil War in France):

১৮৭১ সালের প্যারিস কমিউন ছিল আধুনিক ইতিহাসে প্রথম শ্রমিকশ্রেণির শাসনব্যবস্থাযা নিয়ে কার্ল মার্কস তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংঘকে উদ্দেশ করে বলেন, কমিউন ছিল একটি নতুন সমাজগঠনের সাহসী সূচনা, যা বিদ্যমান পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের পতন এবং ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের বিপর্যয়ের পর প্যারিসের শ্রমজীবীরা রাষ্ট্রক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেয়। তারা পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিত্বের পরিবর্তে সরাসরি ও জবাবদিহিমূলক প্রতিনিধিত্ব প্রবর্তন করেযেখানে সব জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত, স্বল্পমেয়াদি এবং অপসারণযোগ্য; প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও বিচারপতিরাও এই নীতির আওতায় পড়ে। স্থায়ী সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করে সশস্ত্র জনগণকে প্রতিরক্ষা বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পৃথক করা হয় রাষ্ট্র থেকে, শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধর্মনিরপেক্ষ ও সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

মার্কস জোর দিয়ে বলেন, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রকে দখল করে শ্রমিকশ্রেণির মুক্তি সম্ভব নয়; বরং এটি গুঁড়িয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণ করতে হয়যাপ্যারিস কমিউন বাস্তবায়ন করে দেখায়। কমিউন কেবল রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ছিল না, বরং এটি ছিল শ্রমিকশ্রেণির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে সংগঠিত এক সংগ্রাম। কমিউন ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ করতে চায়নি; বরং পুঁজিপতিদের একচেটিয়া মালিকানাভিত্তিক শ্রেণিস্বার্থকে ভেঙে, উৎপাদনের উপকরণকে সমবায় ও সমবেত শ্রমের ভিত্তিতে রূপান্তর করতে চেয়েছিল। এটি ছিল “অভিজাতদের জন্য নয়, উৎপাদকদের দ্বারা ও উৎপাদকদের জন্য পরিচালিত সরকার”।

যদিও কমিউন সামরিকভাবে পরাজিত হয়, তার অস্তিত্ব প্রমাণ করে দেয় যে শ্রমিকশ্রেণিকেবল শোষণের শিকার নয়, বরং তারা রাষ্ট্র ও সমাজকে পুনর্গঠনের ক্ষমতাও রাখে। এটি দেখিয়ে দেয় যে প্রকৃত গণতন্ত্র কেবল পার্লামেন্টের ভেতরে নয়, বরং সরাসরি জনগণের হাতে শাসন ও সম্পদের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্যেই নিহিত। এই অভিজ্ঞতা কেবল ফ্রান্সের জন্য নয়, বিশ্বের সকল নিপীড়িত শ্রমজীবী মানুষের জন্য এক প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে। কমিউন ছিল শ্রমিক শ্রেণির ঐতিহাসিক অভিযানপুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত সংকট উন্মোচন করে একটি নতুন সমাজ নির্মাণের পথে সর্বপ্রথম প্রত্যয়ী পদক্ষেপ।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ