বিশেষ প্রতিবেদন

বাংলাদেশকে চাপে ফেলতে গিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে অর্থনৈতিক ধস!

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ০১ ১৯:৪৯:১১
বাংলাদেশকে চাপে ফেলতে গিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে অর্থনৈতিক ধস!

বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে একতরফাভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করে ভারত এখন নিজেই রাজনৈতিক কূটনীতির জালে আটকে পড়েছে। নয়া দিল্লির এই কঠোর অবস্থানের সবচেয়ে বড় শিকার হয়ে উঠেছে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পরিচিত ‘সেভেন সিস্টারস’ নামে। হিন্দুস্তান টাইমসের সাম্প্রতিক একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে, কীভাবে বাংলাদেশকে চাপে ফেলতে গিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ সীমান্তবর্তী অর্থনীতিই চরম ধসের মুখে পড়েছে।

ভুল কূটনৈতিক কৌশলের প্রেক্ষাপট

নয়া দিল্লির ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, আসবাবপত্র, সিমেন্ট, প্লাস্টিক পণ্যসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু পণ্যের আমদানি সীমিত করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞা মূলত কার্যকর হয় পশ্চিমবঙ্গ এবং সেভেন সিস্টারসের সীমান্ত দিয়ে স্থলপথে প্রবেশকারী পণ্যের ক্ষেত্রে। এভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার মূলে ছিল বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে চাপে রাখার একটি স্পষ্ট বার্তা।

কিন্তু এই কৌশল বাস্তবে কী ফল দিল? কৌশলগত দৃষ্টিকোণে দেখা যায়, বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবাহের জন্য একটি কার্যকর প্রবেশদ্বার। ঐতিহাসিকভাবে অবকাঠামো, সংযোগ এবং বাণিজ্যে বাংলাদেশের ওপর নির্ভরতা এতটাই প্রাসঙ্গিক যে, তা হঠাৎ বন্ধ করে দিলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারতের ভৌগোলিক বিচ্ছিন্ন উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো।

অর্থনৈতিক পরিণতি: বাজার সংকোচন ও আয় সংকট

হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, এই একতরফা সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ভারতীয় বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, পণ্য স্বল্পতা এবং কর্মসংস্থান সংকট একযোগে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে পণ্য আসতে এখন বিকল্প ও দীর্ঘ পথ ব্যবহার করতে হচ্ছে—ফলে লজিস্টিক খরচ বাড়ছে এবং পণ্য পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে, যেখানে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।

বিশ্লেষণ অনুযায়ী, শুধু আমদানি খাতে নয়, রপ্তানিতেও ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। মেঘালয় থেকে কয়লা, চুনাপাথর ও বোল্ডার যা বাংলাদেশে নিয়মিত রপ্তানি হতো, তা থমকে গেছে। মাত্র পাঁচ দিনেই রাজ্যটি হারিয়েছে প্রায় ২.৫ কোটি রুপি রাজস্ব।

আসামের সুতারকান্দি বন্দর এক সময় ছিল বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যের ব্যস্ততম প্রবেশপথ। সেখানে এখন নীরবতা। প্রতিদিন ৫০০–৭৫০ রুপি আয় করা শ্রমিকরা এখন ১০০–১৫০ রুপিতেও কাজ পাচ্ছেন না। এমন পরিস্থিতি শুধু ব্যক্তি নয়, স্থানীয় অর্থনীতির ওপরও সরাসরি আঘাত হেনেছে।

আঞ্চলিক বৈষম্য আরও জটিল হচ্ছে

উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন। তাদের সরবরাহ চেইন অনেকাংশেই বাংলাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত। এই অঞ্চলগুলো ‘সেন্টার–পারিফেরি’ কাঠামোর মধ্যে থেকে দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়ন বঞ্চিত। সেখানে নতুন করে বাণিজ্য সীমাবদ্ধতা আরোপ এই বৈষম্যকে আরও জটিল ও স্থায়ী করে তুলছে।

উদাহরণস্বরূপ, মিজোরামে আদা রপ্তানি বাজারে ধস নেমেছে। বাংলাদেশ অভিমুখী আদার সরবরাহ বন্ধ থাকায় দাম কেজিপ্রতি ৯–১০ রুপি পর্যন্ত কমেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয় কৃষক ও প্রক্রিয়াজাত ব্যবসায়ীরা। এটি নিছক আর্থিক ক্ষতি নয়—এটি খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর আয়, এবং রাজ্যগুলোর রপ্তানির সক্ষমতার ওপর প্রত্যক্ষ আঘাত।

ত্রিপুরা আপাতত বাংলাদেশি পণ্য সরবরাহে তেমন ঘাটতি না দেখলেও, এটি শুধুই পূর্বে মজুদকৃত মালামালের জন্য। একবার মজুদ শেষ হলে এই রাজ্যেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ত্রিপুরার বাজারে বাংলাদেশের বিকল্প নেই। ফলে পরিস্থিতি দ্রুতই সংকটময় হয়ে উঠতে পারে।

কৌশলগত আত্মঘাত: ঢাল হয়ে উঠছে বাংলাদেশ

ভারতের ‘চাপ প্রয়োগ’ নীতিকে বাংলাদেশ কতটা কৌশলে মোকাবিলা করছে, সেটিও এখন দৃশ্যমান। যেমন—চীনের সঙ্গে চিকিৎসা পর্যটনে নতুন গতি, রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি হালনাগাদ, এমনকি মিয়ানমার বা সেন্ট্রাল এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে নতুন রুট তৈরির সম্ভাবনা ইঙ্গিত দিচ্ছে—বাংলাদেশ বিকল্প খুঁজতে প্রস্তুত। অথচ ভারত, বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চল, এখনো বাংলাদেশের উপর নির্ভরশীল ও বিকল্পহীন। সুতরাং প্রশ্ন ওঠে—এই নিষেধাজ্ঞা আদৌ বাংলাদেশের ওপর প্রভাব ফেলেছে নাকি ভারতের নীতিগত একগুঁয়েমি তারই অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে?

এই ঘটনা থেকে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক একটি বড় শিক্ষা নিতে পারে—কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে অর্থনীতিকে ছুঁয়ে যাওয়া বাণিজ্য সিদ্ধান্ত, কেবল বিদেশি প্রতিপক্ষকে নয়, বরং নিজের জনগণকেও চরমভাবে প্রভাবিত করতে পারে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দেখা দেওয়া বাণিজ্য সংকট কেবল এক মুহূর্তের সমস্যা নয়, বরং এটি ভবিষ্যতের জন্যও একটি কৌশলগত সতর্কবার্তা। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই কৌশল সফল হয়নি—বরং আঘাত ফিরেছে অভ্যন্তরেই।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।... বিস্তারিত