লোহাগাড়ায় পাহাড় কেটে ২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি, ধামাচাপা দিল কারা?

সারাদেশ ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ২২ ১৭:৪২:৩০
লোহাগাড়ায় পাহাড় কেটে ২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি, ধামাচাপা দিল কারা?

সত্য নিউজ:দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণকাজে পাহাড় কেটে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করেছিল চট্টগ্রামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান—তমা কনস্ট্রাকশন ও মেসার্স হাসান ইন্টারন্যাশনাল। ২০২১ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর তাদের বিরুদ্ধে ৫০ কোটি টাকা জরিমানা করলেও ২০২২ সালের জুন মাসে তা রহস্যজনকভাবে মওকুফ করে দেওয়া হয়। তদন্তে উঠে এসেছে, তৎকালীন পরিবেশ সচিব মোস্তফা কামাল নিজেই এই জরিমানা মওকুফে মূল ভূমিকা রাখেন। ফলে প্রশ্ন উঠেছে—পরিবেশ ধ্বংসের দায় থেকে কেন এবং কিভাবে রেহাই পেল এই প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলো?

পাহাড় কাটায় ২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি

চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার চুনতি ইউনিয়নে রেলপথ নির্মাণের সময় প্রায় ২০টি পাহাড় কেটে ২ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট মাটি সংগ্রহ করে মেসার্স হাসান ইন্টারন্যাশনাল। এই কাজের জন্য পূর্বে অনুমোদিত অ্যালাইনমেন্ট (১১.৯২ কিমি) স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করে তারা কাজ করে। পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, শুধু তমা কনস্ট্রাকশন কর্তৃক পরিবেশের ক্ষতির কারিগরি মূল্যায়নেই ক্ষতিপূরণের অঙ্ক দাঁড়ায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। অথচ প্রতিষ্ঠানটি শেষ পর্যন্ত মাত্র ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে পার পায়।

প্রথমে জরিমানা, পরে রহস্যজনক ছাড়

২০২১ সালের ১৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিচালক মোহাম্মদ মোয়াজ্জম হোসাইন দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৫০ কোটি টাকা জরিমানা আদায়ের নির্দেশ দেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠান দুটি আপিল করলে ২০২২ সালের জুন মাসে সেই জরিমানা বাতিল করে দেন তৎকালীন সচিব মোস্তফা কামাল, যিনি ছিলেন আপিল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান।

হাসান ইন্টারন্যাশনাল আপিলে জানায়, তারা শুধুমাত্র সামান্য বালু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এবং মূল দায় তমা কনস্ট্রাকশনের। এর ভিত্তিতে মোস্তফা কামাল প্রতিষ্ঠানটিকে পুরোপুরি অব্যাহতি দেন। অপরদিকে, তমা কনস্ট্রাকশনের জরিমানা বিষয়ে কারিগরি মূল্যায়নের নির্দেশ দিয়ে বিষয়টি পরবর্তী শুনানিতে নিষ্পত্তির কথা বলা হয়। কিন্তু সেই শুনানি আর কখনো হয়নি।

ধামাচাপা ও অনিয়মের অভিযোগ

পরিবেশ অধিদপ্তরের নথিপত্র অনুযায়ী, পরিবেশের উপর প্রভাব মূল্যায়নের সময় দেখা যায়, এই পাহাড় কাটার ঘটনা শুধু অ্যালাইনমেন্ট লঙ্ঘনই নয় বরং রাঙ্গাখাল নামের একটি খাল ভরাট করাও হয়, যা সরাসরি পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন। অথচ আদালতে দায় স্বীকার করেও প্রতিষ্ঠান দুটি সামান্য জরিমানায় দায়মুক্তি পায়।

এক কর্মকর্তা বলেন, তমা কনস্ট্রাকশনের প্রকৃত ক্ষতিপূরণ নির্ধারিত হলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা আরও জোরালো হতো। কারণ সে ক্ষতির অঙ্ক পৌঁছেছিল ২ হাজার কোটিতে। তাই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পুরো বিষয়টিই ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে।

মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে ‘যোগসাজশের’ অভিযোগ

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, "এটা এক ভয়াবহ ক্ষমতার অপব্যবহার। এটি বোঝাই যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের সঙ্গে সচিবের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল। এমন পরিস্থিতিতে সচিবকেই প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশীদার হিসেবে গণ্য করা উচিত।"

তিনি আরও বলেন, এই সিদ্ধান্ত সচিব এককভাবে নিয়েছেন কি না—তা খুঁজে দেখতে হবে। কারণ মন্ত্রণালয়ের মতো সংবেদনশীল জায়গায় মন্ত্রীর অজান্তে এমন বড় সিদ্ধান্ত হওয়া কঠিন।

মামলা দায়েরের দীর্ঘসূত্রিতা

২০২১ সালের জানুয়ারিতে জরিমানার আদেশ দেওয়া হলেও মামলা দায়ের করা হয় ওই বছরের নভেম্বর মাসে, অর্থাৎ ৯ মাস পরে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিচালক মোয়াজ্জম হোসাইন এই বিলম্বের কারণ সম্পর্কে বলেন, "জরিমানার পাশাপাশি মামলা করার সুপারিশ জানুয়ারি মাসেই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এরপর আমাকে বদলি করা হয় এবং পরবর্তী কর্মকর্তার সময়ে মামলার কার্যক্রম শুরু হয়।"

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পরিবেশ আদালতে রায় হয় এবং তাতে হাসান ইন্টারন্যাশনালকে মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ও তমা কনস্ট্রাকশনকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

স্বত্বাধিকারীর দেশত্যাগ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

জুলাই ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পর, তমা কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী আতাউর রহমান ভূঁইয়া দেশ ছেড়ে গেছেন বলে জানা গেছে। তার বক্তব্য নেওয়ার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করলেও সফল হওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে দেওয়া নম্বরেও কোনো উত্তর মেলেনি।

সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা হাসান ইন্টারন্যাশনালের মওকুফকৃত জরিমানার নথি পর্যালোচনার সময় তমা কনস্ট্রাকশনের ধামাচাপা দেওয়া শুনানির বিষয়টিও সামনে আসে। এখন অধিদপ্তর নতুন করে তমাকে শুনানির জন্য ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তবে দিনক্ষণ এখনও নির্ধারিত হয়নি।

চট্টগ্রামে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের পাহাড় কাটার এই ঘটনায় বাংলাদেশে পরিবেশ আইনের প্রয়োগ, প্রশাসনিক জবাবদিহি ও রাজনৈতিক প্রভাব—সবকিছুই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তাদের ভূমিকাও গভীর তদন্তের দাবি রাখে।

এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় পরিবেশ বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদ ও নাগরিক সমাজ।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ