ইতিহাস ও দর্শন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: ধ্বংসের ছায়া থেকে নতুন বিশ্বব্যবস্থার উত্থান

২০২৫ আগস্ট ০৮ ২২:২৮:৪৬
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: ধ্বংসের ছায়া থেকে নতুন বিশ্বব্যবস্থার উত্থান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯–১৯৪৫) ছিল মানব ইতিহাসে সংঘটিত সর্ববৃহৎ ও সর্বাধিক বিধ্বংসী যুদ্ধ, যেখানে বিশ্বের প্রায় সকল দেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছিল এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংক, বিমান থেকে শুরু করে পারমাণবিক অস্ত্রের মতো ধ্বংসাত্মক প্রযুক্তির ব্যবহারের নজির স্থাপিত হয়েছিল । এই যুদ্ধটি ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ হিসেবেও পরিগণিত হয়; এতে আনুমানিক ৭০ থেকে ৮৫ মিলিয়ন (৭ থেকে ৮.৫ কোটি) মানুষের প্রাণহানি ঘটে, যার অধিকাংশই ছিলেন নিরীহ বেসামরিক জনগণ। অক্ষশক্তি (জার্মানি, ইতালি ও জাপান) এবং মিত্রশক্তি (যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স প্রভৃতি) — এ দুই জোট পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় এবং ছয় বছরব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ১৯৪৫ সালে মিত্রশক্তির বিজয়ের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এই মহাযুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়, যা পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার ভিত্তি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

প্রেক্ষাপট: যুদ্ধের পটভূমি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী শক্তিগুলো জার্মানির ওপর যেসব কঠোর শর্ত আরোপ করেছিল এবং পরবর্তীকালে সংঘটিত মহামন্দার কারণে ইউরোপ জুড়ে গভীর অসন্তোষ ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। এই সুযোগে জার্মানিতে অ্যাডল্‌ফ হিটলারের নাৎসি মতবাদ, ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ এবং জাপানে সাম্রাজ্যবাদী সামরিকতন্ত্র উদ্দীপিত হয়ে ক্ষমতায় আসে। ১৯৩০-এর দশকে একের পর এক আগ্রাসী পদক্ষেপ বিশ্বকে আবার যুদ্ধের দিকে ধাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, জাপান ১৯৩১ সালে মাঞ্চুরিয়া দখল করে এবং ১৯৩৭ সালে চীনের বিরুদ্ধে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরু করে; স্পেনের গৃহযুদ্ধে (১৯৩৬–৩৯) ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো পরোক্ষভাবে লড়াইয়ের ময়দান পায়; আর নাৎসি জার্মানিঅস্ট্রিয়া ও সুডেটল্যান্ড অধিগ্রহণের মাধ্যমে ইউরোপে তাদের বিস্তারবাদী নীতি জোরদার করে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক শক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্স শুরুতে হিটলারের এসব আগ্রাসন মোকাবিলায় তুষ্টিকরণ নীতি অনুসরণ করলেও ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করার পর আর উদাসীন থাকতে পারেনি। ফলস্বরূপ, ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে; এই ঘোষণার মাধ্যমে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটে।

ছবি:নাৎসি বাহিনীর সাথে অ্যাডল্‌ফ হিটলার

মূল ঘটনাপ্রবাহ (১৯৩৯–১৯৪৫)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছয় বছরে ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া জুড়ে অসংখ্য সামরিক অভিযান ও গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে। সংক্ষিপ্তভাবে বছরের ক্রমানুসারে প্রধান ঘটনাগুলো নিচে তুলে ধরা হলো:

১৯৩৯: সেপ্টেম্বরে নাৎসি জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। অল্পদিনের মধ্যেই পোল্যান্ড জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং ইউরোপব্যাপী মহাসংঘাতের সূচনা হয়।

১৯৪০: জার্মানি পশ্চিম ইউরোপে ঝড় তোলা অভিযান চালায়। এপ্রিল-মে মাসে ডেনমার্ক ও নরওয়ে দখলের পর মে-জুনে বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস হয়ে ফ্রান্সকে পরাস্ত করে জুনের মাঝামাঝিতে প্যারিস অধিকার করে। ফ্রান্স পতনের পর ব্রিটেন এককভাবে নাৎসি হামলার মোকাবিলা করতে থাকে; একই বছরের শেষভাগে অনুষ্ঠিত “ব্যাটল অফ ব্রিটেন” চলাকালে রয়েল এয়ার ফোর্স জার্মান লুফওয়াফের ভয়াবহ বিমান আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়।

১৯৪১: নাৎসি জার্মানি ২২ জুন সোভিয়েত ইউনিয়নে আকস্মিক আক্রমণ (অপারেশন বার্বারোসা) শুরু করে, যার মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপে বিশাল এক নতুন যুদ্ধফ্রন্ট খুলে যায়। অন্যদিকে, একই বছরের ৭ ডিসেম্বর জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই নৌঘাঁটি পার্ল হারবারসহ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ব্রিটিশ ও মার্কিন স্থাপনাগুলিতে আকস্মিক আক্রমণ চালায়। যুক্তরাষ্ট্র এই ঘটনার পর আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং যুদ্ধ সত্যিকার অর্থেই বৈশ্বিক রূপ লাভ করে।

১৯৪২: বছরের প্রথমার্ধে অক্ষশক্তি তাদের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখলেও বছরের মাঝামাঝি থেকে যুদ্ধের মোড় ঘুরতে শুরু করে। জুন ১৯৪২-এ মার্কিন নৌবাহিনী প্রশান্ত মহাসাগরে মিডওয়ে দ্বীপের যুদ্ধে জাপানের নৌ-বহরকে পরাজিত করে, যা জাপানের আগ্রাসন থামিয়ে দেয়। ইউরোপের পূর্বাঞ্চলে একই সময়ে নাৎসি বাহিনী স্টালিনগ্রাদ অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে, যদিও বছরের শেষে এসে সেখানে তাদের অগ্রগতি থেমে যায় এবং মিত্রশক্তির প্রতিরোধ জোরদার হতে শুরু করে।

১৯৪৩: এই বছরটিতে মিত্রশক্তি বিভিন্ন ফ্রন্টে পাল্টা আক্রমণে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফেব্রুয়ারিতে স্টালিনগ্রাদের যুদ্ধ সমাপ্ত হয় মিত্রশক্তির বিজয়ের মাধ্যমে – এই ভয়াবহ সংঘর্ষে সোভিয়েত লালফৌজ নাৎসি বাহিনীর অগ্রযাত্রা সম্পূর্ণরূপে থামিয়ে দেয়। মে মাসে উত্তর আফ্রিকায় জার্মানি-ইতালির যৌথ বাহিনী পরাজিত হয় এবং মিত্রশক্তি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল নিরাপদ করে। জুলাই মাসে মিত্র বাহিনী ইতালির সিসিলি দ্বীপে অবতরণ করে এবং সেপ্টেম্বরে ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকার আত্মসমর্পণ করে (ইতালি এরপর মিত্রশক্তির পক্ষে যোগ দেয়)। একই সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপে ক্রমাগত নাৎসিদের পিছু হটতে বাধ্য করতে থাকে এবং প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র বাহিনী দ্বীপে দ্বীপে জাপানিদের পরাস্ত করে অগ্রসর হয়।

১৯৪৪: মিত্রশক্তি সর্বাত্মক আক্রমণের মাধ্যমে জয়ের পথে অগ্রসর হতে থাকে। ৬ জুন মিত্র বাহিনী ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে ঐতিহাসিক ডি-ডে অবতরণ পরিচালনা করে এবং পশ্চিম ইউরোপ মুক্ত করার অভিযান শুরু করে। পূর্বদিকে সোভিয়েত সেনারা নাৎসিদের থেকে নিজেদের হারানো ভূখণ্ড ফিরে পেতে থাকেন এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো নাৎসি কবল থেকে মুক্ত হতে থাকে। একইসময়ে প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন নৌবাহিনী জাপানের নৌশক্তিকে কার্যত ধ্বংস করে দেয় এবং একের পর এক কৌশলগত দ্বীপ দখলে নিয়ে জাপানের মূল ভূখণ্ডের দিকে অগ্রসর হয়। বছরের শেষ নাগাদ অক্ষশক্তি প্রায় প্রতিটি ফ্রন্টে রক্ষণাত্মক অবস্থানে সংকুচিত হয়ে পড়ে।

১৯৪৫: যুদ্ধের শেষ অধ্যায়ে মিত্রশক্তি সক্রিয়ভাবে অক্ষশক্তির হৃদপিণ্ডে আঘাত হানে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে পশ্চিম দিক থেকে ব্রিটিশ-আমেরিকান ও পূর্ব দিক থেকে সোভিয়েত বাহিনী জার্মান ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। ৩০ এপ্রিল নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলার আত্মহত্যা করেন; তার পরপরই ৮ মে নাৎসি জার্মানি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে এবং ইউরোপে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এদিকে প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরুদ্ধে কঠোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু জাপান এখনও আত্মসমর্পণে রাজি হচ্ছিল না। অবশেষে আগস্ট ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে হিরোশিমা (৬ আগস্ট) ও নাগাসাকিতে (৯ আগস্ট) দুটো পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। একই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ৮ আগস্ট মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করে। এই যুগপৎ আঘাতে জাপানীয় সরকার সম্পূর্ণ বিচলিত হয়ে পড়ে এবং ১৫ আগস্ট ১৯৪৫ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়। ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষরের মাধ্যমে বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু ঐতিহাসিক ছবি।

যুদ্ধের ফলাফল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি বিশ্বের জন্য গভীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। যুদ্ধশেষে বিশ্ব মানচিত্র পুনর্সংগঠিত হয় এবং ক্ষমতার ভারসাম্য ও সমাজের বিন্যাস নতুনভাবে রূপ পায়। নিচে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি ও প্রভাবগুলো আলোচনা করা হলো।

রাজনৈতিক ফলাফল

দুটি পরাশক্তির উত্থান ও শীতল যুদ্ধ:দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি বিশ্ব রাজনীতি ও ক্ষমতার কাঠামোকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়। যুদ্ধ-পূর্ব পৃথিবীতে ইউরোপের একাধিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বৈশ্বিক রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করলেও, যুদ্ধের পরে সেই পুরনো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তাদের স্থান পূরণে আবির্ভূত হয় দুটি নতুন পরাশক্তি — গণতান্ত্রিক-পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্র এবং সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন।

একসময়ের মিত্র এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতাদর্শ দ্রুত বৈরিতার জন্ম দেয়। এর ফলে পৃথিবী প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে শীতল যুদ্ধের মাধ্যমে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী ব্লকে বিভক্ত থাকে — একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক জোট এবং অন্যদিকে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন পূর্ব ব্লক। এই সময়ে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো সোভিয়েত প্রভাবাধীন কমিউনিস্ট শাসনে চলে যায়, আর পশ্চিম ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী সহযোগিতায় একত্রিত হয়। নাৎসি জার্মানির দখলীকৃত ভূখণ্ড বিভাজনের ফলে জার্মানি দুই ভাগে বিভক্ত হয় — পূর্ব জার্মানি (সোভিয়েত প্রভাবাধীন) ও পশ্চিম জার্মানি (মার্কিন প্রভাবাধীন)।

শীতল যুদ্ধের বৈশিষ্ট্য ছিল সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ এড়িয়ে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা, গুপ্তচরবৃত্তি, মহাকাশ প্রতিযোগিতা এবং বিভিন্ন অঞ্চলে প্রক্সি যুদ্ধ পরিচালনা। ১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট এবং ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত-নেতৃত্বাধীন ওয়ারশ চুক্তি গঠিত হওয়ায় পৃথিবী দুটি শক্তিশালী সামরিক শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই বিভাজন কয়েক দশক ধরে বিশ্ব রাজনীতিতে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা বজায় রাখে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিপথ নির্ধারণ করে।

জাতিসংঘের সৃষ্টি: বিশ্বযুদ্ধের বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে বৈশ্বিক শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ (United Nations) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সংলাপ, সহযোগিতা ও সংঘর্ষ প্রতিরোধের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ শুরু করে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী আসন বিজয়ী পরাশক্তিগুলো – যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও চীন – নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়, যা তাদেরকে বৈশ্বিক নিরাপত্তা ইস্যুতে ভেটোসহ বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করে।

ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের পতন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী দেশগুলোকে (যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম) অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে দুর্বল করে দেয়। এর ফলে এশিয়া ও আফ্রিকার অধিকাংশ উপনিবেশে স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্রতর হয় এবং যুদ্ধশেষের মাত্র দুই দশকের মধ্যে ভারত (১৯৪৭), ইন্দোনেশিয়া (১৯৪৫), পাকিস্তান (১৯৪৭), মায়ানমার/বার্মা (১৯৪৮), সিলন/শ্রীলংকা (১৯৪৮), ঘানা (১৯৫৭), আলজেরিয়া (১৯৬২) ইত্যাদি বহু নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম নেয়। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে এসব দেশের উদয়কে ডিকলোনাইজেশন (পূর্ব উপনিবেশগুলোর স্বাধীনতা লাভ) প্রক্রিয়া বলা হয়, যা বিশ্ব রাজনীতিতে ইউরোপের শতাব্দীপ্রাচীন প্রাধান্যের অবসান ঘটায়।

অর্থনৈতিক ফলাফল

যুদ্ধধ্বস্ত অর্থনীতি ও মার্কিন আধিপত্য: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপ ও এশিয়ার প্রায় সমস্ত বড় অর্থনীতিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে যায়। যুদ্ধশেষে জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে কলকারখানা ও অবকাঠামো বিধ্বস্ত হওয়ায় খাদ্য ও জ্বালানির মারাত্মক সংকট দেখা দেয়; ১৯৪৫-৪৬ সালের শীতকালে এসব অঞ্চলে অনেক মানুষকেই অনাহার ও দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাতে হয়েছিল। এর বিপরীতে, যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে দূরে থাকায় এবং যুদ্ধ অর্থনীতির জোয়ারে সক্রিয় থাকায় আমেরিকা অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে যায়। ফলস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ-পরবর্তী যুগে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় অর্থনৈতিক শক্তি এবং শিল্পোৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়।

ইউরোপ পুনর্গঠন ও মার্শাল পরিকল্পনা : যুদ্ধের পর ধ্বংসপ্রায় পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতি পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্র উদার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ১৯৪৮ সালে চালু করা মার্শাল পরিকল্পনার আওতায় যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার অর্থসহায়তা ও বিনিয়োগ দেয়, যার ফলে এসব দেশ দ্রুত শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এই সহযোগিতার ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালির মতো দেশগুলো ১৯৫০-এর দশকে উল্লেখযোগ্য হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। বৈশ্বিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে মিত্রশক্তি একই সময়ে ব্রেটন উডস সম্মেলনের (১৯৪৪) মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ও বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থাও প্রতিষ্ঠা করে, যাতে যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠনে আর্থিক কাঠামো ও সহযোগিতা নিশ্চিত হয়।পশ্চিম ইউরোপ আমেরিকার সাহায্যে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালেও পূর্ব ইউরোপ সোভিয়েত প্রভাবক্ষেত্রে থাকায় সেখানকার পুনর্গঠন হয় ভিন্ন আদর্শে ও তুলনামূলকভাবে ধীরগতিতে।

জাপানের পুনর্জাগরণ: প্রশান্ত মহাসাগরে পরাজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র জাপানকে সাময়িকভাবে দখলে নিয়ে দেশটিতে রাজনৈতিক-اقتصادی সংস্কার কার্যকর করে। মার্কিন সহায়তায় যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপান তার শিল্পকারখানা ও অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে অর্থনীতিকে সচল করে তোলে। ১৯৫০-৬০ দশকে জাপান দ্বিগুণ তালে শিল্পোৎপাদন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটিয়ে একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। পরবর্তীতে জাপান বিশ্বব্যাপী ইলেকট্রনিকস, গাড়ি নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে নেতৃস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে আসে, যা যুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক মিরাকলের একটি উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

সামাজিক ফলাফল

মানবিক বিপর্যয় ও গণহত্যার ক্ষত: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মানবিক মূল্য ছিল অবর্ণনীয়। আনুমানিক ৭ থেকে ৮.৫ কোটি মানুষ এই যুদ্ধে নিহত হন, যার মধ্যে অর্ধের বেশি ছিলেন সাধারণ নিষ্পাপ নাগরিক। নাৎসি জার্মানির শাসনামলে সংঘটিত হলোকাস্ট মানব ইতিহাসে জঘন্যতম গণহত্যার উদাহরণ – প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদিকে নাৎসি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে, পাশাপাশি রোমানীয়, পোলীয়, রুশ ও অন্যান্য জনগোষ্ঠী, যুদ্ধবন্দী ও বেসামরিক লোকদের বিরুদ্ধেও ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। যুদ্ধশেষে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতে (উদাহরণ: নুরেমবার্গ বিচার, টোকিও বিচার) নাৎসি ও জাপানি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচার অনুষ্ঠিত হয়। এসব বিচার মানব ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার জন্য জাতীয় নেতৃবৃন্দকেও জবাবদিহি করতে হবে।

নাৎসি জার্মানির শাসনামলে সংঘটিত-নির্মম হলোকাস্ট এর একটি ভয়াবহ চিত্র।

উদ্বাস্তু সংকট ও জনসংখ্যাগত পরিবর্তন: যুদ্ধের ফলস্বরূপ কোটি কোটি মানুষ গৃহহীন ও وطنছাড়া হয়ে পড়ে। ইউরোপের নানা সীমান্ত পরিবর্তন, জাতিগত সংঘাত ও প্রতিশোধের মাশুল হিসেবে লক্ষ লক্ষ মানুষকে একস্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তরিত হতে হয়েছিল। পূর্ব ও মধ্য ইউরোপে যুদ্ধের পর প্রায় ১ থেকে ২ কোটি মানুষকে তাদের জন্মভূমি থেকে বাধ্যতামূলকভাবে উৎখাত করা হয় – এর মধ্যে নৌৎসিজের অধীনস্থ পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, পূর্ব প্রুশিয়া ইত্যাদি অঞ্চল থেকে জার্মান বংশোদ্ভুত জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক জার্মানিতে পাঠানো এবং পূর্ব পোল্যান্ড থেকে লক্ষাধিক পোলিশকে নিজ দেশ ছাড়তে বাধ্য করা উল্লেখযোগ্য। একই সাথে যুদ্ধকালীন নির্যাতন থেকে বেঁচে যাওয়া ইউরোপীয় ইহুদিরা নিজ নিজ জন্মভূমিতে নিরাপত্তাহীন বোধ করায় বহু ইহুদি শরণার্থী মধ্যপ্রাচ্যের প্যালেস্টাইনে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। এর প্রেক্ষিতে ১৯৪৮ সালে প্যালেস্টাইনে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটে, যা পরে আরব-ইসরায়েল সংঘাতের সূত্রপাত করে। বিশ্বের অন্যান্য যুদ্ধোত্তর সময়ে প্রচুর জনগোষ্ঠী নিজ দেশে বা দেশের বাইরে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়, যা আধুনিক বিশ্বের জনসংখ্যাগত বিন্যাসকে নতুনভাবে গড়ে তুলেছে।

নারীর ভূমিকা ও সামাজিক পরিবর্তন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিভিন্ন দেশের নারীসমাজ সমগ্রভাবে কর্মক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকা পালন করে। পুরুষরা সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ায় মহিলা কর্মীরা কারখানা, পরিবহন, চিকিৎসাসেবা ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রসমূহে বিপুল সংখ্যায় দায়িত্ব গ্রহণ করেন, যা আগে অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষদের অধিকারভুক্ত কর্মক্ষেত্র ছিল। এই পরিস্থিতি নারীর ক্ষমতায়ন ও আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয় এবং যুদ্ধোত্তর বিশ্বে বিভিন্ন দেশে নারীর অধিকার আন্দোলন ও সমাজে নারীর অবস্থান উন্নয়নের পথ প্রশস্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ বহু দেশে যুদ্ধের পরপরই কর্মজীবী নারীদের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে যায় এবং নারীরা ভোটাধিকারের মতো রাজনৈতিক অধিকারের জন্যও জোরালো দাবি ওঠাতে শুরু করে। যুদ্ধের ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক সম্প্রদায় মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করে; ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ সাধারণ সভায় সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়, যাতে বিশ্বের সব মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার আদর্শ স্থাপন করা হয়। এছাড়া যুদ্ধরত পক্ষগুলোর আচরণবিধি উন্নত করার উদ্দেশ্যে জেনেভা কনভেনশনসমূহ ১৯৪৯ সালে পুনর্বিবেচনা ও সম্প্রসারিত হয়। বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সামাজিক অভিঘাত মানবসমাজকে শান্তি, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের গুরুত্ব সম্পর্কে গভীর শিক্ষা দিয়ে গেছে।

পরিশেষে বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানব সভ্যতার এক ক্রান্তিকালের সূচনা করে। এই যুদ্ধের ফলে একদিকে জাতিসমূহ তাদের সমষ্টিগত নিরাপত্তার জন্য জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে শুরু করে, অন্যদিকে নবস্বাধীন দেশগুলোর উত্থান বিশ্বরাজনীতিতে উপনিবেশ-উত্তর যুগের সূচনা করে। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি যেমন পরমাণু শক্তির আবিষ্কার নতুন দ্বন্দ্ব ও ভীতির সৃষ্টি করেছে, তেমনি মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও যুদ্ধ পরবর্তী প্রতিক্রিয়াস্বরূপ অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। নতুন শক্তির ভারসাম্য, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, সামরিক জোট বিন্যাস ও সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যবস্থা পুনর্নিমাণ হয়, যা আধুনিক বিশ্বের গতিধারা নির্ধারণে মৌলিক ভূমিকা রেখেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা মানবজাতিকে একদিকে বিধ্বংসী যুদ্ধের মাশুল এবং অপরদিকে বৈশ্বিক সহযোগিতার মূল্য দুটোই শিখিয়েছে, যা পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পথনির্ধারণে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।


হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.): ন্যায়, প্রজ্ঞা ও বিশ্বনেতৃত্বের এক স্বর্ণযুগ

ইতিহাস ও দর্শন ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ আগস্ট ০৮ ১০:৫৬:৫৮
হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.): ন্যায়, প্রজ্ঞা ও বিশ্বনেতৃত্বের এক স্বর্ণযুগ

ইসলামের ইতিহাসে হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) এমন এক মহান ব্যক্তিত্ব যিনি শক্তি, সাহস, ন্যায়বিচার, প্রজ্ঞা এবং আল্লাহভীতি দ্বারা বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা, নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সাহাবি, এবং এমন এক নেতা যাঁর শাসনকাল মুসলিম সভ্যতার সোনালি যুগ হিসেবে পরিচিত। তাঁর শাসনামলে শুধু ইসলামী সাম্রাজ্য ভৌগোলিকভাবে বিস্তৃত হয়নি, বরং প্রশাসনিক কাঠামো, বিচারব্যবস্থা, করনীতি, সামাজিক কল্যাণ এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী সংস্কার হয়েছে। পশ্চিমা ঐতিহাসিকরাও স্বীকার করেছেন, তাঁর শাসন ছিল মানব ইতিহাসের অন্যতম সফল, সুশৃঙ্খল ও ন্যায়নিষ্ঠ শাসনব্যবস্থার উদাহরণ।

প্রাথমিক জীবন ও পারিবারিক পটভূমি

হযরত ওমর (রা.) ৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় কুরাইশ গোত্রের বানু আদী শাখায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম ছিল খাত্তাব ইবনে নুফাইল এবং মাতার নাম হাতমা বিনতে হাশিম। তাঁর পরিবার কুরাইশদের মধ্যে সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে সম্মানিত ছিল, তবে ধনী ছিল না। শৈশব থেকেই ওমর (রা.) ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সাহসী এবং শারীরিকভাবে বলবান। তিনি তলোয়ার চালনা, ঘোড়সওয়ারি, উটপালন এবং ক্রীড়ায় পারদর্শী ছিলেন।

শিক্ষাজীবনে তিনি আরবি সাহিত্য, কবিতা, বংশাবলি বিদ্যা এবং বক্তৃতাশৈলীতে দক্ষতা অর্জন করেন। সেই সময়ের মক্কার সমাজে বংশগৌরব, বাগ্মিতা এবং শারীরিক সক্ষমতা ছিল নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা—যা ওমর (রা.)-এর মধ্যে শৈশব থেকেই স্পষ্ট ছিল। ইসলাম গ্রহণের আগে তিনি মক্কার বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন এবং কুরাইশদের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতেন।

ইসলাম গ্রহণের পূর্ববর্তী জীবন

ইসলাম আবির্ভাবের প্রথম দিকে ওমর (রা.) ছিলেন নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কঠোর বিরোধীদের একজন। তিনি মুসলমানদের প্রতি শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করতেন এবং তাঁদের ওপর নির্যাতনে অংশ নিতেন। তাঁর কঠোর স্বভাব ও দৃঢ় বিশ্বাস তাঁকে ইসলামের অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ করে তুলেছিল। অনেক ঐতিহাসিক বর্ণনায় এসেছে যে, এক পর্যায়ে তিনি নবীজীকে হত্যা করার সংকল্প করেছিলেন, যাতে মুসলমানদের আন্দোলন পুরোপুরি দমন করা যায়।

ইসলাম গ্রহণের ঘটনা

তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায় এক ঐতিহাসিক ঘটনায়। নবীজীকে হত্যার উদ্দেশ্যে পথে বের হয়ে তিনি শুনলেন, তাঁর বোন ফাতিমা বিনতে খাত্তাব ও ভগ্নীপতি সাঈদ ইবনে যায়েদ ইসলাম গ্রহণ করেছেন। ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে তিনি কুরআন তিলাওয়াত শুনতে পান। সুরা ত্বা-হা’র আয়াত শুনে তাঁর হৃদয় কেঁপে ওঠে। পবিত্র কুরআনের বাণী তাঁর অন্তরে গভীর প্রভাব ফেলে, এবং তিনি উপলব্ধি করেন যে, এটি মানুষের রচিত কোনো কথা নয়, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ সত্য।

এই অভিজ্ঞতার পর তিনি নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। মুসলমানদের জন্য এটি ছিল এক বিশাল বিজয়, কারণ ওমর (রা.)-এর সাহস, প্রভাব এবং নেতৃত্বগুণ মুসলিম সমাজকে নতুন শক্তি যোগায়। তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর থেকেই মুসলমানরা প্রকাশ্যে ইবাদত করতে শুরু করেন।

গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও ভূমিকা

১. নবীজীর সহচর হিসেবে ভূমিকা: ইসলাম গ্রহণের পর হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) শুধুমাত্র একজন সাধারণ অনুসারী হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেননি; বরং তিনি নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্যতম নিকটতম ও বিশ্বস্ত সহচরে পরিণত হন। বদর, উহুদ, খন্দক, খাইবার এবং হুনায়েনসহ প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ গাজওয়ায় তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং প্রতিটি যুদ্ধে তাঁর অসীম সাহস ও কৌশলগত দক্ষতা নবীজীর জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। বদরের যুদ্ধে তাঁর যুদ্ধদক্ষতা মুসলিম বাহিনীর মনোবল বৃদ্ধি করে এবং শত্রুপক্ষের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।

ওমর (রা.)-এর চরিত্রে ছিল দৃঢ়তা ও নির্ভীকতা, যা মুসলিম বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ও আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলত। তিনি কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক পরামর্শেও নবীজীর কাছে মূল্যবান ছিলেন। তাঁর কঠোর মনোভাব এবং সত্যের পক্ষে আপসহীন অবস্থান ইসলামের শত্রুদের মনে এক ধরনের ভয় এবং মুসলমানদের মনে নিরাপত্তার অনুভূতি সৃষ্টি করেছিল।

২. হিজরত: মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সময় অধিকাংশ মুসলমান গোপনে রাতের আঁধারে শহর ত্যাগ করেছিলেন, কারণ কুরাইশরা মুসলমানদের হিজরত ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছিল। কিন্তু ওমর (রা.)-এর সাহস ছিল অতুলনীয়। তিনি প্রকাশ্যে মক্কার কাবাঘরে গিয়ে কুরাইশদের নেতৃবৃন্দের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন,

“যে তার স্ত্রীকে বিধবা করতে চায়, সন্তানকে পিতৃহীন করতে চায়, সে যেন পথে এসে আমাকে বাধা দেয়।”

এই ঘোষণা শুধু ব্যক্তিগত সাহসিকতার প্রকাশই ছিল না, বরং এটি মুসলমানদের জন্য এক বিশাল প্রেরণা হয়ে ওঠে। তাঁর এই কর্মে মক্কার ইসলামের শত্রুরা বুঝে যায় যে মুসলমানরা আর ভীত-সন্ত্রস্ত জনগোষ্ঠী নয়; বরং তারা দৃঢ় বিশ্বাস ও আত্মত্যাগের মানসিকতা অর্জন করেছে। ইসলামী ইতিহাসে এ ঘটনা অনন্য উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

৩. হুদায়বিয়ার সন্ধি ও পরবর্তী ঘটনা: হিজরতের ছয় বছর পর ৬ হিজরিতে (৬২৮ খ্রিঃ) নবী মুহাম্মদ (সা.) ও মুসলিম বাহিনী কাবা শরিফে ওমরাহ আদায়ের উদ্দেশ্যে মক্কার দিকে অগ্রসর হন। কুরাইশদের বাধার কারণে মক্কার উপকণ্ঠে হুদায়বিয়া নামক স্থানে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা মুসলমানদের জন্য আপাতদৃষ্টিতে অসম এবং অপমানজনক মনে হয়েছিল। চুক্তির শর্তগুলোর মধ্যে ছিল—সেই বছর মুসলমানরা উমরাহ করতে পারবে না, এবং মক্কা থেকে কেউ মদিনায় গেলে তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে; তবে মদিনা থেকে কেউ মক্কায় গেলে তাকে ফেরত দিতে হবে না।

এই শর্তগুলো শুনে ওমর (রা.)-এর মন বিদীর্ণ হয়ে যায়। তিনি নবীজীর কাছে প্রশ্ন করেন, “আমরা কি সত্য ধর্মে নেই? আল্লাহ কি আমাদের সহায় নন?” নবীজী ধৈর্যের সাথে উত্তর দেন, “অবশ্যই।” তবুও তাঁর অন্তরে কষ্ট থেকে যায়। কিন্তু কয়েক মাস পর এই চুক্তির সুফল স্পষ্ট হয়—যুদ্ধবিরতির সুযোগে ইসলাম দ্রুত প্রসার লাভ করে, বহু মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম গ্রহণ করে এবং মুসলিম রাষ্ট্র কূটনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়। তখন ওমর (রা.) স্বীকার করেন, নবীজীর দূরদর্শিতা সত্যিই অসাধারণ ছিল এবং এই চুক্তি ছিল কৌশলগত বিজয়ের এক মাইলফলক।

৪. নবীজীর ইন্তেকালের পর: ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ইন্তেকালের সংবাদ শোনার পর ওমর (রা.) গভীর শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। তিনি প্রথমে বাস্তবতা মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং ক্রোধভরে বলেন, “যে বলবে মুহাম্মদ (সা.) ইন্তেকাল করেছেন, আমি তার মাথা উড়িয়ে দেব। বরং তিনি মূসা (আ.)-এর মতো আল্লাহর কাছে গেছেন এবং আবার ফিরে আসবেন।”

এই পরিস্থিতিতে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) মসজিদে এসে কুরআনের আয়াত পাঠ করেন—

“মুহাম্মদ কেবল একজন রাসূল; তাঁর পূর্বে বহু রাসূল অতিবাহিত হয়েছেন। তিনি যদি মারা যান অথবা নিহত হন, তবে কি তোমরা পেছনে ফিরে যাবে?” (সূরা আলে ইমরান: ১৪৪)

এই আয়াত শোনার পর ওমর (রা.) যেন বাস্তবতায় ফিরে আসেন এবং তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রুধারা প্রবাহিত হয়। তিনি উপলব্ধি করেন, আল্লাহর রাসূলের ইন্তেকাল এক বাস্তবতা এবং উম্মাহকে এখন ঐক্যবদ্ধ থেকে নতুন নেতৃত্বের অধীনে অগ্রসর হতে হবে। এই ঘটনার মাধ্যমে তাঁর আন্তরিকতা, নবীজীর প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং সত্য মেনে নেওয়ার বিনয়ী মানসিকতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

খেলাফতকাল (৬৩৪–৬৪৪ খ্রিঃ): হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর ইন্তেকালের পর ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর দশ বছরের শাসনকাল ইসলামী ইতিহাসের এক সুবর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত, কারণ এই সময়ে ইসলামী রাষ্ট্র অভূতপূর্ব ভূখণ্ড বিস্তার, প্রশাসনিক কাঠামো উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং অর্থনৈতিক সংস্কারে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করে।

প্রশাসনিক সংস্কার

প্রদেশ ব্যবস্থা: ওমর (রা.)-এর শাসনামলে দ্রুত বিস্তৃত সাম্রাজ্যকে কার্যকরভাবে পরিচালনার জন্য তিনি একে বিভিন্ন প্রদেশ ও প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করেন। প্রতিটি প্রদেশে গভর্নর (আমির) নিয়োগ করা হতো, যাঁরা প্রশাসন, কর আদায়, আইনশৃঙ্খলা ও জনগণের কল্যাণের দায়িত্ব পালন করতেন। বড় প্রদেশগুলো আবার জেলায় বিভক্ত ছিল, যাতে স্থানীয় পর্যায়ে শাসন কার্যক্রম দ্রুত ও দক্ষতার সাথে পরিচালিত হয়।

দায়িত্বরতদের জবাবদিহিতা: ওমর (রা.) কর্মকর্তাদের আর্থিক ও নৈতিক জবাবদিহিতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তিনি গভর্নর ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব রাখতে বাধ্য করতেন এবং দায়িত্ব গ্রহণের আগে ও পরে তাঁদের সম্পদ তালিকা সংগ্রহ করতেন, যাতে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা যায়। দায়িত্বে অবহেলা বা অনিয়ম প্রমাণিত হলে তিনি বিনা দ্বিধায় তাঁদের অপসারণ করতেন।

দেওয়ান ব্যবস্থা: তাঁর আমলে প্রবর্তিত দেওয়ান ছিল প্রশাসনিক নথিপত্র সংরক্ষণ ও বেতন ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সুশৃঙ্খল রেজিস্ট্রি সিস্টেম। এতে সেনাবাহিনীর সদস্যদের নাম, পদমর্যাদা, দায়িত্ব ও বেতন নির্ধারণের রেকর্ড রাখা হতো। এটি ছিল মুসলিম রাষ্ট্রে প্রথম আধুনিক আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর ভিত্তি।

জনগণের সাথে সরাসরি যোগাযোগ: ওমর (রা.) মদিনার মসজিদে নিয়মিত বসে জনতার অভিযোগ ও পরামর্শ শুনতেন। এভাবে তিনি সাধারণ জনগণকে শাসকের সাথে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ দেন, যা একাধারে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করত। তিনি রাত্রিকালীন টহলেও বের হতেন, যাতে নিজ চোখে জনগণের অবস্থা দেখতে পারেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে সমস্যা সমাধান করতে পারেন।

অর্থনৈতিক সংস্কার

বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠা: ওমর (রা.) রাষ্ট্রীয় অর্থব্যবস্থাকে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনার জন্য বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠা করেন। এতে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ, কর, খাজনা ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় আয় জমা রাখা হতো এবং তা জনকল্যাণে ব্যয় করা হতো। তিনি এই তহবিলের অপচয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন।

ভূমি কর ও খাজনা ব্যবস্থা: তিনি কৃষিজমি ও অন্যান্য উৎপাদনশীল সম্পদের ওপর ন্যায়সঙ্গত কর আরোপ করেন। মুসলিম ও অমুসলিম উভয়েই কর দিত, তবে করহার ছিল সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে নির্ধারিত। যুদ্ধবন্দী ও চুক্তিভিত্তিক অমুসলিম প্রজারা জিজিয়া কর দিত, কিন্তু বিনিময়ে রাষ্ট্র তাঁদের জীবন, সম্পদ ও ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করত।

গরিব ও এতিমদের জন্য ভাতা:তাঁর শাসনামলে দরিদ্র, এতিম, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও বয়স্কদের জন্য নিয়মিত ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা ছিল, যা ইতিহাসে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উদাহরণ। শিশুদের জন্য দুধ ও খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।

বিচার ব্যবস্থা

কাজী নিয়োগ: তিনি প্রতিটি প্রদেশে স্বতন্ত্র বিচার বিভাগ গঠন করেন এবং সেখানকার জন্য ন্যায়পরায়ণ ও যোগ্য বিচারক (কাজী) নিয়োগ করেন। কাজীরা স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করতেন, এবং শাসক পর্যন্ত তাঁদের সিদ্ধান্ত মেনে চলতেন।

আইনের শাসন: ওমর (রা.) দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, শাসকসহ সকলেই আইনের অধীন। একাধিক ঘটনায় দেখা যায়, তিনি সাধারণ নাগরিকের মতো আদালতে হাজির হয়েছেন এবং মামলার রায় নিজের বিপক্ষে গেলে তা বিনা আপত্তিতে মেনে নিয়েছেন। তাঁর এই নীতি আইনের শাসনের প্রকৃত রূপ তুলে ধরে, যা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।

সামরিক ও ভূখণ্ড বিস্তার: হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর খেলাফতকাল ইসলামী সাম্রাজ্যের ভূখণ্ড বিস্তারের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব সময় হিসেবে চিহ্নিত। মাত্র দশ বছরের শাসনামলে তিনি ইসলামী রাষ্ট্রকে আরব উপদ্বীপের বাইরে প্রসারিত করে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা এবং পারস্যের বিশাল অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করেন। এই বিস্তার ছিল শুধু সামরিক শক্তির ফল নয়, বরং দক্ষ কৌশল, শৃঙ্খলাবদ্ধ সেনাবাহিনী, ন্যায়নিষ্ঠ শাসননীতি এবং বিজিত জনগণের সাথে মানবিক আচরণের সমন্বিত ফল।

পারস্য জয়: পারস্যের সাসানীয় সাম্রাজ্য তখনকার বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল। তবে ধারাবাহিক সংঘর্ষে তারা দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং ওমর (রা.)-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী এই সুযোগকে কাজে লাগায়।

কাদিসিয়ার যুদ্ধ (৬৩৬ খ্রিঃ): এই ঐতিহাসিক যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী সাসানীয় সেনাদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে। যুদ্ধটি কয়েক দিন ধরে চলে এবং মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)।

নাহাওয়ান্দের যুদ্ধ (৬৪২ খ্রিঃ): “বিজয়ের বিজয়” নামে পরিচিত এই যুদ্ধের মাধ্যমে সাসানীয় সাম্রাজ্যের পতন সম্পূর্ণ হয়। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই পারস্য সম্পূর্ণ মুসলিম শাসনের অধীনে আসে।এই বিজয় শুধু ভৌগোলিক বিস্তারই নয়, বরং ইসলামী সভ্যতার সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করে, কারণ পারস্যের উন্নত প্রশাসনিক পদ্ধতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইসলামী রাষ্ট্রে যুক্ত হয়।

রোমান ভূখণ্ড জয়:পূর্ব রোমান বা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যও তখন মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করছিল। তবে একাধিক যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী ধারাবাহিক সাফল্য অর্জন করে।

ইয়ামুকের যুদ্ধ (৬৩৬ খ্রিঃ): সিরিয়ার ইয়ামুক নদীর তীরে সংঘটিত এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী বিশাল বিজয় অর্জন করে, যার ফলে সিরিয়া এবং প্যালেস্টাইন মুসলিম শাসনের অধীনে আসে। এই যুদ্ধে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) অসামান্য নেতৃত্বের পরিচয় দেন।

মিশর বিজয় (৬৩৯–৬৪২ খ্রিঃ): আমর ইবনে আস (রা.)-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী মিশর জয় করে। মিশরের কপটিক খ্রিস্টান জনগণ রোমান শাসনের নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেয়ে মুসলিম শাসনকে স্বাগত জানায়।

এই বিজয়গুলো মুসলিম রাষ্ট্রকে সমুদ্রপথে বাণিজ্য ও কৌশলগত অবস্থানে শক্তিশালী করে তোলে।

জেরুজালেম দখল:

জেরুজালেম ছিল খ্রিস্টান ও ইহুদিদের জন্য পবিত্র নগরী। ইয়ামুক যুদ্ধে বাইজান্টাইন বাহিনী পরাজিত হওয়ার পর নগরীর নেতারা আত্মসমর্পণের শর্তে ওমর (রা.)-এর কাছে চাবি হস্তান্তর করতে সম্মত হয়, তবে শর্ত ছিল যে, খলিফা নিজে এসে চাবি গ্রহণ করবেন।

ওমর (রা.) সাধারণ পোশাকে, এক উট ও একজন খাদেমসহ মদিনা থেকে জেরুজালেমে আসেন। তাঁর সরলতা, ন্যায়বিচার ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা খ্রিস্টান নেতাদের মুগ্ধ করে। তিনি শহরে প্রবেশ করে খ্রিস্টান ও ইহুদিদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দেন এবং তাঁদের উপাসনালয় রক্ষা করার নির্দেশ দেন। এই ঘটনা ইসলামী শাসনের সহিষ্ণুতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

সাফল্য ও অবদান

ন্যায়বিচারের প্রতীক – “আল-ফারুক”: ওমর (রা.)-এর অটল ন্যায়পরায়ণতার কারণে তিনি “আল-ফারুক” উপাধি লাভ করেন, যার অর্থ সত্য ও মিথ্যার মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্যকারী। তাঁর শাসনে ধনী-গরিব, মুসলিম-অমুসলিম—সকলের জন্য সমান বিচার নিশ্চিত করা হতো।

রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের আধুনিকীকরণ: তাঁর শাসনে প্রদেশভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো, কর ব্যবস্থা, সেনাবাহিনীর রেজিস্ট্রি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, ডাক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। এটি ছিল মুসলিম বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক সংস্কার।

সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা: তিনি দরিদ্র, এতিম, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও বয়স্কদের জন্য নিয়মিত ভাতা চালু করেন। যুদ্ধাহত সৈনিকদের জন্যও রাষ্ট্রীয় সহায়তার ব্যবস্থা করেন।

শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তার: নতুন অঞ্চলে মসজিদ ও মক্তব প্রতিষ্ঠা করে কুরআন শিক্ষা ও সাধারণ জ্ঞানচর্চার প্রসার ঘটান। বিজিত এলাকায় ইসলামী শিক্ষা ও স্থানীয় জ্ঞানের মেলবন্ধন ঘটাতে সহায়তা করেন।

ধর্মীয় সহিষ্ণুতা: বিজিত অমুসলিম জনগণকে তাঁদের ধর্ম পালনে পূর্ণ স্বাধীনতা দেন এবং তাঁদের উপাসনালয় সংরক্ষণ করেন। তিনি চুক্তিভিত্তিক নিরাপত্তা ও কর ব্যবস্থার মাধ্যমে মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে সহাবস্থান নিশ্চিত করেন।

রাস্তা ও অবকাঠামো উন্নয়ন: তিনি সড়ক, সেতু, কূপ, খাল এবং পানীয় জলের ব্যবস্থা উন্নত করেন। ডাক ব্যবস্থা ও সীমান্ত প্রতিরক্ষা জোরদার করেন, যা বাণিজ্য, যোগাযোগ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে।

শহীদ হওয়া

৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ফজরের নামাজ আদায়ের সময় এক অমুসলিম দাস আবু লুলু ফিরোজ তাঁকে ছুরিকাঘাত করে। কয়েকদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর আগে তিনি শুরা কমিটি গঠন করে পরবর্তী খলিফা নির্বাচন করার নির্দেশ দেন। তাঁকে মদীনায় নবীজীর পাশে দাফন করা হয়।

ইতিহাসে স্থান ও প্রভাব

হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) কেবল ইসলামের দ্বিতীয় খলিফাই নন, তিনি ছিলেন এমন এক দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক, যিনি নেতৃত্ব, প্রশাসনিক প্রজ্ঞা ও নৈতিক দৃঢ়তার মাধ্যমে বিশ্ব ইতিহাসে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন। তাঁর কঠোর ন্যায়বিচার, দৃঢ় প্রশাসন, স্বচ্ছ জবাবদিহিতা এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণে অবিচল মনোভাব তাঁকে মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে।

তাঁর শাসনকাল প্রমাণ করেছে যে একটি রাষ্ট্র কেবল সামরিক শক্তি বা ভূখণ্ড বিস্তারের মাধ্যমে নয়, বরং সুশাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং নৈতিক শৃঙ্খলার মাধ্যমে স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ হতে পারে। ওমর (রা.) এমন এক কাঠামোগত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, যেখানে প্রদেশভিত্তিক শাসন, করনীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সামরিক সংগঠন এবং সামাজিক নিরাপত্তা একে অপরের সাথে সমন্বিত ছিল। এই মডেল পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে মুসলিম সাম্রাজ্যের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।

আধুনিক ঐতিহাসিক, বিশেষত পশ্চিমা গবেষকরাও তাঁকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক থমাস আর্নল্ড ও জর্জ সার্টন তাঁর শাসনকে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও নৈতিক নেতৃত্বের বিরল সমন্বয় বলে অভিহিত করেছেন। এমনকি অমুসলিম গবেষকরাও স্বীকার করেছেন, তাঁর শাসনব্যবস্থা ছিল অগ্রসরমান রাষ্ট্র পরিচালনার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

তাঁর নেতৃত্বে ইসলামী রাষ্ট্র শুধু ভূখণ্ডগতভাবে নয়, বরং প্রশাসনিক ও নৈতিক ক্ষেত্রেও এক সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী রূপ লাভ করে। তিনি রাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে যেমন কঠোর ছিলেন, তেমনি দরিদ্র, এতিম, বিধবা ও অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় ছিলেন অসীম সহৃদয়। ফলে বিজিত অঞ্চলের অনেক জনগণ মুসলিম শাসনকে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে, যা ইসলামের শান্তিপূর্ণ বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ওমর (রা.)-এর মৃত্যুর পরও তাঁর প্রবর্তিত নীতি, আইন ও সংস্কার শতাব্দীর পর শতাব্দী মুসলিম শাসনব্যবস্থায় কার্যকর ছিল। তাঁর ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা, এবং জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ পরবর্তী খলিফা, শাসক ও নেতাদের জন্য আদর্শ হয়ে থাকে।

হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) ছিলেন এমন এক বিরল চরিত্র, যাঁর জীবন মুসলিম উম্মাহর জন্য অনন্ত অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনার উৎস। ইসলাম গ্রহণের আগে একজন দৃঢ় প্রতিপক্ষ থেকে তিনি রূপান্তরিত হয়েছিলেন ইসলামের এক অকুতোভয় রক্ষক ও সংস্কারক নেতায়। তাঁর খেলাফতের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল ঈমান, সাহস, ন্যায়বিচার, বিনয় এবং জনকল্যাণমূলক উদ্যোগের প্রতিফলন।

তিনি প্রমাণ করেছিলেন, একজন শাসকের শক্তি কেবল সামরিক ক্ষমতায় নয়, বরং ন্যায়পরায়ণতা, সততা, এবং প্রজাদের কল্যাণে নিবেদিত নেতৃত্বে নিহিত। তাঁর প্রতিষ্ঠিত নীতি ও দৃষ্টান্ত কেবল ইসলামী সভ্যতার সোনালি অধ্যায় রচনা করেনি, বরং মানব ইতিহাসেও আদর্শ রাষ্ট্রনায়কত্বের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তাঁর জীবন ও শাসন আজও আমাদের শেখায়—ন্যায় ও সত্যের পথে অবিচল থাকলে একটি জাতি শুধু টিকে থাকে না, বরং ইতিহাসে অমর হয়ে যায়।


হুয়াংহে নদীর তীরে এক মহাজাতির উত্থান: চীনা সভ্যতার আদিগন্ত ইতিহাস

২০২৫ আগস্ট ০২ ১৬:১৩:৪৬
হুয়াংহে নদীর তীরে এক মহাজাতির উত্থান: চীনা সভ্যতার আদিগন্ত ইতিহাস

দক্ষিণ এশিয়ার পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এক বিস্ময়কর ভূখণ্ড—চীন। পাহাড়, মরুভূমি, নদীনালা আর বিস্তৃত সমভূমির মাঝে হাজার হাজার বছরের এক বর্ণাঢ্য ইতিহাস ধারণ করে আছে এই দেশটি। প্রাচীন চীন কোনো একক রাজ্যের নয়, বরং এক মহাজাতির আত্মপরিচয়, দর্শন ও ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। আজকের চীন শুধু একটি আধুনিক রাষ্ট্র নয়—এর জন্ম, বিকাশ ও বিস্তার এক মহাকাব্যিক যাত্রা।

হুয়াংহে নদী: সভ্যতার জননী

প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে, পৃথিবীর মানচিত্র তখনো গঠিত হয়নি, নগরায়নও শুরু হয়নি। কিন্তু আজকের চীনের উত্তরাংশে এক নদী—হুয়াংহে, বা ‘হলুদ নদী’—বয়ে চলেছিল। কখনও শান্ত, কখনও করাল; এই নদী ছিল একদিকে মৃত্যুর কারণ, অপরদিকে প্রাণের উৎস। এই নদীকে ঘিরেই গড়ে ওঠে হুয়াশিয়া নামক সভ্যতা, যেটি চীনের ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির বীজ রোপণ করে।

গবেষণা বলছে, হুয়াংহে নদীর তীরে গড়ে ওঠা ন্যাঙ্গাও ও লুয়াংঝু সংস্কৃতির মানুষ কৃষি করত, পশুপালন করত, আর মৃত্তিকা দিয়ে গৃহস্থালির পাত্র বানাতো। তারা ধর্মীয় রীতিতে বিশ্বাস করত এবং সমাজবদ্ধ জীবনযাপন করত। এদের ধাতব অস্ত্র ছিল না, রাজাও ছিল না, কিন্তু ছিল চিন্তা, দর্শন এবং শিল্প।

শিয়া রাজবংশ: কিংবদন্তির ইতিহাস

হুয়াংহে নদীভিত্তিক সভ্যতার ধারাবাহিকতায় চীনের প্রথম কিংবদন্তীতুল্য রাজবংশ ছিল ‘শিয়া’। যদিও এই রাজবংশের কোনো লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তথাপি ‘গ্রেট ইউ’-এর বাঁধ নির্মাণ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের কাহিনী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে। তাকে চীনের প্রথম রাজা হিসেবে স্মরণ করা হয়।

এই পর্যায়ে আকাশপূজা, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ড্রাগনের ধারণা সমাজে গুরুত্ব পেতে শুরু করে। ড্রাগন এখানে ছিল শক্তি, বৃষ্টি ও রাজত্বের প্রতীক। স্বর্গের অনুমোদন ব্যতীত কেউ রাজা হতে পারবে না—এই বিশ্বাস থেকেই জন্ম নেয় "Mandate of Heaven" ধারণা, যা পরবর্তী চীনা রাজতন্ত্রের মৌলিক নৈতিক ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।

সাং রাজবংশ: লিখিত ইতিহাসের শুরু

খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ থেকে ১০৪৬ অব্দ পর্যন্ত স্থায়ী সাং বা শ্যাং রাজবংশ ছিল চীনের প্রথম প্রমাণিত শাসনব্যবস্থা। এই রাজবংশের হাতে গড়ে ওঠে সংগঠিত প্রশাসন, শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও কর ব্যবস্থা। রাজারা নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি মনে করত এবং পূর্বপুরুষদের আত্মাকে সম্মান জানাতো।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার ছিল অরেকেল বোনস—গরুর হাড় বা কচ্ছপের খোলে খোদাই করা প্রতীক, যা আগুনে গরম করে ফাটলের মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী করা হতো। এই প্রতীকগুলোই চীনা ভাষার প্রাচীনতম রূপ জিয়াগুয়ানের সূচনা করেছে। পাশাপাশি সাং রাজবংশ ব্রোঞ্জ প্রযুক্তি এবং যুদ্ধ সংস্কৃতিতে চীনের ভিত মজবুত করে।

ঝৌ রাজবংশ: চীনা দর্শনের অগ্রযাত্রা

খ্রিস্টপূর্ব ১০৪৬ সালে ঝৌদের রাজা উ একটি বিশাল যুদ্ধে সাং রাজবংশকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধ ছিল কেবল সামরিক বিজয় নয়, বরং এক নতুন রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিষ্ঠা। “Mandate of Heaven” ধারণার ওপর ভিত্তি করে ঝৌ শাসকরা স্বর্গীয় অনুমোদনের মাধ্যমে তাদের শাসনের বৈধতা প্রতিষ্ঠা করে।

ঝৌ রাজবংশ ছিল ইতিহাসের দীর্ঘতম—প্রায় ৮০০ বছর। এই সময়েই গড়ে ওঠে সমাজ শ্রেণীবিন্যাস (শাসক, কৃষক, কারিগর, ব্যবসায়ী), ধর্মীয় রীতিনীতির পরিশীলন, এবং ৫ উপাদান তত্ত্ব—আগুন, জল, মাটি, ধাতু ও কাঠ। পাশাপাশি সমাজে শুরু হয় দার্শনিক আত্মানুসন্ধান।

আত্মার জন্ম: কনফিউশনিজম ও টাওইজমের বীজ

ঝৌ যুগের শেষার্ধে চীন বিভক্ত হতে থাকে ছোট ছোট রাজ্যে। যুদ্ধ, বিশৃঙ্খলা আর কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতার মধ্যেও জন্ম নেয় চিন্তা, দর্শন এবং আত্মপরিচয়ের খোঁজ। এখানেই সূচনা হয় চীনের দুই মহান দার্শনিক ধারা—কনফিউশনিজম এবং টাওইজম—যা আগামী হাজার বছর ধরে চীনের সামাজিক কাঠামো, শাসন ও মূল্যবোধ গঠনে গভীর প্রভাব ফেলে।

সময়ের গভীরে গাঁথা চীনের আত্মপরিচয়

হুয়াংহে নদীর পলিমাটি শুধু চাষযোগ্য জমি তৈরি করেনি, বরং ধারণ করেছে এক জাতির ইতিহাস, দর্শন এবং সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়। শিয়া থেকে ঝৌ—প্রতিটি রাজবংশ, প্রতিটি আবিষ্কার, প্রতিটি বিশ্বাস গড়ে তুলেছে এমন এক চীন, যা সময়ের চেয়ে প্রাচীন, কল্পনার চেয়েও বিস্তৃত।

আজকের আধুনিক চীন যখন অর্থনীতিতে, ভূরাজনীতিতে এবং প্রযুক্তিতে বিশ্বমঞ্চে নেতৃত্ব দেয়, তখন তার শেকড় ফিরে যায় সেই প্রাচীন হুয়াংহে নদীর তীরে গড়ে ওঠা এক নিরব, অথচ প্রবল, সভ্যতায়।


শতাব্দীর প্রভাবশালী দলিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র—চতুর্থ তথা শেষ পর্বের শেষাংশ

২০২৫ জুলাই ১৯ ০০:৫৭:৪৫
শতাব্দীর প্রভাবশালী দলিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র—চতুর্থ তথা শেষ পর্বের শেষাংশ

রাজনৈতিক দর্শনের ইতিহাসে এক অনন্য দলিল হলো কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। জার্মান ভাষায় এর মূল নাম “Manifesto der KommunistischenPartei”, অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার। বিখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালে এটি লিখেন, যা প্রথম প্রকাশিত হয় লন্ডনে। ১৮৪৮ সালে যখন এটি ইউরোপে প্রকাশিত হয়, তখনকার বিপ্লবাত্মক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি ছিল এক যুগান্তকারী লেখা। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-কে আজও বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলিলগুলোর অন্যতম বলে বিবেচনা করা হয়।

এই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির চারটি অধ্যায় রয়েছে। ধারাবাহিক ভাবে আমরা এর ভাবানুনাদ পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি। আজ আমরা চতুর্থ তথা শেষ পর্বের শেষাংশে কমিউনিজমের নীতিমালার ১৯ থেকে ২৫ প্রশ্নোত্তর পর্ব-এর সরল, পরিশীলিত ভাষান্তর পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করছি। পাশাপাশি“জার্মানিতে কমিউনিস্ট পার্টির দাবিসমূহ” (১৮৪৮) ওপ্যারিস কমিউন ও মে ১৮৭১-এর ভাষণ (The Civil War in France) পাঠকদের কাছে সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করেছি।আশাকরি পাঠকরা সহজভাবে এর মূল ভাবনা ও তাৎপর্য বুঝতে পারবেন।

১৯। এই বিপ্লব কি একটি মাত্র দেশে সংঘটিত হওয়া সম্ভব?

না, সম্ভব নয়। বৃহৎ শিল্প এমন একটি বিশ্ববাজার সৃষ্টি করেছে, যা পৃথিবীর সমস্ত জাতিকেবিশেষত সভ্য জাতিগুলোকেএমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যুক্ত করেছে যে, একটির ভাগ্য অন্যটির থেকে আলাদা হয়ে থাকতে পারে না।

বৃহৎ শিল্প একই সঙ্গে সভ্য দেশগুলোর সামাজিক বিকাশকে এতটাই সমন্বিত করেছে যে, প্রতিটি দেশেই বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত শ্রেণি সমাজের নির্ধারক শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে এবং এই দুই শ্রেণির মধ্যকার সংগ্রামই হয়ে উঠেছে যুগের প্রধান সংগ্রাম।

এর ফলাফল হলো, কমিউনিস্ট বিপ্লব কোনো একটি দেশে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, বরং এটি সমস্ত সভ্য দেশে একইসঙ্গে সংঘটিত হতে হবেঅন্তত ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স এবং জার্মানিতে।এই বিপ্লব প্রতিটি দেশে বিভিন্ন গতিতে অগ্রসর হবে, নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট দেশের শিল্পের বিকাশ, সম্পদের পরিমাণ এবং উৎপাদনশীল শক্তির পরিসরের ওপর। এই বিপ্লব জার্মানিতে সবচেয়ে ধীরে ও সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হবে, আর ইংল্যান্ডে সবচেয়ে দ্রুত ও সবচেয়ে কম বাধার মধ্যে দিয়ে সফল হবে।

এই বিপ্লব পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ওপরও শক্তিশালী প্রভাব ফেলবে এবং তাদের এতদিনের অনুসৃত বিকাশপথকে পুরোপুরি পাল্টে দেবে, সেইসঙ্গে সেই বিকাশের গতি আরও বহুগুণে বাড়াবে।এটি একটি সর্বজনীন বিপ্লব হবে এবং এর প্রভাবও হবে সর্বজনীন।

২০। ব্যক্তিগত সম্পত্তির চূড়ান্ত বিলুপ্তির ফলে কী কী পরিণতি হবে?

সমাজ তখন সমস্ত উৎপাদনশক্তি ও বাণিজ্য মাধ্যমঅর্থাৎ পণ্য বিনিময় ও বণ্টনের উপায়ব্যক্তিগত পুঁজিপতিদের হাত থেকে নিজেদের হাতে তুলে নেবে এবং সেগুলো পরিচালনা করবে একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনার আলোকে, সম্পদের প্রাপ্যতা ও সমগ্র সমাজের প্রয়োজন অনুসারে।

এইভাবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পরিবর্তনটি ঘটবে তা হলোবর্তমানে বৃহৎ শিল্পের পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে সমস্ত অকল্যাণকর পরিণতি রয়েছে, তা সম্পূর্ণরূপে দূর হয়ে যাবে।

আর কোনো বাণিজ্যিক মন্দা (crisis) থাকবে না; বর্তমানে যে ব্যাপক উৎপাদন সমাজব্যবস্থার চোখে ‘অতিরিক্ত উৎপাদন’ হিসেবে দুঃখ-কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, ভবিষ্যতের সমাজে সেটাই পরিণত হবে একটি অপর্যাপ্ত পরিমাণে, যা আরও সম্প্রসারণের প্রয়োজন হবে।

এভাবে, ‘অতিরিক্ত উৎপাদন’ তখন আর দুঃখ-কষ্টের কারণ হবে না, বরং তা সমাজের মৌলিক প্রয়োজনের বাইরেও সব সদস্যের চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে; এটি সৃষ্টি করবে নতুন চাহিদা এবং সেই চাহিদা পূরণের উপায়ও। এটি তখন নতুন অগ্রগতির উৎস ও প্রেরণা হয়ে উঠবেএমন অগ্রগতি, যা অতীতের মতো সমাজকে বিশৃঙ্খলায় ফেলবে না।

ব্যক্তিগত মালিকানা থেকে মুক্ত বৃহৎ শিল্প তখন এমন মাত্রায় বিস্তার লাভ করবে যে, বর্তমান সময়ের শিল্পকারখানা তার তুলনায় নগণ্য বলে মনে হবে, যেমনভাবে অতীতের হস্তশিল্প বর্তমানের শিল্পের তুলনায় নগণ্য।

এই শিল্পোন্নয়ন সমাজকে এমন বিপুল পরিমাণ পণ্য সরবরাহ করতে পারবে, যা প্রত্যেক সদস্যের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হবে।

এটাই কৃষিক্ষেত্রেও ঘটবে, যা ব্যক্তিগত মালিকানার চাপে আটকে রয়েছে এবং জমির খণ্ডায়ণের (fragmentation) ফলে দমবন্ধ হয়ে আছে। সেখানে বিদ্যমান প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে এক বিশাল অগ্রগতি সম্ভব হবে, যা সমাজকে সমস্ত প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য সরবরাহ করতে পারবে।এভাবে, সমাজের প্রতিটি সদস্যের চাহিদা পূরণের মতো পণ্যের প্রাচুর্য সৃষ্টি হবে।

সমাজের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ শ্রেণীগুলোর বিভাজন তখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। বরং এটি শুধু অপ্রয়োজনীয়ই নয়, বরং নতুন সমাজব্যবস্থায় তা সম্পূর্ণরূপে অসহনীয় হবে।শ্রেণী ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে শ্রম বিভাজন থেকে, এবং যে ধরনের শ্রম বিভাজন আমরা আজ পর্যন্ত দেখেছি, তা সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যাবে। কারণ, শুধুমাত্র যান্ত্রিক বা রাসায়নিক প্রক্রিয়া যথেষ্ট নয়শিল্প ও কৃষিজ উৎপাদনের উন্নয়ন ঘটাতে হলে মানুষের ক্ষমতা ও দক্ষতাও সমানভাবে বিকশিত হতে হবে।

যেমনভাবে কৃষক ও কারিগররা গত শতাব্দীতে বৃহৎ শিল্পের অংশে পরিণত হয়ে সম্পূর্ণভাবে তাদের জীবনধারা পরিবর্তন করেছে এবং একদম নতুন মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে, তেমনি, যখন সমাজ-সমগ্রের হাতে উৎপাদনের উপর নিয়ন্ত্রণ চলে আসবে এবং তার ফলে যে নতুন উন্নয়ন ঘটবে, তা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের মানুষের প্রয়োজন তৈরি করবে।মানুষ তখন আর আজকের মতো একটি নির্দিষ্ট উৎপাদনশাখার দাস হয়ে থাকবে না, বরং তারা আর শোষিত হবে না, নিজেদের একটি ক্ষমতা বিকাশের বিনিময়ে অন্য সব ক্ষমতা উপেক্ষিত হবে না। তারা আর কোনো একটি পেশা বা কোনো একটি শাখার উপশাখা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে না। এমনকি আজকের শিল্পও এমন এক ধরনের একপাক্ষিক মানুষের আর প্রয়োজন অনুভব করছে না।

সমগ্র সমাজের হাতে নিয়ন্ত্রিত শিল্প এবং পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত উৎপাদনব্যবস্থা কেবল তখনই কার্যকর হতে পারে যখন সামগ্রিকভাবে বিকশিত দক্ষতার অধিকারী সর্বাঙ্গীণ মানুষ থাকবে, যারা উৎপাদন ব্যবস্থাকে একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া হিসেবে বুঝতে ও পরিচালনা করতে পারবে।এইভাবে, যে শ্রম বিভাজন মানুষকে কৃষক, মুচি, শ্রমিক বা স্টক মার্কেটের দালালে পরিণত করেছে, তা ইতোমধ্যে যন্ত্রায়নের মাধ্যমে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে এবং অচিরেই সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

শিক্ষাব্যবস্থা তখন মানুষকে দ্রুত সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে পরিচিত করে তুলবে এবং সমাজের প্রয়োজন কিংবা ব্যক্তিগত আগ্রহ অনুসারে এক শাখা থেকে অন্য শাখায় কাজ পরিবর্তনের সুযোগ দেবে। এইভাবে, বর্তমানের একপাক্ষিকতা থেকে মানুষ মুক্ত হবে। এবং কমিউনিস্ট সমাজ তাদের সমগ্ররূপে বিকশিত ক্ষমতাগুলোকে পূর্ণভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ দেবে। আর একবার তা সম্ভব হলে, শ্রেণী ব্যবস্থার বিলুপ্তি অনিবার্য। অর্থাৎ, কমিউনিজমের ভিত্তিতে সংগঠিত সমাজব্যবস্থার সাথে শ্রেণীবিভাজন কখনোই মানানসই নয়, আবার সেই সমাজব্যবস্থার গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই শ্রেণীবিভেদ বিলুপ্তির সমস্ত উপাদান প্রস্তুত হবে।

সমাজের সব সদস্যের যৌথ প্রচেষ্টা দ্বারা উৎপাদনশক্তির পরিকল্পিত ব্যবহার, উৎপাদনের এমন মাত্রায় সম্প্রসারণ যা সকলের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়, কিছু মানুষের প্রয়োজন মেটাতে অন্যদের প্রয়োজন উপেক্ষার সংস্কৃতির বিলুপ্তি, শ্রেণী ও তাদের সংঘাতের পূর্ণ অবসান, এবং সমাজের প্রত্যেক সদস্যের ক্ষমতার সর্বাঙ্গীণ বিকাশএই সবই ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তির প্রধান প্রধান পরিণতি।

২১। কমিউনিস্ট সমাজের পরিবার ব্যবস্থা ও নারীর অবস্থান কীভাবে পরিবর্তিত হবে?

কমিউনিস্ট সমাজ লিঙ্গসম্পর্ককে একটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়ে রূপান্তর করবে, যা কেবল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যকার বিষয় থাকবেসমাজ সেখানে হস্তক্ষেপ করবে না।এই রূপান্তর সম্ভব হবে কারণ এই সমাজ ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তি ঘটাবে এবং সন্তানদের জাতীয় খরচে, জাতীয় প্রতিষ্ঠানে গড়ে তুলবে।ফলে ঐতিহ্যবাহী বিবাহ ব্যবস্থার দুইটি ভিত্তিনারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব এবং সন্তানের উপর পিতামাতার নির্ভরতাএই উভয়ই লুপ্ত হবে।এখানেই উত্তর মেলে সেই তথাকথিত "নারী সমাজভুক্তির" বিরুদ্ধে তথাকথিত উচ্চ নৈতিকতা সম্পন্ন ধনিক শ্রেণির চিৎকারের।

আসলে নারী সমাজভুক্তি বা নারী ভাগাভাগির সংস্কৃতি পুরোপুরি ধনিক সমাজের অবদান, যার চূড়ান্ত রূপ আজকের বেশ্যাবৃত্তি।আর বেশ্যাবৃত্তি ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে এবং এই ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তির সাথেই এর পতন ঘটে। অতএব, কমিউনিস্ট সমাজ নারী সমাজভুক্তিকে প্রবর্তন করবে না, বরং তা বিলুপ্ত করে দেবে।

২২। বিদ্যমান জাতীয়তাগুলোর প্রতি কমিউনিজমের মনোভাব কী?

কমিউনিজমে ঐক্যবদ্ধভাবে যে জাতিগুলো একত্রিত হবে, তারা পারস্পরিক সংমিশ্রণে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে এবং নিজেদের জাতীয় সত্তা হারাবে, যেমনভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তির মাধ্যমে শ্রেণী ও বর্ণবিভাজন বিলুপ্ত হবে।

২৩। ধর্ম নিয়ে কমিউনিজমের দৃষ্টিভঙ্গি কী?

সব ধর্মই বিভিন্ন জাতি বা গোষ্ঠীর ঐতিহাসিক বিকাশপর্বের প্রতিফলন। কিন্তু কমিউনিজম এমন একটি ঐতিহাসিক বিকাশপর্যায়, যা সব বিদ্যমান ধর্মকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলে এবং তা ধীরে ধীরে নির্মূল করে দেয়।

২৪। সমাজতন্ত্রীদের থেকে কমিউনিস্টদের পার্থক্য কী?

সমাজতন্ত্রী নামে পরিচিতরা মূলত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত:

১। প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রী:

এই শ্রেণিটি হল সেইসব সমাজতন্ত্রী যারা একটি পুরনো সামন্তবাদী এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রতি অনুগত, যা বৃহৎ শিল্প এবং বিশ্ববাণিজ্যের মাধ্যমে প্রতিদিনই ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে, এবং যা ধনিক সমাজ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে।এই শ্রেণির লোকেরা বর্তমান সমাজের দুর্দশা দেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, আগের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ফিরে যেতে হবে, কারণ তা ছিল এসব সমস্যামুক্ত। তাদের সব প্রস্তাবের উদ্দেশ্য এই প্রতিক্রিয়াশীল লক্ষ্যই।

কমিউনিস্টরা এই শ্রেণির সমাজতন্ত্রীদের বিরোধিতা করে তিনটি কারণে:

(i) তারা এমন কিছুর জন্য সংগ্রাম করে যা একেবারেই অসম্ভব।

(ii) তারা এমন একটি সমাজ গঠন করতে চায়, যেখানে শাসন করবে জমিদার, গিল্ডমাস্টার, ক্ষুদ্র উৎপাদক, রাজা, পুরোহিত, এবং সৈনিকদের নেতৃত্বাধীন পুরাতন ব্যবস্থাযা আজকের সমাজের মতোই বিপদজনক এবং শ্রমজীবী শ্রেণির মুক্তির কোনো পথও সেখানে নেই।

(iii) এবং অবশেষে, যখনই শ্রমিক শ্রেণি বিদ্রোহী ও কমিউনিস্ট হয়ে ওঠে, তখন এই প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রীরা মুখোশ খুলে ফেলেন এবং ধনিক শ্রেণির পাশে গিয়ে দাঁড়ান।

ধনিক সমাজতন্ত্রী:

এইশ্রেণিটি গঠিত হয়েছে বর্তমান ধনিক সমাজেরই সমর্থকদের দ্বারা, যারা সমাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন।তাদের উদ্দেশ্য হল: এই ধনিক সমাজকে টিকিয়ে রাখা, কিন্তু তার ভেতরের সমস্যাগুলোকে কোনওভাবে মেরামত করা।এজন্য কেউ কেউ সামান্য দান-অনুদানের প্রস্তাব দেন, আবার কেউ কেউ জাঁকজমকপূর্ণ সমাজ সংস্কার পরিকল্পনা পেশ করেনযার লক্ষ্য সমাজকে নতুন রূপ দেওয়া নয়, বরং পুরনো ধনিক সমাজকেই টিকিয়ে রাখা।

কমিউনিস্টদের অবশ্যই এই ধনিক সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করতে হবে, কারণ তারা তাদের আসল শত্রুদের সেবায় নিয়োজিত এবং সেই সমাজকেই রক্ষা করে, যেটিকে কমিউনিস্টরা ধ্বংস করতে চায়।

গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী:

তৃতীয় শ্রেণিটি হল গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী, যারা কমিউনিস্টদের মতোই অনেক প্রস্তাব সমর্থন করেন (যেমন প্রশ্ন ১৮-তে বর্ণিত হয়েছে)।কিন্তু এই প্রস্তাবগুলোকে তারা মনে করেনচলমান সমাজব্যবস্থার সমস্যাগুলো দূর করতে যথেষ্ট, অথচ এগুলোকে কমিউনিজমে রূপান্তরের ধাপ হিসেবে বিবেচনা করেন না।এই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ হলেন শ্রমজীবী মানুষ, যারা নিজেদের মুক্তির পথ এখনও স্পষ্টভাবে বুঝে উঠতে পারেননি।

আবার কেউ কেউ হলেন ক্ষুদ্র ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধি, যারা গণতন্ত্র অর্জনের আগে পর্যন্ত শ্রমজীবী শ্রেণির সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে মিল রাখেন।এই কারণে, কমিউনিস্টদের উচিত হবে যেকোনও কার্যক্রমে এই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা, যতক্ষণ না তারা ধনিক সমাজের সেবায় নিয়োজিত হয়ে কমিউনিস্টদের আক্রমণ করেন।এই ধরণের কৌশলগত সহযোগিতা কোনওভাবে দর্শনীয় পার্থক্যের আলোচনা এবং সমালোচনার বাধা নয়।

২৫। সমসাময়িক রাজনৈতিক দল গুলোর প্রতি কমিউনিস্টদের মনোভাব কী?

এই মনোভাব দেশ ভেদে ভিন্ন। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, এবং বেলজিয়ামে, যেখানে ধনিক শ্রেণি শাসন করছে, সেখানে কমিউনিস্টদের এখনো বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে কিছু সাধারণ স্বার্থ আছে—বিশেষত যখন তারা শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ তুলে ধরে এবং কমিউনিস্টদের লক্ষ্যের কাছাকাছি আসে। উদাহরণস্বরূপ, ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণির চার্টিস্টরা কমিউনিস্টদের অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ, যেকোনও তথাকথিত গণতান্ত্রিক ক্ষুদ্র ধনিক শ্রেণি বা তথাকথিত র‍্যাডিক্যালদের তুলনায়।

আমেরিকায়, যেখানে ইতিমধ্যেই গণতান্ত্রিক সংবিধান চালু আছে, সেখানে কমিউনিস্টদের উচিত এমন একটি দলের সঙ্গে একযোগে কাজ করা, যারা এই সংবিধানকে ধনিক শ্রেণির বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চায়—অর্থাৎ এগ্রেরিয়ান ন্যাশনাল রিফর্মারদের সঙ্গে। সুইজারল্যান্ডে, যদিও র‍্যাডিক্যালরা একটি মিশ্র দল, তারপরও কমিউনিস্টদের একমাত্র বাস্তব অংশীদার তারাই, বিশেষত ভডুয়া ও জেনেভার র‍্যাডিক্যালরা সবচেয়ে অগ্রসর।

জার্মানিতে, এখনো ধনিক শ্রেণি এবং একনায়ক রাজতন্ত্রের মধ্যকার মূল লড়াই চলছে। যেহেতু ধনিক শ্রেণিকে ক্ষমতাচ্যুত না করা পর্যন্ত কমিউনিস্টদের প্রকৃত সংগ্রাম শুরু হতে পারে না, তাই তাদের উচিত প্রথমে ধনিক শ্রেণিকে ক্ষমতায় আনার সহায়তা করা, যেন পরবর্তী ধাপে তাদেরকে উৎখাত করা যায়। এই ক্ষেত্রে, কমিউনিস্টদের উচিত র‍্যাডিক্যাল লিবারেল পার্টির প্রতি সমর্থন জানানো, কিন্তু সেই সাথে ধনিক শ্রেণির মায়াকাজে প্রতারিত না হওয়া এবং তাদের প্রতিশ্রুত সুবিধা থেকে সতর্ক থাকা।

কমিউনিস্টরা জানে, ধনিক শ্রেণির বিজয়ের একমাত্র লাভ:

(i) শ্রমজীবী শ্রেণিকে সংগঠিত করে একটি যুদ্ধপ্রস্তুত শ্রেণিতে রূপান্তরিত করার সুযোগ;

(ii) ধনিক একনায়কত্বের পতনের দিন থেকেই, শ্রমিক শ্রেণি এবং ধনিক শ্রেণির মধ্যে সত্যিকারের সংগ্রাম শুরু হবে।

এই সময় থেকেই, কমিউনিস্টদের নীতি হবে সেই একই যা আজ কার্যকর দেশগুলোতে গ্রহণ করা হয়েছে, যেখানে ধনিক শ্রেণি ইতিমধ্যেই ক্ষমতায় আছে।

“জার্মানিতে কমিউনিস্ট পার্টির দাবিসমূহ” (১৮৪৮):

“সকল দেশের শ্রমিকরা, এক হও!”—এই ঐতিহাসিক আহ্বানের মাধ্যমে কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালের মার্চ মাসে ইউরোপজুড়ে চলমান বিপ্লবের প্রেক্ষিতে একটি ১৭-দফা রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রস্তাব করেন, যা কমিউনিস্ট লীগের আনুষ্ঠানিক ইশতেহার হিসেবে বিবেচিত। এতে তাঁরা জার্মানিকে একটি একক ও অবিভাজ্য প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরের আহ্বান জানান এবং সার্বজনীন ভোটাধিকার, কৃষকদের উপর আরোপিত সামন্তীয় খাজনা ও কর বাতিল, প্রিন্সলি ও জমিদার শ্রেণির ভূসম্পত্তি, খনি ও ব্যাংক রাষ্ট্রীয়করণের দাবি তোলেন। তারা শ্রমজীবী জনগণের জন্য বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা, সমান বেতনভুক্ত নাগরিক সেবা, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা এবং ‘জাতীয় কর্মশালা’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার প্রস্তাব দেন। এই দাবিসমূহ আদর্শবাদী কল্পনা নয়, বরং সামাজিক বাস্তবতায় ভিত্তি করে গঠিত এমন এক রূপান্তরপর্বের রূপরেখা, যা কৃষক ও শ্রমজীবী শ্রেণির উপর আরোপিত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষণের কাঠামো ভেঙে নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে একটি সচেতন পদক্ষেপ।

প্যারিস কমিউন ও মে ১৮৭১-এর ভাষণ (The Civil War in France):

১৮৭১ সালের প্যারিস কমিউন ছিল আধুনিক ইতিহাসে প্রথম শ্রমিকশ্রেণির শাসনব্যবস্থাযা নিয়ে কার্ল মার্কস তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংঘকে উদ্দেশ করে বলেন, কমিউন ছিল একটি নতুন সমাজগঠনের সাহসী সূচনা, যা বিদ্যমান পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের পতন এবং ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের বিপর্যয়ের পর প্যারিসের শ্রমজীবীরা রাষ্ট্রক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেয়। তারা পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিত্বের পরিবর্তে সরাসরি ও জবাবদিহিমূলক প্রতিনিধিত্ব প্রবর্তন করেযেখানে সব জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত, স্বল্পমেয়াদি এবং অপসারণযোগ্য; প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও বিচারপতিরাও এই নীতির আওতায় পড়ে। স্থায়ী সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করে সশস্ত্র জনগণকে প্রতিরক্ষা বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পৃথক করা হয় রাষ্ট্র থেকে, শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধর্মনিরপেক্ষ ও সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

মার্কস জোর দিয়ে বলেন, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রকে দখল করে শ্রমিকশ্রেণির মুক্তি সম্ভব নয়; বরং এটি গুঁড়িয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণ করতে হয়যাপ্যারিস কমিউন বাস্তবায়ন করে দেখায়। কমিউন কেবল রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ছিল না, বরং এটি ছিল শ্রমিকশ্রেণির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে সংগঠিত এক সংগ্রাম। কমিউন ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ করতে চায়নি; বরং পুঁজিপতিদের একচেটিয়া মালিকানাভিত্তিক শ্রেণিস্বার্থকে ভেঙে, উৎপাদনের উপকরণকে সমবায় ও সমবেত শ্রমের ভিত্তিতে রূপান্তর করতে চেয়েছিল। এটি ছিল “অভিজাতদের জন্য নয়, উৎপাদকদের দ্বারা ও উৎপাদকদের জন্য পরিচালিত সরকার”।

যদিও কমিউন সামরিকভাবে পরাজিত হয়, তার অস্তিত্ব প্রমাণ করে দেয় যে শ্রমিকশ্রেণিকেবল শোষণের শিকার নয়, বরং তারা রাষ্ট্র ও সমাজকে পুনর্গঠনের ক্ষমতাও রাখে। এটি দেখিয়ে দেয় যে প্রকৃত গণতন্ত্র কেবল পার্লামেন্টের ভেতরে নয়, বরং সরাসরি জনগণের হাতে শাসন ও সম্পদের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্যেই নিহিত। এই অভিজ্ঞতা কেবল ফ্রান্সের জন্য নয়, বিশ্বের সকল নিপীড়িত শ্রমজীবী মানুষের জন্য এক প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে। কমিউন ছিল শ্রমিক শ্রেণির ঐতিহাসিক অভিযানপুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত সংকট উন্মোচন করে একটি নতুন সমাজ নির্মাণের পথে সর্বপ্রথম প্রত্যয়ী পদক্ষেপ।

-সমাপ্ত-


শতাব্দীর প্রভাবশালী দলিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র—চতুর্থ পর্বের দ্বিতীয়াংশ: কমিউনিজমের নীতিমালা (১১-১৮)

২০২৫ জুলাই ১৯ ০০:২৫:৫০
শতাব্দীর প্রভাবশালী দলিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র—চতুর্থ পর্বের দ্বিতীয়াংশ: কমিউনিজমের নীতিমালা (১১-১৮)

রাজনৈতিক দর্শনের ইতিহাসে এক অনন্য দলিল হলো কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। জার্মান ভাষায় এর মূল নাম “Manifesto der Kommunistischen Partei”, অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার। বিখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালে এটি লিখেন, যা প্রথম প্রকাশিত হয় লন্ডনে। ১৮৪৮ সালে যখন এটি ইউরোপে প্রকাশিত হয়, তখনকার বিপ্লবাত্মক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি ছিল এক যুগান্তকারী লেখা। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-কে আজও বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলিলগুলোর অন্যতম বলে বিবেচনা করা হয়।

এই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির চারটি অধ্যায় রয়েছে। ধারাবাহিক ভাবে আমরা এর ভাবানুনাদ পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি। আজ আমরা চতুর্থ তথা শেষ পর্বের দ্বিতীয়াংশে কমিউনিজমের নীতিমালার ১১ থেকে ১৮ প্রশ্নোত্তর পর্ব-এর সরল, পরিশীলিত ও ব্যাখ্যামূলক ভাষান্তর পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করছি। আশাকরি পাঠকরা সহজভাবে এর মূল ভাবনা ও তাৎপর্য বুঝতে পারবেন।

১১। শিল্প বিপ্লব এবং সমাজকে দুই ভাগে—বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়ান—বিভক্ত করার তাৎক্ষণিক ফলাফল কী ছিল?

-প্রথমত, যন্ত্রশ্রম দ্বারা সৃষ্ট শিল্পপণ্যের ক্রমাগত নিম্ন মূল্য বিশ্বজুড়ে হস্তশ্রমনির্ভর পুরোনো উৎপাদন বা কারিগরি শিল্প ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়।

এইভাবে, অর্ধ-বর্বর সমস্ত দেশ, যারা এতদিন পর্যন্ত ইতিহাসের মূলধারার বাইরেই ছিল এবং যাদের শিল্পপ্রক্রিয়া ছিল হস্তনির্মাণ নির্ভর, তারা জোরপূর্বক তাদের বিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে সরিয়ে আনা হয়। তারা ইংল্যান্ডের সস্তা পণ্য ক্রয় করে এবং নিজের দেশের হস্তশিল্পীদের ধ্বংস করে ফেলে। যে দেশগুলো হাজার হাজার বছর ধরে স্থবির ছিল—যেমন ভারত—তাদের ভেতরে এক গভীর বিপ্লব ঘটানো হয়, এবং এমনকি চীনও এখন বিপ্লবের পথে।

আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছেছি যেখানে ইংল্যান্ডে উদ্ভাবিত একটি নতুন যন্ত্র এক বছরের মধ্যেই লক্ষ লক্ষ চীনা শ্রমিককে তাদের জীবিকা থেকে বঞ্চিত করতে পারে।

এইভাবে বৃহৎ শিল্প গোটা পৃথিবীর জনসাধারণকে একে অপরের সংস্পর্শে নিয়ে এসেছে, সকল আঞ্চলিক বাজারকে একত্রিত করে একটি বিশ্ববাজার সৃষ্টি করেছে, সর্বত্র সভ্যতা ও অগ্রগতি ছড়িয়ে দিয়েছে এবং এভাবে নিশ্চিত করেছে যে, সভ্য দেশগুলোর যেকোনো ঘটনা অবশ্যম্ভাবীরূপে অন্যান্য দেশগুলোর ওপর প্রভাব ফেলবে।

এখন থেকে ধরে নেওয়া যায়, যদি ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সের শ্রমিক শ্রেণি নিজেদের মুক্ত করে তোলে, তবে তা অন্য সব দেশেও বিপ্লব ছড়িয়ে দেবে—যা তাদের নিজ নিজ শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি ঘটাবে, শিগগির অথবা কিছু বিলম্বে।

দ্বিতীয়ত, যেখানে যেখানে বৃহৎ শিল্প হস্তশিল্পকে প্রতিস্থাপন করেছে, সেখানে সেখানে বুর্জোয়া শ্রেণি সম্পদ ও ক্ষমতায় চরম অবস্থায় পৌঁছেছে এবং দেশের প্রধান শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতাও নিজের হাতে তুলে নিয়েছে এবং আগে যে শ্রেণিগুলো শাসন করত—যেমন অভিজাত, গিল্ড মাস্টার এবং তাদের প্রতিনিধিত্বকারী একনায়কতান্ত্রিক রাজতন্ত্র—তাদের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে।

বুর্জোয়া শ্রেণি জমিদারদের ক্ষমতা ধ্বংস করেছে জমির উত্তরাধিকারের নিয়ম বিলোপ করে—অর্থাৎ জমি কেনাবেচার বিষয় করে এবং অভিজাতদের বিশেষাধিকার বিলোপ করে। তারা গিল্ড মাস্টারদের ক্ষমতা ধ্বংস করেছে গিল্ড এবং কারিগরি বিশেষাধিকার বিলোপ করে। তাদের পরিবর্তে তারা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেছে—অর্থাৎ একটি এমন সমাজব্যবস্থা যেখানে প্রত্যেকেই যেকোনো শিল্পে প্রবেশ করতে পারে, শুধুমাত্র মূল বাধা হলো প্রয়োজনীয় পুঁজি না থাকা।

এইভাবে মুক্ত প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠিত হয়, যার অর্থ হলো এখন থেকে সমাজের সদস্যরা কেবল তাদের পুঁজির পরিমাণের ভিত্তিতে একে অপরের থেকে আলাদা; পুঁজি হলো সর্বোচ্চ শক্তি, এবং এইভাবে পুঁজিপতিরা—অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্রেণি—সমাজের প্রথম শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে।

বৃহৎ শিল্পের প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্ত প্রতিযোগিতা একান্ত প্রয়োজনীয়, কারণ কেবল এ ধরনের সমাজব্যবস্থায়ই বৃহৎ শিল্প বিকাশ লাভ করতে পারে।

অভিজাত ও গিল্ড মাস্টারদের সামাজিক ক্ষমতা ধ্বংস করার পাশাপাশি, বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতাও ধ্বংস করেছে। যখন তারা সমাজে প্রথম শ্রেণিতে রূপান্তরিত হয়েছে, তখন তারা নিজেদের প্রধান রাজনৈতিক শ্রেণি হিসেবেও ঘোষণা করেছে।

এটি তারা করেছে প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থার প্রবর্তনের মাধ্যমে, যা আইনের চোখে বুর্জোয়া সমতার ওপর ভিত্তি করে এবং মুক্ত প্রতিযোগিতার স্বীকৃতি দেয়। ইউরোপীয় দেশগুলোতে এটি গঠনমূলক রাজতন্ত্রের রূপ ধারণ করে। এসব রাজতন্ত্রে শুধু সেই সকল নাগরিকই ভোট দিতে পারে যাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ পুঁজি আছে—অর্থাৎ কেবল বুর্জোয়া শ্রেণির সদস্যরা। এই বুর্জোয়া ভোটাররাই সংসদ সদস্য নির্বাচন করে, এবং এই সদস্যরা, কর অনুমোদনে অস্বীকৃতি জানিয়ে, একটি বুর্জোয়া সরকার গঠন করে।

তৃতীয়ত, বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রলেতারিয়ান শ্রেণিও গড়ে ওঠে। যত বুর্জোয়া শ্রেণি সম্পদে বিকশিত হয়, প্রলেতারিয়ান শ্রেণি সংখ্যায় বৃদ্ধি পায়। কারণ, প্রলেতারিয়ানদের কর্মসংস্থান সম্ভব শুধুমাত্র পুঁজির দ্বারা, এবং পুঁজির বিকাশ ঘটে কেবল শ্রম নিযুক্ত করেই। অতএব, প্রলেতারিয়ানদের সংখ্যাবৃদ্ধি পুঁজির বৃদ্ধি অনুসরণ করে।

এই প্রক্রিয়ার ফলে বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়ানদের বৃহৎ শহরগুলোয় একত্রিত করে যেখানে শিল্প সবচেয়ে লাভজনকভাবে পরিচালিত হয় এবং এইভাবে প্রলেতারিয়ানদের মধ্যে তাদের নিজস্ব শক্তির চেতনা গড়ে ওঠে।

এছাড়াও, এই প্রক্রিয়া যতই অগ্রসর হয়, ততই নতুন শ্রম সাশ্রয়ী যন্ত্র উদ্ভাবিত হয়, যার ফলে বৃহৎ শিল্প মজুরির ওপর চাপ সৃষ্টি করে; মজুরি যেমন সর্বনিম্নে পৌঁছে যায়, তেমনি প্রলেতারিয়ানদের অবস্থা ক্রমাগত অসহনীয় হয়ে ওঠে।

এইভাবে প্রলেতারিয়ানদের অসন্তোষ এবং তাদের বিকাশমান শক্তি একত্রিত হয়ে একটি প্রলেতারিয়ান সামাজিক বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি তৈরি করে।

১২। শিল্প বিপ্লবের আরও কী পরিণতি দেখা গেছে?

-বৃহৎ শিল্প, যেমন বাষ্পচালিত যন্ত্র ও অন্যান্য মেশিনের মাধ্যমে, শিল্প উৎপাদনের পরিধি অসীমভাবে বাড়ানো, উৎপাদনকে দ্রুততর করা এবং খরচ কমানোর উপায় সৃষ্টি করেছে। উৎপাদন প্রক্রিয়াকে এভাবে সহজতর করে, মুক্ত প্রতিযোগিতা—which বৃহৎ শিল্পের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত—চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছায়; বহু পুঁজিপতি শিল্পক্ষেত্রে ঢুকে পড়ে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই প্রয়োজনের তুলনায় অধিক পণ্য উৎপাদন করে ফেলে।

ফলে, প্রস্তুত পণ্য বিক্রি করা সম্ভব হয় না, এবং তথাকথিত একটি বাণিজ্যিক সংকট শুরু হয়। কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়, মালিকেরা দেউলিয়া হয়ে পড়ে, শ্রমিকেরা কর্মহীন ও অভুক্ত অবস্থায় পড়ে। সর্বত্র চরম দারিদ্র্য বিরাজ করে।

একটু সময় পর অতিরিক্ত পণ্য বিক্রি হয়ে যায়, কারখানাগুলো আবার চালু হয়, মজুরি বাড়ে এবং ধীরে ধীরে ব্যবসা আবার আগের চেয়েও ভালো হয়।

কিন্তু বেশিদিনের মধ্যে নয়, আবার অতিরিক্ত পণ্য উৎপাদন হয় এবং একটি নতুন সংকট দেখা দেয়, যা পূর্ববর্তী সংকটের পথেই চলে।

এই উনিশ শতকের সূচনালগ্ন থেকে শিল্পের অবস্থা বারবার পরিবর্তিত হচ্ছে—সমৃদ্ধির সময়কাল এবং সংকটের সময়কাল—এই দুইয়ের মধ্যে অস্থিরভাবে দুলছে; প্রায় প্রতি পাঁচ থেকে সাত বছরে একটি করে নতুন সংকট দেখা দিচ্ছে, যা শ্রমিকদের জন্য চরম কষ্ট নিয়ে আসে এবং সর্বদা একটি সামগ্রিক বিপ্লবী আলোড়ন ও বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার জন্য সরাসরি হুমকি সৃষ্টি করে।

১৩। এই পর্যায়ক্রমিক বাণিজ্যিক সংকটগুলো থেকে কী উপসংহার টানা যায়?

-প্রথমত: যে বৃহৎ শিল্প তার প্রাথমিক পর্যায়ে মুক্ত প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছিল, এখন সে নিজেই সেই প্রতিযোগিতার সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। বৃহৎ শিল্পের জন্য প্রতিযোগিতা এবং সাধারণভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা একটি শৃঙ্খল হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা তাকে ভেঙে ফেলতেই হবে এবং ফেলবেই।

বর্তমান ভিত্তিতে যতদিন বৃহৎ শিল্প টিকে থাকবে, ততদিন প্রতি সাত বছর অন্তর সে সারা সমাজজগতকে এক গভীর বিশৃঙ্খলায় নিক্ষেপ করবে। প্রতিবারের সংকট শুধু প্রোলেতারিয়ানদের নয়, বহু বুর্জোয়ারও সর্বনাশ ডেকে আনবে, এবং সভ্যতাকে পুরোপুরিভাবে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে।

অতএব, হয় এই বৃহৎ শিল্পকে সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে হবে—যা একেবারেই অসম্ভব—অথবা সমাজকে এমন একটি নতুন সংগঠনে নিয়ে যেতে হবে যেখানে উৎপাদন আর ব্যক্তিগত শিল্পপতিদের প্রতিযোগিতামূলক নিয়ন্ত্রণে চলবে না, বরং গোটা সমাজ একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী সমস্ত মানুষের চাহিদা অনুযায়ী তা পরিচালনা করবে।

দ্বিতীয়ত: এই বৃহৎ শিল্প এবং এর মাধ্যমে যে সীমাহীন উৎপাদন সম্ভব, তা এমন একটি সামাজিক ব্যবস্থাকে সম্ভবপর করে তুলেছে যেখানে এত বেশি উৎপাদন সম্ভব যে সমাজের প্রতিটি সদস্য নিজের সমস্ত ক্ষমতা ও যোগ্যতা পূর্ণ স্বাধীনতার সঙ্গে ব্যবহার ও বিকাশ করতে পারবে।

অতএব, আজকের সমাজে যা দারিদ্র্য ও সংকট তৈরি করে—বৃহৎ শিল্পের সেই বৈশিষ্ট্যগুলোই—এক ভিন্ন সমাজব্যবস্থায় সেই দারিদ্র্য ও সংকট দূর করবে।

আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাই:(i) এই সমস্ত দুঃখ-কষ্ট আজ থেকে আর কোনোভাবেই বাস্তব পরিস্থিতির প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন একটি সমাজব্যবস্থারই ফল, এবং(ii) একটি নতুন সমাজব্যবস্থার মাধ্যমে এইসব দুঃখ-কষ্ট পুরোপুরি দূর করা সম্ভব।

১৪। এই নতুন সমাজব্যবস্থা কেমন হবে?

-সর্বপ্রথম, এই সমাজব্যবস্থাকে সমস্ত শিল্প ও উৎপাদনের শাখা-প্রশাখার নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতামূলক মালিকদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে গোটা সমাজের হাতে তুলে দিতে হবে। অর্থাৎ, সবকিছুই হবে একটি সাধারণ পরিকল্পনার ভিত্তিতে, একটি সামষ্টিক স্বার্থে এবং সমাজের প্রতিটি সদস্যের সক্রিয় অংশগ্রহণে পরিচালিত।

অর্থাৎ, এই ব্যবস্থা প্রতিযোগিতাকে বিলুপ্ত করে তার স্থানে ‘সহযোগিতার’ প্রতিষ্ঠা ঘটাবে।

এছাড়া, যেহেতু ব্যক্তির হাতে শিল্পের নিয়ন্ত্রণের অর্থই হচ্ছে ব্যক্তিগত মালিকানা, এবং প্রতিযোগিতা মূলত এই ব্যক্তিগত মালিকানার প্রকাশরূপমাত্র, তাই ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিযোগিতা ও ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণ থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। সুতরাং, ব্যক্তিগত মালিকানার বিলুপ্তি অনিবার্য। তার পরিবর্তে আসবে উৎপাদনের সমস্ত উপকরণের যৌথ ব্যবহার এবং উৎপাদিত দ্রব্যের একটি সর্বসম্মত পদ্ধতিতে বণ্টন — সংক্ষেপে, একে বলা হয় সামাজিক মালিকানা।

বাস্তবে, ব্যক্তিগত মালিকানার বিলুপ্তি হল এমন একটি বিপ্লবের সংক্ষিপ্ততম ও সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ উপস্থাপন, যা সম্পূর্ণ সমাজব্যবস্থার মৌলিক রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা থেকে জন্ম নিয়েছে শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে — এবং ঠিক এই কারণেই কমিউনিস্টরা একে তাদের প্রধান দাবি হিসেবে তুলে ধরেন।

১৫। ব্যক্তিগত মালিকানার বিলুপ্তি কি এর আগেও সম্ভব ছিল?

-না, কখনোই নয়। প্রতিটি সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন, মালিকানা-সম্পর্কের প্রতিটি বিপ্লব, সব সময়ই নতুন উৎপাদনশক্তির বিকাশের অপরিহার্য ফল, যখন সেই উৎপাদনশক্তিগুলো আর পুরোনো মালিকানা সম্পর্কের মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না।

ব্যক্তিগত মালিকানা চিরকাল ছিল না।

যখন মধ্যযুগের শেষ দিকে এমন একটি নতুন উৎপাদন পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে, যা তৎকালীন বিদ্যমান সামন্তবাদী ও গিল্ডভিত্তিক মালিকানার ভেতর চলতে পারত না, তখন সেই উৎপাদন পদ্ধতি — মান্যুফ্যাকচার — পুরনো মালিকানা সম্পর্ককে ছাড়িয়ে গিয়ে এক নতুন মালিকানার রূপ সৃষ্টি করে, যাকে বলা হয় ব্যক্তিগত মালিকানা। এবং মান্যুফ্যাকচার ও বড় শিল্পের প্রাথমিক স্তরের জন্য ব্যক্তিগত মালিকানাই ছিল একমাত্র উপযুক্ত রূপ; সেই সময়কার সমাজব্যবস্থার জন্য এটি ছিল একমাত্র সম্ভাব্য কাঠামো।

যতক্ষণ না সমাজের পক্ষে এত পরিমাণ উৎপাদন সম্ভব হয় যে সবার জন্য যথেষ্ট জিনিস সরবরাহ করা যায় এবং সামাজিক পুঁজি বাড়ানোর মতো উদ্বৃত্ত থেকে যায়, ততক্ষণ একটি শাসক শ্রেণির অস্তিত্ব থাকবে, যারা সমাজের উৎপাদনশক্তির নিয়ন্ত্রণ রাখবে এবং একটি দরিদ্র ও নিপীড়িত শ্রেণিরও অস্তিত্ব থাকবে। এই শ্রেণিগুলোর গঠন কেমন হবে, তা নির্ভর করে সমাজের বিকাশের স্তরের ওপর।

মধ্যযুগে ছিল জমিদার ও সার্ব; মধ্যযুগের শেষ দিকে শহরে ছিল গিল্ডমাস্টার, সহকারি ও দিনমজুর; ১৭শ শতকে ছিল মান্যুফ্যাকচার শ্রমিক; আর ১৯শ শতকে এসেছে বৃহৎ কারখানার মালিক ও প্রলেতারিয়েত।

এটি সুস্পষ্ট যে এখন পর্যন্ত উৎপাদনশক্তির এমন বিকাশ হয়নি, যাতে সকলের জন্য পর্যাপ্ত উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়। আর এখন ব্যক্তিগত মালিকানা নিজেই একটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা উৎপাদনের পরবর্তী বিকাশের পথে অন্তরায়।

কিন্তু বর্তমানে, বৃহৎ শিল্পের বিকাশ সমাজকে এক নতুন যুগে প্রবেশ করিয়েছে। পুঁজি ও উৎপাদনশক্তি এমন এক পরিমাণে বেড়েছে, যা অতীতের তুলনায় অভূতপূর্ব; এবং ভবিষ্যতে তা আরও সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে, উৎপাদনশক্তিগুলো খুব অল্পসংখ্যক বুর্জোয়ার হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, আর জনগণের বিশাল অংশ ধীরে ধীরে প্রলেতারিয়েত শ্রেণিতে পরিণত হচ্ছে, তাদের অবস্থা বুর্জোয়ার সম্পদের পরিমাণ যত বাড়ছে, ততই শোচনীয় ও অসহনীয় হয়ে উঠছে। অবশেষে, এই বিশাল ও সহজেই সম্প্রসারিত উৎপাদনশক্তি এতটাই ব্যক্তিগত মালিকানা ও বুর্জোয়া শ্রেণিকে ছাড়িয়ে গেছে যে, তা যেকোনো মুহূর্তে সমাজব্যবস্থাকে প্রচণ্ড রূপে নাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি তৈরি করছে।

এই পরিস্থিতিতে, ব্যক্তিগত মালিকানার বিলুপ্তি এখন কেবল সম্ভব নয়, বরং অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

১৬। ব্যক্তিগত মালিকানার শান্তিপূর্ণ বিলুপ্তি কি সম্ভব?

-এটি সম্ভব হলে নিঃসন্দেহে কাম্য, এবং কমিউনিস্টরাই সর্বশেষ পক্ষ হবে যারা এর বিরোধিতা করবে। কমিউনিস্টরা খুব ভালো করেই জানে যে সব ধরনের ষড়যন্ত্র শুধু অকার্যকরই নয়, বরং ক্ষতিকরও। তারা জানে যে কোনো বিপ্লব ইচ্ছাকৃত বা ইচ্ছাপূর্বকভাবে ঘটানো যায় না, বরং তা সব সময়ই এমন পরিস্থিতির অনিবার্য পরিণতি, যা কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা শ্রেণির ইচ্ছার বাইরে গড়ে ওঠে।

কিন্তু একই সঙ্গে কমিউনিস্টরা এটা-ও দেখছে যে, প্রায় সব সভ্য দেশে প্রলেতারিয়েতের বিকাশকে বর্বরভাবে দমন করা হয়েছে। এইভাবে, কমিউনিজমের বিরোধীরাই আসলে এক বিপ্লবের জন্য নিজেদের সর্বশক্তি দিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ফলে, যদি নিপীড়িত প্রলেতারিয়েত শেষপর্যন্ত বিপ্লবের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়, তাহলে কমিউনিস্টরা যেভাবে এখন কথায় তাদের স্বার্থ রক্ষা করছে, তখন ঠিক সেভাবেই তারা কর্মে তাদের পক্ষে অবস্থান নেবে।

১৭। ব্যক্তিগত মালিকানা কি একবারেই সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা সম্ভব?

-না, যেমনভাবে বর্তমান উৎপাদনশক্তিকে এক লাফে এমন মাত্রায় বাড়ানো সম্ভব নয়, যা একটি সামষ্টিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন, তেমনি এক ঝটকায় ব্যক্তিগত মালিকানাকেও বিলুপ্ত করা সম্ভব নয়।

সবচেয়ে সম্ভাব্য পরিণতি হলো, প্রলেতারিয়েত বিপ্লব ধাপে ধাপে বিদ্যমান সমাজকে রূপান্তর করবে এবং কেবল তখনই ব্যক্তিগত মালিকানা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করতে পারবে, যখন পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন সামর্থ্য তথা উৎপাদন উপায় সমাজের হাতে থাকবে।

১৮। এই বিপ্লবের ধারা কী হবে?

-সবার আগে, এটি একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রতিষ্ঠা করবে এবং এর মাধ্যমে প্রলেতারিয়েত শ্রেণির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে।ইংল্যান্ডে, এই কর্তৃত্ব হবে সরাসরি, কারণ সেখানে প্রলেতারিয়েত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ।ফ্রান্স ও জার্মানিতে, এটি হবে পরোক্ষ, কারণ এই দেশগুলোর জনগণের সংখ্যা গঠিত শুধু প্রলেতারিয়েত দিয়ে নয়, বরং তাদের মধ্যে আছে ক্ষুদ্র কৃষক ও ক্ষুদ্র বুর্জোয়া শ্রেণির মানুষ, যারা ক্রমশ প্রলেতারিয়েত শ্রেণিতে পতিত হচ্ছে এবং যাদের রাজনৈতিক স্বার্থ দিন দিন প্রলেতারিয়েতের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। এদেরও খুব শিগগিরই প্রলেতারিয়েতের দাবির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। যদিও এতে দ্বিতীয় একটি সংগ্রাম প্রয়োজন হতে পারে, তবে শেষ পর্যন্ত প্রলেতারিয়েতের বিজয় অনিবার্য।

তবে, প্রলেতারিয়েতের জন্য গণতন্ত্র তখনই অর্থবহ হবে, যখন এটি অবিলম্বে ব্যক্তিগত মালিকানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যম হয়ে উঠবে এবং প্রলেতারিয়েত শ্রেণির জীবনধারণ নিশ্চিত করবে।

এই বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে আবশ্যিকভাবে উদ্ভূত প্রধান পদক্ষেপগুলো হলো—

১। ক্রমবর্ধমান কর ব্যবস্থা এবং ভারী উত্তরাধিকার কর আরোপের মাধ্যমে ব্যক্তিগত মালিকানার সীমিতকরণ; পার্শ্বীয় উত্তরাধিকার (ভাই, ভাগ্নে ইত্যাদি) বাতিল করা, জোরপূর্বক ঋণ আদায় ইত্যাদি।

২। জমির মালিক, শিল্পপতি, রেলপথ ও জাহাজমালিকদের ধাপে ধাপে জাতীয়করণ—আংশিকভাবে রাষ্ট্রীয় শিল্পের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে এবং আংশিকভাবে বন্ডের বিনিময়ে প্রত্যক্ষ ক্ষতিপূরণ দিয়ে।

৩। জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বিরুদ্ধে থাকা সকল অভিবাসী ও বিদ্রোহীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ।

৪। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জমি, কারখানা ও কর্মশালায় প্রলেতারিয়েতদের কাজের ব্যবস্থা করা—যেখানে শ্রমিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে না এবং যে সব ব্যক্তিগত মালিক এখনো টিকে থাকবে, তাদের বাধ্য করা হবে রাষ্ট্রের মতো একই হারে উচ্চ মজুরি দিতে।

৫। সমাজের প্রতিটি সদস্যের ওপর সমানভাবে শ্রম করার বাধ্যবাধকতা চাপানো যতক্ষণ না সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত মালিকানা বিলুপ্ত হয়। কৃষির জন্য বিশেষভাবে শিল্প বাহিনী গঠন।

৬। জাতীয় মূলধন দিয়ে পরিচালিত রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা ও ঋণ ব্যবস্থা কেন্দ্রীয়করণ, সকল ব্যক্তিগত ব্যাংক ও ব্যাংকার বিলুপ্ত করা।

৭। জাতীয় কারখানা, কর্মশালা, রেলপথ, জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি; নতুন জমিকে চাষের আওতায় আনা এবং বিদ্যমান জমির উন্নয়ন করা—সবকিছু জাতীয় মূলধন ও শ্রমবলের বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে।

৮। সব শিশুদের জাতীয় খরচে, জাতীয় প্রতিষ্ঠানে, মাতৃসেবা থেকে সরানোর পর থেকেই শিক্ষাদান; শিক্ষা ও উৎপাদনের সংযুক্তিকরণ।

৯। সরকারি জমিতে বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ, যেখানে শিল্প ও কৃষির সঙ্গে যুক্ত নাগরিকগণ মিলিতভাবে বসবাস করবে এবং গ্রামীণ ও নগরজীবনের সুবিধাসমূহ একত্রিত করবে, তবে একপাক্ষিকতা এড়িয়ে চলবে।

১০। নগর এলাকার সব অস্বাস্থ্যকর ও ভঙ্গুর বসতি ধ্বংস।

১১। বৈবাহিক ও অবৈবাহিক জন্মের শিশুদের জন্য সমান উত্তরাধিকার অধিকার প্রতিষ্ঠা।

১২। সমস্ত পরিবহন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীভূতকরণ।

অবশ্যই, এই সব পদক্ষেপ একসাথে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তবে একটির বাস্তবায়ন অপরটি আহ্বান করবে। একবার ব্যক্তিগত মালিকানার উপর একটি মৌলিক আঘাত হানার পর, প্রলেতারিয়েত শ্রেণি বাধ্য হবে ক্রমাগত অগ্রসর হতে—সমস্ত মূলধন, কৃষি, পরিবহন ও বাণিজ্য রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীভূত করতে।

এই সমস্ত পদক্ষেপ এই লক্ষ্যেই গ্রহণ করা হবে, এবং এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভব হবে সেই অনুপাতে, যেভাবে প্রলেতারিয়েতরা তাদের শ্রমের মাধ্যমে জাতির উৎপাদনশক্তিকে বহুগুণে বাড়াবে।

সবশেষে, যখন সব মূলধন, উৎপাদন ও বিনিময় জাতির হাতে কেন্দ্রীভূত হবে, তখন ব্যক্তিগত মালিকানা নিজে থেকেই বিলুপ্ত হবে, অর্থের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে, উৎপাদন এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে এবং মানুষের চরিত্র এতটাই রূপান্তরিত হবে যে, সমাজ পূর্বের অর্থনৈতিক অভ্যাসের যে কোনো রূপ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হবে।

চলবে...


শতাব্দীর প্রভাবশালী দলিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র—চতুর্থ পর্বের প্রথমাংশ: কমিউনিজমের নীতিমালা (১-১০) 

২০২৫ জুলাই ১৭ ২২:৪০:৪১
শতাব্দীর প্রভাবশালী দলিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র—চতুর্থ পর্বের প্রথমাংশ: কমিউনিজমের নীতিমালা (১-১০) 

রাজনৈতিক দর্শনের ইতিহাসে এক অনন্য দলিল হলো কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। জার্মান ভাষায় এর মূল নাম “Manifesto der Kommunistischen Partei”, অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার। বিখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালে এই এটি লিখেন, যা প্রথম প্রকাশিত হয় লন্ডনে। ১৮৪৮ সালে যখন এটি ইউরোপে প্রকাশিত হয়, তখনকার বিপ্লবাত্মক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি ছিল এক যুগান্তকারী লেখা। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-কে আজও বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলিলগুলোর অন্যতম বলে বিবেচনা করা হয়।

এই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির চারটি অধ্যায় রয়েছে। ধারাবাহিক ভাবে আমরা এর ভাবানুনাদ পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি। আজ আমরাচতুর্থ তথা শেষপর্বের প্রথমাংশে কমিউনিজমের নীতিমালারতিহাসিকপ্রক্ষাপট ও কমিউনিজমের নীতিমালার ১ থেকে ১০ প্রশ্নোত্তর পর্বসরল, পরিশীলিত ও ব্যাখ্যামূলক ভাষান্তর পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করছি। আশাকরি পাঠকরা সহজভাবে এর মূল ভাবনা ও তাৎপর্য বুঝতে পারবেন।

কমিউনিজমের নীতিমালা (The Principles of Communism): ঐতিহাসিকপ্রক্ষাপট

১৮৪৭ সালে এঙ্গেলস কমিউনিস্ট লীগ-এর জন্য দুটি খসড়া কর্মসূচি রচনা করেন, উভয়টিই ‘প্রশ্নোত্তরমূলক ধর্মোপদেশ’ (catechism)-এর আকারে। প্রথমটি লেখেন জুন মাসে, এবং দ্বিতীয়টি অক্টোবর মাসে।পরবর্তীকালের দলিলটি, যা The Principles of Communism নামে পরিচিত, সর্বপ্রথম ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হয়।

এর আগে লেখা দলিলটিDraft of the Communist Confession of Faithঅনুসন্ধানকারীদের হাতে আসে অনেক পরে, ১৯৬৮ সালে। এটি প্রথমবার প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে, হামবুর্গে, Gründungs Dokumente des Bundes der Kommunisten (Juni bis September 1847) [কমিউনিস্ট লীগের প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত দলিলপত্র, জুন থেকে সেপ্টেম্বর ১৮৪৭] শিরোনামে প্রকাশিত একটি পুস্তিকায়, যেখানে ঐতিহাসিক প্রথম কংগ্রেসের সাথে সংশ্লিষ্ট আরও চারটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল অন্তর্ভুক্ত ছিল।

১৮৪৭ সালের জুন মাসে “লীগ অব দ্য জাস্ট”-এর কংগ্রেসে (যা একাধারে কমিউনিস্ট লীগের প্রতিষ্ঠা সম্মেলনও ছিল), সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে একটি খসড়া ‘বিশ্বাসস্বীকারোক্তি’ প্রস্তুত করে তা লীগ-এর বিভিন্ন শাখায় আলোচনার জন্য পাঠানো হবে।সম্প্রতি আবিষ্কৃত দলিলটি প্রায় নিশ্চিতভাবেই সেই মূল খসড়া দলিল।

এই দুটি দলিলের তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়, Principles of Communism হলো পূর্ববর্তী খসড়াটির একটি সংশোধিত ও পরিশীলিত সংস্করণ।

এই নতুন কর্মসূচির খসড়ায় এঙ্গেলস তিনটি প্রশ্নের উত্তর দেননি, বরং দুটি জায়গায় তিনি “unchanged” (জার্মান ভাষায় “bleibt”) বলে মন্তব্য করেছেনযা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে তিনি পূর্ববর্তী খসড়ার উত্তরের সঙ্গে ঐ প্রশ্নগুলোকে অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।এই নতুন খসড়া কর্মসূচি তৈরি করেছিলেন এঙ্গেলস, প্যারিসের কমিউনিস্ট লীগ-এর শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশ অনুযায়ী। এই নির্দেশনা আসে ২২ অক্টোবর ১৮৪৭ তারিখে অনুষ্ঠিত কমিটি সভায়, যেখানে এঙ্গেলস “ট্রু সোশ্যালিস্ট” মোজেস হেস প্রণীত একটি কর্মসূচির খসড়া নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেন এবং পরবর্তীতে সেটি বাতিল করা হয়।

যদিও Principles of Communism কে একটি অন্তর্বর্তী খসড়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল, তবুও ২৩২৪ নভেম্বর ১৮৪৭ তারিখে মার্কসকে লেখা চিঠিতে এঙ্গেলস মত দেন যে পুরোনো ‘প্রশ্নোত্তর কাঠামো’ (catechistic form) পরিত্যাগ করা উচিত এবং এর পরিবর্তে একটি কর্মসূচি ঘোষণাপত্র বা Manifesto আকারে প্রণয়ন করা উচিত।

১৮৪৭ সালের ২য় কংগ্রেসে (২৯ নভেম্বর৮ ডিসেম্বর), মার্কস ও এঙ্গেলস কমিউনিজমের মৌলিক বৈজ্ঞানিক নীতিমালার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন এবং তাঁরা যৌথভাবে কমিউনিস্ট পার্টির জন্য একটি ঘোষণা আকারে কর্মসূচি লেখার দায়িত্ব পান।এই ঘোষণাপত্র রচনার সময় তাঁরা Principles of Communism-এ প্রণীত বিভিন্ন বক্তব্য ও ধারণা ব্যবহার করেন।

কমিউনিজমের নীতিমালা (The Principles of Communism)

১। কমিউনিজম কী?

-কমিউনিজম হলো প্রলেতারিয়েত শ্রেণির মুক্তির শর্তাবলির তত্ত্ব

২। প্রলেতারিয়েত কী?

প্রলেতারিয়েত হলো সেই শ্রেণি, যাদের জীবিকা একমাত্র নির্ভর করে তাদের নিজ শ্রমশক্তি বিক্রির ওপর। এই শ্রেণির নিজের কোনো উৎপাদন উপকরণ নেই, নেই জমি, যন্ত্র, কিংবা মূলধন। তারা পুঁজির কোনো অংশীদার নয়; বরং সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল শ্রমবাজারের অস্থির চাহিদার ওপর।

এই শ্রেণির জন্য জীবনের প্রতিটি অনুষঙ্গ—সুখ-দুঃখ, নিরাপত্তা-অনিশ্চয়তা, এমনকি জীবন-মৃত্যুর হিসাব—সবকিছু নির্ধারিত হয় অর্থনীতির চক্র, পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ এবং পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতার শীতল বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে। যখন কাজ আছে, তখন বেঁচে থাকা সম্ভব। যখন কাজ নেই, তখন অনাহার, অভাব আর অদৃষ্টের সঙ্গে লড়াই—এই হলো প্রলেতারিয়েত জীবনের নির্মম সত্য।

এই শ্রেণি কোনো স্থিতিশীলতায় বিশ্বাস করতে পারে না, কারণ তার জীবনের ভিত্তি—শ্রম—নিজেই এক অস্থির পণ্য। এদের কাছে ভবিষ্যৎ মানে অনিশ্চয়তা; এবং বর্তমান মানে টিকে থাকার এক ক্লান্তিকর সংগ্রাম।

এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা উনবিংশ শতাব্দীতে প্রথম স্পষ্টভাবে চিহ্নিত হয়, যখন শিল্পবিপ্লবের ফলে শহুরে প্রলেতারিয়ানের উদ্ভব ঘটে। পুঁজিবাদ তার আধিপত্য কায়েম করে এবং উৎপাদন ব্যবস্থার প্রতিটি শাখা চলে যায় বড় পুঁজির হাতে। এর ফলেই একদিকে যেমন গড়ে ওঠে শোষণ-নির্ভর বুর্জোয়া শ্রেণি, অন্যদিকে গড়ে ওঠে উৎপাদনের মৌলিক শক্তি—প্রলেতারিয়েত।

সংক্ষেপে, প্রলেতারিয়েত হলো সেই শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী, যারা সমাজের চাকা ঘোরাতে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করে, কিন্তু সবচেয়ে কম ভোগ করে। তাদের অস্তিত্ব শুধু কর্মজীবনের সঙ্গে নয়, বরং পুঁজির বিকাশ ও সংকোচনের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত। তাই প্রলেতারিয়েত শুধুই একটি শ্রেণি নয়; এটি এক রাজনৈতিক অবস্থান, এক দার্শনিক সত্তা, এক বিপ্লবী সম্ভাবনা।

৩। তাহলে কি প্রলেতারিয়েত শ্রেণি সর্বদা বিদ্যমান ছিল?

-না।দারিদ্র্যপীড়িত ও শ্রমজীবী শ্রেণি সর্বদা ছিল, এবং শ্রমজীবীরাই অধিকাংশ সময় দরিদ্র ছিল।কিন্তু পূর্বে কখনোই এমন পরিস্থিতিতে শ্রমজীবী ও দরিদ্র মানুষ বাঁচেনি যেভাবে আজকের দিনে প্রলেতারিয়েত বাঁচছে।অর্থাৎ, অতীতে সর্বদা প্রলেতারিয়েত ছিল না, ঠিক তেমনি করে অতীতে সর্বদা অবাধ ও লাগামহীন প্রতিযোগিতাও ছিল না।

৪। প্রলেতারিয়েত শ্রেণির উদ্ভব কীভাবে ঘটল?

-প্রলেতারিয়েত শ্রেণির উৎপত্তি ঘটে শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে, যা প্রথম শুরু হয় ইংল্যান্ডে, গত (অষ্টাদশ) শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে।পরবর্তীকালে তা বিশ্বের সকল সভ্য দেশে পুনরাবৃত্ত হয়।এই শিল্পবিপ্লব সূচিত হয়েছিল স্টিম ইঞ্জিন, বিভিন্ন ধরনের সুতা কাটা যন্ত্র, যান্ত্রিক তাঁত, এবং আরও বহু প্রযুক্তিগত আবিষ্কারের মাধ্যমে।এই যন্ত্রগুলো ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং কেবল ধনী মূলধনীরাই তা কিনতে পারত।যন্ত্রগুলো উৎপাদনের পদ্ধতিকে সম্পূর্ণভাবে রূপান্তর করে ফেলে এবং আগেকার শ্রমিকদের স্থান দখল করে নেয়,কারণ যন্ত্রের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন হতো অধিক দ্রুত এবং অধিক উন্নতমানের, যা তখনকার শ্রমিকদের অদক্ষ চাকা ও হস্তচালিত তাঁতের মাধ্যমে সম্ভব ছিল না।ফলে শিল্প সম্পদ পুরোপুরি ধনী মূলধনীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং শ্রমিকদের সামান্য যা কিছু সম্পত্তি ছিলযেমন হাতিয়ারের জিনিসপত্র, তাঁত ইত্যাদিতাসম্পূর্ণভাবে মূল্যহীন হয়ে পড়েএইভাবে মূলধনীদের হাতে সবকিছু জমা হতে থাকে এবং শ্রমিকদের হাতে কিছুই থাকে না।

এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বস্ত্রশিল্পে কারখানা-ভিত্তিক উৎপাদনপদ্ধতিরসূচনা ঘটে।একবার যন্ত্র ও কারখানা-ভিত্তিক উৎপাদনের প্রবর্তন শুরু হলে, তাদ্রুত অন্যান্য শিল্পে ছড়িয়ে পড়েবিশেষ করে কাপড় ও বই ছাপানো, কুমারশিল্প এবং ধাতুশিল্পে।

শ্রমকে ধাপে ধাপে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে ফেলা হয়, যাতে করে পূর্বে যে শ্রমিক সম্পূর্ণ একটি কাজ করতেন, এখন তিনি কেবল একটি অংশবিশেষই তৈরি করেন।

এই শ্রমবিভাজন উৎপাদনকে দ্রুততর ও সাশ্রয়ী করে তোলে।শ্রমিকের কাজ সীমিত হয়ে দাঁড়ায় যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তির মাঝে, যা শেষমেশ যন্ত্র দিয়ে আরও ভালোভাবে করা সম্ভব হয়ে ওঠে।

এইভাবে একের পর এক শিল্প শাখা যন্ত্র, স্টিমকারখানাব্যবস্থার অধীনতায় চলে আসেযেমনটা ইতিপূর্বে সুতা ও তাঁত শিল্পে ঘটেছিল।একই সঙ্গে এই শিল্পগুলো বড় মূলধনীদের দখলে চলে যায় এবং শ্রমিকরা তাদের শেষ স্বাধীনতার চিহ্নটুকুও হারায়।ধীরে ধীরে কেবল আসল ‘ম্যানুফ্যাকচার’ বা উৎপাদন ব্যবস্থা নয়, হস্তশিল্পও চলে আসে কারখানার আওতায়।

বড় মূলধনী শ্রেণি ক্রমশ ছোট ছোট কারিগর ও কারুশিল্পীদের স্থান দখল করে নেয় বিশাল কর্মশালা স্থাপনের মাধ্যমেযা ব্যয় সাশ্রয়ী এবং শ্রমবিভাজনকে আরও জটিলভাবে বাস্তবায়ন করে।

এইভাবে আমরা এমন এক অবস্থানে পৌঁছেছি যেখানে সভ্য দেশগুলোর প্রায় সব ধরনের শ্রমই এখন কারখানাভিত্তিক।এবং প্রায় সব কাজেই হস্তশিল্প ও ম্যানুফ্যাকচার পরিত্যক্ত হয়েছে।এইপ্রক্রিয়াপুরাতনমধ্যবিত্তশ্রেণিকে, বিশেষতছোটছোটহস্তশিল্পীদের, ব্যাপক ভাবেধ্বংসকরেছেএটি শ্রমিক শ্রেণির অবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিয়েছে এবং এর ফলে গড়ে উঠেছে দুটি নতুন শ্রেণি, যারা ধীরে ধীরে সকল পুরাতন শ্রেণিকে গ্রাস করছে।এই দুটি শ্রেণি হলোঃ

(১) বড় মূলধনীর শ্রেণি, যারা সকল সভ্য দেশে প্রায় একচেটিয়া মালিক হয়ে উঠেছে জীবনের উপকরণ এবং যেসব যন্ত্র ও উপকরণ (যেমনঃ যন্ত্রপাতি, কারখানা) দরকার এসব উৎপাদনের, সেগুলোর।এই শ্রেণিই হলো বুর্জোয়া শ্রেণি বা বুর্জোয়াজি।

(২) সম্পূর্ণভাবে নিঃস্ব একটি শ্রেণি, যাদের বেঁচে থাকার জন্য তাদের শ্রম বুর্জোয়া শ্রেণির কাছে বিক্রি করতে হয়, যাতে তারা বিনিময়ে জীবনের উপকরণ পায়।এই শ্রেণিই হলো প্রলেতারিয়েত শ্রেণি বা প্রলেতারিয়ানস।

৫। প্রলেতারিয়েতরা বুর্জোয়ার কাছে যে শ্রম বিক্রি করে, তা কী শর্তে বিক্রি করে?

-শ্রম, অন্যান্য পণ্যের মতোই, একটি বাণিজ্যিক পণ্য। সুতরাং, এর মূল্য নির্ধারিত হয় সেই একই অর্থনৈতিক নীতিমালার ভিত্তিতে, যা অন্য সকল পণ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বৃহৎ শিল্পব্যবস্থা অথবা অবাধ প্রতিযোগিতার পরিস্থিতিতে—যা কার্যত একই ফলাফল সৃষ্টি করে—পণ্যের গড় মূল্য নির্ধারিত হয় সেই পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় ব্যয়ের সমতুল্যে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, শ্রমের মূল্যও নির্ধারিত হয় শ্রম উৎপাদনের ব্যয়ের ভিত্তিতে। কিন্তু শ্রম উৎপাদনের ব্যয় বলতে বোঝানো হয় এমন পরিমাণ জীবিকা ও উপকরণ, যা একজন শ্রমিককে শ্রমশক্তি ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট এবং একই সঙ্গে গোটা শ্রমজীবী শ্রেণিকে প্রজনন ও পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয়। অর্থাৎ, শ্রমিক তার শ্রমের বিনিময়ে যা পায়, তা কেবলমাত্র জীবনধারণের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট—তার বেশি নয়। শ্রমের মূল্য, বা মজুরি, এই ন্যূনতম জীবিকা নির্বাহের মানদণ্ডেই স্থির থাকে।

তবে বাস্তবতায় অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ভিন্নতা অনুসারে এই মজুরি কখনো কিছুটা বাড়ে, আবার কখনো কমে। ব্যবসার ভালো সময়ে শ্রমিক তুলনামূলকভাবে বেশি মজুরি পেতে পারে, আর মন্দাবেলায় তা হ্রাস পায়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে, দীর্ঘমেয়াদে, শ্রমিক গড় হিসেবে তার ন্যূনতম জীবিকা নির্বাহের চাহিদার অতিরিক্ত কিছুই পায় না—ঠিক যেমনভাবে পুঁজিপতি তার পণ্যের প্রকৃত উৎপাদন ব্যয়ের বাইরে স্থায়ীভাবে লাভ বা ক্ষতির মুখোমুখি হয় না। এই মজুরি নির্ধারণের অর্থনৈতিক আইন বিশেষত তখনই সবচেয়ে কঠোরভাবে প্রয়োগযোগ্য হয়ে ওঠে, যখন বৃহৎ শিল্পব্যবস্থা সমাজের সমস্ত উৎপাদন খাতকে ধীরে ধীরে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে শুরু করে।

৬। শিল্পবিপ্লবের পূর্বে শ্রমজীবী শ্রেণির প্রকৃতি কেমন ছিল?

-সমাজের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমজীবী শ্রেণির অবস্থান ও ভূমিকার রূপান্তর ঘটেছে প্রতিনিয়ত। ভিন্ন ভিন্ন যুগে এবং ভিন্ন ভিন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এই শ্রেণি নিজেকে আবিষ্কার করেছে ভিন্ন ভিন্ন রূপে—কখনো দাস, কখনো সেরফ, আবার কখনো ক্ষুদ্র উৎপাদক হিসেবে।

প্রাচীন যুগে শ্রমজীবীরা ছিল মূলত দাস, যারা ছিল ব্যক্তি সম্পত্তির অংশ। গ্রীস ও রোমের দাসপ্রথা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই রীতির ধারা এখনো কিছু পশ্চাৎপদ সমাজে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলেও অতীতে টিকে ছিল। দাসরা সম্পূর্ণরূপে তাদের প্রভুদের অধীন ছিল এবং তাদের শ্রমের বিনিময়ে তারা কোনো ব্যক্তিস্বাধীনতা কিংবা সামাজিক মর্যাদা লাভ করত না।

মধ্যযুগে, এই দাসপ্রথা ধীরে ধীরে রূপ নেয় সেরফ ব্যবস্থায়। তখনকার ইউরোপীয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজে শ্রমজীবীরা ভূমির সঙ্গে আবদ্ধ সেরফে পরিণত হয়। তারা ছিল জমির মালিক বা অভিজাতদের কর্দমভূক্ত, যারা জমি চাষ করত এবং তার বিনিময়ে অতি সামান্য জীবিকা ও আশ্রয়ের অধিকার পেত। আজও হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড এবং রাশিয়ার কিছু অংশে এই ব্যবস্থার চিহ্ন বিদ্যমান রয়েছে।

শিল্পবিপ্লবের আগ পর্যন্ত শহরাঞ্চলে শ্রমজীবী শ্রেণি ছিল মূলত হস্তশিল্পী ও ‘জার্নিম্যান’ (journeymen)। এরা ক্ষুদ্র মালিকানাধীন কারখানা বা দোকানে কাজ করত এবং সাধারণত একজন কারিগরের অধীনে থেকে পেশাগত দক্ষতা অর্জন করত। তারা এক ধরনের আধা-স্বাধীন কর্মী ছিল, যাদের নির্দিষ্ট মজুরি বা আয় থাকত না, বরং কাজের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করত।

পরবর্তীতে যখন ‘ম্যানুফ্যাকচার’ বা বৃহৎ হস্তশিল্প ভিত্তিক উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে উঠতে শুরু করে, তখন এই ‘জার্নিম্যান’-রাই পরিণত হয় ম্যানুফ্যাকচারিং শ্রমিকে। এ পর্যায়ে তারা ক্ষুদ্র পুঁজির মালিকদের পরিবর্তে বৃহৎ পুঁজিপতিদের অধীনে শ্রম প্রদান করতে থাকে। এই রূপান্তরের মধ্য দিয়েই আধুনিক প্রলেতারিয়েত শ্রেণির ভিত্তি তৈরি হতে থাকে, যা শিল্পবিপ্লবের পূর্ণ বিকাশের মধ্য দিয়ে একটি সংগঠিত ও বৃহৎ শ্রমজীবী শ্রেণিতে পরিণত হয়।

৭। প্রলেতারিয়ানরা কিভাবে দাসদের থেকে আলাদা?

-দাসত্ব ও প্রলেতারিয়ান অবস্থার মধ্যে রয়েছে এক মৌলিক পার্থক্য। দাস একবারেই বিক্রি হয়—চূড়ান্তভাবে এবং স্থায়ীভাবে—একজন প্রভুর মালিকানায়। অপরদিকে, প্রলেতারিয়ান প্রতিদিন, এমনকি প্রতি ঘণ্টায়, নিজের শ্রম শক্তিকে বারবার বিক্রি করতে বাধ্য হয়, কারণ তার কাছে পুঁজি নেই—শুধু শ্রমই তার পণ্য।

একজন দাস যেহেতু নির্দিষ্ট কোনো প্রভুর মালিকানাধীন, সেই প্রভু তার জীবনধারণের ন্যূনতম নিশ্চয়তা প্রদান করে, অন্তত তার স্বার্থে। দাস দুর্দশাগ্রস্ত হলেও তার বেঁচে থাকার একটি অর্থনৈতিক ভিত্তি থাকে, কারণ প্রভুর অর্থনৈতিক কল্যাণ সেই দাসের টিকে থাকার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অপরদিকে, একজন প্রলেতারিয়ানের শ্রম কেবল তখনই কেনা হয়, যখন কোনো পুঁজিপতির তার প্রয়োজন হয়। ফলে তার জীবনের কোনো স্থায়ী নিরাপত্তা নেই—সে নিছক বাজারে বিক্রয়ের যোগ্য একটি মানবসম্পদ মাত্র।

দাস প্রতিযোগিতার বাইরে থাকে। তার অবস্থান স্থির, নির্ধারিত। কিন্তু প্রলেতারিয়ান প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতার মধ্যে অবস্থান করে—অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে, মেশিনের সঙ্গে, বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে। এই প্রতিযোগিতা তাকে এক অস্থির ও অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়।

সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে দাস সমাজে নিছক একটি 'সম্পত্তি' হিসেবে বিবেচিত হতো, একজন পূর্ণাঙ্গ নাগরিক বা ব্যক্তি হিসেবে নয়। অথচ প্রলেতারিয়ান একটি 'উচ্চতর' সামাজিক কাঠামোর অংশ হলেও, বাস্তবে তার জীবনদশা অনেক সময়ই একজন দাসের চেয়ে দুর্বিষহ হতে পারে। তার স্বাধীনতা কেবল কাগজে-কলমে, কিন্তু অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সে বুর্জোয়ার আধিপত্যেই বন্দী।

আরও তাৎপর্যপূর্ণ হলো—দাস মুক্ত হয় যখন সে কেবল দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয় এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক হওয়ার মাধ্যমে প্রলেতারিয়ান শ্রেণিতে প্রবেশ করে। কিন্তু প্রলেতারিয়ানের মুক্তি আরও গভীরতর—তাকে শুধু নিজের দারিদ্র্য বা নির্ভরতাকে অস্বীকার করলেই চলবে না, তাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শ্রেণি ও প্রতিযোগিতার গোটা কাঠামোকেই বিলুপ্ত করতে হবে।

৮। প্রলেতারিয়ানরা সেরফদের থেকে কিভাবে আলাদা?

সেরফ বা ভূমিদাস মূলত জমির সঙ্গে যুক্ত এক রূপের শ্রমজীবী, যার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান দাসের চেয়ে কিছুটা উন্নত। সেরফ জমির মালিকের অধীনে থেকে তার জমি চাষ করত এবং বিনিময়ে ফসলের একটি অংশ কিংবা শ্রমসেবা প্রদান করত। সে জমির কিছু ব্যবহারিক অধিকার উপভোগ করত এবং সাধারণত সেই ভূমিতে তার বসবাস ও জীবিকা নিশ্চিত থাকত।

প্রলেতারিয়ান কিন্তু এমন নয়। সে কাজ করে এমন একটি উৎপাদন ব্যবস্থায়, যেখানে উৎপাদনের সব উপকরণই অন্য কারো মালিকানায়। সে কেবল নিজের শ্রম বিক্রি করে এবং তার বিনিময়ে সামান্য মজুরি পায়। এখানে জমির মালিকানার কোনো অংশীদারিত্ব নেই, নেই কোনো টেকসই নিরাপত্তা বা সামাজিক বন্ধন।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, সেরফের অবস্থা কিছু ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। তার জীবিকা, সীমিত হলেও, অন্তত নির্ভরযোগ্য। প্রলেতারিয়ানের জীবনে সেই নিশ্চয়তা অনুপস্থিত। তার স্থায়ী কর্মসংস্থান নেই, নেই জমি, ঘর কিংবা উৎপাদনের অন্য কোনো নিয়ন্ত্রণ।

সেরফ প্রতিযোগিতার বাইরে থাকে। সে নির্দিষ্ট জমিতে নির্দিষ্ট কর প্রদান করে টিকে থাকে। প্রলেতারিয়ান এর সম্পূর্ণ বিপরীত—তার বেঁচে থাকাটাই নির্ভর করে শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ওপর।

সেরফ তিনটি উপায়ে মুক্তি লাভ করতে পারে:

১. শহরে পালিয়ে গিয়ে সে হস্তশিল্পী বা শহুরে শ্রমিক হয়ে উঠতে পারে;২. প্রভুকে কর বা শ্রম না দিয়ে নগদ অর্থ প্রদান করে মুক্ত প্রজায় রূপান্তরিত হতে পারে;৩. কিংবা প্রভুকে উৎখাত করে নিজেই জমির মালিক হতে পারে।

উপরোক্ত প্রতিটি পথেই সে পরিণত হয় এক প্রকার ‘ক্ষুদ্র মালিক’-এবং সেই অনুযায়ী প্রতিযোগিতার অংশে পরিণত হয়। অন্যদিকে, প্রলেতারিয়ানের মুক্তি একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির। সে মুক্ত হয় তখনই, যখন সে প্রতিযোগিতা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং শ্রেণিভিত্তিক সামাজিক কাঠামোকেই বিলুপ্ত করে দেয়।

৯। প্রলেতারিয়ানরা হস্তশিল্পীদের থেকে কীভাবে আলাদা?

-প্রলেতারিয়ানদের সঙ্গে তথাকথিত হস্তশিল্পীদের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে—এটি শুধু পেশাগত নয়, বরং শ্রেণিগত এবং মনস্তাত্ত্বিকও। হস্তশিল্পী, বিশেষ করে যিনি আঠারো শতকে সর্বত্র বিদ্যমান ছিলেন এবং এখনও কোথাও কোথাও টিকে আছেন, তাঁকে সর্বোচ্চ মাত্রায় একজন 'সাময়িক' প্রলেতারিয়ান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তাঁর লক্ষ্য প্রলেতারিয়ানদের মতো নিছক শ্রম বিক্রি করে টিকে থাকা নয়; বরং নিজের পুঁজি জমিয়ে ভবিষ্যতে অন্য শ্রমিকদের শোষণকারী বুর্জোয়া শ্রেণিতে প্রবেশ করাই তাঁর আকাঙ্ক্ষিত অবস্থা।

এই হস্তশিল্পী সাধারণত তখনই তার লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হন, যখন তারা একটি গিল্ড বা কারুশিল্প সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত থাকেন, যেখানে প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রিত থাকে এবং কারখানাভিত্তিক উৎপাদনের আধিপত্য এখনো শুরু হয়নি। এই অবস্থা তাদের স্বাধীনতা ও সীমিত নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার সুযোগ দেয়।

কিন্তু একবার যখন উৎপাদনে কারখানা-পদ্ধতির প্রবেশ ঘটে, আর বাজারে অবাধ প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তখন এই হস্তশিল্পী নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারেন না। পুঁজির দখল, উৎপাদন দক্ষতা এবং বাজার কাঠামোর প্রতিযোগিতায় তিনি ক্রমশ পিছিয়ে পড়েন এবং এক সময় তিনিও প্রলেতারিয়ানের সারিতে এসে পড়েন—নিজের শ্রম বিক্রির বাইরে আর কোনো বিকল্প তাঁর হাতে থাকে না।

সুতরাং, হস্তশিল্পীর ভবিষ্যৎ মূলত তিনটি পথে গড়ে উঠতে পারে:

১। তিনি সফলভাবে পুঁজি সঞ্চয় করে একজন ক্ষুদ্র বুর্জোয়ায় পরিণত হন—এটি একটি সম্ভাব্য, তবে সীমিত পথ।

২। তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উত্তরণ ঘটান—বিশেষত উচ্চ দক্ষতা বা কৌশল থাকলে।

৩। অথবা—এটাই সবচেয়ে সাধারণ ও আধুনিক বাস্তবতা—তীব্র প্রতিযোগিতার চাপে পড়ে তিনি প্রলেতারিয়ানে পরিণত হন, একজন বেতননির্ভর শ্রমজীবীতে রূপান্তরিত হন।

এই শেষ পর্যায়ে এসে তিনি যদি সচেতন হন এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেন, তবে তাঁর সামনে খুলে যায় মুক্তির নতুন দ্বার—তিনি কমিউনিস্ট বা প্রলেতারিয়ান আন্দোলনে যুক্ত হয়ে এই শোষণমূলক কাঠামোর বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামতে পারেন। এই সংগ্রাম তখন আর শুধু তার ব্যক্তিগত মুক্তির জন্য নয়, বরং গোটা প্রলেতারিয়ান শ্রেণির মুক্তির অংশ হয়ে ওঠে।

১০। প্রলেতারিয়ানরা 'ম্যানুফ্যাকচারিং' শ্রমিকদের থেকে কীভাবে আলাদা?

-'ম্যানুফ্যাকচারিং' যুগের শ্রমিকরা—যাদের আমরা ষোড়শ থেকে আঠারো শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়কালে দেখতে পাই—মূলত একটি ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর অংশ ছিলেন। তাঁরা ছিলেন পুঁজির প্রাথমিক স্তরে অন্তর্ভুক্ত শ্রমিক, যাঁদের জীবন ছিল আধা-স্বাধীন এবং যাঁরা নিজেদের উৎপাদন উপকরণের ওপর আংশিকভাবে হলেও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারতেন।

এই শ্রমিকদের অধিকাংশেরই ছিল নিজস্ব তাঁত, পরিবারের ব্যবহৃত সুতা কাঁটার চাকা, এমনকি অবসরে নিজ চাহিদা মেটানোর মতো ছোট একটি জমির মালিকানাও। তাঁরা কেবলমাত্র শ্রম বিক্রেতা ছিলেন না; তারা ছিলেন একজন ক্ষুদ্র উৎপাদকও। পুঁজি তখনও তাঁদের কাছ থেকে পুরোপুরি শ্রমের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেয়নি।

অন্যদিকে, আধুনিক প্রলেতারিয়ান—বিশেষ করে শিল্প বিপ্লব-পরবর্তী সময়ের শহরভিত্তিক শ্রমজীবী—সম্পূর্ণরূপে নিজের উৎপাদনের উপকরণ হারিয়ে ফেলেছে। তাঁর না আছে জমি, না তাঁত, না সুতা কাঁটার চাকা, এমনকি অনেক সময় মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও থাকে ভাড়া করা। প্রলেতারিয়ান এখন কেবলমাত্র নিজের শ্রমশক্তি বিক্রি করেই বেঁচে থাকে, এবং তা করতে হয় প্রতিনিয়ত একটি প্রতিকূল প্রতিযোগিতার বাজারে।

'ম্যানুফ্যাকচারিং' যুগের শ্রমিকদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল—তাঁদের সঙ্গে মালিক বা নিয়োগকারীর সম্পর্ক অনেকাংশেই পিতৃতান্ত্রিক ছিল। এটি কখনো বন্ধুত্বপূর্ণ, কখনো করুণানির্ভর হলেও অন্তত কিছুটা মানবিক ছিল। শ্রমিকরা গ্রামে থাকতেন, একই মালিকের অধীনে কাজ করতেন বছরের পর বছর, ফলে একধরনের সামাজিক বন্ধন তৈরি হতো।

প্রলেতারিয়ানদের ক্ষেত্রে এই চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আধুনিক প্রলেতারিয়ান মূলত শহরবাসী, তাঁরা হয়তো বারবার মালিক পরিবর্তন করেন, অথবা এক মালিকের অধীনে কাজ করলেও তার সঙ্গে সম্পর্কটি একান্তই অর্থনৈতিক—ঠান্ডা, চুক্তিভিত্তিক এবং অবসান-সক্ষম। এখানে কোনো পিতৃতান্ত্রিকতা নেই; আছে কেবল শ্রমের বিনিময়ে নির্ধারিত মজুরি।

বৃহৎ শিল্প ব্যবস্থা যখন ধীরে ধীরে 'ম্যানুফ্যাকচারিং' প্রক্রিয়াকে গ্রাস করে নেয়, তখনই ঘটে এই রূপান্তর। প্রথাগত হস্তশিল্পীরা হারান নিজেদের পুঁজি, ছোটখাটো উপকরণ এবং স্বাধীনতা। ধীরে ধীরে তাঁরা রূপান্তরিত হন প্রলেতারিয়ানে—একজন নির্ভরশীল, নিরুপায়, বেতননির্ভর শ্রমজীবীতে।

এই রূপান্তর কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিকও। এটি মানবজীবনের ভেতরে গভীরতর নিঃসঙ্গতা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। যেখানে এক সময় একজন শ্রমিক নিজেকে আংশিক মালিক ভাবতে পারতেন, সেখানে আজকের প্রলেতারিয়ান কেবল নিজের শ্রম বিক্রি করেই জীবনধারণ করেন—নিজের শ্রমের উৎপাদন কীভাবে ব্যবহৃত হবে, সে বিষয়ে তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

এভাবে, শিল্পায়নের বিকাশ শুধু একটি উৎপাদন প্রক্রিয়ার রূপান্তর নয়; এটি একটি শ্রেণির ভেতরের আত্মপরিচয়, জীবনের দর্শন এবং সমাজের কাঠামো বদলে দেয়।


শতাব্দীর প্রভাবশালী দলিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র—তৃতীয় পর্বের শেষাংশ

২০২৫ জুলাই ১৫ ১৭:২১:৩৬
শতাব্দীর প্রভাবশালী দলিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র—তৃতীয় পর্বের শেষাংশ

রাজনৈতিক দর্শনের ইতিহাসে এক অনন্য দলিল হলো কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। জার্মান ভাষায় এর মূল নাম “Manifesto der Kommunistischen Partei”, অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার। বিখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালে এই এটি লিখেন, যা প্রথম প্রকাশিত হয় লন্ডনে। ১৮৪৮ সালে যখন এটি ইউরোপে প্রকাশিত হয়, তখনকার বিপ্লবাত্মক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি ছিল এক যুগান্তকারী লেখা। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-কে আজও বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলিলগুলোর অন্যতম বলে বিবেচনা করা হয়।

এই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির চারটি অধ্যায় রয়েছে। ধারাবাহিক ভাবে আমরা এর ভাবানুনাদ পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি। আজ আমরা তৃতীয় পর্বের শেষাংশে বিভিন্ন বিদ্যমান বিরোধী দলের প্রতি কমিউনিস্টদের অবস্থান, এ সম্পর্কে কার্ল মার্কসকে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের চিঠি, কমিউনিস্ট বিশ্বাস স্বীকারোক্তির খসড়া এবং একজন কমিউনিস্টের বিশ্বাস স্বীকারোক্তি (A Communist Confession of Faith) এর সরল, পরিশীলিত ও ব্যাখ্যামূলক ভাষান্তর পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করছি। আশাকরি পাঠকরা সহজভাবে এর মূল ভাবনা ও তাৎপর্য বুঝতে পারবেন।

বিভিন্ন বিদ্যমান বিরোধী দলের প্রতি কমিউনিস্টদের অবস্থান

দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ইতোমধ্যেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে ইংল্যান্ডে চার্টিস্ট আন্দোলন এবং আমেরিকায় কৃষি সংস্কারপন্থীদের মতো বিদ্যমান শ্রমিক শ্রেণির দলগুলোর প্রতি কমিউনিস্টদের সম্পর্ক কেমন।

কমিউনিস্টরা শ্রমিক শ্রেণির তাৎক্ষণিক লক্ষ্য এবং মুহূর্তের প্রয়োজনীয় স্বার্থ বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম করে। তবে তারা কেবলমাত্র বর্তমান আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সেই আন্দোলনের ভবিষ্যত্‌তাকেও তারা প্রতিনিধিত্ব করে এবং তার সুরক্ষাও করে।

ফ্রান্সে কমিউনিস্টরা রক্ষণশীল এবং চরমপন্থী বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলে। তবে তারা ফরাসি বিপ্লবের উত্তরাধিকার হিসেবে যে সব বিভ্রম ও ধাপ প্রচলিত আছে, সেগুলোর প্রতি সমালোচনামূলক অবস্থান গ্রহণের অধিকারও সংরক্ষণ করে।

সুইজারল্যান্ডে তারা র‍্যাডিকালদের সমর্থন করে। তবে তারা ভুলে যায় না যে এই দলটি পরস্পরবিরোধী উপাদানে গঠিত। এর একটি অংশ হলো ফরাসি অর্থে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী এবং অন্যটি চরমপন্থী বুর্জোয়া।

পোল্যান্ডে তারা সেই দলটির পাশে দাঁড়ায় যারা মনে করে, জাতীয় মুক্তির প্রধান শর্ত হলো কৃষিভিত্তিক বিপ্লব। এই দলটিই ১৮৪৬ সালের ক্রাকো বিদ্রোহ সংঘটনে নেতৃত্ব দেয়।

জার্মানিতে কমিউনিস্টরা বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে যৌথভাবে লড়াই করে, যখন সেই শ্রেণি বিপ্লবী ভূমিকা গ্রহণ করে। এই সংগ্রামের লক্ষ্য থাকে একচেটিয়া রাজতন্ত্র, সামন্ত প্রভুশ্রেণি এবং ক্ষুদ্র বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে।

তবে তারা কখনোই এক মুহূর্তের জন্যও থেমে যায় না শ্রমিক শ্রেণিকে এই শিক্ষা দিতে যে বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েতের মধ্যে একটি মৌলিক বৈরিতা ও শত্রুতা বিরাজ করে। তারা চায় যেন জার্মান শ্রমিকরা, বুর্জোয়া শ্রেণির কর্তৃত্বের সঙ্গে সঙ্গে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিগুলো অবশ্যম্ভাবীভাবে আসবে, সেগুলোকে বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শেখে। এভাবে, জার্মানির প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণিগুলোর পতনের পরপরই যেন বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধেও সংগ্রাম শুরু করা যায়।

কমিউনিস্টদের বিশেষ মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে জার্মানির দিকে, কারণ এই দেশটি একটি বুর্জোয়া বিপ্লবের প্রাক্কালে অবস্থান করছে। এই বিপ্লব সংঘটিত হবে ইউরোপীয় সভ্যতার তুলনামূলকভাবে উন্নত পরিস্থিতিতে এবং এমন এক প্রলেতারিয়েত শ্রেণির দ্বারা, যা সতেরো শতকের ইংল্যান্ড কিংবা আঠারো শতকের ফ্রান্সের তুলনায় অধিক পরিণত। তদুপরি, জার্মানির বুর্জোয়া বিপ্লব হবে অবিলম্বে ঘনিয়ে আসা প্রলেতারিয়েত বিপ্লবের এক পূর্বসূচনা।

সার্বিকভাবে, কমিউনিস্টরা বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রতিটি বিপ্লবী আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়। এ সকল আন্দোলনে তারা প্রতিটি ক্ষেত্রেই সর্বাগ্রে সম্পত্তির প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে, তা যে পর্যায়েই থাকুক না কেন।

সবশেষে, তারা কাজ করে বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দলের মধ্যে ঐক্য ও সমঝোতা স্থাপনের লক্ষ্যে।

কমিউনিস্টরা নিজেদের মতাদর্শ ও লক্ষ্যের কথা গোপন রাখে না। তারা খোলাখুলিভাবে ঘোষণা করে যে তাদের উদ্দেশ্য কেবলমাত্র বিদ্যমান সমস্ত সামাজিক শর্তের বলপ্রয়োগে ধ্বংসের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব।

শাসক শ্রেণিরা যেন কমিউনিস্ট বিপ্লবের কাছে শিহরিত হয়।

প্রলেতারিয়েতের হারানোর কিছু নেই, কেবল তাদের শৃঙ্খল ছাড়া। তাদের সামনে রয়েছে একটি জয়ী বিশ্ব।

সকল দেশের শ্রমিকগণ, ঐক্যবদ্ধ হও।

কার্ল মার্কসকে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের চিঠি

প্যারিস, ২৩–২৪ নভেম্বর ১৮৪৭

প্রিয় মার্কস,

এই সন্ধ্যা পর্যন্ত নিশ্চিত হয়নি যে আমি যাচ্ছি।তাহলে দেখা হচ্ছে শনিবার সন্ধ্যায়, ওস্টেন্ডে, হোটেল দ্য লা কুরোন-এ, যেটি বন্দর সংলগ্ন রেলস্টেশনের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত।রবিবার সকালে আমরা জলপথে পার হবো।তুমি যদি বিকেল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনটি ধরো, তাহলে তুমি আমার সঙ্গে প্রায় একই সময়ে পৌঁছাবে।

... মঙ্গলবার সন্ধ্যায়, ভার্টে(পৃষ্ঠার উল্টো দিকে দেখো)

“বিশ্বাসস্বীকারোক্তি” বিষয়টা নিয়ে একটু ভাবো।আমার ধারণা, আমরা ‘প্রশ্নোত্তরমূলক’ কাঠামোটি বাদ দিয়ে এই লেখাটিকে “কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো” নামে প্রকাশ করলেই ভালো হবে।যেহেতু এতে ইতিহাসের কিছু ব্যাখ্যা দেওয়া অপরিহার্য, তাই পূর্ববর্তী রূপটি এই কাজের জন্য উপযুক্ত নয়।

আমি এখানকার যেটি করেছি [Principles of Communism], সেটি সঙ্গে আনবো।এটি সাধারণ বর্ণনামূলক রূপে লেখা, কিন্তু অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে লেখা হওয়ায় ভাষা অনেকখানি দুর্বল হয়ে পড়েছে।আমি শুরু করেছি এই প্রশ্ন দিয়ে—“কমিউনিজম কী?”এরপর সরাসরি চলে গেছি প্রলেতারিয়েত-এর বিষয়ে।বর্ণনা করেছি তার উৎপত্তির ইতিহাস, পূর্ববর্তী শ্রমজীবীদের থেকে তার পার্থক্য, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির দ্বন্দ্বের বিকাশ, সংকটসমূহ এবং উপসংহার।এর ফাঁকে বিভিন্ন গৌণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছি এবং শেষে রেখেছি কমিউনিস্টদের দলগত নীতি, যতটুকু প্রকাশযোগ্য।

এই পাঠ্য এখনো সম্পূর্ণভাবে অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয়নি।তবে, কিছু অপ্রাসঙ্গিক বা তুচ্ছ বিষয় বাদ দিলে, আমি মনে করি এটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে পারবো যাতে এর কোনোকিছু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়।

কমিউনিস্ট বিশ্বাস স্বীকারোক্তির খসড়া

এই দলিলটি হলো কমিউনিস্ট লীগের প্রথম কংগ্রেসে (লন্ডন, ২–৯ জুন ১৮৪৭) আলোচিত কর্মসূচির একটি খসড়া। এই কংগ্রেসটি ছিল “লিগ অব দ্য জাস্ট” নামে পরিচিত সংগঠনটির পুনর্গঠনের চূড়ান্ত ধাপ। উক্ত সংগঠনটি ১৮৩৬–৩৭ সালে প্যারিসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এটি ছিল মূলত জার্মান শ্রমিক ও কারিগরদের একটি সংগঠন। অল্প সময়ের মধ্যেই এটি একটি আন্তর্জাতিক চরিত্র অর্জন করে এবং জার্মানি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ব্রিটেন ও সুইডেনে এর শাখা সম্প্রসারিত হয়।

মার্কস ও এঙ্গেলসের সক্রিয় তত্ত্বগত ও সাংগঠনিক ভূমিকা, যা সমাজতন্ত্রী ও অগ্রসর শ্রমিকদের মধ্যে মতাদর্শগত ঐক্য গঠনের দিকে পরিচালিত হয়, তা “লিগ অব দ্য জাস্ট”-এর লন্ডন-অবস্থিত নেতৃবৃন্দকে (কার্ল শাপার, জোসেফ মল, হাইনরিশ বাউয়ার) অনুপ্রাণিত করে। ১৮৪৬ সালের নভেম্বর থেকে এই নেতারা মার্কস ও এঙ্গেলসের কাছে অনুরোধ করেন—লিগকে পুনর্গঠন করতে এবং এর জন্য একটি নতুন কর্মসূচি প্রস্তুত করতে সাহায্য করতে।

যখন মার্কস ও এঙ্গেলস নিশ্চিত হন যে, এই নেতারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নীতিগুলোকে সংগঠনের কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত, তখন ১৮৪৭ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে তারা লীগের সদস্যপদ গ্রহণের প্রস্তাব গ্রহণ করেন।

এই কংগ্রেসে এঙ্গেলসের সক্রিয় অংশগ্রহণ (মার্কস লন্ডনে যেতে পারেননি) কংগ্রেসের গতি ও ফলাফলের উপর সুস্পষ্ট প্রভাব ফেলেছিল।সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে “কমিউনিস্ট লীগ” রাখা হয় এবং পূর্বের আদর্শবাক্য “সকল মানুষ ভাই” (All men are brothers)-এর পরিবর্তে নতুন মার্কসবাদী স্লোগান “বিশ্বের শ্রমিকরা এক হও” (Working Men of All Countries, Unite!) গ্রহণ করা হয়।

কংগ্রেসের শেষ দিনে, অর্থাৎ ৯ জুন ১৮৪৭, সংগঠনের খসড়া কর্মসূচি ও খসড়া বিধিনিয়ম পাস হয়।

এই “কমিউনিস্ট বিশ্বাসস্বীকারোক্তি” (Credo)-এর পূর্ণ পাঠ্য প্রথমবারের মতো জানা যায় ১৯৬৮ সালে, যখন সুইস গবেষক বার্ট আঁদ্রেয়াস এই খসড়া বিধিনিয়ম ও প্রথম কংগ্রেসের সদস্যদের উদ্দেশে প্রেরিত একটি সার্কুলারের সঙ্গে এটি আবিষ্কার করেন। এই দলিলগুলো ছিল কমিউনিস্ট লীগের সক্রিয় সদস্য জোয়াখিম ফ্রিডরিশ মার্টেন্সের ব্যক্তিগত সংগ্রহে, যা বর্তমানে হামবুর্গ রাজ্য ও বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত রয়েছে।

এই আবিষ্কার কমিউনিস্ট লীগের ইতিহাস এবং এর কর্মসূচির দলিল তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচন করে।

পূর্বে ধারণা করা হতো যে, প্রথম কংগ্রেসে শুধু একটি কর্মসূচি তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল এবং এরপর জুন থেকে আগস্ট ১৮৪৭ এর মধ্যে লন্ডনের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ (জোসেফ মল, কার্ল শাপার, হাইনরিশ বাউয়ার) এই খসড়াটি তৈরি করেন।

তবে নতুন প্রাপ্ত দলিলগুলো প্রমাণ করে যে, খসড়াটি ৯ জুন ১৮৪৭ তারিখেই প্রস্তুত ছিল এবং এর লেখক ছিলেন ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস। মার্টেন্সের সংগ্রহে পাওয়া পাণ্ডুলিপিটি এঙ্গেলসের হাতের লেখা। কেবল কয়েকটি শব্দ, উপসংহার এবং কংগ্রেসের সভাপতি ও সচিবের স্বাক্ষর ছাড়া বাকিটুকু তাঁরই রচনা।

এই দলিলটি প্রমাণ করে যে কংগ্রেসে কর্মসূচির আলোচনায় এঙ্গেলসের প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর। অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তরই বিশুদ্ধ মার্ক্সবাদী রূপে রচিত।

এছাড়া, কর্মসূচির খসড়া তৈরির সময় এঙ্গেলসকে এই বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হয়েছিল যে, লীগ সদস্যরা তখনো পর্যন্ত ইউটোপিয়ান সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হননি। এটি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে প্রথম ছয়টি প্রশ্ন ও উত্তররূপে।

এই “বিপ্লবী ধর্মপুস্তক” বা "catechism"-এর ধরন সে সময় “লিগ অব দ্য জাস্ট” এবং অন্যান্য শ্রমিক ও কারিগর সংগঠনে খুব প্রচলিত ছিল।

এটি ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, এঙ্গেলস ভবিষ্যতে এই কর্মসূচির দলিলটির ভাষা ও যুক্তির আরও পরিমার্জন ও নির্ভুলতা আনার উদ্দেশ্য নিয়েই কাজ করছিলেন।

প্রথম কংগ্রেসের পর “কমিউনিস্ট বিশ্বাসস্বীকারোক্তি” এবং খসড়া বিধিনিয়ম সংগঠনের অন্যান্য শাখায় পাঠানো হয়। এই পাঠ্যের ওপর আলোচনার ফলাফল বিবেচনা করে পরবর্তী দ্বিতীয় কংগ্রেসে কর্মসূচি ও বিধিনিয়মের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হবে—এই ছিল পরিকল্পনা।

১৮৪৭ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে, এঙ্গেলস যখন Principles of Communism নামে একটি পরিমার্জিত কর্মসূচি রচনা করছিলেন, তখন তিনি সরাসরি এই “বিশ্বাসস্বীকারোক্তি” দলিলটিকে ব্যবহার করেছিলেন। দুই দলিলের পাঠ্যাংশে মিল দেখা যায় এবং Principles-এ পূর্ববর্তী দলিলটির প্রতি ইঙ্গিতও পাওয়া যায়, যেখানে এঙ্গেলস সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে কিছু উত্তর পূর্বের মতোই রেখে দেওয়া হবে।

একজন কমিউনিস্টের বিশ্বাস স্বীকারোক্তি (A Communist Confession of Faith)

প্রণেতা: ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস
লন্ডন, ৯ জুন ১৮৪৭

প্রশ্ন ১: আপনি কি একজন কমিউনিস্ট?
উত্তর: হ্যাঁ।

প্রশ্ন ২: কমিউনিস্টদের লক্ষ্য কী?
উত্তর: সমাজকে এমনভাবে সংগঠিত করা যাতে তার প্রতিটি সদস্য সম্পূর্ণ স্বাধীনতার মধ্যে নিজ নিজ ক্ষমতা ও দক্ষতার সর্বাঙ্গীন বিকাশ ও প্রয়োগ করতে পারে, এবং তাতে সমাজের মৌলিক শর্তাবলীর কোনো লঙ্ঘন না ঘটে।

প্রশ্ন ৩: এই লক্ষ্য আপনি কীভাবে বাস্তবায়ন করতে চান?
উত্তর: ব্যক্তিগত মালিকানা বিলুপ্ত করে তাকে সামাজিক মালিকানা দিয়ে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে।

প্রশ্ন ৪: এই সামাজিক মালিকানার ভিত্তি কী?
উত্তর: প্রথমত, শিল্প, কৃষি, বাণিজ্য এবং ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণের মাধ্যমে উৎপাদনশীল শক্তি ও জীবনধারণের উপকরণের বিপুল পরিমাণ সঞ্চয়ের ওপর। যন্ত্র, রসায়ন ও অন্যান্য প্রযুক্তিগত উন্নতির মাধ্যমে যা ক্রমাগত সম্প্রসারিত হওয়ার সামর্থ্য রাখে।
দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক ব্যক্তির চেতনা বা অনুভবে নিহিত কিছু অপ্রতিরোধ্য মৌলিক নীতির ওপর, যা সমগ্র ঐতিহাসিক বিকাশের ফলাফল হিসেবে প্রমাণের প্রয়োজন ছাড়াই গ্রহণযোগ্য।

প্রশ্ন ৫: এমন মৌলিক নীতিগুলো কী কী?
উত্তর: যেমন, প্রত্যেক ব্যক্তি সুখী হতে চায়। ব্যক্তিগত সুখ সর্বসাধারণের সুখ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, ইত্যাদি।

প্রশ্ন ৬: আপনি কীভাবে এই সামাজিক মালিকানার পথ প্রস্তুত করতে চান?
উত্তর: প্রলেতারিয়েতকে প্রজ্ঞা দিয়ে আলোকিত ও ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে।

প্রশ্ন ৭: প্রলেতারিয়েত কী?
উত্তর: সমাজের সেই শ্রেণি যারা শুধুমাত্র নিজেদের শ্রমের মাধ্যমে বেঁচে থাকে, কোনো ধরণের মূলধনের মুনাফা থেকে নয়। এদের জীবন ও মৃত্যু নির্ভর করে ব্যবসার চক্রাকার উত্থান-পতনের ওপর। সংক্ষেপে, প্রতিযোগিতার ওঠানামার ওপর।

প্রশ্ন ৮: তাহলে কি সব সময় প্রলেতারিয়েত ছিল?
উত্তর: না। গরিব ও শ্রমজীবী শ্রেণি সর্বদা ছিল, আর যারা কাজ করত তারা প্রায় সবসময়ই ছিল দরিদ্র। কিন্তু প্রলেতারিয়েত সর্বদা ছিল না, যেমন প্রতিযোগিতাও সবসময় মুক্ত ছিল না।

প্রশ্ন ৯: প্রলেতারিয়েত কীভাবে গড়ে উঠল?
উত্তর: প্রলেতারিয়েত গঠিত হয় বিগত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হওয়া যন্ত্রপাতির আবিষ্কারের ফলে। এসব যন্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো স্টিম ইঞ্জিন, স্পিনিং মেশিন এবং পাওয়ার লুম। এ যন্ত্রগুলো ছিল ব্যয়বহুল এবং শুধুমাত্র ধনীদের পক্ষেই ক্রয়যোগ্য। তারা শ্রমিকদের প্রতিস্থাপন করেছিল, কারণ যন্ত্র ব্যবহারে পণ্য উৎপাদন সম্ভব হয়েছিল দ্রুত এবং কম খরচে। এর ফলে শিল্প গিয়েছিল ধনী পুঁজিপতিদের হাতে, এবং শ্রমিকদের সামান্য যে সম্পত্তি—তাঁদের হাতের যন্ত্র, তাঁত ইত্যাদি—তা হয়ে পড়েছিল মূল্যহীন। ফলে পুঁজিপতিরা পায় সবকিছু, আর শ্রমিক পায় কিছুই না।

এইভাবেই গড়ে উঠেছিল কারখানা ব্যবস্থা। পুঁজিপতিরা বুঝতে পারে এই ব্যবস্থা তাঁদের জন্য কতটা লাভজনক, এবং তাঁরা এটিকে আরও বেশি কাজের ক্ষেত্রে প্রসারিত করে। তাঁরা শ্রমিকদের কাজ বিভক্ত করে, ফলে আগে যারা একটি সম্পূর্ণ পণ্য তৈরি করত, তারা এখন শুধুমাত্র তার একটি অংশ বানায়। এই সরলীকরণে উৎপাদন দ্রুত হয় এবং কম খরচে হয়। তখন দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি কাজেই যন্ত্রের ব্যবহার সম্ভব। একবার কোনো শাখা কারখানাভিত্তিক উৎপাদনে গেলে, সেটিও পুঁজিপতিদের হাতে চলে যায়, আর শ্রমিকেরা হারায় শেষ স্বাধীনতাটুকু।

আমরা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে প্রায় সব কাজই কারখানা ভিত্তিক। এই প্রক্রিয়া ধ্বংস করেছে পূর্ববর্তী মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র কারিগরদের, আর শ্রমিকদের অবস্থানকে পুরোপুরি রূপান্তর করেছে। এর ফলে গড়ে উঠেছে দুইটি নতুন শ্রেণি:

১. ধনী পুঁজিপতিদের শ্রেণি, যারা উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে প্রায় একচেটিয়া দখলে রেখেছে জীবিকা নির্বাহের উপায় ও সেইসব উপায় (যন্ত্র, কারখানা, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি) যেগুলো দিয়ে এসব জীবনধারণের উপায় উৎপাদিত হয়। এদের বলা হয় বুর্জোয়া শ্রেণি বা বুর্জোয়াজি।
২. একেবারে সম্পত্তিহীন শ্রেণি, যারা জীবিকা নির্বাহের জন্য বাধ্য হয়ে নিজেদের শ্রম বিক্রি করে বুর্জোয়াদের কাছে, যাতে তারা নিজেদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী পেতে পারে। যেহেতু এই লেনদেনে পক্ষদ্বয় সমান নয় এবং বুর্জোয়াদের হাতে সুবিধা, তাই শ্রমিকদের বাধ্য হয়ে বুর্জোয়া দ্বারা নির্ধারিত প্রতিকূল শর্ত মেনে চলতে হয়। এই শ্রেণিকে বলা হয় প্রলেতারিয়েত।

প্রশ্ন ১০: প্রলেতারিয়েত কিভাবে দাসের থেকে ভিন্ন?
উত্তর: দাস একবারের জন্য বিক্রি হয়, প্রলেতারিয়েতকে প্রতিদিন কিংবা প্রতি ঘণ্টায় নিজেকে বিক্রি করতে হয়।
দাস একজন প্রভুর সম্পত্তি এবং সেই কারণেই, তার জীবিকা—যতই করুণ হোক না কেন—গ্যারান্টি দেওয়া থাকে।
প্রলেতারিয়েত বলতে গেলে পুরো বুর্জোয়া শ্রেণির দাস, কোনো একক প্রভুর নয়, ফলে তার জীবিকা কোনোভাবেই নিশ্চিত নয়, কারণ তার শ্রম তখনই কেনা হয় যখন বুর্জোয়া শ্রেণির প্রয়োজন পড়ে।
দাসকে সমাজে ব্যক্তি নয়, বস্তুর মর্যাদা দেওয়া হয়।
প্রলেতারিয়েতকে ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, সে নাগরিক সমাজের একজন সদস্য।
সুতরাং, দাসের জীবিকা প্রলেতারিয়েতের চেয়ে ভালো হতে পারে, কিন্তু প্রলেতারিয়েত উন্নয়নের উচ্চতর স্তরে অবস্থান করে।
দাস মুক্ত হয় যখন সে প্রলেতারিয়েতে রূপান্তরিত হয়, অর্থাৎ সম্পত্তিগত সম্পর্কের মধ্যে কেবল দাসত্বের সম্পর্কটিকেই বিলোপ করে।
কিন্তু প্রলেতারিয়েত সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারে কেবল তখনই, যখন সে সমস্ত ধরনের সম্পত্তির মালিকানাই বিলুপ্ত করে।

প্রশ্ন ১১: প্রলেতারিয়েত কীভাবে ক্রীষক বা সার্ফ থেকে আলাদা?
উত্তর: সার্ফ ভূমি ব্যবহারের সুযোগ পায়, অর্থাৎ উৎপাদনের একটি উপকরণের মালিক হয়, বিনিময়ে তাকে তার উৎপাদনের একটি অংশ হস্তান্তর করতে হয়।
প্রলেতারিয়েত এমন উপকরণ দিয়ে কাজ করে যেগুলোর মালিক অন্য কেউ, এবং তার শ্রমের বিনিময়ে সে পায় প্রতিযোগিতা দ্বারা নির্ধারিত একটি অংশ।
সার্ফের আয় নির্ধারিত হয় তার নিজের শ্রম দ্বারা, অর্থাৎ তার নিজের দ্বারা;
প্রলেতারিয়েতের ভাগ্য নির্ধারিত হয় প্রতিযোগিতা দ্বারা, অর্থাৎ বুর্জোয়ার দ্বারা।
সার্ফের জীবিকা গ্যারান্টিযুক্ত, প্রলেতারিয়েতের নয়।
সার্ফ স্বাধীন হয় তার প্রভুকে বিতাড়ন করে এবং নিজেই জমির মালিক হয়ে প্রতিযোগিতায় প্রবেশ করে, ফলে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও সে হয়ে ওঠে মালিক শ্রেণির একজন সদস্য।
প্রলেতারিয়েত স্বাধীন হয় সম্পত্তি, প্রতিযোগিতা ও শ্রেণি ব্যবস্থার বিলুপ্তির মাধ্যমে।

প্রশ্ন ১২: প্রলেতারিয়েত কীভাবে হস্তশিল্পী থেকে ভিন্ন?
উত্তর: হস্তশিল্পী, যিনি গত শতাব্দীতে প্রায় সর্বত্র ছিলেন এবং এখনো কোথাও কোথাও বিদ্যমান, তিনি মূলত একজন অস্থায়ী প্রলেতারিয়েত।
তার লক্ষ্য হচ্ছে নিজেই মূলধন সংগ্রহ করে অন্য শ্রমিককে শোষণ করা।
এই লক্ষ্য সে তখনই অর্জন করতে পারে যখন কোথাও গিল্ড ব্যবস্থা এখনো টিকে আছে কিংবা যেখানে পেশাগত স্বাধীনতা এখনো শিল্পকে কারখানা ভিত্তিক উৎপাদনে রূপান্তর করেনি এবং প্রতিযোগিতা তীব্র হয়নি।
কিন্তু যেই মুহূর্তে হস্তশিল্পে কারখানা ব্যবস্থা প্রবেশ করে এবং প্রতিযোগিতা তীব্র হয়, তখন এই সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় এবং হস্তশিল্পী প্রলেতারিয়েতে পরিণত হন।
হস্তশিল্পী মুক্ত হতে পারেন হয় বুর্জোয়া শ্রেণিতে প্রবেশ করে, অথবা প্রতিযোগিতার ফলে প্রলেতারিয়েত হয়ে গিয়ে প্রলেতারিয়েত আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে—অর্থাৎ সচেতন বা অসচেতনভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সদস্য হয়ে।

প্রশ্ন ১৩: তাহলে আপনি কি বিশ্বাস করেন না যে কখনোই যৌথ সম্পত্তির ভিত্তিতে সমাজ গঠিত হয়েছে?
উত্তর: না।
কমিউনিজম কেবল তখনই সম্ভব হয়েছে যখন যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য উদ্ভাবন এমন সম্ভাবনা এনে দিয়েছে, যেখানে সমাজের প্রতিটি সদস্যের জন্য সর্বাঙ্গীন বিকাশ ও সুখী জীবনের নিশ্চয়তা দেওয়া যেতে পারে।
কমিউনিজম এক ধরনের মুক্তির তত্ত্ব যা দাস, সার্ফ বা হস্তশিল্পীদের জন্য সম্ভব ছিল না—এটি কেবল প্রলেতারিয়েতদের মাধ্যমেই সম্ভব এবং এ কারণেই এটি উনিশ শতকের একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। পূর্ববর্তী কোনো যুগে তা সম্ভব ছিল না।

প্রশ্ন ১৪: আসুন আমরা ষষ্ঠ প্রশ্নে ফিরে যাই। আপনি যদি প্রলেতারিয়েতকে আলোকিত ও ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে যৌথ সম্পত্তির পথে প্রস্তুতি নিতে চান, তাহলে কি আপনি বিপ্লবকে প্রত্যাখ্যান করেন?
উত্তর: আমরা কেবল সব ধরনের ষড়যন্ত্রের অকার্যকারিতা নয়, বরং তার ক্ষতিকর প্রভাবেও বিশ্বাস করি।
আমরা জানি বিপ্লব ইচ্ছা বা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে গঠিত হয় না, বরং তা সর্বত্র এবং সবসময় পরিস্থিতির অনিবার্য পরিণতি যা ব্যক্তি বা শ্রেণির ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল নয়।
কিন্তু আমরা এটাও দেখি যে, প্রায় সব দেশে প্রলেতারিয়েতদের বিকাশ সম্পদশালী শ্রেণিরা বলপ্রয়োগে দমন করছে।
ফলে বিপ্লব একরকম এই বিরোধীরা নিজেরাই বাধ্য করছে।
যদি অবশেষে প্রলেতারিয়েত বিপ্লবে ঠেলে দেওয়া হয়, তাহলে আমরা আমাদের কাজ দিয়ে ঠিক যেমনভাবে এই মুহূর্তে আমাদের শব্দ দিয়ে তাদের পক্ষে আছি, তখনও থাকব।

প্রশ্ন ১৫: আপনি কি বর্তমান সমাজব্যবস্থাকে এক লাফে যৌথ সম্পত্তির ব্যবস্থায় রূপান্তর করতে চান?
উত্তর: না, আমাদের এমন কোনো অভিপ্রায় নেই।
জনগণের বিকাশ কোনো ফরমান বা নির্দেশে সংঘটিত হয় না।
এটি নির্ধারিত হয় সেই পরিস্থিতির দ্বারা, যেখানে তারা বাস করে এবং সুতরাং তা ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়।

প্রশ্ন ১৬: তাহলে এই রূপান্তর আপনি কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন?
উত্তর: যৌথ সম্পত্তি প্রবর্তনের প্রথম ও মৌলিক শর্ত হলো প্রলেতারিয়েতের রাজনৈতিক মুক্তি, যা একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে।

প্রশ্ন ১৭: একবার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে, আপনার প্রথম পদক্ষেপ কী হবে?
উত্তর: প্রলেতারিয়েতের জীবিকার নিশ্চয়তা বিধান।

প্রশ্ন ১৮: আপনি কীভাবে এটি করবেন?
উত্তর:
১. ব্যক্তিগত মালিকানাকে সীমিত করে, ধাপে ধাপে সামাজিক মালিকানার পথে রূপান্তরের জন্য, যেমন ধাপে ধাপে কর বৃদ্ধি, উত্তরাধিকার অধিকারের সীমাবদ্ধতা ইত্যাদির মাধ্যমে।
২. জাতীয় কর্মশালা ও কারখানায় শ্রমিকদের কর্মসংস্থান প্রদান করে।
৩. সকল শিশুদের রাষ্ট্রীয় খরচে শিক্ষাদান করে।

প্রশ্ন ১৯: এই রূপান্তরকালীন সময়কালে আপনি কীভাবে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করবেন?
উত্তর: যখনই শিশু মায়ের প্রাথমিক যত্ন ছাড়া থাকতে পারবে, তখন থেকেই সে রাষ্ট্র পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণ করবে।

প্রশ্ন ২০: তাহলে যৌথ সম্পত্তির প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কি নারীদের যৌথ ব্যবহারের ঘোষণাও আসবে?
উত্তর: মোটেই না।
আমরা পুরুষ-নারীর পারস্পরিক সম্পর্ক কিংবা পরিবারের ক্ষেত্রে কেবল তখনই হস্তক্ষেপ করব যখন বিদ্যমান পারিবারিক প্রতিষ্ঠান নতুন সমাজব্যবস্থার ব্যাঘাত ঘটাবে।
তাছাড়া আমরা সচেতন যে, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্ব ও সম্পত্তিগত সম্পর্ক অনুযায়ী পারিবারিক সম্পর্ক পরিবর্তিত হয়েছে এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তি পরিবারকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে।

প্রশ্ন ২১: কমিউনিজমে জাতিগত পরিচয় টিকে থাকবে কি?
উত্তর: যেসব জাতিগোষ্ঠী কমিউনিটির নীতির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবে, তারা নিজে থেকেই একে অপরের সঙ্গে মিশে যাবে এবং ধীরে ধীরে নিজেদের আলাদা অস্তিত্ব বিলুপ্ত করবে, যেমনভাবে শ্রেণি ও বর্ণভেদের পার্থক্য বিলুপ্ত হয় সম্পত্তিগত ভিত্তি বিলুপ্তির মাধ্যমে।

প্রশ্ন ২২: তাহলে কি কমিউনিস্টরা বিদ্যমান সব ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করে?
উত্তর: পূর্বে যেসব ধর্ম ছিল, তারা ইতিহাসের নির্দিষ্ট পর্যায়ে নির্দিষ্ট জাতির বা জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়নের প্রতিফলন ছিল।
কিন্তু কমিউনিজম হলো এমন এক ইতিহাস-পর্যায়ের প্রতিফলন, যা বিদ্যমান সব ধর্মকে অপ্রয়োজনীয় ও অতীত করে তোলে।

চলবে...


বার্নেবি হোয়াইট-স্পানারের ‘Partition’: একটি পরিশীলিত পাঠপ্রতিক্রিয়া

রিয়ার এডমিরাল (অব.) খোরশেদ আলম
রিয়ার এডমিরাল (অব.) খোরশেদ আলম
পরিচালক,সেন্টার ফর বে অব বেঙ্গল স্ট্যাডিজ, আইইউবি।
২০২৫ জুলাই ১৫ ১৩:৫৪:৪৪
বার্নেবি হোয়াইট-স্পানারের ‘Partition’: একটি পরিশীলিত পাঠপ্রতিক্রিয়া

বার্নেবি হোয়াইট-স্পানারের লেখা Partition একটি বিস্তৃত গবেষণানির্ভর ২৫০ পৃষ্ঠার ঐতিহাসিক বিবরণী, যেখানে ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের জটিল রাজনৈতিক পরিণতি এবং এর গভীর মানবিক বিপর্যয় বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই গ্রন্থে কেবল রাজনৈতিক পটভূমি নয়, বরং এই বিভাজনের কারণে সংঘটিত বিভৎস মানবিক ট্র্যাজেডি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। লেখক নিজে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল, যিনি বিভাজনের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল অচিনলেকের ডেপুটি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ফলে বইটি ব্রিটিশ দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হলেও মানবিক দুঃখবোধ ও যন্ত্রণার বিবরণে এটি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং অনেক পাঠকের জন্য তা মানসিকভাবে ভারী হয়ে উঠতে পারে।

গ্রন্থটি শুরু হয়েছে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের আলোচনা দিয়ে, যেখানে উল্লিখিত হয়েছে বিদ্রোহীদের সহিংসতা এবং পরে ব্রিটিশ বাহিনীর নিষ্ঠুর প্রতিক্রিয়া। এই বিদ্রোহের ফলস্বরূপ ভারতে কোম্পানির পরিবর্তে ব্রিটিশ ক্রাউন সরাসরি শাসন শুরু করে। ভাইসরয় হন রানি ভিক্টোরিয়ার প্রধান প্রতিনিধি, এবং এককভাবে ব্রিটিশদের দ্বারা গঠিত লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রশাসন পরিচালিত হতে থাকে। পরে ধীরে ধীরে কিছু ভারতীয় সদস্যকে এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই পরিষদের চারপাশেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের রাজনীতি আবর্তিত হতে থাকে, পরিণতিতে যা এসে পৌঁছায় দেশভাগের দ্বারপ্রান্তে।

বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা সেনা নিয়োগ নীতিতে আমূল পরিবর্তন আনে। বাংলা ও উত্তরপ্রদেশ থেকে সৈন্য নিয়োগ বন্ধ করে তারা রাজপুত, মারাঠা, পাঠান, ডোগরা, গুর্খা, জাঠ এবং পাঞ্জাবি মুসলিম ও শিখদের অগ্রাধিকার দেয়। পরে পাঞ্জাবি মুসলিম ও শিখরাই ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রায় ৫০% গঠন করে। জাতপাত ও জাতিগত ভিত্তিতে গঠিত এই সেনাবাহিনী দেশভাগের সময় সংঘটিত সহিংসতা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়।

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময় সেনা চলাচলের অসুবিধা মোকাবিলায় ব্রিটিশ সরকার রেলপথ নির্মাণে ব্যাপক বিনিয়োগ করে—ভারতের অর্থে গড়ে ওঠা বিশ্বের অন্যতম লাভজনক রেলব্যবস্থা। কিন্তু এই রেলব্যবস্থাই দেশভাগের সময় রক্তাক্ত হত্যাযজ্ঞের অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। দেশভাগ-পরবর্তী গণহত্যার একটি স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় খুশবন্ত সিংয়ের Train to Pakistan গ্রন্থে। দেশভাগে প্রায় ১০ থেকে ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়।

ব্রিটিশরা ‘ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস’ (ICS) গঠন করে, যার মাধ্যমে শিক্ষিত ব্রিটিশ যুবকরা ভারতে এসে প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই শ্রেণি পরবর্তীতে ভারতীয় সমাজে গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তর ঘটায়। ব্রিটিশরা মুসলিম শরিয়তভিত্তিক আইনি কাঠামো বিলুপ্ত করে ইংরেজি আইনি ব্যবস্থা প্রবর্তন করে।

এই পর্যায়ে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায় নিজেদের অভ্যন্তরে এবং একে অপরকে পুনর্মূল্যায়নের প্রক্রিয়া শুরু করে। মুসলমানদের মধ্যে একদল দিওবন্দি ধারার উদ্ভব ঘটায়—যাঁরা ইসলামের রক্ষণশীল ও আত্মরক্ষামূলক ব্যাখার পক্ষে ছিলেন। অপরদিকে, একটি আধুনিকতাপন্থী মুসলিম শ্রেণি গড়ে ওঠে যারা ব্রিটিশ শিক্ষাপদ্ধতির অনুসারী হয় এবং আলিগড় কলেজ ও পরবর্তীতে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে।

হিন্দুদের পক্ষেও ধর্মীয় সংস্কারের আন্দোলন শুরু হয়। ব্রাহ্ম সমাজ, দয়ানন্দ সরস্বতী, স্বামী বিবেকানন্দের মতো চিন্তাবিদরা হিন্দুধর্মে উদারতা এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রচলন ঘটান, যা পরবর্তীতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ভিত রচনা করে।

এদিকে, ব্রিটিশ সরকার সেনা ও পুলিশ বাহিনীর উন্নয়নে বাজেটের প্রায় অর্ধেক ব্যয় করে। তবে এই বিশাল দেশ শাসন করতে হলে স্থানীয় জনগণকে প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত করতেই হবে—এই উপলব্ধি থেকে শুরু হয় আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রয়াস। কলকাতা, বম্বে, মাদ্রাজ, পাঞ্জাব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এই শিক্ষিত শ্রেণিই ব্রিটিশদের শাসনের বিরুদ্ধে তর্ক, প্রশ্ন ও দাবির মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে শুরু করে। লন্ডন ফেরত আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল, জিন্নাহ, চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষচন্দ্র বসু, গোপাল কৃষ্ণ গোখলে প্রমুখ।

১৮৮৩ সালে ভাইসরয় লর্ড রিপনের ‘ইলবার্ট বিল’ ব্যর্থ হওয়া ছিল একটি টার্নিং পয়েন্ট। এতে ভারতীয় শিক্ষিত শ্রেণি উপলব্ধি করে—ব্রিটিশরা শিক্ষা দিলেও ভারতীয়দের কখনো সমান মর্যাদা দেবে না। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে কংগ্রেস গঠিত হয়। প্রথমে তারা শুধু সমান অধিকারের দাবিতে আন্দোলন চালায়; ১৯২০ সাল থেকে তারা পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলে।

এই সময়কালে (১৮৮৩–১৯২০) দুটি বড় ঘটনা ঘটে—১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯১১ সালে তার প্রত্যাহার। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের পক্ষে থাকলেও জমিদারপ্রধান কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দুরা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ফলে মুসলমানদের মধ্যে মুসলিম লীগ গঠনের তাগিদ তৈরি হয়—১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় মুসলিম লীগ গঠিত হয়।

১৯০৯ সালে লর্ড মিন্টো একটি আইন প্রবর্তন করেন, যাতে ভাইসরয়ের কাউন্সিলে ১২ জনের মধ্যে একজন ভারতীয় থাকবেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪–১৮) শুরু হলে ১২ লাখ ভারতীয় সৈন্য যুদ্ধে যোগ দেয়, এবং ভারত ১০ কোটি পাউন্ড অনুদান দেয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের চাপে ব্রিটিশরা ‘মনটেগু-চেমসফোর্ড রিফর্ম’ পাস করে, যদিও এটির বাস্তব রূপায়ন ছিল সীমিত। ১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড জাতিকে ক্ষুব্ধ করে। ১৯২০ সালে নাগপুর কংগ্রেস সম্মেলনে ‘স্বরাজ’-এর দাবি উঠে আসে।

১৯১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে আসা মহাত্মা গান্ধী তিনটি আন্দোলনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মাঝে পরিচিত হয়ে ওঠেন—চম্পারণ, আহমেদাবাদ এবং খেদা সত্যাগ্রহ। মোতিলাল ও জওহরলাল নেহরু ছিলেন বাম ঘরানার। প্যাটেল ছিলেন কট্টরপন্থী। জিন্নাহ ছিলেন সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ, ধর্মাচরণে অনাগ্রহী, এবং মুসলমানদের একটি সমাজিক গোষ্ঠী হিসেবে দেখতেন। তাঁর মতে, হিন্দু-মুসলমান সামাজিকভাবে অভিন্ন হতে পারেন না; তাই আলাদা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম থাকা প্রয়োজন। তিনি ১৯২০ পর্যন্ত কংগ্রেসে ছিলেন, পরে বিরক্ত হয়ে ব্রিটেনে চলে যান এবং ১৯৩৪ সালে মুসলিম লীগের অনুরোধে ফিরে আসেন।

১৯৩৫ সালে গভার্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট পাস হয়, ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে কংগ্রেস মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বে ব্যর্থ হয়। মুসলিম লীগের ফলাফলও দুর্বল ছিল—এটি মুসলিম রাজনীতির প্রাদেশিক চরিত্র প্রকাশ করে।

১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারত ২০ লাখ সৈন্য প্রেরণ করে। বিধানসভা ভেঙে ফেলা হয়। ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’ ব্যর্থ হয়। মুসলিম লীগ এই আন্দোলনে অংশ নেয়নি, বরং অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়।

১৯৪৩-৪৪ সালে ঘটে ভয়াবহ বেঙ্গল দুর্ভিক্ষ—চাল ৬ টাকা থেকে ৩৬ টাকা হয়ে যায়, খাদ্যশস্য তুলে নিয়ে যুদ্ধের জন্য ইতালিতে পাঠানো হয়। ৪-৫ মিলিয়নের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ সামরিক দিক থেকে সাফল্য অর্জন না করলেও, তার প্রভাব ছিল ব্যাপক। বিশেষত ব্রিটিশ ভারতীয় নৌবাহিনীতে বিদ্রোহের পরিবেশ তৈরি হয়।

১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশন আসে, মুসলিম লীগ ৮০% মুসলিম আসন এবং মোট আসনের ২৬% লাভ করে। প্রাথমিকভাবে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ মিশনের প্রস্তাবে সম্মত হয়; পরে কংগ্রেস পিছিয়ে যায়। জিন্নাহ ১৬ আগস্ট ১৯৪৬-কে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ ঘোষণা করেন। কলকাতা, নোয়াখালী, বিহার, পাঞ্জাবসহ বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতা শুরু হয়, যা স্বাধীনতার পরেও থামেনি।

মূলত ১৯৪৮ সালের ৩০ জুন ব্রিটিশ প্রত্যাহারের তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু মাউন্টব্যাটেন হঠাৎ করে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের তারিখ ঘোষণা করেন। দুইটি কমিশন গঠন করা হয়—একটি দেশভাগ, আরেকটি সীমান্ত নির্ধারণের জন্য। মাত্র ৪৫ দিনে স্যার সাইরিল র‍্যাডক্লিফ সীমান্ত নির্ধারণ করেন। আজও কেউ জানে না, কমিশনের ভেতরে কী আলোচনা হয়েছিল।

এরপর শুরু হয় রক্তাক্ত অধ্যায়। ট্রেনভর্তি মৃতদেহ একদিকে আসছে ২০০০ জনের লেখা ‘কাতাল করনা সিখো’, আরেকদিকে ৩০০০ জনের মৃতদেহের সঙ্গে লেখা ‘কাতাল করনা সিখ লিয়া’। নারীরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয়। গান্ধীর উপস্থিতি কলকাতা ও নোয়াখালীতে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত করে।

পাকিস্তানি পাঞ্জাব থেকে সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত হিন্দু ও শিখকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, ভারতীয় পাঞ্জাব থেকে সমস্ত মুসলমানকে। কিছু মানবিক ব্যতিক্রম ছিল, যেখানে বিপরীত সম্প্রদায়ের লোকজন একে অপরকে রক্ষা করে।

নারীদের নিয়ে লিয়াকত ও নেহরুর মধ্যে একটি চুক্তি হলেও, অনেক পরিবার তাঁদের ফেরত নিতে অস্বীকৃতি জানায়। অনেক নারী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। সাদত হাসান মান্টো তাঁদের দুঃখগাথা নিয়ে লেখেন।

জিন্নাহ ও নেহরু দুজনেই মর্মাহত হন, কিন্তু কিছুই করতে পারেননি। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী কেবল ব্রিটিশদের রক্ষা করতে নিয়োজিত ছিল।

জেনারেল অচিনলেক এত ব্যস্ত ছিলেন সেনা সম্পদ বণ্টন নিয়ে যে, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় বাহিনী ব্যবহারে ব্যর্থ হন। ভারতে নেহরু ব্রিটিশ সেনা সরিয়ে স্বদেশি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন, পাকিস্তানে মিলিটারি রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম বাহক হয়ে ওঠে।

ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীও সাধারণ মানুষের জন্য ছিল না, ছিল কেবল ঊর্ধ্বতনদের সেবা দেওয়ার জন্য। সেই মনোভাব আজও বদলায়নি।

জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে, এবং পরে লিয়াকত আলী খান মারা যান। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢেকে যায়। এর পরের ইতিহাস একটি আলাদা অধ্যায়।

এই বইটি একইসাথে দারুণভাবে উপস্থাপিত এবং হৃদয়বিদারক একটি ঐতিহাসিক মানবিক ট্র্যাজেডির দলিল। যারা ইতিহাস বোঝে এবং ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা নিতে চায়, তাঁদের জন্য এটি এক অপরিহার্য পাঠ্য।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধ: এক বৈশ্বিক রক্তপাতের ইতিহাস ও এর উত্তরাধিকার

২০২৫ জুলাই ০৭ ০৮:২৫:২১
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ: এক বৈশ্বিক রক্তপাতের ইতিহাস ও এর উত্তরাধিকার

বিশ্ব ইতিহাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪–১৯১৮) একটি যুগান্তকারী অধ্যায়, যা শুধু ইউরোপই নয়, গোটা মানবসভ্যতার ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলেছে। সাম্রাজ্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, সামরিক জোটপ্রথা এবং কূটনৈতিক ব্যর্থতার জটিল সমন্বয়ে এক অভূতপূর্ব বৈশ্বিক সংঘাতের সূচনা ঘটে, যা পৃথিবীর চারটি মহাদেশজুড়ে যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে আনে। প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে চলা এই যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর বহু পুরনো সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, নতুন রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক আদর্শের উত্থান হয়, এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা হয়। এই যুদ্ধ আধুনিক পরাশক্তির উদ্ভব, নারীর সমাজে নতুন ভূমিকা এবং পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধের বীজ বপনের ক্ষেত্রেও গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এই প্রতিবেদনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পেছনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, যুদ্ধের বিবরণ ও কৌশল, প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ, যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্ব ব্যবস্থার রূপরেখা এবং শান্তিচুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি আলোচনা করা হয়েছে। পাঠককে যুদ্ধের একটি সমন্বিত ও বিশ্লেষণধর্মী চিত্র উপস্থাপন করাই এ প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য।

যুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পেছনে একাধিক রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক কারণ কাজ করেছিল। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে ইউরোপে পরস্পরবিরোধী সামরিক জোট গঠিত হয়েছিল – একটি পক্ষ ছিল ট্রিপল এলায়েন্স (জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও ইতালি) এবং বিপরীতে ছিল ট্রিপল আন্তান্তে (ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া)। ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সাম্রাজ্যবাদ, ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সমরবাদ (সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা), তীব্র জাতীয়তাবাদ, এবং বিপক্ষ জোটগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা মিলিয়ে ইউরোপে এক উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষ করে, জার্মান সাম্রাজ্যের উত্থান ও অটোমান সাম্রাজ্যের অধঃপতন ইউরোপের পুরনো ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট করেছিল। বলকান অঞ্চলে সার্বিয়া ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির মধ্যে জাতিগত ও রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছে। এই পরিস্থিতিতে ১৯১৪ সালের ২৮শে জুন বসনিয়ার সারায়েভো শহরে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সিংহাসনের উত্তরাধিকারী আর্চডিউক ফ্রানৎস ফার্ডিনান্ডকে গাভরিলো প্রিন্সিপ নামক এক যুব সার্বীয় জাতীয়তাবাদী হত্যা করেন। এই হত্যা-কাণ্ড প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তাৎক্ষণিক শুভেচক (trigger) হিসেবে কাজ করে। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এই ঘটনার জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং কঠোর শর্তসহ সার্বিয়াকে চূড়ান্ত নোটিশ পাঠায়। সার্বিয়া কিছু শর্ত মেনে নিলেও সব পূরণ করতে অপারগ হয়। ফলশ্রুতিতে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি যুদ্ধের পথ বেছে নেয়। অবশেষে ১৯১৪ সালের ২৮শে জুলাই অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ ঘটনার জেরে জোটবদ্ধ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দ্রুত অন্যান্য শক্তিগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। রাশিয়া সার্বিয়ার পক্ষসমর্থনে সামরিক মোবিলাইজেশন শুরু করলে ১লা আগস্ট জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং পরবর্তীতে ফ্রান্সের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করে। জার্মান সেনাবাহিনী ফ্রান্স আক্রমণের উদ্দেশ্যে নিরপেক্ষ বেলজিয়ামে আগ্রাসন চালালে ব্রিটেন ৪ঠা আগস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। অটোমান তুরস্ক নবেম্বরে জার্মান পক্ষ (কেন্দ্রীয় শক্তি) নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেয়। এভাবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ইউরোপের প্রধান শক্তিগুলো দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং বিশ্বজুড়ে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে।

চিত্র: ১৯১৪ সালে ইউরোপের সামরিক জোটসমূহ – প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ইউরোপের শক্তিগুলোর দুই বিপরীত জোটের মানচিত্র। সবুজ রঙে মিত্রশক্তি (ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও তাদের মিত্ররা) এবং কমলা/বাদামী রঙে কেন্দ্রীয় শক্তি (জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, পরবর্তীতে অটোমান সাম্রাজ্য) দেখানো হয়েছে। যুগোস্লাভ জাতীয়তাবাদের কেন্দ্র বলকান অঞ্চল ছিল অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে সার্বিয়া ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির দ্বন্দ্ব ইউরোপের বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ প্রজ্বলিত করে।

যুদ্ধের বিবরণ: প্রধান ঘটনা ও কৌশল

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ২৮ জুলাই ১৯১৪ তারিখে এবং চলতে থাকে প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে ১১ নভেম্বর ১৯১৮ পর্যন্ত। যুদ্ধে মূলত দুটি জোট মুখোমুখি ছিল: মিত্রশক্তি (এন্টেন্ট) এবং কেন্দ্রীয় শক্তি। কেন্দ্রীয় শক্তির প্রধান দেশগুলো ছিল জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, অটোমান সাম্রাজ্য (তুরস্ক) ও প্রথমে ইতালি; মিত্রশক্তিতে ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, সার্বিয়া ও তাদের উপনিবেশসমূহ, পরবর্তীতে ইতালি (১৯১৫ সালে পক্ষ পরিবর্তন করে) ও ১৯১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো কিছু দেশ। ইউরোপ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কিছু অঞ্চলেও যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, কারণ উপনিবেশ এবং মিত্রদেশগুলোও সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল। জার্মানির সামরিক কৌশল ছিল দ্রুত ফ্রান্সকে পরাজিত করে পরে পূর্বদিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা (শ্লিফেন পরিকল্পনা)। ১৯১৪ সালের আগস্টে জার্মান বাহিনী বেলজিয়াম হয়ে ফ্রান্স অভিমুখে দ্রুত অগ্রসর হয়। শুরুতেই জার্মানরা কিছু সফলতা পেলেও সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্যারিসের নিকটস্থ মার্ন নদীর প্রথম যুদ্ধে মিত্রশক্তি তাদের অগ্রাভিযান থামিয়ে দেয়। ফলে পশ্চিম রণক্ষেত্রে যুদ্ধটি স্থবির হয়ে পড়ে এবং দুপক্ষই পরিখা খুঁড়ে অবস্থান যুদ্ধ (ট্রেঞ্চ ওয়ারফেয়ার) শুরু করে। ১৯১৪ সালের শেষ নাগাদ উত্তর সাগর থেকে সুইজারল্যান্ড সীমান্ত পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে পরিখা-নির্ভর এক স্থবির যুদ্ধরেখা সৃষ্টি হয়েছিল। বিপরীতে পূর্ব রণাঙ্গনে (রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে) যুদ্ধ গতিশীল ছিল; জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ট্যানেনবার্গ ও মশুরিয়ান লেকস প্রভৃতি যুদ্ধে জয় পেলেও রাশিয়ার বিশাল জনবল ও এলাকা জয়ের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এবং কেউই দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারেনি।

চিত্র: পশ্চিম ফ্রন্টে ব্রিটিশ সেনাদের ট্রেঞ্চ (ফ্রান্স, জুলাই ১৯১৬) – পশ্চিম রণক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ ও মেশিনগানের মুখে সৈন্যরা মাটির নিচে পরিখা বা ট্রেঞ্চে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ করত। এই পরিখাযুদ্ধ পদ্ধতিতে দুই পক্ষ মাসের পর মাস স্থানে স্থানে স্থিতিশীল থেকে অবস্থান ধরে রাখে, ফলে যুদ্ধ অচলাবস্থায় পড়ে। ট্রেঞ্চগুলো ছিল কাদামাটিতে ভরা, অস্বাস্থ্যকর এবং বিপজ্জনক; সেখানে রোগ-বিস্তার, ইঁদুরের উপদ্রব, এবং শেল শক নামে পরিচিত তীব্র মানসিক আঘাতের ঘটনা ঘটতো। দীর্ঘস্থায়ী পরিখাযুদ্ধের কারণে উভয় পক্ষই বিপুল হতাহত হওয়া সত্ত্বেও খুব সামান্য ভূখণ্ড লাভ করত।

১৯১৫ ও ১৯১৬ সালে যুদ্ধের ভয়াবহতা আরও বৃদ্ধি পায়। উভয় পক্ষ নতুন নতুন অস্ত্র ও কৌশল অবলম্বন করতে থাকে। বিমান প্রথমবারের মতো ব্যাপকভাবে নজরদারি ও বোমাবর্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়, ট্যাংক প্রয়োগ শুরু হয় ১৯১৬ সালে (ব্রিটিশ সেনাবাহিনী সোম্মের যুদ্ধে প্রথম ট্যাংক ব্যবহার করে), এবং দুই পক্ষই মারাত্মক রাসায়নিক অস্ত্র (বিশেষ করে ক্লোরিন ও মাস্টার্ড গ্যাস) ব্যবহার করে যার ফলে ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয়। ১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারি-ডিসেম্বরে ভারডাঁর যুদ্ধ এবং জুলাই-নভেম্বরে সোম্মের যুদ্ধ – এই দুটি পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টের যুদ্ধে অমানবিক রক্তক্ষয় হয়, কিন্তু তবু কোনো পক্ষই দৃশ্যমান সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। ভারডাঁতে প্রায় ৭ লক্ষের বেশি ফরাসি-জার্মান সেনা হতাহত হয় এবং সোম্মে যুদ্ধে প্রায় ১০ লক্ষ সৈন্য হতাহত হয়েছিল। এসব যুদ্ধ অবস্থানগত স্থবিরতা ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছিল। সমুদ্রপথে, ব্রিটিশ রয়্যাল নৌবাহিনী ও জার্মান নৌবাহিনীর মধ্যে উত্তাল প্রতিযোগিতা চলে।

১৯১৬ সালের মে মাসে উত্তর সাগরে যুটল্যান্ডের নৌযুদ্ধ সংঘটিত হয় – এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বৃহত্তম নৌসমর। যদিও এই যুদ্ধে কোনো পক্ষই নির্ণায়ক জয় পায়নি, ব্রিটিশ নৌবাহিনী সমুদ্রে তার আধিপত্য বজায় রাখে। অন্যদিকে, জার্মানি ব্রিটেনকে দুর্বল করতে ইউ-বোট সাবমেরিন দিয়ে আটলান্টিকে মিত্রদের জাহাজডুবি শুরু করে। এই অসীম সাবমেরিন যুদ্ধনীতি (unrestricted submarine warfare) ব্রিটেনের জন্য হুমকি তৈরি করলেও পরবর্তীতে জার্মানির বড় ভুল হিসেবে পরিগণিত হয়, কারণ এর ফলে নিরপেক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাত তৈরি হয়। ১৯১৭ সালে জার্মানি যখন আবার নিরঙ্কুশভাবে সাবমেরিন দ্বারা বাণিজ্যিক জাহাজ ডুবানো শুরু করে, তখন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হয়ে মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধে প্রবেশ করে (এপ্রিলে, ১৯১৭)। যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল মানববল ও শিল্পসম্পদ মিত্রশক্তির পক্ষ শক্তির ভারসাম্য বাড়িয়ে দেয়। একই বছরে (১৯১৭) রাশিয়ার ভেতরে বিপ্লব সংঘটিত হয়। সাম্রাজ্যবাদী জার ও পুরোনো শাসনের পতন ঘটে এবং বলশেভিক (কমিউনিস্ট) সরকার ক্ষমতায় আসে। বলশেভিক সরকার যুদ্ধ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে চেয়েছিল। তারা ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় শক্তির সাথে সাময়িক যুদ্ধবিরতি এবং পরবর্তীতে ১৯১৮ সালের মার্চ মাসে ব্রেস্ট-লিটোভস্ক চুক্তির মাধ্যমে আলাদাভাবে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে রাশিয়াকে যুদ্ধ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এই চুক্তির ফলে পূর্ব মোর্চা বন্ধ হয়ে গেলেও কেন্দ্রীয় শক্তির জন্য এটি স্বস্তির ছিল সাময়িক; জার্মানি পশ্চিম রণাঙ্গনে সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনা করে।

১৯১৮ সালের বসন্তে জার্মানি পশ্চিম ফ্রন্টে একটি চূড়ান্ত বড় আক্রমণ শুরু করে (বসন্ত অভিযান)। প্রথম দিকে জার্মান বাহিনী কিছু অঞ্চলে অগ্রগতি লাভ করলেও তাদের সৈন্যরা অতিমাত্রায় ক্লান্ত ও রসদশূন্য হয়ে পড়ে। বিপরীতে, যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্রশক্তির মজবুত প্রশিক্ষিত নতুন সেনাবাহিনী ও প্রাচুর্যপূর্ণ রসদ নিয়ে একই বছরে আগস্ট থেকে শতদিনের পাল্টা অভিযান শুরু করে। এই পাল্টা আক্রমণে জার্মান ফ্রন্ট একের পর এক ভেঙে পড়ে এবং কেন্দ্রীয় শক্তির মনোবল চূর্ণ হয়। ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মিত্রবাহিনী বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে বার্দার অভিযান সফলভাবে চালিয়ে গেলে বুলগেরিয়া আত্মসমর্পণ করে। অক্টোবরে মিত্রশক্তির অভিযানে মধ্যপ্রাচ্য ও বলকানেও অটোমান ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির পরাজয় স্পষ্ট হয়ে যায়; নভেম্বরের প্রথম দিকে অটোমান সাম্রাজ্য এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি মিত্রশক্তির কাছে পৃথক অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে সই করে যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসে। একে একে সব মিত্র দেশ হারিয়ে জার্মানি একা হয়ে পড়ে এবং দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধবিরোধী বিপ্লব শুরু হয়। অবশেষে ১৯১৮ সালের ৯ নভেম্বর জার্মান সম্রাট ক্যায়সার উইলহেলম দ্বিতীয় অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের মুখে সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১১ নভেম্বর ১৯১৮ তারিখে ফ্রান্সের কম্পিয়েনে জার্মান কর্তৃপক্ষ মিত্রশক্তির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি (Armistice) চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার মাধ্যমে চার বছর ধরে চলা মহাযুদ্ধের সক্রিয় শত্রুতার অবসান ঘটে।

ক্ষয়ক্ষতি: প্রাণহানি, ধ্বংস ও সামাজিক প্রভাব

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মানব ইতিহাসের অন্যতম সর্বাধিক প্রাণসংহারী সংঘাত। চার বছরের যুদ্ধে অসংখ্য সৈন্য এবং নিরীহ নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে। ধারণা করা হয় যে প্রায় ৮৫ লক্ষ সামরিক সদস্য (সৈনিক) সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয়েছেন বা যুদ্ধজনিত আঘাত ও রোগে মারা গেছেন এবং সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে সম্ভবত ১.৩ কোটি পর্যন্ত লোক প্রাণ হারিয়েছে। মোট মৃত্যুর হিসাব বিভিন্ন অনুমান অনুযায়ী ১.৫ কোটি থেকে ২.২ কোটি পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া প্রায় ২ কোটি ৩০ লক্ষের মতো সৈন্য আহত বা বিকলাঙ্গ হয়ে ফিরে আসে। এই বিপুল সংখ্যক হতাহতের মূল কারণ ছিল নতুন ধরণের উন্নত অস্ত্র ও যুদ্ধকৌশল, যেমন ভারী আর্টিলারি গোলাবর্ষণ, মেশিনগান, ট্যাংক ও বিষাক্ত গ্যাসের ব্যবহার, যা আগের সব যুদ্ধের তুলনায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক বাড়িয়ে দেয়। অনেক সামরিক সদস্য বছরের পর বছর ট্রেঞ্চে অবস্থান নিয়ে লড়াই করার কারণে শারীরিক আঘাতের পাশাপাশি মানসিক আঘাত (যেমন শেল শক) নিয়ে ভুগেছেন, যা তখনকার সমাজে গুরুতর স্বাস্থ্যসমস্যা হিসেবে দেখা দেয়।

যুদ্ধ চলাকালীন এবং পরবর্তী সময়ে বেসামরিক জনগণও বিশাল বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। যুদ্ধ গুলিতে শহর, জনপদ ও অবকাঠামোর ব্যাপক ধ্বংস সাধিত হয়। বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের যুদ্ধকবলিত অঞ্চলসমূহ একেবারে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। উদাহরণস্বরূপ, বেলজিয়ামে জার্মান আক্রমণের সময় অনেক শহর (যেমন দিনাঁ শহর) সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং যুদ্ধ শেষে দেশটির অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে এই ধ্বংসযজ্ঞ প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ফ্রান্সের বহু ঐতিহাসিক নগর ও গ্রামের প্রায় কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। সারা ইউরোপ জুড়ে রেলওয়ে, সেতু, কারখানা, খনি ও কৃষিজমি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, যা যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকটকে তীব্রতর করে। অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অভূতপূর্ব ব্যয়বহুল সংঘাত ছিল। যুদ্ধ চালাতে গিয়ে যুদ্ধে জড়িত দেশগুলোকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয় যা তাদের অর্থনীতিকে নড়বড়ে করে দেয়। একটি হিসাব অনুযায়ী মিত্রশক্তি দেশগুলো সমগ্র যুদ্ধে প্রায় ১৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (১৯১৩ সালের মূল্যমান অনুযায়ী) খরচ করে এবং কেন্দ্রীয় শক্তিগুলো ব্যয় করে প্রায় ৬১ বিলিয়ন ডলার। যুদ্ধফান্ড জোগাড় করতে ব্রিটেন তার স্বর্ণ ভাণ্ডার ও বৈদেশিক বিনিয়োগ খরচ করে এবং ১৯১৭ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়। যুদ্ধ শেষে পরাজিত শক্তিদের ওপর বিশাল ক্ষতিপূরণ আরোপ করা হলেও বাস্তবে এই অর্থনৈতিক বোঝা বিশ্বব্যাপী মন্দা ও ঋণের চক্র সৃষ্টি করে, যা বহু দেশকে দশকজুড়ে বিপদে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঋণ পরিশোধ করতে শতাব্দীর বেশি সময় নিয়েছিল এবং শেষ কিস্তিটি ২০১৫ সালে গিয়ে পরিশোধ করে। সামাজিক ক্ষেত্রে যুদ্ধের প্রভাব ছিল ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী।

ইউরোপের জনসংখ্যার একটি পুরো প্রজন্ম এই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার কারণে পরবর্তীতে এই প্রজন্মকে “হারানো প্রজন্ম” (Lost Generation) বলা হয়ে থাকে। সমাজে নারীদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হতে শুরু করে – যুদ্ধে কোটি কোটি পুরুষ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ায় তাদের স্থান পূরণ করতে নারীরা বৃহৎ পরিসরে কল-কারখানা, অফিস ও বিভিন্ন পেশায় কাজ শুরু করেন। অনেক দেশে নারী শ্রমিকদের এই অভিজ্ঞতা নারীর অধিকারের প্রসার ও ভোটাধিকারের আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে। যুদ্ধ শেষে বেশ কয়েকটি দেশ (যেমন ব্রিটেন ১৯১৮ সালে আংশিকভাবে, ও যুক্তরাষ্ট্র ১৯২০ সালে) নারীদের ভোটাধিকার প্রদান করে, যা নারীর ক্ষমতায়নের পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। যুদ্ধপরবর্তী সমাজে মানসিক আঘাত ও শোক ছিল সর্বত্র বিদ্যমান। নিহত ও আহত সৈন্যদের পরিবারের ওপর এর গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং বহু শিশু পিতৃহীন হয়ে বড় হয়। সৈন্যদের মধ্যে মানসিক রোগ ও পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার ঘটনা সাধারণ হয়ে দাঁড়ায়, যা সরকার ও সমাজকে পুনর্বাসন ও কল্যাণমূলক উদ্যোগ নিতে বাধ্য করে। তাছাড়া, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির অব্যবহিত পরেই বিশ্ব এক ভয়াবহ মহামারীর কবলে পড়ে – ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু। যুদ্ধের কারণে সৈন্য ও শরণার্থীদের বিশ্বজুড়ে চলাচল এই ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী দ্রুত বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা রাখে। ফলে ১৯১৮-১৯ সালের মাঝে আনুমানিক ২ থেকে ৫ কোটি মানুষ এই মহামারীতে মারা যায়, যা বিশ্বের জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতিকে আরো বিপর্যস্ত করে তোলে। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, স্প্যানিশ ফ্লুতে মৃত্যুহার সরাসরি যুদ্ধের চেয়েও বেশি ছিল। যুদ্ধ এবং মহামারির যুগপত্ আঘাতে সমাজে এক ধরনের হতাশা ও মানবসভ্যতার প্রতি অবিশ্বাস দেখা দেয়, যা শিল্প-সাহিত্যেও প্রতিফলিত হয় (উদাহরণস্বরূপ যুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় সাহিত্য ও শিল্পে বিষাদ ও বিমূঢ়তার ছাপ)।

যুদ্ধের ফলাফল ও প্রভাব

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি বিজয়ী হয় এবং কেন্দ্রীয় শক্তি পরাজিত হয়। ১৯১৮ সালের শেষ দিকে যুদ্ধবিরতি চুক্তিগুলো স্বাক্ষরের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় জোটের পরাজয় নিশ্চিত হয় এবং যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে। এই যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে ইউরোপ ও বিশ্বের ক্ষমতার কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আসে। একদিকে মিত্রশক্তির প্রধান দেশগুলি (ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি) বিজয়ী শক্তি হিসেবে অবস্থানে আসে, অন্যদিকে পরাজিত রাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যগুলোর পতন ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ ফলাফল হিসেবে ইউরোপের চারটি প্রাচীন সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে: জার্মানিতে হোহেনৎসোলার্ন রাজবংশের সাম্রাজ্য (কায়সারের শাসন) উৎখাত হয়, রাশিয়ায় রোমানভ রাজবংশের সমাপ্তি ঘটে (বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে), অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিতে হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্য ভেঙে যায়, এবং অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যেরও অবসান হয়। শতাব্দীপ্রাচীন এই সাম্রাজ্যগুলোর পতনের ফলে ইউরোপের ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র নতুন করে আঁকা হয়। পরাজিত সাম্রাজ্যগুলো ভেঙে ছোট ছোট জাতিরাষ্ট্র গঠিত হতে থাকে – উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির বিভাজনে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া ও ইউগোস্লাভিয়া নামে নতুন রাষ্ট্র জন্ম নেয়; রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চল থেকে পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া প্রভৃতি স্বাধীন দেশ তৈরি হয়; এবং মধ্যপ্রাচ্যে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রদেশগুলো বিভাজিত হয়ে তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়া, প্যালেস্টাইনসহ বেশ কিছু অঞ্চল নতুন শাসনকাঠামোর অধীনে আসে। যুদ্ধের পর ক্ষমতার ভারসাম্যে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যুদ্ধকালীন মিত্রশক্তির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় – অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে ইউরোপের ক্লান্ত শক্তিগুলোর তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র অনেক শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে যায়।

১৯১৭ সালে যুদ্ধশেষের প্রাক্কালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে “চৌদ্দ দফা” নামক পরিকল্পনা ঘোষণা করেন যা যুদ্ধ-পরবর্তী আলোচনা প্রভাবিত করে। এসময় কমিউনিস্ট বলশেভিক বিপ্লব রাশিয়াকে যুদ্ধ থেকে সরিয়ে নিলেও পরবর্তীতে বিশ্বের রাজনীতিতে দ্বিধাবিভক্তির (পুঁজিবাদ বনাম কমিউনিজম) প্রেক্ষাপট তৈরি হয়, যা শীতল যুদ্ধের ভিত গড়ে দেয়। অপরদিকে, যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে সমকালীন ইউরোপীয়েরা এই যুদ্ধকে "সকল যুদ্ধের অবসান ঘটাবে যে যুদ্ধ" বলেও অভিহিত করেন, কেননা তাদের ধারণা ছিল এত বড় ধ্বংসযজ্ঞের পুনরাবৃত্তি মানবসভ্যতা আর করবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল ও শান্তিচুক্তিসমূহ এমন কিছু পরিস্থিতির জন্ম দেয় যা পরবর্তী যুগে আরও ভয়াবহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মঞ্চ তৈরি করে দেয়। যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক অভিজ্ঞতা থেকে জাতিসংঘ পর্যায়ের একটি বিশ্বসংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। ১৯১৯ সালে মিত্রশক্তির উদ্যোগে লীগ অব নেশনস (জাতিপুঞ্জ) প্রতিষ্ঠিত হয়, যার লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক বিরোধগুলোকে সংলাপের মাধ্যমে সমাধান করে পুনরায় বিশ্বযুদ্ধ এড়ানো। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দেশের আন্তরিকতা ও সদস্যপদ নিয়ে জটিলতা, এবং সংস্থাটির নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে লীগ অব নেশনস বিশ্বশান্তি রক্ষায় কার্যত ব্যর্থ হয়। এর ব্যর্থতার ফলে বিশের দশক ও ত্রিশের দশকে বিশ্ব আবার সংঘাত ও আগ্রাসনের দিকে ধাবিত হয়, যার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ১৯৩৯ সালে।

যুদ্ধের সমাপ্তি: শান্তিচুক্তি ও উত্তরাধিকার

চিত্র: ১৯১৯ সালের ২৮শে জুন ভার্সাইয়ের ‘হল অব মিরর্‌স’-এ শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রধান শান্তিচুক্তি ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরের মুহূর্ত।

মিত্রশক্তি ও জার্মানির প্রতিনিধিবৃন্দ ফ্রান্সের ভার্সাই প্রাসাদের বিখ্যাত হল অফ মিরর্‌সে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, যার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধের অবসান এবং যুদ্ধ-পরবর্তী ব্যবস্থাপনার সূচনা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সক্রিয় যুদ্ধসূচি শেষ হয় ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর – এই দিনে সন্ধ্যা ৫টাতে ফ্রান্সের কম্পিয়েন অঞ্চলে জার্মানি এবং মিত্রশক্তির মধ্যে একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তি (Armistice) স্বাক্ষরিত হয়, যা ১১ নভেম্বর ১৯১৮ রাত ১১টা থেকে কার্যকর হয় এবং সম্মুখসমর থেমে যায়। এই অস্ত্রবিরতির ফলে যুদ্ধবিগ্রহ থেমে গেলেও এটি ছিল মূলত একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি; চূড়ান্ত শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি আনুষ্ঠানিক শান্তিচুক্তি দরকার ছিল। সেই উদ্দেশ্যে ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে প্যারিসে একটি বিশাল আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন আহ্বান করা হয়, যেখানে মিত্রশক্তির নেতৃবৃন্দ পরাজিত শক্তিগুলোর ভাগ্য নির্ধারণে আলোচনা শুরু করেন। আলোচনার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর ১৯১৯ সালের ২৮শে জুন তারিখে জার্মানির সাথে ভার্সাই শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির আওতায় জার্মানিকে যুদ্ধের সম্পূর্ণ দায়ভার গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয় (চুক্তির beruchte War Guilt Clause অনুযায়ী), তাদের বিশাল অংকের যুদ্ধক্ষতিপূরণ প্রদান করতে বলা হয়, এবং জার্মান সামরিক শক্তির উপর কড়া সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়। জার্মানি তার ইউরোপীয় ভূখণ্ডের উল্লেখযোগ্য অংশ এবং সব বিদেশী উপনিবেশ মিত্রশক্তির কাছে হারায়।

ভার্সাই চুক্তি ছাড়াও পরাজিত অন্যান্য কেন্দ্রীয় শক্তির সাথে আলাদা আলাদা শান্তিচুক্তি হয় – অস্ট্রিয়াের সাথে সেন্ট জার্মেইন চুক্তি (১৯১৯), হাঙ্গেরির সাথে ট্রিয়ানোর চুক্তি (১৯২০), বুলগেরিয়ার সাথে নিয়ি চুক্তি (১৯১৯) এবং অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে প্রথমে সেভ্র্‌ চুক্তি (১৯২০), যা পরবর্তীতে তুরস্কের যুদ্ধের পর লোজান চুক্তি (১৯২৩) দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। এসব চুক্তির মাধ্যমেই যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে এবং ইউরোপের নতুন সীমানা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপিত হয়।

ভার্সাই চুক্তি ও সংশ্লিষ্ট শান্তিচুক্তিসমূহ যুদ্ধের পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থাকে সংজ্ঞায়িত করেছিল, তবে এ কঠোর শর্ত বিশেষত জার্মানিতে গভীর অসন্তোষ ও অর্থনৈতিক সংকটের জন্ম দেয়। জার্মান জনগণ এই চুক্তিকে অপমানজনক ও অন্যায় মনে করে এবং “পিছন থেকে ছুরি মারা” মত কিংবদন্তি তৈরি হয় যে, দেশটি আসলে যুদ্ধে অজেয় ছিল কিন্তু অন্তর্ঘাতের শিকার হয়েছে। যুদ্ধক্ষতিপূরণের বিশাল বোঝা ও জাতীয় অপমান না ভুলতে পারার অনুভূতি জার্মানিতে চরমপন্থী রাজনীতির উত্থান ঘটায়, যার সুযোগ নিয়ে অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি আন্দোলন ক্ষমতায় আসে এবং পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পথ প্রশস্ত হয়। অন্যদিকে বিজয়ী মিত্রশক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থে পরাজিতদের উপর কঠোর শর্ত আরোপ করলেও আন্তর্জাতিক শান্তি টেকসই করতে ব্যর্থ হয়। তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটলেও এর অসমাপ্ত বাস্তবতা ও অসম শান্তির কাঠামো বিশ্বরাজনীতিতে আরও বড় সংঘাতের বীজ বপন করে যায়।


ম্যাক্স ভেবারের দৃষ্টিতে প্রোটেস্ট্যান্টিজম: ধর্ম থেকে পুঁজিবাদের উত্থান

মো. অহিদুজ্জামান
মো. অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
২০২৫ জুলাই ০৫ ১৭:০১:৩১
ম্যাক্স ভেবারের দৃষ্টিতে প্রোটেস্ট্যান্টিজম: ধর্ম থেকে পুঁজিবাদের উত্থান

জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ভেবার ১৯১৮ সালে তাঁর আলোড়ন সৃষ্টিকারী গবেষণা The Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism–এ ধর্মবিশ্বাস এবং আধুনিক পুঁজিবাদের উত্থানের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্কের ধারণা উপস্থাপন করেন। এই কাজটি আধুনিক সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হিসেবে বিবেচিত হয়।

ভেবারের মূল থিসিস হলো—প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলন, বিশেষত কালভিনবাদ এবং পিউরিটান ধর্মবিশ্বাস, এমন এক ধরনের নীতিবোধ সৃষ্টি করেছিল যা কঠোর পরিশ্রম, শৃঙ্খলা, আত্মসংযম এবং যুক্তিনির্ভর কর্মপদ্ধতিকে উৎসাহিত করেছিল। এই নীতিবোধই আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তি স্থাপন করে দেয়।

ধর্মীয় তত্ত্ব ও পুঁজিবাদী মানসিকতার মিলন

ভেবার বলেন, প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মবিশ্বাস—বিশেষ করে ‘calling’ বা ধর্মীয় আহ্বান (যার মানে হলো পেশাগত কাজকেও ঈশ্বরের প্রতি দায়িত্ব হিসেবে দেখা), ‘predestination’ বা পূর্বনির্ধারিত মুক্তি (যার ধারণা হলো ঈশ্বর কারো মুক্তি আগে থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছেন), এবং ‘worldly asceticism’ বা জাগতিক আত্মসংযম (যেখানে জীবনের ভোগ–বিলাস বর্জন করে কষ্টসহিষ্ণু জীবনযাপনকে শ্রেয়তর ধরা হয়)—এই তিনটি মূল ভাবনা মানুষকে তার পার্থিব জীবনে অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমী, সঞ্চয়ী এবং নিয়মতান্ত্রিক করে তোলে।

এগুলো থেকে গড়ে ওঠে এমন এক কর্ম-নৈতিকতা, যেখানে অর্থোপার্জন ছিল শুধু জীবিকা নির্বাহের জন্য নয়, বরং ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভের সম্ভাব্য ইঙ্গিত হিসেবেও বিবেচিত। ফলে পুঁজিবাদী মানসিকতার বিকাশ ঘটে এক নতুন নৈতিক ভিত্তির ওপর।

"The Spirit of Capitalism" বা পুঁজিবাদের আত্মা/চেতনা

ভেবার “পুঁজিবাদের আত্মা/চেতনা” বলতে যা বোঝাতে চেয়েছেন তা কেবল অর্থ উপার্জনের লালসা নয়, বরং এর মধ্যে নিহিত রয়েছে শৃঙ্খলাবদ্ধ কর্মতৎপরতা, সৎ জীবনযাপন, এবং সময় ও সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের নৈতিক আবশ্যকতা। তিনি বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের উক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, “Time is money” বা "সময় মানেই অর্থ", যা এই নৈতিকতার সারমর্ম প্রকাশ করে।

মধ্যযুগীয় খ্রিস্টীয় ধারায় যেখানে পার্থিব বিষয় থেকে দূরে থাকা ছিল ধর্মনিষ্ঠতার প্রতীক, সেখানে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মবিশ্বাস জাগতিক পেশাগত কর্মকাণ্ডকে ধর্মীয় গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে। ফলে একজন সাধারণ কৃষক বা মুচিও তাঁর পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করে ঈশ্বরের সেবা করছেন—এই ধারণা থেকেই এক নতুন কর্ম–নৈতিকতা বিকশিত হয়।

পুঁজিবাদী সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপন

এই ধর্মীয় মূল্যবোধগুলো সময়ের সাথে সাথে পুঁজিবাদী সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপন করে দেয়। মূলধন সঞ্চয়, উদ্যমী উদ্যোক্তা–চেতনা, মিতব্যয়িতা এবং পেশাগত সফলতার প্রতি নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মতো বৈশিষ্ট্যগুলো গড়ে ওঠে ধর্মীয় অনুপ্রেরণার মধ্য দিয়ে। যদিও ভেবার সরলভাবে বলেননি যে কেবল প্রোটেস্ট্যান্টিজম পুঁজিবাদ সৃষ্টি করেছে, বরং তিনি একে একটি "elective affinity" বা "নির্বাচিত সাদৃশ্য" হিসেবে ব্যাখ্যা করেন—অর্থাৎ ধর্মীয় মূল্যবোধ ও পুঁজিবাদ একে অপরের পরিপূরক হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে।

প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলন: একটি ধর্মীয় বিপ্লব

১৬শ শতকের প্রোটেস্ট্যান্ট রিফরমেশন বা সংস্কার আন্দোলন ইউরোপীয় ধর্মজগতে এক আমূল পরিবর্তন আনে। মার্টিন লুথার ও জন ক্যালভিনের মতো সংস্কারকরা রোমান ক্যাথলিক চার্চের কিছু মৌলিক মতবাদ ও কার্যপ্রণালীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই আন্দোলনের ফলে ইউরোপে কেবল ধর্মীয় ব্যবস্থাই নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চিন্তাচেতনাও রূপান্তরিত হতে থাকে।

ক্যাথলিক মতবাদের মূল ভিত্তি ছিল—মানুষ ঈশ্বরের করুণা লাভ করতে পারে ‘বিশ্বাস’ এবং ‘সৎ কর্ম’ বা গুড ওয়ার্কস–এর মাধ্যমে, যার মধ্যস্থতাকারী ছিল চার্চ ও এর ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। ধর্মীয় জীবন বলতে বোঝানো হতো গির্জার প্রার্থনা, সন্ন্যাসজীবন, পবিত্রতা পালন, এবং দান-খয়রাত।

এর বিপরীতে, প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারকরা বললেন, মানুষ কেবল ঈশ্বরের করুণা (sola gratia) ও বিশ্বাসের (sola fide) মাধ্যমে মুক্তি লাভ করতে পারে। কোনো গির্জা, যাজক, কিংবা দানকর্ম এই মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে না। ভেবার উল্লেখ করেন, এই পরিবর্তনের ফলে মানুষ আগে যে গির্জাভিত্তিক আত্মবিশ্বাসে ছিল, তা ভেঙে পড়ে। ফলে বিশ্বাসীরা তাদের জীবনে ঈশ্বরের অনুগ্রহের কোনো চিহ্ন খুঁজতে শুরু করে।

‘Calling’ বা পেশাজীবনকে ঈশ্বরীয় দায়িত্ব হিসেবে দেখা

মার্টিন লুথার প্রবর্তিত আরেকটি ধারণা ছিল ‘calling’ বা Beruf—যার অর্থ একজন মানুষের দৈনন্দিন পেশাগত জীবনকেও ঈশ্বরের নির্দেশনা হিসেবে গ্রহণ করা। অর্থাৎ একজন কৃষক, দর্জি, বা ব্যবসায়ীও তাঁর পেশায় নিষ্ঠাবান থেকে ঈশ্বরের ইচ্ছা পূরণ করতে পারেন, যেমন একজন পুরোহিত করেন মণ্ডলীতে।

এই দৃষ্টিভঙ্গি মধ্যযুগীয় ক্যাথলিক চিন্তার এক বিপরীতধর্মী অবস্থান। পূর্বে পার্থিব কাজকে নিম্নমানের ও নাস্তিকতার ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখা হতো, যেখানে সন্ন্যাসজীবন ছিল শ্রেষ্ঠ ধর্মচর্চার পথ। কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্ট সমাজে প্রতিটি বৈধ পেশা হয়ে উঠলো ঈশ্বরের সেবা করার ক্ষেত্র। ফলস্বরূপ, দৈনন্দিন শ্রম ও পেশাগত নিষ্ঠা অর্জন করলো এক অভূতপূর্ব ধর্মীয় মর্যাদা।

পূর্বনির্ধারিত মুক্তি ও আত্মবিশ্বাসের সংগ্রাম

জন ক্যালভিনের প্রবর্তিত ‘predestination’ বা পূর্বনির্ধারিত মুক্তি ধারণাটি ছিল প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মচিন্তার এক কঠোরতম রূপ। এই মতে, ঈশ্বর সৃষ্টির শুরুতেই নির্ধারণ করে রেখেছেন কারা মুক্তি পাবে (elect) আর কারা ধ্বংস হবে—এটা কোনো মানবিক আচরণ, সৎকর্ম, দান-খয়রাত কিংবা চার্চে অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিবর্তনযোগ্য নয়।

এই ধারণা মানুষের মনে সৃষ্টি করে তীব্র আত্ম-উৎকণ্ঠা। যেহেতু চার্চ আর গ্যারান্টি দিতে পারছিল না, মানুষ ঈশ্বরের অনুগ্রহের চিহ্ন খুঁজতে লাগল নিজের পার্থিব জীবনে—পেশাগত সফলতা, পরিশ্রমের ফলাফল, সঞ্চয় এবং সমাজে মর্যাদা। এইসব বিষয় হয়ে ওঠে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস অর্জনের উপায়।

ভেবার বিশ্লেষণ করেন, এই মনোভাব মানুষকে সময়, শ্রম, সম্পদ, এবং জীবনকে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রিত ও উৎপাদনশীলভাবে পরিচালনার দিকে ঠেলে দেয়। কেননা আত্মবিশ্বাস হারানোকে ঈশ্বরবিরোধী সন্দেহ হিসেবে গণ্য করা হতো।

আত্মসংযম, সাধুতা, ও জাগতিক নিয়ন্ত্রণ

প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মবিশ্বাসের আরেকটি কেন্দ্রীয় উপাদান ছিল worldly asceticism—জাগতিক জীবনে আত্মসংযম ও শৃঙ্খলা। যদিও মধ্যযুগীয় সন্ন্যাসীরা জাগতিক জীবন ত্যাগ করতেন, প্রোটেস্ট্যান্ট নীতিতে বলা হয় যে জগতে থেকেই আত্মসংযম ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব।

পিউরিটান, পিয়েতিস্ট, কোয়াকার ইত্যাদি সন্নিবিষ্ট প্রোটেস্ট্যান্ট গোষ্ঠীগুলো কঠোর নৈতিক জীবনযাপনের ওপর জোর দিত। তারা বিলাসিতা, অলসতা, অথবা অপ্রয়োজনীয় ভোগবিলাসকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করত। তাদের মতে, অর্থ উপার্জন করা কোনো সমস্যা নয়, সমস্যা হলো সেই অর্থ অপ্রয়োজনীয় ভোগে ব্যয় করা।

ফলে মানুষ তাদের অর্জিত অর্থ সঞ্চয় করতো অথবা তা পুনর্বিনিয়োগ করত ব্যবসা বা উৎপাদনশীল খাতে—এই অভ্যাস পরবর্তী সময়ে মূলধন গঠনের ভিত্তি তৈরি করে। এমনকি অতিরিক্ত দান বা সাহায্যও নিরুৎসাহিত হতো যদি তা অলসতা বা ভিক্ষাবৃত্তিকে উৎসাহ দিত।

একটি নতুন নৈতিক অর্থনীতি

এই ধর্মীয় মূল্যবোধগুলো সমাজের মধ্যে এক নতুন ধরনের নৈতিক অর্থনীতির জন্ম দেয়। যেখানে—

  • পরিশ্রম = ধর্মীয় কর্তব্য
  • অর্থোপার্জন = ঈশ্বরের অনুগ্রহের চিহ্ন
  • সঞ্চয় ও বিনিয়োগ = নৈতিক দায়িত্ব
  • অলসতা ও বিলাসিতা = পাপ

এই মূল্যবোধগুলো শুধুমাত্র পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে সক্রিয় করেনি, বরং পুঁজিবাদের একটি নৈতিক ভিত্তি প্রদান করেছে, যা একে “ধর্মের দ্বারা বৈধতা পাওয়া অর্থনৈতিক কার্যকলাপ”-এ পরিণত করে।পুঁজিবাদী আত্মা: শুধু অর্থলোভ নয়, একটি নৈতিক ধারাভেবার তাঁর বইয়ে যে “spirit of capitalism” বা ‘পুঁজিবাদের আত্মা’ উল্লেখ করেছেন, তা কেবল অর্থ উপার্জনের আকাঙ্ক্ষা নয়, বরং এক ধরনের নৈতিক–সাংস্কৃতিক মানসিকতা। এটি এমন একটি মানসিকতা যা মানুষকে—

  • কঠোর পরিশ্রম করতে শেখায়
  • সময়ের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে উদ্বুদ্ধ করে
  • বিলাসিতা থেকে বিরত রাখতে প্ররোচিত করে
  • এবং পৃথিবীর কর্মকাণ্ডকে নৈতিক কর্তব্য হিসেবে দেখতে শেখায়

এই নৈতিকতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কর্মকে “calling” হিসেবে দেখা—অর্থাৎ পেশাগত কাজ কেবল জীবিকার উপায় নয়, বরং তা ঈশ্বরের সেবাও বটে।

বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের মাধ্যমে তত্ত্ব ব্যাখ্যা

ভেবার বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের নীতিবাক্য “Remember, time is money” তুলে ধরে দেখান যে, এই মানসিকতা কেবল অর্থনৈতিক চর্চা নয়, বরং একটি নৈতিক অবস্থানও। এখানে ‘অর্থ উপার্জন’ নিজেই হয়ে ওঠে এক নৈতিক অভিপ্রায়। মানুষ অর্থ উপার্জন করছে কেবল ভোগের জন্য নয়, বরং তার পেশাগত কর্তব্য পালনের মাধ্যমে ঈশ্বরের অনুগ্রহ প্রাপ্তির প্রত্যাশায়।

ধর্মীয় আত্মসংযম এবং পুঁজিবাদী প্রবাহ

প্রোটেস্ট্যান্ট নীতিবোধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল asceticism—অর্থাৎ আত্মসংযম। তবে এটি কোনো সন্ন্যাসধর্মী আত্মত্যাগ নয়, বরং জাগতিক জীবনে থেকেও নিজেকে শৃঙ্খলার মাঝে পরিচালিত করা। বিলাসিতা, অলসতা, এবং অপ্রয়োজনীয় ভোগবিলাসকে এখানে তীব্রভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়।

এর ফলে অর্থ উপার্জন যেমন উৎসাহিত হয়েছে, তেমনি সেই অর্থ অপচয় না করে পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে সঞ্চয় বৃদ্ধি এবং মূলধন গঠনের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই স্বভাবতই পুঁজিবাদকে একটি সুগঠিত ভিত্তি দেয়।

সময়, শৃঙ্খলা, এবং যুক্তিবোধের ওপর জোর

প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কৃতিতে সময়ের মূল্য, শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনধারা, এবং দৈনন্দিন কাজের বিস্তারিত রেকর্ড রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে তারা আত্মিক ও আর্থিক উভয় অগ্রগতির লক্ষ্যে জীবনকে পরিচালিত করে।

এই ধারণা ভেবার “disenchantment of the world” ধারণার সঙ্গে যুক্ত—অর্থাৎ ধর্মীয় ভাবধারার পরিবর্তে যুক্তিনির্ভর, সংগঠিত, এবং জাগতিকভাবে সফল জীবনকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

কেন এই নৈতিকতা পুঁজিবাদের জন্য আদর্শ?

ভেবার দেখান যে এই নৈতিকতা তিনটি স্তম্ভে দাঁড়িয়ে আছে—

  • পরিশ্রম — নিজের পেশাকে ঈশ্বরের নির্দেশ হিসেবে পালন করা
  • আত্মসংযম — ভোগবিলাস বর্জন করে সঞ্চয় ও বিনিয়োগে মনোনিবেশ
  • যুক্তিবাদিতা — কাজকে পদ্ধতিগত ও ফলপ্রসূভাবে পরিচালনা করা

এই বৈশিষ্ট্যগুলো পুঁজিবাদী অর্থনীতির জন্য একেবারে নিখুঁত উপাদান: আপনি যদি এমন একটি জনগোষ্ঠী পান যারা পরিশ্রমকে নৈতিক কর্তব্য মনে করে, যারা অর্থ উপার্জন করে কিন্তু তা ভোগ না করে পুনরায় বিনিয়োগ করে, এবং যারা প্রতিটি কাজ অত্যন্ত পদ্ধতিগতভাবে করে—তাহলে তারা স্বাভাবিকভাবেই এক শক্তিশালী পুঁজিবাদী সমাজ গড়ে তুলবে।

একটি সরল কারণ-প্রভাব সম্পর্ক নয়

ভেবার নিজেও স্বীকার করেন যে তিনি কোনো সরল ‘cause-effect’ ব্যাখ্যা দিচ্ছেন না। তিনি বলেন এটি একটি “elective affinity”—অর্থাৎ, প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মীয় মূল্যবোধ ও পুঁজিবাদী সংস্কৃতি একে অপরের সঙ্গে বিশেষভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। ধর্মীয় নৈতিকতা যেন এক ধরনের উর্বর মাটি তৈরি করেছিল, যেখানে পুঁজিবাদের বীজ অঙ্কুরিত হতে পেরেছে।

উদাহরণস্বরূপ, ভেবার উল্লেখ করেন—

-পুঁজিবাদ প্রথম বিকশিত হয়েছে মূলত প্রোটেস্ট্যান্ট অঞ্চলে (যেমন ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, উত্তর জার্মানি)

-মিশ্র ধর্মবিশ্বাসবিশিষ্ট সমাজে ব্যবসায়িক শ্রেণির মধ্যে প্রোটেস্ট্যান্টদের আধিপত্য ছিল

এই পর্যবেক্ষণগুলো তাঁকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করে যে, পুঁজিবাদের আত্মা ও প্রোটেস্ট্যান্ট নৈতিকতা পারস্পরিকভাবে একে অপরকে শক্তি জুগিয়েছে।

Calling, Predestination ও Worldly Asceticism — প্রোটেস্ট্যান্ট অর্থনৈতিক আচরণের স্তম্ভ

প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মবিশ্বাসের একটি মৌলিক ভিত্তি হলো Beruf বা Calling—অর্থাৎ পেশাকে ঈশ্বরের আহ্বান হিসেবে দেখা। এই ধারণা মার্টিন লুথারের চিন্তা থেকে উৎসারিত। প্রথাগত ক্যাথলিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পেশাগত কাজকে ধর্মীয়ভাবে ততটা মর্যাদাপূর্ণ মনে করা হতো না; ধর্মীয় কর্ম বা সন্ন্যাস জীবনকে শ্রেষ্ঠ মনে করা হতো। কিন্তু লুথার এই ধারণাটি পাল্টে দেন। তাঁর মতে, প্রতিটি বৈধ পেশা—কৃষিকাজ, কারিগরি, ব্যবসা, এমনকি সাধারণ কাজও—ঈশ্বরের আহ্বানে সাড়া দেওয়া। একজন মুচি বা কৃষকও তাঁর নিজস্ব পেশাগত নিষ্ঠার মাধ্যমে ঈশ্বরের মহিমা প্রচার করতে পারেন।

ভেবারের মতে, এই ধারণা শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে এক নতুন কর্মনৈতিকতা গড়ে তোলে, যেখানে পরিশ্রম কেবল অর্থ উপার্জনের জন্য নয়, বরং ঈশ্বরের প্রতি দায়িত্ব পালনের একটি পথ। অলসতা, সময় নষ্ট, বা কাজ এড়ানো কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতিই নয়, তা ধর্মীয় ব্যর্থতাও বটে। যেমনটি পিউরিটান লেখক ও বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন বলেছিলেন—“Remember, time is money”—অর্থাৎ সময়ের অপচয় মানেই সম্ভাব্য আধ্যাত্মিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি। এই মনোভাব শ্রমজীবী শ্রেণিকে আত্মনিয়ন্ত্রণ, পদ্ধতিগত পরিশ্রম, এবং সময় ব্যবস্থাপনাকে জীবনের অংশ করে তোলে, যা পুঁজিবাদী উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি মৌলিক শক্তি হিসেবে কাজ করে।

Predestination বা পূর্বনির্ধারিত মুক্তির ধারণাটি আসে জন ক্যালভিনের চিন্তা থেকে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি মুক্তি পাবে কি না—তা ঈশ্বর সৃষ্টি মুহূর্তেই নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং এটি কোনো মানবিক প্রচেষ্টা, বিশ্বাস বা কর্মের উপর নির্ভর করে না। এই কঠোর ধর্মতত্ত্ব মানুষকে ফেলে দেয় গভীর আত্মসন্দেহ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে: “আমি কি নির্বাচিত? নাকি ধ্বংসপ্রাপ্ত?” চার্চ আর এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। ফলে মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে খোঁজে ঈশ্বরের অনুগ্রহের সংকেত বা signs of grace—যেমন নিয়মতান্ত্রিক জীবনধারা, সফল ও সৎ ব্যবসা, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ, এবং সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক স্থিতি।

ভেবার ব্যাখ্যা করেন, এই অন্তর্নিহিত দুশ্চিন্তা মানুষকে ঠেলে দেয় কঠোর পরিশ্রম, আত্মসংযম, এবং সফলতা অর্জনের দিকে। কারণ সফলতা নিজেই হয়ে দাঁড়ায় ঈশ্বরের নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রমাণ। ক্যালভিনবাদের অনুসারীদের কাছে এটি ছিল এক “আবশ্যিক কর্তব্য”—নিজেকে নির্বাচিত হিসেবে বিশ্বাস করা এবং সন্দেহকে প্রত্যাখ্যান করা। আত্মবিশ্বাস হারানো মানেই ঈশ্বরে অবিশ্বাস, যা আবার ধ্বংসের ইঙ্গিত দিতে পারে। ফলে ধর্মীয়ভাবে অনুপ্রাণিত এই “সাফল্যপ্রয়াসী জীবন” পরিণত হয় এক পুঁজি-সঞ্চয়ী ও উদ্যমী অর্থনৈতিক জীবনে, যার সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাস এক অদ্ভুত ভারসাম্য গড়ে তোলে।

প্রোটেস্ট্যান্ট নৈতিকতা ছিল ascetic অর্থাৎ আত্মসংযমী। তবে এটি কোনো সন্ন্যাসধর্মী পরিপ্রেক্ষিতে নয়; বরং জাগতিক জীবনের মধ্যেই এই আত্মসংযমের চর্চা করা হয়েছে। পিউরিটান, কোয়াকার, পিয়েতিস্ট, বাপটিস্ট ইত্যাদি গোষ্ঠীগুলো বিলাসিতা পরিহার করেছে, অলসতা ও ভোগবাদকে নিন্দা করেছে, এবং ধর্মীয় ও পার্থিব জীবনকে একীভূত করেছে কঠোর শৃঙ্খলা ও নৈতিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। অর্থ উপার্জন উৎসাহিত হলেও, তার অপচয় ছিল নিষিদ্ধ। এমনকি অতিরিক্ত দান—যা কোনো অলস ব্যক্তিকে আরও অলস করে তুলতে পারে—তাও নিরুৎসাহিত করা হতো।

এই নৈতিকতা মানুষকে সঞ্চয় ও পুনর্বিনিয়োগের পথে পরিচালিত করেছে, যা আবার মূলধনের বিকাশ এবং শিল্পায়নের জন্য অত্যন্ত উপযোগী ছিল। এর ফলে দেখা দেয় পুঁজির পুনঃচক্রায়ন, নতুন ব্যবসা ও উদ্যোগের জন্ম, এবং শিল্প ও বাণিজ্যে উদ্ভাবনের গতি। ভেবার তুলনা করে বলেন: পূর্ব-পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ প্রয়োজন মিটলেই কাজ থামিয়ে দিত (leisure preferred over surplus labor), কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্ট নৈতিকতাধারী মানুষ কাজ করত ঈশ্বরের মহিমা প্রচারে এবং নিজের নির্বাচিত হওয়ার আত্মপ্রত্যয় অর্জনে।

Calling, Predestination এবং Worldly Asceticism—এই তিনটি উপাদান একত্রে গড়ে তোলে একটি ধর্মীয়–নৈতিক কাঠামো, যেখানে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়ে ওঠে ঈশ্বরের অনুগ্রহের অনুসন্ধানের একটি পথ। অর্থ উপার্জন শুধু স্বার্থপরতা নয়, বরং একটি নৈতিক কর্তব্য; এটি একটি ইঙ্গিত যে আপনি ঈশ্বরের নির্বাচিতজন, কিন্তু সেই অর্থ ভোগে নয়, বরং কাজে নিয়োজনে ব্যয় করা উচিত।

ভেবার বলেন, এটাই ছিল পুঁজিবাদের জন্মভূমি। এক সময় এই ধর্মীয় অনুপ্রেরণা কমে গেলেও, এর আচরণগত ছাপ থেকে গেছে। মানুষ হয়ে উঠেছে এমন এক শ্রেণি, যারা অর্থনৈতিক সাফল্যকে জীবনের গন্তব্য নয়, বরং কর্তব্য হিসেবে দেখে—এবং এভাবেই গড়ে উঠেছে আধুনিক পুঁজিবাদী সংস্কৃতি।

জার্মানি, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস — তুলনামূলক উদাহরণে ভেবারের তত্ত্বের প্রয়োগ

ভেবার ও পরবর্তী গবেষকদের মতে, ১৭শ শতকে নেদারল্যান্ডস বা ডাচ রিপাবলিক ছিল বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পথিকৃৎ। এটি ছিল একটি শক্তিশালী ক্যালভিনিস্ট রাষ্ট্র, যেখানে প্রথম স্টক এক্সচেঞ্জ গড়ে ওঠে এবং Dutch East India Company–এর মতো আধুনিক বহুজাতিক কর্পোরেশন গঠিত হয়। এই অর্থনৈতিক কাঠামো নিয়ন্ত্রিত হতো ব্যবসায়িক শৃঙ্খলা, মিতব্যয়িতা ও আত্মসংযমের নীতিমালায়। ডাচ ক্যালভিনিস্টরা পরিচিত ছিলেন পরিশ্রমী, মিতব্যয়ী এবং অর্থনৈতিকভাবে যুক্তিবাদী হিসেবে। ধর্মীয় বিশ্বাস ও বাণিজ্যিক নৈতিকতার এই সংমিশ্রণ ভেবারের থিসিসের এক শক্তিশালী বাস্তব প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

ইংল্যান্ড ছিল ভেবারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ, যেখানে প্রোটেস্ট্যান্টিজম, বিশেষত পিউরিটানিজম, পুঁজিবাদের নৈতিক ভিত্তি গঠনে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। ভেবার ও আর.এইচ. টনি উল্লেখ করেন, শিল্পবিপ্লবের আগেই ইংল্যান্ডের মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী শ্রেণির মধ্যে পিউরিটান নৈতিকতা গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। শ্রম, সঞ্চয়, শৃঙ্খলা ও সময়ানুবর্তিতা তখনকার সমাজে গৌরবজনক মূল্যবোধে পরিণত হয়েছিল। পিউরিটান ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা ইংল্যান্ডের শিল্প ও বাণিজ্যের অগ্রপথিক ছিলেন। বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের মতামত উদ্ধৃত করে ভেবার দেখিয়েছেন, কীভাবে প্রোটেস্ট্যান্টরা অর্থোপার্জনকে ঈশ্বরের ইচ্ছা পূরণের একটি উপায় হিসেবে দেখতেন। ১৮শ ও ১৯শ শতকে কোয়াকাররা, যারা ছিল আরেকটি প্রোটেস্ট্যান্ট গোষ্ঠী, ইংল্যান্ডের ব্যাংকিং ও শিল্প খাতে বিশেষভাবে সফল হন। তাদের সততা, নির্ভরযোগ্যতা, এবং কঠোর পরিশ্রম তাদের ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য একটি আদর্শ চরিত্রে পরিণত করে।

জার্মানির প্রেক্ষাপটে ভেবার একটি বিশেষ বৈসাদৃশ্য তুলে ধরেন—প্রুশিয়া ও উত্তর জার্মানি, যেখানে প্রোটেস্ট্যান্টরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেগুলো ছিল অধিক শিল্পোন্নত, বাণিজ্যিকভাবে সফল এবং শিক্ষার দিক থেকে অগ্রসর। বিপরীতে, বাভারিয়া ও রাইনল্যান্ড, যা ছিল প্রধানত ক্যাথলিক অধ্যুষিত, সেগুলো ছিল তুলনামূলকভাবে কৃষিভিত্তিক, অনগ্রসর ও রক্ষণশীল। ভেবার উল্লেখ করেন, প্রোটেস্ট্যান্ট অঞ্চলে উদ্যোক্তা, কারিগর এবং পেশাজীবীদের সংখ্যা ছিল বেশি; তারা শিক্ষা ও নতুন উদ্যোগে আগ্রহী ছিলেন। ক্যাথলিক অঞ্চলে মানুষ তুলনামূলকভাবে চার্চ বা রাষ্ট্রভিত্তিক চাকরিতে অথবা ঐতিহ্যনির্ভর পেশায় বেশি নিয়োজিত ছিল। এই পার্থক্যের মূল কারণ ভেবারের মতে ছিল ধর্মীয় নৈতিকতার বৈচিত্র্য—প্রোটেস্ট্যান্টরা তাঁদের কাজ ও দায়িত্বকে ঈশ্বরের আহ্বান হিসেবে দেখতেন, যা অর্থনৈতিক উত্তরণকে ত্বরান্বিত করেছে।

স্কটল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গেও ভেবার তাঁর তত্ত্ব প্রয়োগ করেন। স্কটল্যান্ডের প্রেসবিটারিয়ানরা ছিলেন ক্যালভিনবাদে প্রভাবিত, এবং ধর্মীয় সংস্কারের পর তারা অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত অগ্রসর হয়। একইভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক অভিবাসী জনগোষ্ঠী—যেমন পিউরিটান, কোয়াকার, বাপটিস্ট প্রভৃতি—ছিলেন গভীর প্রোটেস্ট্যান্ট চেতনায় গঠিত। এই জনগোষ্ঠী ‘Protestant Work Ethic’ নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি সমাজ, যেখানে কর্মে নিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা, আত্মনির্ভরতা, এবং সঞ্চয় ও বিনিয়োগ ছিল সামাজিক গর্বের বিষয়। এসব নৈতিক মূল্যবোধ পরবর্তীকালে আমেরিকান শিল্পোন্নতির ভিত্তি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভেবারের পর্যবেক্ষণ ছিল—এই সমাজগুলো কেবল পুঁজিবাদকে গ্রহণই করেনি, বরং একে নৈতিকতা দিয়ে বৈধতা প্রদান করেছে।

Iron Cage of Rationalization: ভেবারের সতর্ক সংকেত

ম্যাক্স ভেবার তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মবিশ্বাস—বিশেষ করে কালভিনবাদ, পিউরিটানিজম ও অন্যান্য আত্মসংযমী (ascetic) মতবাদ—একধরনের “নৈতিক রেশনালিটি” বা যুক্তিবাদী শৃঙ্খলা তৈরি করেছিল। শুরুতে এটি ছিল এক ধর্মীয় অনুপ্রেরণা: মানুষ পরিশ্রম করত ঈশ্বরের আহ্বানে সাড়া দিতে, সঞ্চয় করত আত্মসংযমের কারণে, এবং ভোগবিলাস থেকে বিরত থাকত নৈতিকতার খাতিরে।

কিন্তু এই ধর্মীয় আচরণগুলো সময়ের সাথে সাথে পরিণত হয় একটি ধর্মহীন সাংস্কৃতিক অভ্যাসে, যা তার আধ্যাত্মিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলে, অথচ আচরণগত কাঠামো হিসেবে থেকে যায়। ভেবারের মতে, এই ধর্মীয় নৈতিকতা থেকে উৎপন্ন হওয়া শৃঙ্খলা, যুক্তিবাদী উৎপাদন, দক্ষতা এবং ফলাফল-ভিত্তিক মানসিকতা ক্রমে একটি "লোহার খাঁচা" বা iron cage–এ পরিণত হয়।

Iron Cage” বলতে ভেবার বোঝাতে চান এমন একটি জটিল, অপরিবর্তনশীল, যুক্তিবাদী কাঠামো, যেখানে মানুষ আর ধর্ম বা নৈতিকতার কারণে নয়, বরং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মেকানিক্যাল চাপে বাধ্য হয়ে কাজ করে, হিসাব রাখে, সময় মেনে চলে, এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে জীবন পরিচালনা করে। এটি একধরনের মানবিকতা–বিচ্যুত, অব্যক্ত কর্তব্যের শৃঙ্খল, যাকে কেউ চাইলেও সহজে ভাঙতে পারে না।

ভেবার বলেন:“The Puritan wanted to work in a calling; we are forced to do so.”অর্থাৎ, পিউরিটানরা একসময় পেশাকে ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করে কাজ করত; আজকের মানুষ সেই একই কাজ করে, কিন্তু এটি এখন একটি বাধ্যবাধকতা—যার পেছনে ধর্ম নেই, আছে কেবল অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা, কাঠামোগত দায়, ও সমাজের চাপ।

ভেবারের মতে, আধুনিক বিশ্ব ধীরে ধীরে র‍্যাশনালাইজড হয়ে উঠছে—অর্থাৎ সব কিছুই পরিমাপযোগ্য, পূর্বনির্ধারিত ও দক্ষতানির্ভর নিয়মে চলছে। এই র‍্যাশনালাইজেশন, যা মূলত প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মীয় নৈতিকতা থেকে উৎসারিত, এখন নিজেই এক ধর্মহীন কাঠামোতে রূপ নিয়েছে, যা মানুষকে দ্রুত, দক্ষ, কিন্তু আত্মিকভাবে শূন্য করে তুলছে।

“Iron Cage” তাই ভেবারের চিন্তার একটি সতর্ক সংকেত: প্রোটেস্ট্যান্ট নৈতিকতা শুরুতে মানুষকে পবিত্রতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের পথে চালিত করেছিল, কিন্তু আধুনিক পুঁজিবাদ সেই নৈতিকতাকে একধরনের শীতল, নিয়ন্ত্রিত, অমানবিক কাঠামোতে পরিণত করেছে, যেখানে আমরা জীবনকে উৎপাদনের জন্যই যাপন করি—ভাবনার জন্য নয়, আত্মার পরিতৃপ্তির জন্য নয়।

এই ধারণাটি পরবর্তীতে দার্শনিক, সমাজতাত্ত্বিক ও সমালোচনামূলক তত্ত্ববিদদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয় (উদাহরণ: Theodor Adorno, Herbert Marcuse, Michel Foucault প্রমুখ) এবং আধুনিক পুঁজিবাদী সভ্যতার "ডিসএনচ্যান্টমেন্ট" বা আধ্যাত্মিক নির্জনতা–র বিপরীতে এক গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক চিন্তার দিকনির্দেশনা দেয়।

ম্যাক্স ভেবারের The Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism একটি যুগান্তকারী গবেষণা যা আধুনিক পুঁজিবাদকে কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক–নৈতিক প্রকল্প হিসেবেও চিহ্নিত করে। এই গবেষণার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে, ধর্ম, সংস্কৃতি ও নৈতিকতা কেবল আধ্যাত্মিক নয়, তারা অর্থনৈতিক কাঠামো নির্মাণেও গূঢ় ভূমিকা রাখে।

যে আত্মসংযম একসময় ঈশ্বরের অনুগ্রহের সন্ধানে মানুষকে পরিশ্রমী করে তুলেছিল, তা-ই পরবর্তীতে পরিণত হয় এক কঠিন পুঁজিবাদী শৃঙ্খলায়। আর এভাবেই ধর্মের ভেতর থেকে জন্ম নেয় পুঁজিবাদের আত্মা বা চেতনা। তবে ভেবার সরাসরি কখনো বলেননি যে “প্রোটেস্ট্যান্ট সমাজ মানেই সফল পুঁজিবাদী সমাজ।” তিনি এটিকে দেখেছেন একটি সাধারণ প্রবণতা হিসেবে, যেখানে ধর্মীয় সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক মনোভঙ্গি এক ধরনের নির্বাচিত সাদৃশ্য (elective affinity) গড়ে তোলে। তিনি স্বীকার করেন যে ভূগোল, রাজনীতি, উপনিবেশবাদ, প্রযুক্তি প্রভৃতিও পুঁজিবাদের বিকাশে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। যেমন: ফ্রান্স বা বেলজিয়াম, যেগুলো ক্যাথলিক দেশ, পরবর্তীকালে শিল্পোন্নত হয়েছে। তবে ভেবারের মতে, ১৬শ থেকে ১৮শ শতকের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কৃতি একটি নৈতিক অনুপ্রেরণার ভূমিকা পালন করেছিল, যা পুঁজিবাদী উদ্ভাবন ও প্রচেষ্টাকে জ্বালানি জুগিয়েছে।

-লেখক মো. অহিদুজ্জামান ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ এর গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গভর্ন্যান্স বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। পাশাপাশি তিনি অনলাইন সংবাদমাধ্যম "সত্য নিউজ"-এর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

পাঠকের মতামত: