কোটার প্রশ্নে আগুন ছড়িয়ে দিল রাজু ভাস্কর্য থেকে

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ০১ ০৯:১৫:৩২
কোটার প্রশ্নে আগুন ছড়িয়ে দিল রাজু ভাস্কর্য থেকে

১ জুলাই ২০২৫, বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে নতুন এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে। 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন'-এর ব্যানারে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় সংগঠিত ছাত্রআন্দোলন, যার কেন্দ্রে ছিল সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস ও পুনর্বহালের দাবি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের সূচনা হয় সকালে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের জড়ো হওয়ার মধ্য দিয়ে। সেখানে অবস্থান কর্মসূচির পর বর্ণাঢ্য মিছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ চত্বর ও হল প্রদক্ষিণ করে ফের রাজু ভাস্কর্যে সমবেত হয়। পরবর্তীতে আয়োজিত সমাবেশ থেকে ঘোষণা আসে: ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করা হবে।

সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম (বর্তমানে এনসিপির আহ্বায়ক) সরকারের উদ্দেশে স্পষ্ট বার্তা দেন ৪ জুলাইয়ের মধ্যে আন্দোলনকারীদের দাবির আইনগত সমাধান নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে গ্রন্থাগার, হল ও চিকিৎসাসেবাসহ শিক্ষার্থীদের সব ধরনের সুবিধা সচল রাখার দাবি জানান। বিশেষভাবে তিনি ‘প্রত্যয় স্কিম’-বিরোধী আন্দোলনে শিক্ষকদের প্রতি সংহতি জানালেও শিক্ষার্থীদের অধিকার যেন এতে ক্ষুণ্ণ না হয়, সে বিষয়ে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান।

সমাবেশ থেকেই আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ২, ৩ ও ৪ জুলাই শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এ সময়ে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বাকৃবি) আরও বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হয় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি।

আন্দোলনকারীদের মূল দাবি ছিল ২০১৮ সালের সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহাল করা এবং ভবিষ্যতে যদি সরকার কোটাব্যবস্থা নিয়ে কোনো পরিবর্তন আনতে চায়, তবে তা যেন একটি কমিশনের মাধ্যমে হয়। সেই কমিশনের দায়িত্ব হবে যুক্তিসঙ্গতভাবে বৈষম্যমূলক ও অযৌক্তিক কোটা বাতিল করে একটি স্বচ্ছ নিয়োগব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

এই আন্দোলনের পেছনে যে নীরব সংগঠন ও প্রস্তুতির ধারা ছিল, তা তুলে ধরেন আন্দোলনের শুরুর দিন মাঠপর্যায়ের সংগঠক আবু বাকের মজুমদার। বর্তমানে তিনি গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়কের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি জানান, ৫ জুন মুক্তিযোদ্ধা কোটাবাতিল-সংক্রান্ত সরকারি পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে উচ্চ আদালতের রায় দেয়। সেই রায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় এবং ৫-৯ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদী কর্মসূচি পালিত হয়।

৩০ জুন পর্যন্ত সরকারের প্রতি দেওয়া হয় সময়সীমা, যে সময়ের মধ্যে কোনো সদুত্তর না আসায় ১ জুলাই থেকে সারা দেশে সংগঠিতভাবে আন্দোলনের ঘোষণা কার্যকর হয়। এই সময়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ১১টি স্থানে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে একযোগে আন্দোলন শুরু হয়। পাশাপাশি আরও ছয়-সাতটি জায়গায় ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ ব্যানারেও প্রতিবাদ হয়।

আন্দোলনের প্রথম দিনেই স্পষ্ট হয় যে, এটি ছিল হঠাৎ গড়ে ওঠা বিক্ষোভ নয়, বরং জুন মাসজুড়ে চলে আসা সুসংগঠিত প্রস্তুতির ফলাফল। সংগঠন গঠনের দিক থেকেও এই আন্দোলন দেশের ছাত্ররাজনীতিতে একটি নতুন ধারা ও ভাষা সৃষ্টি করে যা রাজনৈতিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে, মৌলিক অধিকার ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ছাত্রদাবির প্রতিনিধিত্ব করে।

১ জুলাইয়ের আন্দোলন শুধু কোটাব্যবস্থার ইস্যুতে সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অধিকারের প্রশ্নে শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রতিবাদের প্রতীক। সময় যত গড়াবে, এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা, এর রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অভিঘাত ও ফলাফল নিয়েই মূল প্রশ্নটি সামনে আসবে এই ছাত্রজাগরণ কি কেবল ক্ষণস্থায়ী চাপ, না কি এটি দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত পরিবর্তনের সূচনা?

-ইসরাত, নিজস্ব প্রতিবেদক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ