ইউরোপের ইতিহাস

প্রটেস্ট্যান্ট রিফরমেশন: ইউরোপীয় রাজনীতি, অর্থনীতি ও চেতনার রূপান্তর

ইতিহাস ও দর্শন ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২৫ ১৬:২৩:০০
প্রটেস্ট্যান্ট রিফরমেশন: ইউরোপীয় রাজনীতি, অর্থনীতি ও চেতনার রূপান্তর

একটি নখ, একটি হাতুড়ি এবং একটি দরজার কাঠ—ইতিহাসে আর কখনো এত সাধারণ উপকরণ এত অসাধারণ পরিবর্তনের সূচনা করেনি। ১৫১৭ সালে মার্টিন লুথারের “পঁচানব্বইটি মতবাদ” উইটেনবার্গের গির্জার দরজায় পেরিয়ে দেয়ার সেই মুহূর্ত থেকে ইউরোপ শুধু ধর্ম নয়, সমাজ, রাজনীতি, শিক্ষা ও অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকেও এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলনশুধুধর্মীয় অনিয়মের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ ছিল না ; এটি ছিল মানুষের আত্মিক মর্যাদা, চিন্তার স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় স্বায়ত্তশাসনের এক জাগরণ।

এই লেখায় আমরা অনুসন্ধান করব—কীভাবে লুথার ও ক্যালভিনের মতো চিন্তাবিদেরা ধর্মতত্ত্বের ভিত পাল্টে দিলেন; কীভাবে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো রাষ্ট্রসমূহ এই আন্দোলনের অভিঘাতে নিজেদের রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটালো; কীভাবে এই আন্দোলনের ধাক্কায় জন্ম নিল আধুনিক ইউরোপ—যার ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীনতা, যুক্তি, এবং বহুত্ববাদী সমাজচেতনার উপর।

প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও কারণ:

প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলন ছিল ১৬শ শতাব্দীর এক বিপ্লবাত্মক আন্দোলন, যা রোমান ক্যাথলিক চার্চের কর্তৃত্ব ও মতবাদের প্রতি গভীরভাবে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় এবং যার ফলে পশ্চিমা খ্রিষ্টধর্মে স্থায়ী বিভাজন ঘটে। এই উত্তাল পরিবর্তনের পটভূমি তৈরি হয় বিভিন্ন আন্তঃসম্পর্কযুক্ত কারণের মাধ্যমে। অন্যতম প্রধান কারণ ছিল চার্চের দুর্নীতি—অনেক যাজক অর্থ উপার্জনের জন্য এমনকি ইন্ডালজেন্স (অর্থের বিনিময়ে পাপমোচনের দলিল) বিক্রি করত, যা সাধারণ মানুষের নৈতিক বোধকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।

বহু বছর ধরে ধর্মীয় সংস্কারের জন্য আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন বিভিন্ন ধর্মতাত্ত্বিক ও সাধারণ মানুষ। একই সময়ে মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার (১৪৪০ সালের দিকে) নতুন ধারার চিন্তাকে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে—ফলে সংস্কারপন্থী লেখাপত্র ও সাধারণ ভাষায় বাইবেল সহজলভ্য হয়ে ওঠে।

সাধারণ খ্রিষ্টানদের মাঝে নিজ ভাষায় বাইবেল পাঠের আগ্রহ বাড়তে থাকে এবং তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে ঈশ্বরের বাণীই সর্বোচ্চ ধর্মীয় কর্তৃত্ব, চার্চের প্রথা নয়। পাশাপাশি ধর্মতত্ত্বের ভিতরেও পরিবর্তনের স্রোত তৈরি হয়: অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেন, উদ্ধার শুধুমাত্র ঈশ্বরের অনুগ্রহ ও বিশ্বাসের মাধ্যমে সম্ভব, কেবলমাত্র বিশ্বাস ও সৎ কর্মের সমন্বয়ে নয়—যেমনটি ক্যাথলিক চার্চ শিক্ষা দিত।

এই সময় রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাও প্রভাব ফেলতে শুরু করে—যেমন ইংল্যান্ডের রাজা হেনরি অষ্টম পোপের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে নিজ রাজ্যে ধর্মীয় কর্তৃত্ব নিজের হাতে তুলে নিতে চেয়েছিলেন। এইসব একত্রিত শক্তি ১৫০০ সালের গোড়ার দিকে এক বৃহৎ ধর্মীয় বিপ্লবের পরিবেশ তৈরি করে দেয়।

মার্টিন লুথারের সংস্কারে ভূমিকা

প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কার সাধারণত ১৫১৭ সাল থেকে গণ্য করা হয়, যখন জার্মানির একজন আগস্টিনীয় ভিক্ষু এবং ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক মার্টিন লুথার ইন্ডালজেন্স বিক্রির বিরুদ্ধে তাঁর “পঁচানব্বইটি থিসিস” বা মতবাদ প্রকাশ করেন। ইন্ডালজেন্স ছিল এমন এক লিখিত দলিল, যা রোমান ক্যাথলিক চার্চ বিক্রি করত—যার মাধ্যমে ক্রেতাকে জানানো হতো যে তার বা তার প্রিয়জনের পাপ মার্জিত হয়েছে এবং শাস্তির সময়কাল হ্রাস পেয়েছে। এই দলিল অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হতো এবং এর পেছনে যুক্তি দেওয়া হতো যে চার্চের ‘অতিরিক্ত পুণ্য ভাণ্ডার’ (Treasury of Merit) থেকে এ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে।

এই প্রথাটি সাধারণ মানুষের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে চালানো হতো এবং পাপমোচনের ধারণাকে একধরনের বাণিজ্যিক চুক্তিতে পরিণত করেছিল। বিশেষত, জোহান টেট্‌জেল নামক একজন যাজক জার্মানিতে প্রচার করতেন—"যেই মুহূর্তে মুদ্রা কড়িতে পড়ে, আত্মা উঠে আসে প্রায়শ্চিত্তাগ্নি থেকে"। এই ধরনের মন্তব্য ও কর্মকাণ্ড লুথারকে তীব্রভাবে ক্ষুব্ধ করে তোলে। তিনি বিশ্বাস করতেন, পাপ ক্ষমা হয় শুধুমাত্র ঈশ্বরের করুণা ও বিশ্বাসের মাধ্যমে, অর্থ প্রদানের মাধ্যমে নয়।

লুথারের পোপের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে এই সাহসী চ্যালেঞ্জ দ্রুত এক দ্বন্দ্বে পরিণত হয়: তাঁকে পোপ দ্বারা চরম ধর্মচ্যুত করা হয় এবং হোলি রোমান সম্রাট চার্লস পঞ্চম তাঁকে “ডায়েট অব ওয়ার্মস” (১৫২১ খ্রিষ্টাব্দ) সভায় হাজির করে মত পরিবর্তনের আহ্বান জানান। কিন্তু লুথার তাঁর অবস্থান থেকে সরেননি এবং বলেন:“আমি বাইবেল ও বিবেকের কাছে বাধ্য। আমি কিছুই প্রত্যাহার করব না। ঈশ্বর আমাকে সাহায্য করুন। আমেন।”

সম্রাট তাঁকে ধর্মদ্রোহী এবং সমাজচ্যুত ঘোষণা করেন, কিন্তু এর মধ্যেই লুথারের চিন্তা-ভাবনা ইউরোপে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে মুদ্রণযন্ত্রের বদৌলতে। জার্মানির কিছু প্রভাবশালী প্রিন্স বা রাজপুত্ররা লুথারকে আশ্রয় দেন এবং তিনি সেখানে জার্মান ভাষায় বাইবেল অনুবাদ, ধর্মতাত্ত্বিক প্রবন্ধ রচনা ইত্যাদির মাধ্যমে লুথারানিজম নামক এক নতুন মতবাদের ভিত্তি স্থাপন করেন।

লুথারের ধর্মতাত্ত্বিক অবদান ছিল বিপ্লবাত্মক। তিনি শিক্ষা দেন যে, উদ্ধার একান্তই ঈশ্বরের অনুগ্রহের দান, যা কেবল বিশ্বাসের মাধ্যমে লাভযোগ্য—কোনো মানবীয় কর্ম বা পূজা-পার্বণের মাধ্যমে নয়। তিনি ক্যাথলিক ধারার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলেন যে, ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক গঠনের জন্য যাজক শ্রেণির প্রয়োজন নেই। বরং, তিনি ঘোষণা করেন “সব বিশ্বাসীরাই পুরোহিত”—অর্থাৎ প্রত্যেক খ্রিষ্টান সরাসরি ঈশ্বরের কাছে যেতে পারেন, ঈশ্বরের বাক্য (বাইবেল) বুঝতে পারেন এবং আত্মিক জীবনযাপন করতে পারেন।

লুথার “সোলা স্ক্রিপচুরা” নীতিও প্রচার করেন, যার অর্থ—ধর্মীয় যাবতীয় সিদ্ধান্ত ও বিশ্বাস শুধুমাত্র বাইবেলের ভিত্তিতে হতে হবে; গির্জার ঐতিহ্য বা পুরোহিতদের সিদ্ধান্তে নয়। এই নীতি অনুসরণে তিনি সাতটি ক্যাথলিক সাক্রামেন্ট কমিয়ে মাত্র দুটি (বাপ্তিস্ম ও প্রভু ভোজন) রাখেন এবং ইউক্যারিস্ট বা প্রভু ভোজ নিয়ে ক্যাথলিক মতবাদের বিপরীতে “কনসাবস্ট্যানসিয়েশন” তত্ত্ব প্রচার করেন, অর্থাৎ রুটি ও মদের মধ্যে খ্রিষ্টের উপস্থিতি সহাবস্থান করে, কিন্তু পরিবর্তিত হয় না।

তিনি বাইবেলকে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন (১৫২২ সালে নিউ টেস্টামেন্ট) এবং সাধারণ জনগণের জন্য “ক্যাটেকিজম” বা ধর্মীয় নির্দেশিকা রচনা করেন, যাতে তারা নিজেরাই ঈশ্বরের বাণী বুঝতে পারে।

লুথারের লেখাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল The Freedom of a Christian (একজন খ্রিষ্টানের স্বাধীনতা নিয়ে লেখা প্রবন্ধ), যেখানে তিনি ব্যক্তি বিশ্বাস, আত্মিক স্বাধীনতা ও ঈশ্বরের করুণা নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর এইসব সাহসী পদক্ষেপ ও মতবাদ খ্রিষ্টধর্মে এক গভীর ভাঙন সৃষ্টি করে এবং ইউরোপের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে নতুন করে গড়ে তোলে।

জন ক্যালভিন ও সংস্কার ধর্মতত্ত্বের বিস্তার

মার্টিন লুথারের প্রাথমিক বিদ্রোহের পর সংস্কার আন্দোলনের দ্বিতীয় প্রজন্মের চিন্তাবিদেরা প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মতত্ত্বকে আরও প্রসারিত ও সংহত করেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট ছিলেন জন ক্যালভিন, এক ফরাসি আইনজ্ঞ ও ধর্মতাত্ত্বিক, যিনি সংস্কারপন্থী চিন্তাধারার ধারাবাহিক উন্নয়ন ঘটিয়ে রিফর্মড প্রোটেস্ট্যান্টিজম-এর প্রধান রূপকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।

ক্যালভিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা ছিল Institutes of the Christian Religion (প্রথম প্রকাশ ১৫৩৬ সালে), যা প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মতত্ত্বের একটি পূর্ণাঙ্গ ও সুসংগঠিত সংকলন। তিনি লুথারের সঙ্গে অনেক মৌলিক মতবাদের ক্ষেত্রে একমত ছিলেন—যেমন মানবজাতির পাপপূর্ণতা (original sin), বাইবেলের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব, ঈশ্বরের করুণা ও অনুগ্রহের অপরিহার্যতা এবং শুধু বিশ্বাসের মাধ্যমে ন্যায্যতা অর্জন (justification by faith alone)।

তবে ক্যালভিন কিছু আলাদা দৃষ্টিকোণও উন্নয়ন করেন এবং একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ কাঠামোর মধ্যে প্রটেস্ট্যান্ট চিন্তাধারাকে স্থাপন করেন। তিনি বিশেষভাবে জোর দেন ঈশ্বরের সর্বময় সার্বভৌমত্ব ও পরম অধিকার-এর উপর—শিক্ষা দেন যে সৃষ্টির প্রতিটি দিক ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণাধীন। এই বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত হয় ক্যালভিনের অন্যতম বিতর্কিত মতবাদ “পূর্বনির্ধারিত পরিত্রাণ” (Predestination)—যেখানে তিনি বলেন, ঈশ্বর চিরকাল আগেই নির্ধারণ করে রেখেছেন কে মুক্তি পাবে এবং কে পাবে না।

যদিও লুথারও ঈশ্বরের সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণে বিশ্বাসী ছিলেন, তবে ক্যালভিন এই তত্ত্বকে আরও কঠোর ও গঠনমূলক করে তোলেন।

ক্যালভিন লুথারের থেকে গির্জার সংগঠন ও সমাজের সাথে ধর্মের সম্পর্ক নিয়েও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। লুথার সাধারণত একটি সহজ গির্জার রূপ চেয়েছিলেন এবং ধর্মনিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষকে ঈশ্বরের ব্যবস্থার অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু ক্যালভিন জেনেভা শহরে এক শক্তিশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং বিশ্বাস করেন যে খ্রিষ্টীয় সমাজকে অবশ্যই বাইবেলভিত্তিক শৃঙ্খলায় পরিচালিত হওয়া উচিত।

জেনেভায় ক্যালভিন একটি ধর্মীয় কমনওয়েলথ বা পবিত্র নগর প্রতিষ্ঠা করেন, যেটি পরিচালিত হতো চার্চের জ্যেষ্ঠ নেতা (Consistory) ও নাগরিক প্রশাসকের যৌথ নেতৃত্বে। এখানে তিনি কঠোর নৈতিক বিধিনিষেধ আরোপ করেন যাতে সমাজ বাইবেলীয় আদর্শের অনুসরণে পরিচালিত হয়। তাঁর লক্ষ্য ছিল এমন একটি সমাজ গঠন করা যা হবে “পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজ্য”র প্রতিচ্ছবি।

ক্যালভিনের নেতৃত্বে জেনেভা ইউরোপজুড়ে প্রটেস্ট্যান্ট নির্বাসিতদের জন্য এক আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং সেখানে তারা ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা পেতেন। এই ভাবধারা পরে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশে—ফ্রান্সের হুগেনোটরা ক্যালভিনের শিক্ষাকে গ্রহণ করে, নেদারল্যান্ডসের রিফর্মড চার্চ এবং স্কটল্যান্ডের প্রেসবিটারিয়ান চার্চ-এ জন নক্সের মাধ্যমে এই চিন্তা বিকাশ লাভ করে।

ক্যালভিনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ছিল এক আন্তর্জাতিক ক্যালভিনিস্ট নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, যা কঠোর বিশ্বাস, শৃঙ্খলা, নৈতিকতা এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা সমর্থন করত। লুথারের পাশাপাশি ক্যালভিনও প্রাথমিক প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মতত্ত্বের প্রধান নির্মাতা হিসেবে বিবেচিত হন এবং তাঁর চিন্তা বহু শতাব্দী ধরে গির্জা ও সমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।

প্রটেস্ট্যান্ট বিশ্বাসের মূল ধারণাসমূহ: সোলা ফিদে, সোলা স্ক্রিপচুরা, এবং “সব বিশ্বাসীর পুরোহিতত্ব”

প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কার চলাকালীন সময়ে কিছু মৌলিক ধর্মতাত্ত্বিক নীতিমালা গড়ে ওঠে, যেগুলি মূলধারার প্রটেস্ট্যান্টিজমের পরিচায়ক হয়ে দাঁড়ায়। এসব নীতির মাধ্যমে ক্যাথলিক চার্চের প্রথা ও বিশ্বাস থেকে প্রটেস্ট্যান্ট চিন্তার প্রভেদ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

● সোলা স্ক্রিপচুরা (শুধু বাইবেল)প্রটেস্ট্যান্টরা বিশ্বাস করেন যে বাইবেলই খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস ও ধর্মচর্চার একমাত্র অব্যর্থ ও চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ। গির্জার কোনো সিদ্ধান্ত, ঐতিহ্য বা পোপের নির্দেশ—সবই বাইবেল দ্বারা যাচাইযোগ্য হতে হবে। এই নীতির মাধ্যমে প্রটেস্ট্যান্টরা চার্চ কর্তৃপক্ষের হাতে থাকা ব্যাখ্যার একচ্ছত্র অধিকার ভেঙে দেন এবং সাধারণ বিশ্বাসীদের নিজ ভাষায় বাইবেল পাঠ ও ব্যাখ্যার অধিকার স্বীকার করে নেন।

এই ভাবধারার ফলে বাইবেল অনুবাদ ও মুদ্রণ আন্দোলন ত্বরান্বিত হয়। প্রটেস্ট্যান্টরা জনগণকে বাইবেল পড়তে উৎসাহিত করেন, ফলে জনগণের ধর্মীয় অংশগ্রহণ বাড়ে এবং বাইবেলভিত্তিক ধার্মিকতা গড়ে ওঠে। ক্যাথলিকদের চোখে এটি বিপজ্জনক অবাধ্যতা মনে হলেও, প্রটেস্ট্যান্টদের কাছে এটি ছিল আত্মিক মুক্তির পথ।

● সোলা ফিদে (শুধু বিশ্বাস)এই মতবাদ অনুযায়ী, উদ্ধার বা ঈশ্বরের কাছে ন্যায়বান হিসেবে বিবেচিত হওয়ার পথ শুধুই বিশ্বাসের মাধ্যমে। খ্রিষ্টে বিশ্বাস রাখার ফলে ঈশ্বর তাঁর অনুগ্রহ দান করেন—মানবীয় কর্ম বা সাধনার মাধ্যমে নয়। মার্টিন লুথার এই নীতিকে বলেছিলেন “গির্জা টিকে থাকার বা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মূল স্তম্ভ।”

এটি ক্যাথলিক মতবাদের একেবারে বিপরীত, যেখানে শিক্ষা দেওয়া হয় যে বিশ্বাস ও কর্ম—উভয়ের মাধ্যমে অনুগ্রহ লাভ হয়। প্রটেস্ট্যান্টরা বলেন, মানুষ নিজে কোনো কিছু করেই পাপমোচন বা মুক্তি অর্জন করতে পারে না; বরং, ঈশ্বরই তাঁর অনুগ্রহ দিয়ে নির্দিষ্ট সময় ও পন্থায় মুক্তি প্রদান করেন।

তবে প্রটেস্ট্যান্টরা এটাও বলেন যে, প্রকৃত বিশ্বাস থেকেই ভালো কাজের জন্ম হয়, কিন্তু সেই ভালো কাজ মুক্তির শর্ত নয়। এই মতবাদ ব্যক্তির সঙ্গে ঈশ্বরের সরাসরি সম্পর্ককে প্রাধান্য দেয়, চার্চ বা যাজক নয়।

● “সব বিশ্বাসীরাই পুরোহিত”এই ধারণাটি লুথার দ্বারা উপস্থাপিত হয়, এবং এটি প্রচলিত ধর্মতাত্ত্বিক কাঠামোকে ওলটপালট করে দেয়। ক্যাথলিক মত অনুযায়ী, শুধুমাত্র পোপ, বিশপ ও পুরোহিতদের মাধ্যমেই ঈশ্বরের অনুগ্রহ পাওয়া যায়, কিন্তু লুথার বলেন, প্রত্যেক খ্রিষ্টান বিশ্বাসীই ঈশ্বরের সামনে সমান মর্যাদাসম্পন্ন পুরোহিত।

এর অর্থ—পাপ স্বীকার, অনুশোচনা, প্রার্থনা বা বাইবেল বোঝার জন্য আর যাজকের দরকার নেই। প্রত্যেক বিশ্বাসী নিজেই ঈশ্বরের কাছে যেতে পারেন, তাঁর বাক্য বুঝতে পারেন এবং আত্মিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

এই ধারণা ধর্মীয় গণতন্ত্রের বীজ রোপণ করে। এতে সাধারণ মানুষের আত্মিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং তারা গির্জার নিষ্প্রভ শ্রোতা না হয়ে সক্রিয় অংশগ্রাহক হয়ে ওঠেন।

এই নীতির ফলাফল হিসেবে প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মাচরণে দেখা যায়—বর্ণনাধর্মী মাতৃভাষায় উপাসনা, কোরাসে সমবেত গান, জনগণের হাতে বাইবেল, এবং গির্জার অভ্যন্তরীন নেতৃত্বে বিশ্বাসীদের অংশগ্রহণ।

এই তিনটি মূল নীতিই—সোলা ফিদে (শুধু বিশ্বাস), সোলা স্ক্রিপচুরা (শুধু বাইবেল), এবং সব বিশ্বাসীর পুরোহিতত্ব—প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারের মূল ভিত্তি গড়ে তোলে। এগুলো ক্যাথলিক কর্তৃত্ববাদকে প্রত্যাখ্যান করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ঈশ্বরভক্তি ও চিন্তার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করে, যা শুধু ধর্ম নয়—সমগ্র ইউরোপীয় সংস্কার ও আধুনিকতার দিগন্ত উন্মোচন করে দেয়।

ইউরোপীয় শক্তিগুলোর প্রতিক্রিয়া ও ভূমিকা: ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং হোলি রোমান সাম্রাজ্য

প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কার কেবলমাত্র নতুন গির্জা সৃষ্টি করেনি, বরং এটি তৎকালীন ইউরোপীয় শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহের রাজনীতির সঙ্গেও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি দেশ নিজস্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও শাসকের কৌশল অনুযায়ী এই আন্দোলনের প্রভাব অনুভব করে এবং বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়।

ইংল্যান্ড

ইংল্যান্ডে সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় উপরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, যার সূচনা করেন রাজা হেনরি অষ্টম। শুরুতে তিনি লুথারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ক্যাথলিক ধর্মের পক্ষেই ছিলেন (এমনকি তিনি একটি ধর্মতাত্ত্বিক রচনাও প্রকাশ করেছিলেন যা তাঁকে পোপের কাছ থেকে “Faithful Defender” উপাধি এনে দেয়)। কিন্তু যখন তিনি তার স্ত্রী ক্যাথারিন অব অ্যারাগন-এর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করতে চাইলেন এবং পোপ তাতে অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানান, তখন তিনি পোপীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।

এরপর ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট “Act of Supremacy” (১৫৩৪) পাশ করে—যার মাধ্যমে রাজা নিজেকে ইংল্যান্ডের গির্জার “Supreme Head” বা সর্বোচ্চ নেতা ঘোষণা করেন এবং পোপের ধর্মীয় কর্তৃত্ব পুরোপুরি বাতিল করে দেন। এই সিদ্ধান্তের ফলে চার্চের সমস্ত সম্পত্তি রাষ্ট্রের অধীনে চলে যায় এবং গির্জার ভূমি, অর্থ ও প্রভাব রাজপরিবার ও অভিজাতদের হাতে চলে আসে।

এই সংস্কার শুরুতে doctrinal বা ধর্মতাত্ত্বিক ছিল না; বরং রাজনৈতিক ও আর্থিক স্বার্থেই তা পরিচালিত হয়। তবে হেনরির মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র এডওয়ার্ড ষষ্ঠ (শৈশবাবস্থায় রাজত্ব শুরু করেন) সংস্কারপন্থী উপদেষ্টাদের মাধ্যমে প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদ ও উপাসনার রূপ সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। প্রখ্যাত ধর্মগুরু টমাস ক্র্যানমার এ সময় Book of Common Prayer রচনা করেন এবং ক্যাথলিক রীতিনীতি বাতিল করে একটি বিশুদ্ধ প্রটেস্ট্যান্ট লিটার্জি চালু করেন।

তবে এই রূপান্তর স্থায়ী হয়নি। হেনরির কন্যা মেরি টিউডর (Bloody Mary) রাজগদিতে আসার পর তিনি আবার পোপীয় কর্তৃত্ব পুনঃস্থাপন করেন এবং বিপুলসংখ্যক প্রটেস্ট্যান্টকে দগ্ধ করে হত্যা করেন। ফলে ইংল্যান্ডে ধর্মীয় সংঘর্ষ আবার মাথাচাড়া দেয়।

পরবর্তীতে রানী এলিজাবেথ প্রথম (১৫৫৮–১৬০৩) শাসনকালে “Elizabethan Settlement” নামক এক মধ্যপন্থী ধর্মীয় নীতি গ্রহণ করা হয়, যা ইংল্যান্ডকে সরকারিভাবে প্রটেস্ট্যান্ট ঘোষণা করে, তবে কিছু ক্যাথলিক আচার আচরণও রক্ষা করে। এই নীতির ফলে Church of England (আঙ্গলিক চার্চ) প্রতিষ্ঠিত হয়—যা ধর্মতত্ত্বে প্রটেস্ট্যান্ট হলেও গির্জার কাঠামো ও রীতিতে অনেকটাই ক্যাথলিকধর্মীয় চেতনা বহন করে। ইংল্যান্ড এই সময় থেকে ইউরোপের একটি শক্তিশালী প্রটেস্ট্যান্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

ফ্রান্স

ফ্রান্সে সংস্কার আন্দোলন একেবারে ভিন্ন রূপ নেয়—এখানে ধর্মীয় সংকট রূপ নেয় দীর্ঘস্থায়ী ও রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে। জন ক্যালভিনের চিন্তাধারা ১৬শ শতকের শুরুর দিকে ফ্রান্সে প্রবেশ করে এবং শিক্ষিত অভিজাত শ্রেণির একাংশ ও কিছু শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্যে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই প্রটেস্ট্যান্টদের “হুগেনোট” বলা হতো।

ফ্রান্সের রাজতন্ত্র শুরুতে কিছুটা সহনশীলতা দেখালেও পরে ব্যাপক দমননীতি গ্রহণ করে। ক্যাথারিন দ্য মেডিচি-র শাসনামলে, বিশেষ করে, পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। ১৫৬২ থেকে ১৫৯৮ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সে ধর্মীয় গৃহযুদ্ধের (French Wars of Religion) এক ভয়াবহ অধ্যায় চলে, যার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা ছিল St. Bartholomew’s Day Massacre (১৫৭২)—যেখানে প্যারিসসহ বহু শহরে হাজার হাজার হুগেনোটকে গণহারে হত্যা করা হয়।

এই সংঘর্ষ ধীরে ধীরে বিদেশি শক্তিদেরও জড়িয়ে ফেলে—স্পেন ক্যাথলিকদের পক্ষ নিয়ে হস্তক্ষেপ করে, কারণ তারা ফ্রান্সে প্রটেস্ট্যান্টদের উত্থানকে নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করত।

শেষমেশ, হুগেনোট নেতা হেনরি অব নাভার গৃহযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ফ্রান্সের রাজা হেনরি চতুর্থ হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করেন (লোকমুখে তাঁর বিখ্যাত উক্তি: “প্যারিস একটি মেসার যোগ্য”)। তবে তিনি ১৫৯৮ সালে এডিক্ট অব নঁত্‌স জারি করে হুগেনোটদের আইনগত ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অধিকার প্রদান করেন, যার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে।

এই ডিক্রি ফ্রান্সে প্রটেস্ট্যান্টদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেও এটি অনেক দেরিতে আসে এবং ১৬৮৫ সালে রাজা লুই চতুর্দশ কর্তৃক তা বাতিল করা হয়—ফলে বহু হুগেনোট দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।

ফলে বলা যায়, ফ্রান্সের সংস্কার আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় পরিবর্তনের বদলে ছিল রক্তক্ষয়ী সংঘাতের ইতিহাস, যা ধর্মীয় সহাবস্থানের দিকে ধীরে ধীরে গড়ায়।

হোলি রোমান সাম্রাজ্য (জার্মান রাজ্যসমূহ)

সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয় মূলত জার্মানভুক্ত হোলি রোমান সাম্রাজ্যে, এবং সেখানেই এটি প্রথম প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই সাম্রাজ্য ছিল বহু স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য ও প্রদেশে বিভক্ত—যেগুলো একটি নির্বাচিত সম্রাট দ্বারা নামমাত্র শাসিত হতো (লুথারের সময় সেই সম্রাট ছিলেন চার্লস পঞ্চম)। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ ক্যাথলিক এবং লুথার ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে উদ্যত হন।

তবে জার্মানির বহু প্রিন্স ও শহর লুথারের সংস্কার আন্দোলনকে সমর্থন জানান, কেউ কেউ ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে, কেউবা রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও ক্যাথলিক চার্চের প্রভাব থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে। এদের নিয়ে গঠিত হয় Schmalkaldic League, যারা সাম্রাটের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়।

পরবর্তীতে দীর্ঘ সংঘর্ষ ও যুদ্ধের পর সম্রাট চার্লস পঞ্চম এক সমঝোতায় পৌঁছাতে বাধ্য হন। ১৫৫৫ সালের Augsburg শান্তিচুক্তি অনুযায়ী, “Cuius regio, eius religio” নীতিমালা গ্রহণ করা হয়—অর্থাৎ, যার রাজত্ব, তার ধর্ম—প্রতিটি শাসক তাঁর রাজ্যে ক্যাথলিক কিংবা লুথারান ধর্মের মধ্যে যেকোনো একটি বেছে নিতে পারবেন এবং তার প্রজারাও সেই ধর্ম পালন করবেন।

এই চুক্তির মাধ্যমে লুথারানিজমকে প্রথমবারের মতো বৈধতা প্রদান করা হয়, তবে এটি ক্যালভিনিস্ট বা অন্যান্য ধর্মীয় শাখাকে স্বীকৃতি দেয়নি, যার ফলে ভবিষ্যতে আরও সংঘাতের জন্ম হয়।

এই অসম্পূর্ণ চুক্তি এবং চলমান ধর্মীয় বিভাজনই শেষ পর্যন্ত ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধ (Thirty Years’ War)-এর সূত্রপাত ঘটায় (১৬১৮–১৬৪৮)। এটি ছিল ইউরোপের ইতিহাসে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক সংঘাতগুলোর একটি।

এই যুদ্ধের অবসান ঘটে Peace of Westphalia (১৬৪৮) চুক্তির মাধ্যমে, যা কেবল ক্যালভিনিজমকেও বৈধতা প্রদান করে না, বরং একে ইউরোপের ইতিহাসে একক খ্রিষ্টধর্মবিশ্বের অবসান ও রাষ্ট্রভিত্তিক ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনের সূচনা হিসেবে দেখা হয়।

ফলে, হোলি রোমান সাম্রাজ্যে সংস্কার আন্দোলনের পরিণতি ছিল ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক বিভাজন ও সহাবস্থানের জন্য নতুন কাঠামোর বিকাশ, যা আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের ভিত্তি গঠনে সহায়ক হয়।

ইউরোপীয় উন্নয়নে প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কার কেবল একটি ধর্মীয় মোড় পরিবর্তনই ছিল না—বরং এটি এক বিস্তৃত সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক রূপান্তরের সূচনা করেছিল, যার প্রভাব শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইউরোপীয় সভ্যতাকে নতুন রূপ দিয়েছে। এই আন্দোলনের উত্তরাধিকার আজও ইউরোপ ও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ধর্মনিরপেক্ষতা, শিক্ষা, অর্থনীতি ও গণতন্ত্রে প্রতিফলিত হয়।

● ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের উত্থান

প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কার ইউরোপে একক খ্রিষ্টান একত্বের অবসান ঘটায়, যার ফলে ধর্মীয় বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এই বহুত্ববাদ রাজনীতিতে এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করে—সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা। রাজাদের আর কোনো “একমাত্র সত্য ধর্ম” সংরক্ষণ করার দায় রইল না; বরং প্রত্যেক শাসক নিজ রাজ্যে ধর্ম নির্ধারণ করতে পারতেন।

এই ধারার পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ঘটে Peace of Westphalia (১৬৪৮)-এর মাধ্যমে, যা পোপের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে রাষ্ট্রভিত্তিক ধর্মীয় স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়। এই চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের সার্বভৌম ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে এবং “খ্রিষ্টধর্মবিশ্ব” নামক এক অভিন্ন ধারণার বিলুপ্তি ঘটে।

এই অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যতের চিন্তাবিদেরা রাষ্ট্র ও গির্জার পৃথকীকরণ (Separation of Church and State) এর ধারণা উপস্থাপন করেন। আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা জেমস ম্যাডিসন এই নীতির সূত্রপাত খুঁজে পান লুথারের দুই রাজ্য তত্ত্বে—যেখানে তিনি ধর্মীয় ও জাগতিক কর্তৃত্বকে আলাদা রাখার কথা বলেন।

ফলস্বরূপ, প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কার আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ভিত্তি নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে—যেখানে আইনের ভিত্তি ধর্ম নয়, বরং নাগরিক অধিকার ও নৈতিকতা।

● শিক্ষা ও সাক্ষরতার বিস্তার

প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল সর্বজনীন শিক্ষা ও সাক্ষরতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিশাল উদ্যোগ। প্রটেস্ট্যান্ট বিশ্বাসীরা মনে করতেন, প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ ভাষায় বাইবেল পাঠ করা উচিত—এটি কেবল আত্মিক মুক্তির পথ নয়, বরং নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্বও বটে।

ফলে, সংস্কারপন্থীরা স্কুল ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন, যাতে সাধারণ জনগণ, এমনকি দরিদ্র ও নারীরাও শিক্ষার সুযোগ পায়। প্রটেস্ট্যান্টরা বাইবেল অনুবাদ করে, ক্যাটেকিজম রচনা করে এবং লেখাপড়ার জন্য সহায়ক উপকরণ ছড়িয়ে দেন। এর ফলশ্রুতিতে উত্তর ইউরোপে সাক্ষরতার হার দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

এই শিক্ষাব্যবস্থা ছিল উভয় ধর্মীয় ও নাগরিক প্রশিক্ষণের মিশ্রণ, যা পরবর্তী কালে এনলাইটেনমেন্ট (আলোকায়ন) এবং জ্ঞানচর্চা ভিত্তিক সমাজের ভিত্তি স্থাপন করে।

একইসঙ্গে, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ক্যাথলিক চার্চও শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগ নেয়, বিশেষ করে জেসুইটদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশ্বজুড়ে উচ্চমানের শিক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠে। এইভাবে, সংস্কার ও প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে গোটা ইউরোপেই এক শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক পুনর্জাগরণ ঘটে, যা আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ব্যবস্থার দিকে গতি সঞ্চার করে।

● অর্থনৈতিক রূপান্তর ও পুঁজিবাদের বিকাশ

প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারের সাথে আধুনিক পুঁজিবাদের সম্পর্ক নিয়ে বহু বিতর্ক থাকলেও, সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism-এ ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে প্রটেস্ট্যান্ট বিশেষত ক্যালভিনিস্টরা কঠোর পরিশ্রম, সময়ের মূল্যায়ন, সাশ্রয়ী জীবনযাপন এবং ধর্মীয় অনুপ্রেরণাকে একটি “পেশাগত আহ্বান” হিসেবে দেখতেন।

এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলে—

শ্রম ও অর্থোপার্জন একটি ঈশ্বরপ্রদত্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়;

ব্যবসা ও বাণিজ্যকে নৈতিক কর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়;

সময় অপচয় ও অলসতা নিন্দনীয় হিসেবে বিবেচিত হয়।

এছাড়া, প্রটেস্ট্যান্ট অঞ্চলে মঠ, যাজকীয় সম্পত্তি ও আর্থিক নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়ায় অর্থনৈতিক কার্যকলাপ স্বাধীনতা লাভ করে এবং উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে ওঠে।

ফলত, নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড ও প্রুশিয়ার মতো প্রটেস্ট্যান্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো অচিরেই ইউরোপের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও শিল্পবিপ্লবের অগ্রদূত হয়ে ওঠে। যদিও পুঁজিবাদের উত্থানে আরও বহু উপাদান ভূমিকা রাখে, তথাপি প্রটেস্ট্যান্ট কর্মসংস্কৃতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণ-এর অবদান ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরা হয়।

● বুদ্ধিবৃত্তিক আধুনিকায়ন ও এনলাইটেনমেন্ট

প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলন একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক আত্মসচেতনতা ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়। একবার যদি পোপ বা চার্চের সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়, তাহলে রাজা, সমাজ, কিংবা অন্য যে কোনো কর্তৃত্বকেও প্রশ্ন করা যায়—এই চিন্তা থেকে আধুনিক স্কেপটিসিজম ও সমালোচনামূলক বোধ জন্ম নেয়।

ধর্মীয় ভিন্নমতের ফলে শতাব্দীব্যাপী সংঘাত ও ধর্মযুদ্ধ ইউরোপে যে ধ্বংস ডেকে আনে, তা অনেক চিন্তাবিদকে ধর্মের নামে রক্তপাত নিয়ে ভাবিয়ে তোলে। ফলে Enlightenment চিন্তাবিদেরা ধর্মীয় সহনশীলতা, যুক্তি, মানবাধিকার ও স্বাধীনতা-এর পক্ষে মত দিতে শুরু করেন।

এছাড়া, ধর্মের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ভেঙে এক বহুধর্মীয় পরিবেশ গড়ে ওঠে, যেখানে সহাবস্থান, যুক্তির মুক্তচর্চা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নীতির ভিত্তি রচিত হয়।

প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারের শিক্ষা বিস্তার, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, ভাষার democratization ও যুক্তিবাদী বোধ—সবকিছু মিলে ইউরোপকে জ্ঞানবিজ্ঞানে, দার্শনিক চিন্তায় ও নাগরিক স্বাধীনতায় নতুন দিগন্তের দিকে ঠেলে দেয়।

প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলন এক অভূতপূর্ব ধর্মীয় উত্তরণ হলেও, এর প্রভাব কেবল ধর্মীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিল না। বরং এই আন্দোলন ইউরোপের রাজনৈতিক মানচিত্র, সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস, অর্থনৈতিক কাঠামো এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অভিমুখ—সবই পাল্টে দেয়।

মার্টিন লুথার ও জন ক্যালভিন-এর নেতৃত্বে একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক, বাইবেলভিত্তিক, ও আত্মিক স্বাধীনতার উপর গড়ে ওঠা ধর্মতত্ত্ব সৃষ্টি হয়, যা গির্জার স্বরূপ বদলে দেয়। সোলা ফিদে, সোলা স্ক্রিপচুরা, ও সব বিশ্বাসীর পুরোহিতত্ব-এর মতো নীতিগুলো ধর্মের প্রতিটি স্তরে বিপ্লব ঘটায়। দীর্ঘমেয়াদে, প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কার ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি, শিক্ষা বিপ্লব, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, এবং এনলাইটেনমেন্ট-এর জ্ঞানদীপ্ত সভ্যতা গঠনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এটি মধ্যযুগীয় ইউরোপের পর্দা নামিয়ে দিয়ে আধুনিক ইউরোপের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে—যার চেতনা আজও আমাদের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজে প্রতিফলিত হয়।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

আমেরযত কাহিনি

আমেরযত কাহিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ ‘আম’ শুধু একটি ফল নয়, বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত এক... বিস্তারিত