প্রথম বিশ্বযুদ্ধ: এক বৈশ্বিক রক্তপাতের ইতিহাস ও এর উত্তরাধিকার

বিশ্ব ইতিহাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪–১৯১৮) একটি যুগান্তকারী অধ্যায়, যা শুধু ইউরোপই নয়, গোটা মানবসভ্যতার ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলেছে। সাম্রাজ্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, সামরিক জোটপ্রথা এবং কূটনৈতিক ব্যর্থতার জটিল সমন্বয়ে এক অভূতপূর্ব বৈশ্বিক সংঘাতের সূচনা ঘটে, যা পৃথিবীর চারটি মহাদেশজুড়ে যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে আনে। প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে চলা এই যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর বহু পুরনো সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, নতুন রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক আদর্শের উত্থান হয়, এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা হয়। এই যুদ্ধ আধুনিক পরাশক্তির উদ্ভব, নারীর সমাজে নতুন ভূমিকা এবং পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধের বীজ বপনের ক্ষেত্রেও গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এই প্রতিবেদনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পেছনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, যুদ্ধের বিবরণ ও কৌশল, প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ, যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্ব ব্যবস্থার রূপরেখা এবং শান্তিচুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি আলোচনা করা হয়েছে। পাঠককে যুদ্ধের একটি সমন্বিত ও বিশ্লেষণধর্মী চিত্র উপস্থাপন করাই এ প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য।
যুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পেছনে একাধিক রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক কারণ কাজ করেছিল। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে ইউরোপে পরস্পরবিরোধী সামরিক জোট গঠিত হয়েছিল – একটি পক্ষ ছিল ট্রিপল এলায়েন্স (জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও ইতালি) এবং বিপরীতে ছিল ট্রিপল আন্তান্তে (ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া)। ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সাম্রাজ্যবাদ, ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সমরবাদ (সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা), তীব্র জাতীয়তাবাদ, এবং বিপক্ষ জোটগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা মিলিয়ে ইউরোপে এক উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষ করে, জার্মান সাম্রাজ্যের উত্থান ও অটোমান সাম্রাজ্যের অধঃপতন ইউরোপের পুরনো ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট করেছিল। বলকান অঞ্চলে সার্বিয়া ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির মধ্যে জাতিগত ও রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছে। এই পরিস্থিতিতে ১৯১৪ সালের ২৮শে জুন বসনিয়ার সারায়েভো শহরে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সিংহাসনের উত্তরাধিকারী আর্চডিউক ফ্রানৎস ফার্ডিনান্ডকে গাভরিলো প্রিন্সিপ নামক এক যুব সার্বীয় জাতীয়তাবাদী হত্যা করেন। এই হত্যা-কাণ্ড প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তাৎক্ষণিক শুভেচক (trigger) হিসেবে কাজ করে। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এই ঘটনার জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং কঠোর শর্তসহ সার্বিয়াকে চূড়ান্ত নোটিশ পাঠায়। সার্বিয়া কিছু শর্ত মেনে নিলেও সব পূরণ করতে অপারগ হয়। ফলশ্রুতিতে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি যুদ্ধের পথ বেছে নেয়। অবশেষে ১৯১৪ সালের ২৮শে জুলাই অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ ঘটনার জেরে জোটবদ্ধ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দ্রুত অন্যান্য শক্তিগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। রাশিয়া সার্বিয়ার পক্ষসমর্থনে সামরিক মোবিলাইজেশন শুরু করলে ১লা আগস্ট জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং পরবর্তীতে ফ্রান্সের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করে। জার্মান সেনাবাহিনী ফ্রান্স আক্রমণের উদ্দেশ্যে নিরপেক্ষ বেলজিয়ামে আগ্রাসন চালালে ব্রিটেন ৪ঠা আগস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। অটোমান তুরস্ক নবেম্বরে জার্মান পক্ষ (কেন্দ্রীয় শক্তি) নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেয়। এভাবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ইউরোপের প্রধান শক্তিগুলো দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং বিশ্বজুড়ে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে।
চিত্র: ১৯১৪ সালে ইউরোপের সামরিক জোটসমূহ – প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ইউরোপের শক্তিগুলোর দুই বিপরীত জোটের মানচিত্র। সবুজ রঙে মিত্রশক্তি (ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও তাদের মিত্ররা) এবং কমলা/বাদামী রঙে কেন্দ্রীয় শক্তি (জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, পরবর্তীতে অটোমান সাম্রাজ্য) দেখানো হয়েছে। যুগোস্লাভ জাতীয়তাবাদের কেন্দ্র বলকান অঞ্চল ছিল অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে সার্বিয়া ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির দ্বন্দ্ব ইউরোপের বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ প্রজ্বলিত করে।
যুদ্ধের বিবরণ: প্রধান ঘটনা ও কৌশল
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ২৮ জুলাই ১৯১৪ তারিখে এবং চলতে থাকে প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে ১১ নভেম্বর ১৯১৮ পর্যন্ত। যুদ্ধে মূলত দুটি জোট মুখোমুখি ছিল: মিত্রশক্তি (এন্টেন্ট) এবং কেন্দ্রীয় শক্তি। কেন্দ্রীয় শক্তির প্রধান দেশগুলো ছিল জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, অটোমান সাম্রাজ্য (তুরস্ক) ও প্রথমে ইতালি; মিত্রশক্তিতে ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, সার্বিয়া ও তাদের উপনিবেশসমূহ, পরবর্তীতে ইতালি (১৯১৫ সালে পক্ষ পরিবর্তন করে) ও ১৯১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো কিছু দেশ। ইউরোপ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কিছু অঞ্চলেও যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, কারণ উপনিবেশ এবং মিত্রদেশগুলোও সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল। জার্মানির সামরিক কৌশল ছিল দ্রুত ফ্রান্সকে পরাজিত করে পরে পূর্বদিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা (শ্লিফেন পরিকল্পনা)। ১৯১৪ সালের আগস্টে জার্মান বাহিনী বেলজিয়াম হয়ে ফ্রান্স অভিমুখে দ্রুত অগ্রসর হয়। শুরুতেই জার্মানরা কিছু সফলতা পেলেও সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্যারিসের নিকটস্থ মার্ন নদীর প্রথম যুদ্ধে মিত্রশক্তি তাদের অগ্রাভিযান থামিয়ে দেয়। ফলে পশ্চিম রণক্ষেত্রে যুদ্ধটি স্থবির হয়ে পড়ে এবং দুপক্ষই পরিখা খুঁড়ে অবস্থান যুদ্ধ (ট্রেঞ্চ ওয়ারফেয়ার) শুরু করে। ১৯১৪ সালের শেষ নাগাদ উত্তর সাগর থেকে সুইজারল্যান্ড সীমান্ত পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে পরিখা-নির্ভর এক স্থবির যুদ্ধরেখা সৃষ্টি হয়েছিল। বিপরীতে পূর্ব রণাঙ্গনে (রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে) যুদ্ধ গতিশীল ছিল; জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ট্যানেনবার্গ ও মশুরিয়ান লেকস প্রভৃতি যুদ্ধে জয় পেলেও রাশিয়ার বিশাল জনবল ও এলাকা জয়ের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এবং কেউই দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারেনি।
চিত্র: পশ্চিম ফ্রন্টে ব্রিটিশ সেনাদের ট্রেঞ্চ (ফ্রান্স, জুলাই ১৯১৬) – পশ্চিম রণক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ ও মেশিনগানের মুখে সৈন্যরা মাটির নিচে পরিখা বা ট্রেঞ্চে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ করত। এই পরিখাযুদ্ধ পদ্ধতিতে দুই পক্ষ মাসের পর মাস স্থানে স্থানে স্থিতিশীল থেকে অবস্থান ধরে রাখে, ফলে যুদ্ধ অচলাবস্থায় পড়ে। ট্রেঞ্চগুলো ছিল কাদামাটিতে ভরা, অস্বাস্থ্যকর এবং বিপজ্জনক; সেখানে রোগ-বিস্তার, ইঁদুরের উপদ্রব, এবং শেল শক নামে পরিচিত তীব্র মানসিক আঘাতের ঘটনা ঘটতো। দীর্ঘস্থায়ী পরিখাযুদ্ধের কারণে উভয় পক্ষই বিপুল হতাহত হওয়া সত্ত্বেও খুব সামান্য ভূখণ্ড লাভ করত।
১৯১৫ ও ১৯১৬ সালে যুদ্ধের ভয়াবহতা আরও বৃদ্ধি পায়। উভয় পক্ষ নতুন নতুন অস্ত্র ও কৌশল অবলম্বন করতে থাকে। বিমান প্রথমবারের মতো ব্যাপকভাবে নজরদারি ও বোমাবর্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়, ট্যাংক প্রয়োগ শুরু হয় ১৯১৬ সালে (ব্রিটিশ সেনাবাহিনী সোম্মের যুদ্ধে প্রথম ট্যাংক ব্যবহার করে), এবং দুই পক্ষই মারাত্মক রাসায়নিক অস্ত্র (বিশেষ করে ক্লোরিন ও মাস্টার্ড গ্যাস) ব্যবহার করে যার ফলে ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয়। ১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারি-ডিসেম্বরে ভারডাঁর যুদ্ধ এবং জুলাই-নভেম্বরে সোম্মের যুদ্ধ – এই দুটি পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টের যুদ্ধে অমানবিক রক্তক্ষয় হয়, কিন্তু তবু কোনো পক্ষই দৃশ্যমান সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। ভারডাঁতে প্রায় ৭ লক্ষের বেশি ফরাসি-জার্মান সেনা হতাহত হয় এবং সোম্মে যুদ্ধে প্রায় ১০ লক্ষ সৈন্য হতাহত হয়েছিল। এসব যুদ্ধ অবস্থানগত স্থবিরতা ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছিল। সমুদ্রপথে, ব্রিটিশ রয়্যাল নৌবাহিনী ও জার্মান নৌবাহিনীর মধ্যে উত্তাল প্রতিযোগিতা চলে।
১৯১৬ সালের মে মাসে উত্তর সাগরে যুটল্যান্ডের নৌযুদ্ধ সংঘটিত হয় – এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বৃহত্তম নৌসমর। যদিও এই যুদ্ধে কোনো পক্ষই নির্ণায়ক জয় পায়নি, ব্রিটিশ নৌবাহিনী সমুদ্রে তার আধিপত্য বজায় রাখে। অন্যদিকে, জার্মানি ব্রিটেনকে দুর্বল করতে ইউ-বোট সাবমেরিন দিয়ে আটলান্টিকে মিত্রদের জাহাজডুবি শুরু করে। এই অসীম সাবমেরিন যুদ্ধনীতি (unrestricted submarine warfare) ব্রিটেনের জন্য হুমকি তৈরি করলেও পরবর্তীতে জার্মানির বড় ভুল হিসেবে পরিগণিত হয়, কারণ এর ফলে নিরপেক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাত তৈরি হয়। ১৯১৭ সালে জার্মানি যখন আবার নিরঙ্কুশভাবে সাবমেরিন দ্বারা বাণিজ্যিক জাহাজ ডুবানো শুরু করে, তখন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হয়ে মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধে প্রবেশ করে (এপ্রিলে, ১৯১৭)। যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল মানববল ও শিল্পসম্পদ মিত্রশক্তির পক্ষ শক্তির ভারসাম্য বাড়িয়ে দেয়। একই বছরে (১৯১৭) রাশিয়ার ভেতরে বিপ্লব সংঘটিত হয়। সাম্রাজ্যবাদী জার ও পুরোনো শাসনের পতন ঘটে এবং বলশেভিক (কমিউনিস্ট) সরকার ক্ষমতায় আসে। বলশেভিক সরকার যুদ্ধ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে চেয়েছিল। তারা ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় শক্তির সাথে সাময়িক যুদ্ধবিরতি এবং পরবর্তীতে ১৯১৮ সালের মার্চ মাসে ব্রেস্ট-লিটোভস্ক চুক্তির মাধ্যমে আলাদাভাবে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে রাশিয়াকে যুদ্ধ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এই চুক্তির ফলে পূর্ব মোর্চা বন্ধ হয়ে গেলেও কেন্দ্রীয় শক্তির জন্য এটি স্বস্তির ছিল সাময়িক; জার্মানি পশ্চিম রণাঙ্গনে সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনা করে।
১৯১৮ সালের বসন্তে জার্মানি পশ্চিম ফ্রন্টে একটি চূড়ান্ত বড় আক্রমণ শুরু করে (বসন্ত অভিযান)। প্রথম দিকে জার্মান বাহিনী কিছু অঞ্চলে অগ্রগতি লাভ করলেও তাদের সৈন্যরা অতিমাত্রায় ক্লান্ত ও রসদশূন্য হয়ে পড়ে। বিপরীতে, যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্রশক্তির মজবুত প্রশিক্ষিত নতুন সেনাবাহিনী ও প্রাচুর্যপূর্ণ রসদ নিয়ে একই বছরে আগস্ট থেকে শতদিনের পাল্টা অভিযান শুরু করে। এই পাল্টা আক্রমণে জার্মান ফ্রন্ট একের পর এক ভেঙে পড়ে এবং কেন্দ্রীয় শক্তির মনোবল চূর্ণ হয়। ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মিত্রবাহিনী বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে বার্দার অভিযান সফলভাবে চালিয়ে গেলে বুলগেরিয়া আত্মসমর্পণ করে। অক্টোবরে মিত্রশক্তির অভিযানে মধ্যপ্রাচ্য ও বলকানেও অটোমান ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির পরাজয় স্পষ্ট হয়ে যায়; নভেম্বরের প্রথম দিকে অটোমান সাম্রাজ্য এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি মিত্রশক্তির কাছে পৃথক অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে সই করে যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসে। একে একে সব মিত্র দেশ হারিয়ে জার্মানি একা হয়ে পড়ে এবং দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধবিরোধী বিপ্লব শুরু হয়। অবশেষে ১৯১৮ সালের ৯ নভেম্বর জার্মান সম্রাট ক্যায়সার উইলহেলম দ্বিতীয় অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের মুখে সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১১ নভেম্বর ১৯১৮ তারিখে ফ্রান্সের কম্পিয়েনে জার্মান কর্তৃপক্ষ মিত্রশক্তির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি (Armistice) চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার মাধ্যমে চার বছর ধরে চলা মহাযুদ্ধের সক্রিয় শত্রুতার অবসান ঘটে।
ক্ষয়ক্ষতি: প্রাণহানি, ধ্বংস ও সামাজিক প্রভাব
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মানব ইতিহাসের অন্যতম সর্বাধিক প্রাণসংহারী সংঘাত। চার বছরের যুদ্ধে অসংখ্য সৈন্য এবং নিরীহ নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে। ধারণা করা হয় যে প্রায় ৮৫ লক্ষ সামরিক সদস্য (সৈনিক) সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয়েছেন বা যুদ্ধজনিত আঘাত ও রোগে মারা গেছেন এবং সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে সম্ভবত ১.৩ কোটি পর্যন্ত লোক প্রাণ হারিয়েছে। মোট মৃত্যুর হিসাব বিভিন্ন অনুমান অনুযায়ী ১.৫ কোটি থেকে ২.২ কোটি পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া প্রায় ২ কোটি ৩০ লক্ষের মতো সৈন্য আহত বা বিকলাঙ্গ হয়ে ফিরে আসে। এই বিপুল সংখ্যক হতাহতের মূল কারণ ছিল নতুন ধরণের উন্নত অস্ত্র ও যুদ্ধকৌশল, যেমন ভারী আর্টিলারি গোলাবর্ষণ, মেশিনগান, ট্যাংক ও বিষাক্ত গ্যাসের ব্যবহার, যা আগের সব যুদ্ধের তুলনায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক বাড়িয়ে দেয়। অনেক সামরিক সদস্য বছরের পর বছর ট্রেঞ্চে অবস্থান নিয়ে লড়াই করার কারণে শারীরিক আঘাতের পাশাপাশি মানসিক আঘাত (যেমন শেল শক) নিয়ে ভুগেছেন, যা তখনকার সমাজে গুরুতর স্বাস্থ্যসমস্যা হিসেবে দেখা দেয়।
যুদ্ধ চলাকালীন এবং পরবর্তী সময়ে বেসামরিক জনগণও বিশাল বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। যুদ্ধ গুলিতে শহর, জনপদ ও অবকাঠামোর ব্যাপক ধ্বংস সাধিত হয়। বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের যুদ্ধকবলিত অঞ্চলসমূহ একেবারে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। উদাহরণস্বরূপ, বেলজিয়ামে জার্মান আক্রমণের সময় অনেক শহর (যেমন দিনাঁ শহর) সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং যুদ্ধ শেষে দেশটির অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে এই ধ্বংসযজ্ঞ প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ফ্রান্সের বহু ঐতিহাসিক নগর ও গ্রামের প্রায় কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। সারা ইউরোপ জুড়ে রেলওয়ে, সেতু, কারখানা, খনি ও কৃষিজমি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, যা যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকটকে তীব্রতর করে। অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অভূতপূর্ব ব্যয়বহুল সংঘাত ছিল। যুদ্ধ চালাতে গিয়ে যুদ্ধে জড়িত দেশগুলোকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয় যা তাদের অর্থনীতিকে নড়বড়ে করে দেয়। একটি হিসাব অনুযায়ী মিত্রশক্তি দেশগুলো সমগ্র যুদ্ধে প্রায় ১৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (১৯১৩ সালের মূল্যমান অনুযায়ী) খরচ করে এবং কেন্দ্রীয় শক্তিগুলো ব্যয় করে প্রায় ৬১ বিলিয়ন ডলার। যুদ্ধফান্ড জোগাড় করতে ব্রিটেন তার স্বর্ণ ভাণ্ডার ও বৈদেশিক বিনিয়োগ খরচ করে এবং ১৯১৭ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়। যুদ্ধ শেষে পরাজিত শক্তিদের ওপর বিশাল ক্ষতিপূরণ আরোপ করা হলেও বাস্তবে এই অর্থনৈতিক বোঝা বিশ্বব্যাপী মন্দা ও ঋণের চক্র সৃষ্টি করে, যা বহু দেশকে দশকজুড়ে বিপদে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঋণ পরিশোধ করতে শতাব্দীর বেশি সময় নিয়েছিল এবং শেষ কিস্তিটি ২০১৫ সালে গিয়ে পরিশোধ করে। সামাজিক ক্ষেত্রে যুদ্ধের প্রভাব ছিল ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী।
ইউরোপের জনসংখ্যার একটি পুরো প্রজন্ম এই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার কারণে পরবর্তীতে এই প্রজন্মকে “হারানো প্রজন্ম” (Lost Generation) বলা হয়ে থাকে। সমাজে নারীদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হতে শুরু করে – যুদ্ধে কোটি কোটি পুরুষ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ায় তাদের স্থান পূরণ করতে নারীরা বৃহৎ পরিসরে কল-কারখানা, অফিস ও বিভিন্ন পেশায় কাজ শুরু করেন। অনেক দেশে নারী শ্রমিকদের এই অভিজ্ঞতা নারীর অধিকারের প্রসার ও ভোটাধিকারের আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে। যুদ্ধ শেষে বেশ কয়েকটি দেশ (যেমন ব্রিটেন ১৯১৮ সালে আংশিকভাবে, ও যুক্তরাষ্ট্র ১৯২০ সালে) নারীদের ভোটাধিকার প্রদান করে, যা নারীর ক্ষমতায়নের পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। যুদ্ধপরবর্তী সমাজে মানসিক আঘাত ও শোক ছিল সর্বত্র বিদ্যমান। নিহত ও আহত সৈন্যদের পরিবারের ওপর এর গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং বহু শিশু পিতৃহীন হয়ে বড় হয়। সৈন্যদের মধ্যে মানসিক রোগ ও পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার ঘটনা সাধারণ হয়ে দাঁড়ায়, যা সরকার ও সমাজকে পুনর্বাসন ও কল্যাণমূলক উদ্যোগ নিতে বাধ্য করে। তাছাড়া, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির অব্যবহিত পরেই বিশ্ব এক ভয়াবহ মহামারীর কবলে পড়ে – ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু। যুদ্ধের কারণে সৈন্য ও শরণার্থীদের বিশ্বজুড়ে চলাচল এই ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী দ্রুত বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা রাখে। ফলে ১৯১৮-১৯ সালের মাঝে আনুমানিক ২ থেকে ৫ কোটি মানুষ এই মহামারীতে মারা যায়, যা বিশ্বের জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতিকে আরো বিপর্যস্ত করে তোলে। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, স্প্যানিশ ফ্লুতে মৃত্যুহার সরাসরি যুদ্ধের চেয়েও বেশি ছিল। যুদ্ধ এবং মহামারির যুগপত্ আঘাতে সমাজে এক ধরনের হতাশা ও মানবসভ্যতার প্রতি অবিশ্বাস দেখা দেয়, যা শিল্প-সাহিত্যেও প্রতিফলিত হয় (উদাহরণস্বরূপ যুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় সাহিত্য ও শিল্পে বিষাদ ও বিমূঢ়তার ছাপ)।
যুদ্ধের ফলাফল ও প্রভাব
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি বিজয়ী হয় এবং কেন্দ্রীয় শক্তি পরাজিত হয়। ১৯১৮ সালের শেষ দিকে যুদ্ধবিরতি চুক্তিগুলো স্বাক্ষরের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় জোটের পরাজয় নিশ্চিত হয় এবং যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে। এই যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে ইউরোপ ও বিশ্বের ক্ষমতার কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আসে। একদিকে মিত্রশক্তির প্রধান দেশগুলি (ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি) বিজয়ী শক্তি হিসেবে অবস্থানে আসে, অন্যদিকে পরাজিত রাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যগুলোর পতন ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ ফলাফল হিসেবে ইউরোপের চারটি প্রাচীন সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে: জার্মানিতে হোহেনৎসোলার্ন রাজবংশের সাম্রাজ্য (কায়সারের শাসন) উৎখাত হয়, রাশিয়ায় রোমানভ রাজবংশের সমাপ্তি ঘটে (বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে), অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিতে হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্য ভেঙে যায়, এবং অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যেরও অবসান হয়। শতাব্দীপ্রাচীন এই সাম্রাজ্যগুলোর পতনের ফলে ইউরোপের ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র নতুন করে আঁকা হয়। পরাজিত সাম্রাজ্যগুলো ভেঙে ছোট ছোট জাতিরাষ্ট্র গঠিত হতে থাকে – উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির বিভাজনে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া ও ইউগোস্লাভিয়া নামে নতুন রাষ্ট্র জন্ম নেয়; রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চল থেকে পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া প্রভৃতি স্বাধীন দেশ তৈরি হয়; এবং মধ্যপ্রাচ্যে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রদেশগুলো বিভাজিত হয়ে তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়া, প্যালেস্টাইনসহ বেশ কিছু অঞ্চল নতুন শাসনকাঠামোর অধীনে আসে। যুদ্ধের পর ক্ষমতার ভারসাম্যে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যুদ্ধকালীন মিত্রশক্তির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় – অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে ইউরোপের ক্লান্ত শক্তিগুলোর তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র অনেক শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে যায়।
১৯১৭ সালে যুদ্ধশেষের প্রাক্কালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে “চৌদ্দ দফা” নামক পরিকল্পনা ঘোষণা করেন যা যুদ্ধ-পরবর্তী আলোচনা প্রভাবিত করে। এসময় কমিউনিস্ট বলশেভিক বিপ্লব রাশিয়াকে যুদ্ধ থেকে সরিয়ে নিলেও পরবর্তীতে বিশ্বের রাজনীতিতে দ্বিধাবিভক্তির (পুঁজিবাদ বনাম কমিউনিজম) প্রেক্ষাপট তৈরি হয়, যা শীতল যুদ্ধের ভিত গড়ে দেয়। অপরদিকে, যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে সমকালীন ইউরোপীয়েরা এই যুদ্ধকে "সকল যুদ্ধের অবসান ঘটাবে যে যুদ্ধ" বলেও অভিহিত করেন, কেননা তাদের ধারণা ছিল এত বড় ধ্বংসযজ্ঞের পুনরাবৃত্তি মানবসভ্যতা আর করবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল ও শান্তিচুক্তিসমূহ এমন কিছু পরিস্থিতির জন্ম দেয় যা পরবর্তী যুগে আরও ভয়াবহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মঞ্চ তৈরি করে দেয়। যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক অভিজ্ঞতা থেকে জাতিসংঘ পর্যায়ের একটি বিশ্বসংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। ১৯১৯ সালে মিত্রশক্তির উদ্যোগে লীগ অব নেশনস (জাতিপুঞ্জ) প্রতিষ্ঠিত হয়, যার লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক বিরোধগুলোকে সংলাপের মাধ্যমে সমাধান করে পুনরায় বিশ্বযুদ্ধ এড়ানো। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দেশের আন্তরিকতা ও সদস্যপদ নিয়ে জটিলতা, এবং সংস্থাটির নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে লীগ অব নেশনস বিশ্বশান্তি রক্ষায় কার্যত ব্যর্থ হয়। এর ব্যর্থতার ফলে বিশের দশক ও ত্রিশের দশকে বিশ্ব আবার সংঘাত ও আগ্রাসনের দিকে ধাবিত হয়, যার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ১৯৩৯ সালে।
যুদ্ধের সমাপ্তি: শান্তিচুক্তি ও উত্তরাধিকার
চিত্র: ১৯১৯ সালের ২৮শে জুন ভার্সাইয়ের ‘হল অব মিরর্স’-এ শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রধান শান্তিচুক্তি ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরের মুহূর্ত।
মিত্রশক্তি ও জার্মানির প্রতিনিধিবৃন্দ ফ্রান্সের ভার্সাই প্রাসাদের বিখ্যাত হল অফ মিরর্সে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, যার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধের অবসান এবং যুদ্ধ-পরবর্তী ব্যবস্থাপনার সূচনা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সক্রিয় যুদ্ধসূচি শেষ হয় ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর – এই দিনে সন্ধ্যা ৫টাতে ফ্রান্সের কম্পিয়েন অঞ্চলে জার্মানি এবং মিত্রশক্তির মধ্যে একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তি (Armistice) স্বাক্ষরিত হয়, যা ১১ নভেম্বর ১৯১৮ রাত ১১টা থেকে কার্যকর হয় এবং সম্মুখসমর থেমে যায়। এই অস্ত্রবিরতির ফলে যুদ্ধবিগ্রহ থেমে গেলেও এটি ছিল মূলত একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি; চূড়ান্ত শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি আনুষ্ঠানিক শান্তিচুক্তি দরকার ছিল। সেই উদ্দেশ্যে ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে প্যারিসে একটি বিশাল আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন আহ্বান করা হয়, যেখানে মিত্রশক্তির নেতৃবৃন্দ পরাজিত শক্তিগুলোর ভাগ্য নির্ধারণে আলোচনা শুরু করেন। আলোচনার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর ১৯১৯ সালের ২৮শে জুন তারিখে জার্মানির সাথে ভার্সাই শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির আওতায় জার্মানিকে যুদ্ধের সম্পূর্ণ দায়ভার গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয় (চুক্তির beruchte War Guilt Clause অনুযায়ী), তাদের বিশাল অংকের যুদ্ধক্ষতিপূরণ প্রদান করতে বলা হয়, এবং জার্মান সামরিক শক্তির উপর কড়া সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়। জার্মানি তার ইউরোপীয় ভূখণ্ডের উল্লেখযোগ্য অংশ এবং সব বিদেশী উপনিবেশ মিত্রশক্তির কাছে হারায়।
ভার্সাই চুক্তি ছাড়াও পরাজিত অন্যান্য কেন্দ্রীয় শক্তির সাথে আলাদা আলাদা শান্তিচুক্তি হয় – অস্ট্রিয়াের সাথে সেন্ট জার্মেইন চুক্তি (১৯১৯), হাঙ্গেরির সাথে ট্রিয়ানোর চুক্তি (১৯২০), বুলগেরিয়ার সাথে নিয়ি চুক্তি (১৯১৯) এবং অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে প্রথমে সেভ্র্ চুক্তি (১৯২০), যা পরবর্তীতে তুরস্কের যুদ্ধের পর লোজান চুক্তি (১৯২৩) দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। এসব চুক্তির মাধ্যমেই যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে এবং ইউরোপের নতুন সীমানা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপিত হয়।
ভার্সাই চুক্তি ও সংশ্লিষ্ট শান্তিচুক্তিসমূহ যুদ্ধের পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থাকে সংজ্ঞায়িত করেছিল, তবে এ কঠোর শর্ত বিশেষত জার্মানিতে গভীর অসন্তোষ ও অর্থনৈতিক সংকটের জন্ম দেয়। জার্মান জনগণ এই চুক্তিকে অপমানজনক ও অন্যায় মনে করে এবং “পিছন থেকে ছুরি মারা” মত কিংবদন্তি তৈরি হয় যে, দেশটি আসলে যুদ্ধে অজেয় ছিল কিন্তু অন্তর্ঘাতের শিকার হয়েছে। যুদ্ধক্ষতিপূরণের বিশাল বোঝা ও জাতীয় অপমান না ভুলতে পারার অনুভূতি জার্মানিতে চরমপন্থী রাজনীতির উত্থান ঘটায়, যার সুযোগ নিয়ে অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি আন্দোলন ক্ষমতায় আসে এবং পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পথ প্রশস্ত হয়। অন্যদিকে বিজয়ী মিত্রশক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থে পরাজিতদের উপর কঠোর শর্ত আরোপ করলেও আন্তর্জাতিক শান্তি টেকসই করতে ব্যর্থ হয়। তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটলেও এর অসমাপ্ত বাস্তবতা ও অসম শান্তির কাঠামো বিশ্বরাজনীতিতে আরও বড় সংঘাতের বীজ বপন করে যায়।
পাঠকের মতামত:
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- বাংলাদেশে কারাগার/হেফাজতে আত্মহত্যা: একটি উপেক্ষিত সংকট
- ৯ জুলাইয়ের পর কী হবে? শুল্ক আতঙ্কে কাঁপছে বাজার
- মোটা হলেই কি অসুস্থ? বাস্তবতা, বিজ্ঞান ও ভুল বোঝাবুঝির অনুসন্ধানে
- আদানিকে সব বকেয়া পরিশোধ করল বাংলাদেশ
- বেকিং সোডা ও পাউডার: রান্নার সফলতার দুই গোপন যোদ্ধা
- রাতে বিছানায় ত্বক চুলকানি? জানুন কারণ ও প্রতিকার
- ম্যাক্স ভেবারের দৃষ্টিতে প্রোটেস্ট্যান্টিজম: ধর্ম থেকে পুঁজিবাদের উত্থান
- ইন্টারভিউয়ে সফল হওয়ার ছয়টি চাবিকাঠি
- একটি ব্যালকনি, তিনটি জীবন—যশোরে নির্মাণ বিভীষিকা!
- তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের দিনক্ষণ ঠিক, প্রস্তুত হচ্ছে বুলেটপ্রুফ নিরাপত্তা ও সাংগঠনিক কাঠামো
- বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা কার হাতে, তা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে
- ৩০ জুনদরপতনের শীর্ষে যারা
- সপ্তাহের শেষ দিনে যেসব শেয়ারে প্রবল সাড়া
- দাদাদের বাহাদুরির দিন শেষ: নাহিদ ইসলাম
- শিশু হত্যায় মায়ের হাতে মেয়ে খুন, যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় ডাক্তার মা গ্রেপ্তার
- মাদ্রাসা শিক্ষকদের ফাঁদে ফেলছে ভুয়া ডিজি!
- হারুন-বিপ্লবের গ্রেপ্তার দাবি: সেনবাগে সমাবেশে বিএনপির তীব্র প্রতিবাদ
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধ: এক বৈশ্বিক রক্তপাতের ইতিহাস ও এর উত্তরাধিকার
- লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম রাজস্ব আদায়, ব্যর্থতার পেছনে ২২টি চ্যালেঞ্জ: এনবিআর
- মঙ্গল থেকে আসা বৃহত্তম উল্কাপিণ্ড উঠছে নিলামে
- টেকনাফে পাহাড়ে যৌথ বাহিনীর অভিযানে গোলাগুলি, অস্ত্র-গুলিসহ অপহৃত যুবক উদ্ধার
- প্রেমে চারবার, বিয়ে কখনোই নয়—রতন টাটার নিঃসঙ্গ জীবনের গল্প
- নির্বাচনের আগে সংস্কার না হলে গণঅভ্যুত্থানের শঙ্কা: নুরুল হক নুর
- ‘নির্বাচনের ভয়েই পিআর পদ্ধতির কথা উঠছে’— বিএনপি নেতা প্রিন্স
- এক কিডনির গ্রাম: বাংলাদেশ-ভারত জুড়ে দারিদ্র্যের ফাঁদে অঙ্গপাচার
- চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটির হস্তান্তর সম্পন্ন, পরিচালনায় ড্রাইডক
- আশিয়ান সিটির মাসব্যাপী আবাসন মেলায় থাকছে আকর্ষনীয় অফার
- খনিজ সম্পদে শক্তি সঞ্চয়, বৈদেশিক মিত্রতা গড়ছে আফগানিস্তান
- দাদাদের বাহাদুরির দিন শেষ: নাহিদ ইসলাম
- বরগুনায় ট্রাফিক মামলায় ক্ষুব্ধ চালক নিজের মোটরসাইকেলে আগুন দিলেন
- ৯ জুলাইয়ের পর কী হবে? শুল্ক আতঙ্কে কাঁপছে বাজার
- মোটা হলেই কি অসুস্থ? বাস্তবতা, বিজ্ঞান ও ভুল বোঝাবুঝির অনুসন্ধানে
- রাঙ্গুনিয়ায় ভাঙা সড়ক নিজেরা মেরামত করলেন ছাত্রদল কর্মীরা
- হিজাব, রামমন্দির ও কঙ্গনা: মামদানির প্রাইমারি জয়ে হিন্দুত্বের ছোবল
- কর্মমুখী উদ্যোগে বিএনপি নেতা, খুলনার নারীরা পেলেন সেলাই মেশিন
- রহস্য-অ্যাকশনে ভরপুর 'ধুরন্ধর' নিয়ে হাজির রণবীর সিং
- যুগ যুগ ধরে জামায়াত জনগণের মনোভাব বুঝতে চায়নি: রিজভী
- এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছড়ানো হয়েছে তাসনিম জারার বিকৃত ছবি
- “আমগাছে বেঁধে বিচার করা হবে” — শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মন্তব্য এনসিপি নেতার
- ২০২৫ করবর্ষে করদাতাদের জন্য ৫ স্বস্তির বার্তা
- বাংলাদেশে কারাগার/হেফাজতে আত্মহত্যা: একটি উপেক্ষিত সংকট
- ৯ জুলাইয়ের পর কী হবে? শুল্ক আতঙ্কে কাঁপছে বাজার
- মোটা হলেই কি অসুস্থ? বাস্তবতা, বিজ্ঞান ও ভুল বোঝাবুঝির অনুসন্ধানে
- আদানিকে সব বকেয়া পরিশোধ করল বাংলাদেশ
- বেকিং সোডা ও পাউডার: রান্নার সফলতার দুই গোপন যোদ্ধা
- রাতে বিছানায় ত্বক চুলকানি? জানুন কারণ ও প্রতিকার
- ম্যাক্স ভেবারের দৃষ্টিতে প্রোটেস্ট্যান্টিজম: ধর্ম থেকে পুঁজিবাদের উত্থান
- ইন্টারভিউয়ে সফল হওয়ার ছয়টি চাবিকাঠি
- একটি ব্যালকনি, তিনটি জীবন—যশোরে নির্মাণ বিভীষিকা!
- তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের দিনক্ষণ ঠিক, প্রস্তুত হচ্ছে বুলেটপ্রুফ নিরাপত্তা ও সাংগঠনিক কাঠামো
- বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা কার হাতে, তা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে
- ৩০ জুন দরপতনের শীর্ষে যারা
- সপ্তাহের শেষ দিনে যেসব শেয়ারে প্রবল সাড়া
- দাদাদের বাহাদুরির দিন শেষ: নাহিদ ইসলাম
- শিশু হত্যায় মায়ের হাতে মেয়ে খুন, যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় ডাক্তার মা গ্রেপ্তার