সোশ্যাল থিওরি নেটওয়ার্ক আয়োজিত ওয়েবিনার ভিত্তিক বিশ্লেষণ

সরদার ফজলুল করিম: এক নিঃস্বার্থ চিন্তাবিদের রাজনৈতিক পুনর্পাঠ

ইতিহাস ও দর্শন ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২৯ ২২:৫২:৪২
সরদার ফজলুল করিম: এক নিঃস্বার্থ চিন্তাবিদের রাজনৈতিক পুনর্পাঠ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষক, জাতীয় অধ্যাপক, দার্শনিক ও মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবী সরদার ফজলুল করিমের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত হয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক সম্মেলন। এই ওয়েবিনারের শিরোনাম ছিল "Rethinking the Political Philosophy of Sardar Fazlul Karim"। এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল সরদার করিমের রাজনৈতিক দর্শন, নৈতিকতা ও সাম্যবাদী মানবিকতা নতুন করে অনুধাবন করা এবং তার প্রাসঙ্গিকতা বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় বিশ্লেষণ করা।

সভার সঞ্চালনা করেন গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক শামসুল আরেফীন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. খুরশীদ আলম, যিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান এবং একজন বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শাহাদাত হোসেন, ড. আনিসুর রহমান (গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়), মো. অহিউজ্জামান (ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি), এবং বিইউপির সাইফুল আলমসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষক ও গবেষকবৃন্দ।

জীবন, দর্শন ও প্রতিরোধের রাজনীতি

ড. খুরশীদ আলম তাঁর বক্তব্যে সরদার ফজলুল করিমের জীবন ও চিন্তার তিনটি মূল স্তম্ভ চিহ্নিত করেন: সাম্যবাদী সমাজ, আদর্শ রাষ্ট্র এবং গণতন্ত্র। সরদার করিম ছিলেন আদর্শনিষ্ঠ একজন কমিউনিস্ট, যিনি বিশ্বাস করতেন রাজনীতি যদি ন্যায়ের পথে না থাকে তবে তা জনগণের বিপক্ষে দাঁড়ায়। পাকিস্তান আমলে সামরিক দমন-পীড়নের প্রতিবাদে তিনি একাধিকবার কারাবরণ করেন, যার মোট সময় প্রায় ১১ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি নিজের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করে দেন এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলা একাডেমি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত থাকলেও তিনি চিরকাল সাধারণ মানুষের পক্ষেই চিন্তা করে গেছেন।

তার বিখ্যাত উক্তি "আমি পলিটিক্স তৈরি করিনি, আমি পলিটিক্সে জড়িত হয়েছি" মূলত এক অভিজ্ঞতা-নির্ভর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। তিনি রাজনীতিকে কখনো জটিল তাত্ত্বিক কাঠামো হিসেবে দেখেননি, বরং মানুষের মুক্তির অনুষঙ্গ হিসেবে দেখেছেন। রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, সমাজে বৈষম্য ও রাষ্ট্রীয় দমননীতির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক নির্ভীক কণ্ঠ।

তিনটি স্তম্ভ: সাম্যবাদ, আদর্শ রাষ্ট্র ও গণতন্ত্র

ড. খুরশীদ আলমের বিশ্লেষণে উঠে আসে, সরদারের রাজনৈতিক চিন্তার ভিত গঠিত হয়েছে তিনটি পরস্পরবিরোধী কিন্তু সংশ্লেষযোগ্য দর্শনের সমন্বয়ে। মার্ক্সীয় সাম্যবাদ তাঁকে অর্থনৈতিক ও শ্রেণিকাঠামোর সমালোচনা শিখিয়েছে, প্লেটোর ‘আদর্শ রাষ্ট্র’ তাঁকে ন্যায্যতা ও শাসকের নৈতিক দায় সম্পর্কে সচেতন করেছে এবং গণতন্ত্র, যা তার মতে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয় বরং এমন শাসনব্যবস্থা যা মানুষকে সম্মান করে, এটি ছিল তার দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্র।

তিনি বলেছিলেন, মানুষ যদি মানুষ হতে চায় তবে বাম রাজনীতির বিকল্প নেই। এই বক্তব্য প্রমাণ করে যে তিনি রাজনৈতিক দর্শনকে কেবল তাত্ত্বিক উচ্চারণ হিসেবে দেখেননি, বরং ন্যায়ের উপযোগী কার্যকর রূপে কল্পনা করেছেন।

সামরিক শাসন ও রাষ্ট্রবিরোধী অভিজ্ঞতা

সরদার করিম সামরিক শাসনকে অন্ধভাবে প্রত্যাখ্যান করেননি বরং অভিজ্ঞতার আলোকে তাকে মূল্যায়ন করেছেন। তিনি বলেছিলেন, সামরিক শাসন না এলে বুঝতাম না এটি কতখানি অমানবিক। এই বক্তব্যে তিনি দেখিয়েছেন, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা কেবল আঘাত নয়, তা শিক্ষাও।

এ বিষয়ে আলোচকরা বলেন, সরদার ছিলেন একাধারে সক্রেটিসীয় জিজ্ঞাসু ও মার্ক্সীয় বাস্তবতার ভাষ্যকার, একজন দার্শনিক যিনি জীবনকে নিছক অনুশীলন নয় বরং উত্তরণের উপায় হিসেবে ভেবেছেন।

রচনাশৈলী ও চিন্তার ধারাবাহিকতা

যদিও সরদার ফজলুল করিম কোনো মৌলিক রাজনৈতিক বই লেখেননি, তবে তাঁর অনুবাদকাজ, বক্তৃতা, সাক্ষাৎকার এবং প্রবন্ধগুলোতেই তার চিন্তার জগত উন্মোচিত হয়েছে। দর্শন কোষ, আমি সরদার বলছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম সমাজ এবং আমার পৃথিবী আমার প্রিয় মুখ গ্রন্থসমূহে সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবতা নিয়ে তার গভীর মনোযোগের ছাপ স্পষ্ট।

তিনি ছিলেন একজন দর্শনের জনপ্রিয় অনুবাদক, যিনি কঠিন তত্ত্বকে মানুষের কাছে সহজ করে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। দর্শনচর্চা ছিল তার কাছে নিছক বিদ্যাবিনিময় নয় বরং মানবিক দায়বদ্ধতা।

প্রাসঙ্গিকতা ও ভবিষ্যতের সংকেত

অধ্যাপক শাহাদাত হোসেন বলেন, আজকের বাংলাদেশে যখন নিওলিবারাল শোষণব্যবস্থা, অলিগার্কি ও দমননীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিচ্ছে তখন সরদার করিমের মতো একজন নৈতিক চিন্তকের রাজনৈতিক দর্শন আমাদের সামনে নতুন দিক উন্মোচন করতে পারে।

ড. খুরশীদ আলম বলেন, দর্শন যদি জীবনকে পরিবর্তনের প্রেরণা না দেয় তবে সেই দর্শন মৃত। এই বক্তব্য সরদারের চিন্তার গভীরতা ও প্রাসঙ্গিকতা দুইই নির্দেশ করে। তিনি ছিলেন অতি সাধারণ জীবনযাপনের এক ব্যতিক্রমী দার্শনিক, যিনি শিখিয়েছেন সংকটই আমাদের শিক্ষক, জীবনই দর্শনের শ্রেষ্ঠ পাঠ্যপুস্তক।

সোশ্যাল থিওরি নেটওয়ার্ক আয়োজিত এই আলোচনা শুধুমাত্র একটি স্মরণানুষ্ঠান নয় বরং এক রাজনৈতিক পুনর্পাঠ, যেখানে ইতিহাস, দর্শন এবং ভবিষ্যতের সংগ্রামের মধ্যে সংলাপ তৈরি হয়। সরদার ফজলুল করিমের চিন্তা, সংগ্রাম ও জীবনবোধ আমাদের নতুন সমাজ, ন্যায়ের রাষ্ট্র এবং মানবিক রাজনীতির স্বপ্ন দেখায়।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

প্রেস সচিবের বক্তব্যে বাকস্বাধীনতা, মব কালচার ও সাংবাদিকতার দ্বন্দ্ব: পাঠবিশ্লেষণ

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি এক দীর্ঘ বক্তব্যে দেশের সাংবাদিকতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সরকারের অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত... বিস্তারিত

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ক্যাশ ফ্লো বিশ্লেষণ:উত্থানে ১২ কোম্পানি, হঠাৎ ধসে ৯টি

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ক্যাশ ফ্লো বিশ্লেষণ:উত্থানে ১২ কোম্পানি, হঠাৎ ধসে ৯টি

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)-এ তালিকাভুক্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ২৩টি কোম্পানির মধ্যে ২১টি প্রতিষ্ঠান চলতি ২০২৫ অর্থবছরের মার্চ প্রান্তিক (জুলাই... বিস্তারিত