বিশ্ব পরিচিতি
সিন্ধু সভ্যতা থেকে পরমাণু পাকিস্তান: প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ভূরাজনীতি, ধর্ম ও টিকে থাকার পূর্ণাঙ্গ আখ্যান

পাকিস্তান একটি দেশ যার ইতিহাস, ভূগোল, ধর্ম, রাজনীতি ও সংস্কৃতি একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। এই রাষ্ট্র ইসলামের আদর্শে গঠিত হলেও আজ এটি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি, নিরাপত্তা এবং অর্থনীতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা থেকে শুরু করে আধুনিক পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানের যাত্রা এক দীর্ঘ ও জটিল অধ্যায়। এর ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, ধর্মীয় ঐক্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংগ্রাম এবং কৌশলগত সক্ষমতা সব মিলিয়ে পাকিস্তান এখন এক বহুমাত্রিক বাস্তবতার প্রতীক।
ভৌগোলিক অবস্থান:
পাকিস্তান ভৌগোলিকভাবে এক অনন্য অবস্থান দখল করে আছে। এর পূর্বে ভারত, পশ্চিমে আফগানিস্তান ও ইরান, উত্তরে চীন এবং দক্ষিণে আরব সাগর—এই চারপাশের অবস্থান দেশটিকে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার সংযোগসেতুতে পরিণত করেছে। মোট আয়তন প্রায় ৮৮১,৯১৩ বর্গকিলোমিটার, যা এটিকে বিশ্বের ৩৩তম বৃহত্তম দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে।
চিত্র- মানচিত্রে পাকিস্তান
দেশটির ভূপ্রকৃতি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। উত্তরে রয়েছে হিমালয় ও কারাকোরাম পর্বতমালা, যেখানে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কে–টু (K2) অবস্থিত। দক্ষিণে রয়েছে শুষ্ক থর মরুভূমি, পশ্চিমে বেলুচিস্তানের মালভূমি, আর পূর্বে প্রবাহিত হয়েছে ঐতিহাসিক সিন্ধু নদী (Indus River), যা পাকিস্তানের কৃষি ও সভ্যতার মূল প্রাণশক্তি। এই নদী ও তার শাখানদীগুলো দেশটির অর্থনীতি, কৃষি ও জনজীবনের মেরুদণ্ড।
পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান কেবল প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, ভূরাজনীতির দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন–পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC) এই অঞ্চলকে চীনের পশ্চিমাঞ্চল ও আরব সাগরের মধ্যে বাণিজ্যপথে পরিণত করেছে, যা ভবিষ্যতে এশিয়ার বাণিজ্য ও জ্বালানিনীতিতে পাকিস্তানকে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় স্থাপন করতে পারে।
ইতিহাস
পাকিস্তানের ইতিহাসের শুরু প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা (Indus Valley Civilization) থেকে, যা প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০–১৯০০ সালের মধ্যে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো অঞ্চলে বিকশিত হয়। এটি ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন নগরসভ্যতা, যেখানে নগর পরিকল্পনা, বাণিজ্য, শিল্প ও সামাজিক সংগঠন ছিল অত্যন্ত উন্নত। পরবর্তী সময়ে এই অঞ্চল আর্য, পারস্য, গ্রিক, মৌর্য ও কুষাণ সাম্রাজ্যের অধীনে আসে।
চিত্র- প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা (Indus Valley Civilization) ধ্বংসাবশেষ
৮ম শতকে আরব সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম ইসলামের পতাকা উড়িয়ে আনেন সিন্ধু উপত্যকায়, যার মধ্য দিয়েই পাকিস্তানের বর্তমান ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ভিত্তির সূচনা হয়। এরপর ঘজনভি, গুরিদ, দিল্লি সালতানাত ও মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনে এই অঞ্চলে ইসলামী সংস্কৃতি, পারস্য ভাষা ও সুফিবাদ বিকশিত হয়।শ
১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হলে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানরা ক্রমে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রান্তিক হয়ে পড়ে। এর প্রতিক্রিয়ায় ১৮৭৫ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ খান আলিগড় আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানদের শিক্ষাজাগরণে নেতৃত্ব দেন। ১৯০৬ সালে গঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ মুসলমানদের রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলন ক্রমে গতি পায়, যার ফলশ্রুতিতে ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের মাধ্যমে পাকিস্তানের জন্ম হয়—একটি রাষ্ট্র যা মুসলমানদের স্বাধীনতা, সংস্কৃতি ও পরিচয় রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
স্বাধীনতার পর পাকিস্তানকে মুখোমুখি হতে হয় শরণার্থী সংকট, প্রশাসনিক কাঠামোর অভাব ও কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হয়—যা পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বিপর্যয়।
পরবর্তী সময়ে দেশটি সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রের মধ্যে দোলাচলে থেকেছে—আয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়াউল হক, পারভেজ মোশাররফের মতো সামরিক শাসক এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো, বেনজির ভুট্টো, নওয়াজ শরিফ ও ইমরান খান-এর মতো বেসামরিক নেতারা পালাক্রমে দেশ পরিচালনা করেছেন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস এখনো সেই সামরিক ও বেসামরিক ক্ষমতার ভারসাম্যের সন্ধানে রয়েছে
শাসনব্যবস্থা
পাকিস্তান একটি ফেডারেল সংসদীয় প্রজাতন্ত্র, যার সংবিধান ১৯৭৩ সালে প্রণীত হয়। রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপ্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সংসদ দুটি কক্ষ নিয়ে গঠিত—জাতীয় পরিষদ (National Assembly) ও সিনেট (Senate)।
দেশটি প্রশাসনিকভাবে চারটি প্রদেশে বিভক্ত—পাঞ্জাব, সিন্ধ, খাইবার পাখতুনখোয়া ও বেলুচিস্তান, পাশাপাশি ইসলামাবাদ ক্যাপিটাল টেরিটরি এবং গিলগিত-বালতিস্তান। ২০১০ সালের ১৮তম সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বৃদ্ধি করা হয়।
তবে শাসনব্যবস্থায় সামরিক প্রভাব, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সংঘাত এখনো পাকিস্তানের প্রশাসনিক স্থিতিশীলতার প্রধান বাধা।
সংস্কৃতি ও ধর্ম
পাকিস্তানের সংস্কৃতি মূলত ইন্দো-পারস্য, মধ্য এশীয় ও ইসলামী ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ। উর্দু জাতীয় ভাষা এবং ইংরেজি সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়, পাশাপাশি পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পশতু, বেলুচি ও সারাইকি ভাষার ব্যবহারও ব্যাপক।
সংগীতে কাওয়ালি, গজল, সুফি সংগীত ও আধুনিক ফিউশন পাকিস্তানকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করেছে। ট্রাক আর্ট, মৃৎশিল্প, পোশাক ও ক্যালিগ্রাফি দেশের লোকজ ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। খাদ্যে রয়েছে বিরিয়ানি, নিহারি, হালিম, সিক কাবাব ও নানা আঞ্চলিক পদ, যা সংস্কৃতির বৈচিত্র্যকে ফুটিয়ে তোলে।
ধর্মের দিক থেকে পাকিস্তান একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র, যেখানে প্রায় ৯৬% নাগরিক মুসলমান, অধিকাংশ সুন্নি, কিছু শিয়া সম্প্রদায় এবং সীমিত সংখ্যক হিন্দু, খ্রিষ্টান ও শিখ বাস করে। সুফিবাদ বা তাসাউফ পাকিস্তানি সমাজে সহনশীলতা ও মানবিকতার প্রতীক হিসেবে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে, যদিও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে, যা রাষ্ট্রের সামাজিক ঐক্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
রাজনীতি
পাকিস্তানের রাজনীতি মূলত তিনটি বড় দলকে ঘিরে আবর্তিতহয়—পাকিস্তানমুসলিমলীগ (নওয়াজ),পাকিস্তানপিপলসপার্টি, এবংপাকিস্তানতেহরিক-ই-ইনসাফ (ইমরানখান)।সামরিকবাহিনীরনেপথ্যভূমিকা ও বিচারবিভাগেররাজনৈতিকহস্তক্ষেপপাকিস্তানেররাজনীতিকেপ্রভাবিত করে।
যদিও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সামরিক প্রভাব, দুর্নীতি, রাজনীতিক প্রতিহিংসা ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা গণতান্ত্রিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। পাকিস্তানের রাজনীতি এখনো একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক গণতন্ত্র ও শক্তিশালী সামরিক প্রশাসনের টানাপোড়েনে জর্জরিত।
প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনীতি
পাকিস্তান প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ। বেলুচিস্তান ও সিন্ধ প্রদেশে রয়েছে বিশাল গ্যাস, তামা, সোনা, কয়লা ও ক্রোমাইট ভান্ডার। সিন্ধু নদীর অববাহিকা কৃষিতে অত্যন্ত উর্বর—গম, ধান, তুলা ও আখ দেশের প্রধান ফসল।
অর্থনীতির দিক থেকে পাকিস্তান একটি অর্ধ-শিল্পায়িত কৃষিনির্ভর দেশ, যার প্রধান খাত টেক্সটাইল, কৃষি, রেমিট্যান্স, জ্বালানি ও নির্মাণ। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক ঋণ, বাণিজ্য ঘাটতি এবং IMF-এর ওপর নির্ভরশীলতা অর্থনীতিকে অনিশ্চিত করে তুলেছে।
চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC) পাকিস্তানের অবকাঠামো ও বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত খুলেছে, যদিও এতে ঋণঝুঁকি ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগও রয়েছে। সবুজ জ্বালানি, ডিজিটাল প্রযুক্তি ও আঞ্চলিক বাণিজ্য সংযোগ ভবিষ্যতে পাকিস্তানের অর্থনীতিকে রূপান্তরিত করতে পারে।
সামরিক শক্তি ও পরমাণু সক্ষমতা
পাকিস্তানের জাতীয় নীতির মূল কেন্দ্র হলো নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনা, বিশেষত কাশ্মীর ইস্যু, দেশটির প্রতিরক্ষা মনোভাবকে গঠন করেছে। ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১ ও ১৯৯৯ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ এই প্রতিরক্ষা নীতিকে আরও দৃঢ় করেছে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে পরাজয় পাকিস্তানকে উপলব্ধি করায় যে আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষায় পারমাণবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা অপরিহার্য। ভারতের ১৯৭৪ সালের পরমাণু পরীক্ষার পর পাকিস্তান তৎক্ষণাৎ নিজস্ব পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করে, যার নেতৃত্ব দেন বিজ্ঞানী ড. আবদুল কাদির খান। দীর্ঘ প্রস্তুতির পর ১৯৯৮ সালের ২৮ মে বেলুচিস্তানের চাগাই অঞ্চলে পাকিস্তান তার প্রথম পরমাণু পরীক্ষা সম্পন্ন করে।
এই পরীক্ষার মাধ্যমে পাকিস্তান বিশ্বের সপ্তম এবং মুসলিম বিশ্বের প্রথম পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বর্তমানে পাকিস্তানের হাতে আনুমানিক ১৬০–১৭০টি পরমাণু ওয়ারহেড রয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
দেশটির সশস্ত্র বাহিনী—আর্মি, নেভি ও এয়ার ফোর্স—তিনটি শাখায় সংগঠিত। এর মধ্যে সেনাবাহিনী সবচেয়ে প্রভাবশালী। পাকিস্তানের ISI (Inter-Services Intelligence) শুধু গোয়েন্দা সংস্থা নয়, বরং আঞ্চলিক রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে।
চীনের সঙ্গে যৌথভাবে JF-17 থান্ডার যুদ্ধবিমান প্রকল্প, ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি (Shaheen, Ghauri, Abdali series) এবং আধুনিক নৌ ও ড্রোন প্রযুক্তির উন্নয়ন পাকিস্তানকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী সামরিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
তবে বিশাল প্রতিরক্ষা বাজেটের চাপ দেশের অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে। তাই পাকিস্তানের সামনে প্রধান কৌশলগত প্রশ্ন হলো—কীভাবে সামরিক শক্তি ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা যায়।
পর্যটন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য
পাকিস্তান প্রকৃতির এক জীবন্ত ক্যানভাস। উত্তরে হুনজা, গিলগিত, স্কার্দু, ফেয়ারি মেডোজ, দক্ষিণে গোয়াদার উপকূল ও সিন্ধু উপত্যকা, এবং পশ্চিমে বেলুচিস্তানের মরুভূমি—সব মিলিয়ে দেশটি প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর।
চিত্র- হুনজা ভ্যালী
চিত্র-স্কার্দু লেক
ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ পাকিস্তানে রয়েছে মহেঞ্জোদারো, টাকশশিলা, লাহোর ফোর্ট, মাকলি নেক্রোপলিস ও রোহতাস ফোর্ট—যেগুলো ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত। কার্তারপুর করিডর, কাটাস রাজ মন্দির ও তাকত-ই-বাহি পাকিস্তানের বহু ধর্মীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করে আছে।
চিত্র- লাহোর ফোর্ট
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানের পর্যটন খাত দ্রুত বিকাশ পাচ্ছে। এডভেঞ্চার ট্যুরিজম, রেলিজিয়াস ট্যুরিজম ও কালচারাল ট্যুরিজম দেশটির অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম পাকিস্তানকে এখন “Asia’s Next Great Travel Destination” হিসেবে চিহ্নিত করছে।
আন্তর্জাতিক সদস্যপদ ও পররাষ্ট্রনীত
পাকিস্তান জাতিসংঘ (UN), ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (OIC), সার্ক (SAARC), সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (SCO), IMF ও বিশ্বব্যাংকের সক্রিয় সদস্য।পররাষ্ট্রনীতিতে পাকিস্তান চারটি স্তম্ভ অনুসরণ করে—নিরাপত্তা, আঞ্চলিক ভারসাম্য, মুসলিম ঐক্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা।
- ভারত: কাশ্মীর ইস্যু দুই দেশের সম্পর্কে স্থায়ী উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
- চীন: পাকিস্তানের “অল-ওয়েদার পার্টনার”, যার সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর।
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে সহযোগী হলেও পারস্পরিক আস্থাহীনতা অব্যাহত।
- তুরস্ক, সৌদি আরব, উপসাগরীয় রাষ্ট্রসমূহ: পাকিস্তানের ঐতিহ্যগত কূটনৈতিক মিত্র।
বর্তমানে পাকিস্তান ভারত-চীন প্রতিযোগিতা, আফগানিস্তানের অনিশ্চয়তা, এবং মধ্যপ্রাচ্যের পুনর্গঠন রাজনীতি—এই তিন বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার নীতি গ্রহণ করছে।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
পাকিস্তানের সামনে একাধিক জটিল চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান—রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, ঋণনির্ভর অর্থনীতি, জলবায়ু সংকট ও সন্ত্রাসবাদ। ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যা দেখিয়ে দিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে দেশের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করতে পারে।
তবুও পাকিস্তানের সম্ভাবনা সীমাহীন। যুব জনসংখ্যা, ভৌগোলিক কৌশলগত অবস্থান, অর্থনৈতিক করিডোর, পর্যটন ও কৃষিতে আধুনিকায়ন, এবং সবুজ জ্বালানি উন্নয়ন—এই উপাদানগুলো দেশটিকে একবিংশ শতাব্দীতে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে পারে।
যদি পাকিস্তান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে, অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখে, এবং ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে—তবে এটি দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার কৌশলগত ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হয়ে উঠতে সক্ষম হবে।
পাকিস্তান এমন এক দেশ যেখানে ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি ও ভূগোল একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটি প্রাচীন সভ্যতার উত্তরাধিকার বহন করছে এবং একই সঙ্গে আধুনিক বিশ্বে একটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে নিজের অবস্থান সুসংহত করেছে। সামরিক শক্তি পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, তবে প্রকৃত টেকসই উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক শাসন অপরিহার্য। যদি পাকিস্তান রাজনৈতিক পরিপক্বতা অর্জন করে, অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন করে এবং পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে, তবে এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে আবির্ভূত হতে পারবে।

ফ্রান্স: সভ্যতা, প্রজাতন্ত্র ও মানবমুক্তির দীপ্ত ইতিহাস
ইউরোপের হৃদয়ে অবস্থিত ফ্রান্স কেবল একটি রাষ্ট্র নয়, এটি একটি দর্শন, একটি ধারণা, একটি সাংস্কৃতিক প্রতীক। এটি এমন এক জাতি যার ইতিহাসে জ্বলজ্বল করছে মানবমুক্তি, গণতন্ত্র, দর্শন ও শিল্পের দীপ্তি। প্রাচীন গল জাতির রোমানীকরণ থেকে শুরু করে ফরাসি বিপ্লব, নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য, দুই বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল ইতিহাস এবং ইউরোপীয় ঐক্যের নির্মাণ—ফ্রান্সের প্রতিটি অধ্যায় মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় এক অবিচ্ছেদ্য মাইলফলক। এই দেশটি যেন এক জীবন্ত জাদুঘর, যেখানে প্রতিটি শহর, প্রতিটি রাস্তাঘাট, প্রতিটি স্থাপত্য মানুষের চিন্তা ও আত্মমর্যাদার ইতিহাস বহন করে।
ভৌগোলিক পরচয় ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য
ফ্রান্স পশ্চিম ইউরোপের বৃহত্তম রাষ্ট্র, যার আয়তন প্রায় ৫৫১,৬৯৫ বর্গকিলোমিটার। উত্তরে ইংলিশ চ্যানেল ও বেলজিয়াম, পূর্বে জার্মানি, লুক্সেমবার্গ ও সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণে ইতালি, স্পেন ও ভূমধ্যসাগর, আর পশ্চিমে বিস্তৃত আটলান্টিক মহাসাগর—এই অবস্থান ফ্রান্সকে ইউরোপের বাণিজ্য ও সংস্কৃতির সংযোগস্থলে পরিণত করেছে।
ছবি- ইউরোপেরমানচিত্রে ফ্রান্স
দেশটির ভূপ্রকৃতি বৈচিত্র্যময় ও মনোমুগ্ধকর। দক্ষিণ-পূর্বে আলপস পর্বতমালা, যেখানে ইউরোপের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মঁ ব্লঁ (মন্ট ব্লাঙ্ক) ৪,৮০৯ মিটার উচ্চতায় রাজসিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণ-পশ্চিমে পিরেনিজ পর্বতমালা স্পেন সীমান্তকে রক্ষা করছে, আর কেন্দ্রে রয়েছে উর্বর সমভূমি ও নদী অববাহিকা যা কৃষি ও জনজীবনের প্রাণ। সেন, লোয়ার, গারোন ও রোন নদী ফ্রান্সের কৃষি, বাণিজ্য ও পরিবেশ ব্যবস্থার মেরুদণ্ড।
ছবি-ইউরোপের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মঁ ব্লঁ (মন্ট ব্লাঙ্ক)
ফ্রান্স শুধু ইউরোপীয় মূলভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ নয়; এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বিভিন্ন “ওভারসিজ টেরিটরি”—যেমন মার্টিনিক, গুয়াডেলুপ, রিইউনিয়ন, নিউ ক্যালেডোনিয়া ও ফরাসি পলিনেশিয়া—যা দেশটিকে একটি বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক উপস্থিতি প্রদান করেছে।
রাষ্ট্রীয় প্রতীক ও মৌলিক তথ্য
ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় পতাকা তিন রঙের—নীল, সাদা ও লাল। এই ত্রিবর্ণ পতাকা স্বাধীনতা, সমতা ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শের প্রতীক, যা ১৭৮৯ সালের বিপ্লবের পর রাষ্ট্রীয় চিহ্নে পরিণত হয়।
ছবি-ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় পতাকা
রাষ্ট্রীয় প্রতীক ‘La Marianne’, স্বাধীনতা ও প্রজাতন্ত্রের নারীমূর্ত রূপ, যা ফরাসি জাতিসত্তার প্রতীক হিসেবে সর্বত্র ব্যবহৃত হয়।
ছবি-রাষ্ট্রীয় প্রতীক ‘La Marianne’
রাজধানী প্যারিস, যা শুধু প্রশাসনিক কেন্দ্র নয়, বরং শিল্প, সাহিত্য ও প্রেমের বিশ্বনগরী।ফ্রান্সের সরকারি ভাষা ফরাসি (Français), এবং রাষ্ট্রীয় মুদ্রা ইউরো (€)।দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ৬৮ মিলিয়ন (২০২৫), এবং মানব উন্নয়ন সূচকে (HDI ২০২৩) স্কোর ০.৯০৩, যা একে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশের কাতারে স্থান দিয়েছে।বর্তমান রাষ্ট্র কাঠামো একটি আধা-রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রজাতন্ত্র, যেখানে রাষ্ট্রপতি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন এবং প্রধানমন্ত্রী সংসদীয় নেতৃত্বের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন।
ইতিহাস: রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে
ফ্রান্সের ইতিহাস ইউরোপের রাজনৈতিক বিবর্তনের সঙ্গে একীভূত। প্রাচীন গল জাতির ভূমি প্রথম খ্রিস্টপূর্ব শতকে রোমানদের অধীনে আসে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর পঞ্চম শতকে ফ্রাঙ্ক জাতি এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে, যেখান থেকে “France” নামটির উৎপত্তি।
মধ্যযুগে চার্লেম্যাগনের ক্যারোলিঞ্জীয় সাম্রাজ্য ইউরোপের ঐক্যের ধারণা তৈরি করে। পরবর্তী সময়ে ক্যাপেট ও বোরবোঁ রাজবংশ ফ্রান্সকে রাজতান্ত্রিক শক্তিতে পরিণত করে। কিন্তু ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব সবকিছু পাল্টে দেয়। রাজা ষোড়শ লুই ও রাণী মেরি আঁতোয়ানেতের পতনের মাধ্যমে রাজতন্ত্র ধ্বংস হয় এবং মানবমুক্তি, সমতা ও গণতন্ত্রের নতুন অধ্যায় শুরু হয়।
ন্যাপোলিয়ন বোনাপার্ট বিপ্লবের আদর্শকে সামরিক শক্তিতে রূপ দেন। তার নেতৃত্বে ফ্রান্স ইউরোপের বৃহৎ অংশে আধিপত্য বিস্তার করে, তবে ওয়াটারলু যুদ্ধের পর তার পতন ঘটে। তবুও নেপোলিয়নের সংবিধান, প্রশাসনিক সংস্কার ও Napoleonic Code আজও আধুনিক আইনের ভিত্তি হিসেবে টিকে আছে।
১৯শ শতক জুড়ে ফ্রান্স বারবার রাজতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের মধ্যে দোলাচলে থেকেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মানি ফ্রান্স দখল করে নেয়, কিন্তু চার্লস দ্য গল-এর নেতৃত্বে প্রতিরোধ আন্দোলন দেশটিকে পুনরুদ্ধার করে। ১৯৫৮ সালে দ্য গল আধুনিক পঞ্চম প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজও বিদ্যমান এবং রাষ্ট্রপতির হাতে শক্তিশালী নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করে।
রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা
বর্তমান ফরাসি শাসনব্যবস্থা একটি আধা-রাষ্ট্রপতি শাসিত গণতন্ত্র, যেখানে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী প্রধান। রাষ্ট্রপতি সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন পাঁচ বছরের মেয়াদে। সংসদ দুটি কক্ষ নিয়ে গঠিত—ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি (Assemblée Nationale) এবং সেনেট (Sénat)।
ফ্রান্স প্রশাসনিকভাবে ১৮টি অঞ্চল ও ১০১টি বিভাগে বিভক্ত। বিচারব্যবস্থা স্বাধীন, এবং সাংবিধানিক পরিষদ সংবিধানের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের দায়িত্বে নিয়োজিত।
রাজনৈতিকভাবে দেশটি দীর্ঘদিন ধরে মধ্য-বাম ও মধ্য-ডানপন্থী চিন্তাধারার দ্বন্দ্বে আবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ-এর “La RépubliqueEn Marche” দল একটি প্রগতিশীল ও উদারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে, যা তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে পুনর্নির্মাণ করছে।
অর্থনীতি ও সম্পদ
ফ্রান্স বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম অর্থনৈতিক ভিত্তি। এর অর্থনীতি বৈচিত্র্যময়—শিল্প, কৃষি, প্রযুক্তি, জ্বালানি ও পর্যটন সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।প্যারিস ইউরোপের অন্যতম আর্থিক কেন্দ্র, যেখানে শত শত বহুজাতিক কোম্পানির সদর দপ্তর অবস্থিত। এয়ারবাস, রেনল্ট, পিউজো, টোটালএনার্জিস, ডাসো, ল’ওরিয়াল, লুই ভিটোঁ, শ্যানেল, ডিওর ও মিশেলিন ফ্রান্সের শিল্পশক্তির প্রতীক।
দেশটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কৃষি উৎপাদক, বিশেষত শস্য, ফল, সবজি, আঙ্গুর এবং দুগ্ধজাত পণ্য রপ্তানিতে অগ্রগণ্য। ফ্রান্স বিশ্বের শীর্ষ ওয়াইন উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশ, এবং “বোর্দো” ও “শ্যাম্পেন” অঞ্চল বৈশ্বিক ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে।
ফ্রান্সের প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ হলো বক্সাইট, লোহা, ইউরেনিয়াম, কয়লা, লবণ, কাঠ ও মৎস্যসম্পদ। এটি পারমাণবিক শক্তিনির্ভর দেশ, যেখানে বিদ্যুতের ৭০ শতাংশেরও বেশি আসে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে।
মানব উন্নয়ন, শিক্ষা ও জীবনমান
ফ্রান্স মানব উন্নয়ন সূচকে বিশ্বের শীর্ষে। ২০২৩ সালে এর এইচডিআই ০.৯০৩, যা একে “খুব উচ্চ মানব উন্নয়ন” দেশগুলোর মধ্যে স্থান দিয়েছে। গড় আয়ু ৮৩ বছর, এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ সর্বজনীন।শিক্ষা বাধ্যতামূলক ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত, এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায় বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান করে। ফ্রান্সের শিক্ষা ব্যবস্থা “République”–এর আদর্শ অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষ, যৌক্তিক এবং নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে নিবেদিত।
বিশ্বখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে Sorbonne University, École Normale Supérieure, Sciences Po, École Polytechnique, HEC Paris, যেগুলো বিশ্বব্যাপী বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব গড়ে তুলছে।
ছবি-Sorbonne University, Paris.
সংস্কৃতি, শিল্প ও ধর্ম
ফ্রান্স এমন একটি দেশ যেখানে সংস্কৃতি রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের অংশ। এখানে সাহিত্য, দর্শন, চিত্রকলা, সংগীত, ফ্যাশন ও খাদ্য—সবকিছুই নন্দনতত্ত্ব ও চিন্তার প্রতীক।
ফরাসি সাহিত্য ও দর্শন মানব সভ্যতার বিকাশে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে। ভলতেয়ার, রুশো, দিদরো, সার্ত্র, সিমোন দ্য বোভোয়ার, ফুকো, দেরিদা—এই বুদ্ধিজীবীরা মানুষের স্বাধীনতা, নৈতিকতা ও সমাজচিন্তার ধারণাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
ফ্রান্সের শিল্পের রাজধানী প্যারিস, যেখানে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জাদুঘর লুভর। ফ্যাশনে প্যারিস ফ্যাশন উইক, খাদ্যে ফরাসি কুইজিন, সংগীতে এডিথ পিয়াফ ও ডেবুসি—সবই দেশের সাংস্কৃতিক প্রতীক।
ধর্মের ক্ষেত্রে ফ্রান্স কঠোরভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র (Laïcité)। নাগরিকদের প্রায় ৬৩ শতাংশ রোমান ক্যাথলিক, ৯ শতাংশ মুসলমান, ১ শতাংশ ইহুদি ও বৌদ্ধ, এবং বাকি জনগোষ্ঠী নির্ধর্মীয়। ধর্মীয় স্বাধীনতা ফরাসি প্রজাতন্ত্রের মৌলিক নীতির অংশ।
সামরিক শক্তি ও বৈশ্বিক ভূমিকা
ফ্রান্স ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী সামরিক রাষ্ট্র এবং বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম প্রতিরক্ষা বাজেটধারী দেশ। এটি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার (Force de Frappe) রয়েছে, যা জাতীয় নিরাপত্তার মেরুদণ্ড।
ফরাসি সেনাবাহিনী আধুনিক প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট গোয়েন্দা ব্যবস্থা, বিমানবাহী রণতরী Charles de Gaulle, এবং বিশ্বব্যাপী শান্তিরক্ষা অভিযানে সক্রিয় উপস্থিতির জন্য বিখ্যাত। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে ফ্রান্স আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পর্যটন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য
ফ্রান্স বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভ্রমণকৃত দেশ। প্রতি বছর প্রায় ৯ কোটি পর্যটক এখানে আসেন। আইফেল টাওয়ার, লুভর মিউজিয়াম, নটরডেম ক্যাথেড্রাল, আর্ক দ্য ত্রিয়ঁফ, শঁজেলিজে, মনমার্ত্র, এবং ভার্সাই প্রাসাদ—এই প্রতিটি স্থাপনা শুধু স্থাপত্য নয়, ইতিহাসের জীবন্ত দলিল।
ছবি- বিশ্ব বিখ্যাতলুভর মিউজিয়াম
ছবি-নটরডেম ক্যাথেড্রাল
দক্ষিণ ফ্রান্সের ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা, আলপসের স্কি রিসোর্ট, বোর্দো ও বুরগুন্ডির আঙ্গুরক্ষেত, নর্মান্ডির উপকূল এবং প্রোভঁস অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফ্রান্সকে পৃথিবীর অন্যতম রোমান্টিক ও বৈচিত্র্যময় পর্যটন স্বর্গে পরিণত করেছে।
ছব-ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা
পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক সদস্যপদ
ফ্রান্স আন্তর্জাতিক কূটনীতির অন্যতম স্তম্ভ। এটি জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো, জি-৭, ওআইসিডি, ডব্লিউটিও, ফ্রান্সোফনি, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সদস্য।
ফ্রান্সের পররাষ্ট্রনীতি “স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও বহুপাক্ষিক কূটনীতি”-র ভিত্তিতে পরিচালিত। এটি আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ায় শান্তিরক্ষা মিশনে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে ফ্রান্স ও জার্মানি একত্রে নীতিনির্ধারণের প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বর্তমান ফ্রান্স একাধিক জটিল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি—অভিবাসন সমস্যা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলামফোবিয়া বিতর্ক, অর্থনৈতিক বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও ইউরোপীয় রাজনীতির নতুন ভারসাম্য। সামাজিক অসন্তোষ ও “Yellow Vest Movement” অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
তবুও ফ্রান্সের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। এটি একটি উদ্ভাবনী ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ, যেখানে গবেষণা, প্রযুক্তি, সবুজ শক্তি ও সংস্কৃতি একসঙ্গে অগ্রগতি ঘটাচ্ছে। “France 2030” কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী দেশটি নবায়নযোগ্য জ্বালানি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মহাকাশ প্রযুক্তিতে বিশ্ব নেতৃত্ব অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করছে।
ফ্রান্স হলো স্বাধীনতার প্রতীক, মানবমুক্তির দিশারী এবং সভ্যতার আলোকবর্তিকা। এটি এমন এক দেশ, যেখানে রাজনীতির সঙ্গে দর্শন, বিজ্ঞানের সঙ্গে শিল্প, এবং স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্ববোধ সমানভাবে বিকশিত হয়েছে। আজও ফ্রান্স পৃথিবীকে মনে করিয়ে দেয় যে, একটি জাতির সত্যিকারের শক্তি তার অস্ত্রে নয়, বরং তার চিন্তা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধে নিহিত।
প্রাচুর্যের আড়ালে নির্মমতা: জাপানের হাশিমার বুকে চাপা পড়া কান্না ও এক রক্তাক্ত অধ্যায়
নাগাসাকি, জাপান - একসময় জাপানের শিল্প বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র এবং বিশ্বের অন্যতম জনবহুল স্থান হিসেবে পরিচিত, হাশিমা দ্বীপ, যা "গুনকানজিমা" বা "ব্যাটলশিপ আইল্যান্ড" নামেও পরিচিত, বর্তমানে এক নীরব, পরিত্যক্ত ভুতুড়ে দ্বীপে পরিণত হয়েছে। ৬০ বছর আগে এখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, বিশাল ভবন, স্কুল, ক্যাসিনো এবং সিনেমা হল ছিল, যা জাপানকে বিশ্বের ধনী দেশগুলির মধ্যে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু আজ, এই দ্বীপ সম্পূর্ণ জনশূন্য।
কয়লার স্বর্ণযুগ:
১৮০০-এর দশকের শেষদিকে জাপানে শিল্প বিপ্লব শুরু হলে কয়লার চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। ১৮৮৭ সালে নাগাসাকি থেকে ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে হাশিমা দ্বীপে প্রচুর কয়লার সন্ধান পাওয়া যায়। ১৮৯০ সালে শিল্পগোষ্ঠী মিৎসুবিশি এই দ্বীপের মালিকানা কিনে নেয় এবং কয়লা উৎপাদনে জোর দেয়। সমুদ্রের নিচে ২০০ মিটার গভীরে খনি স্থাপন করে তারা কয়লা উত্তোলন বৃদ্ধি করে। কয়লা খনির কাজ করতে আসা শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের আগমনে দ্বীপের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ১৯১৬ সালের মধ্যে জনসংখ্যা ৩,০০০-এ পৌঁছায় এবং ১৯৫৯ সালে তা ৫,২৫৯-এ দাঁড়ায়, যা হাসিমা-কে বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ স্থান করে তোলে। দ্বীপের ছোট আয়তনের কারণে, মিৎসুবিশি কয়লা উত্তোলনের বর্জ্য ব্যবহার করে কৃত্রিম ভূমি তৈরি করে এবং উঁচু কংক্রিটের দেয়াল দিয়ে দ্বীপটিকে সুরক্ষিত করে। টাইফুন থেকে রক্ষা পেতে কাঠের বাড়ির পরিবর্তে একের পর এক অ্যাপার্টমেন্ট, হাসপাতাল, স্কুল, দোকান এবং সিনেমা হল নির্মাণ করা হয়, যা দূর থেকে দ্বীপটিকে একটি যুদ্ধজাহাজের মতো দেখাত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং কালো অধ্যায়:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কয়লার চাহিদা আরও বেড়ে যায় এবং ১৯৪১ সালে হাসিমায় রেকর্ড পরিমাণ ৪ লক্ষ ১০ হাজার টন কয়লা উত্তোলন হয়। এই সময় মিৎসুবিশি জাপানি সামরিক বাহিনীর জন্য যুদ্ধজাহাজ এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম তৈরি করত। তবে এই সমৃদ্ধির আড়ালে ছিল এক নির্মম ইতিহাস। জাপান কোরিয়া এবং চীনের যুবক ও পুরুষদের জোরপূর্বক ধরে এনে এই খনিগুলিতে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করত। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে প্রায় ৮০০ থেকে ১,০০০ কোরিয়ান এবং চাইনিজ শ্রমিক এখানে কাজ করেছিল। তাদের জীবন ছিল নরকের চেয়েও খারাপ; ১৪-১৫ ঘন্টা কাজ করতে হতো প্রায় ৩৮-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়, ন্যূনতম মজুরি এবং অপর্যাপ্ত খাবারের বিনিময়ে। যারা কাজ করতে পারত না, তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হতো। কাজের সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবে অনেকে ধসে চাপা পড়ে মারা যেত, এবং অনেকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সমুদ্রে ঝাঁপ দিত। ১৯২৫ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে প্রায় ১২৩ জন কোরিয়ান এবং ১৫ জন চাইনিজ শ্রমিক এখানে মারা গিয়েছিল।
পরিত্যাগ এবং বর্তমান অবস্থা:
১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে জ্বালানি হিসেবে পেট্রোলিয়ামের আগমন এবং ৭০-এর দশকে কয়লার মজুত কমে যাওয়ায় হাসিমার ভাগ্য পরিবর্তিত হয়। ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে মিৎসুবিশি সমস্ত খনি বন্ধ ঘোষণা করে এবং বাসিন্দাদের তিন মাসের মধ্যে দ্বীপ ছেড়ে যেতে বলা হয়। ১৯৭৪ সালের ২০ এপ্রিল হাসিমা থেকে শেষবার শ্রমিকদের বহনকারী নৌকা ছেড়ে যায়, এবং এরপর থেকে দ্বীপটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
দীর্ঘদিন জনশূন্য থাকার পর, ২০০৯ সালে হাসিমা দ্বীপকে পর্যটকদের জন্য পুনরায় খুলে দেওয়া হয়। জাপান এটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করার চেষ্টা করলে দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীনের আপত্তির মুখে পড়ে, যারা জোরপূর্বক শ্রমের ইতিহাস তুলে ধরে। ২০১৫ সালে একটি চুক্তির মাধ্যমে জাপান এই ইতিহাস প্রকাশ করতে সম্মত হলেও, পরবর্তীতে একটি বিতর্কিত বিবৃতিতে এই অভিযোগ অস্বীকার করে।
আজও হাসিমা জনবসতিহীন। এর কারণ হিসেবে পুরনো ভবনগুলিতে ব্যবহৃত অ্যাসবেস্টসের বিষাক্ত ধুলো, মিঠা জলের উৎসের অভাব এবং বছরে কয়েক মাস ঝড় ও বৃষ্টির কবলে পড়ার মতো বিষয়গুলি উল্লেখ করা হয়। একসময়ের জনাকীর্ণ এই দ্বীপ এখন কেবল ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে মিশে আছে সমৃদ্ধি, সংগ্রাম এবং এক নির্মম অতীত।
/আশিক
পৃথিবীর মানচিত্রেও যার অস্তিত্ব নেই! তিব্বতের সেই লুকানো জগতের অবিশ্বাস্য রূপ
আজ থেকে প্রায় ৫০ মিলিয়ন বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে এশিয়ার সংঘর্ষের ফলে জন্ম নিয়েছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চভূমি তিব্বত, যাকে বলা হয় 'পৃথিবীর ছাদ'। আকাশছোঁয়া এই ভূমিতে শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়, কিন্তু এখানেই গড়ে উঠেছে এক অনন্য জগত—যেখানে রয়েছে দুর্গম উপত্যকা, পবিত্র পর্বতশৃঙ্গ, লুকানো হ্রদ আর আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এসব বাইরের দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়েই গড়ে উঠেছে।
তিব্বতের দুর্গম সৌন্দর্য:
দুর্গম উপত্যকা ও প্রাচীন বাণিজ্যপথ: পূর্ব তিব্বতের চামু অঞ্চলে মেকং, সালুইন এবং ইয়ংসি—এশিয়ার এই তিনটি বড় নদী পাহাড়ের ভেতর দিয়ে শান্তধারায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে। একসময় এই দুর্গম উপত্যকার মধ্য দিয়ে টি হর্স রোড (Tea Horse Road) নামের প্রাচীন এক বাণিজ্যপথ চলত, যা ইউনান প্রদেশের পাহাড়ি চা বোঝাই ইয়াকের কাফেলাকে লাসা পর্যন্ত নিয়ে যেত। আজ সেই পথ ধরেই তৈরি হয়েছে জাতীয় মহাসড়ক ৩১৮, যা সাংহাই থেকে নেপাল সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ৫০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এই অংশকে অনেকে 'স্বর্গের রাস্তা' বলেও অভিহিত করেন।
ভয়ঙ্কর পাহাড়ি রাস্তা ও পবিত্র মনি পাথর: ডজন ডজন উঁচু গিরিপথ পেরিয়ে বরফমোড়া পর্বতের পাশ ঘেঁষে এই সর্পিল সড়ক যেন আকাশের দিকে উঠে গেছে। প্রতিটা বাঁকে রঙিন প্রার্থনা পতাকার বিছানা বাতাসে উড়ে উড়ে পথচারীদের আশীর্বাদ জানায়। জাং পর্বতের গায়ে ৭২টি তীক্ষ্ণ বাঁক পেঁচিয়ে এক কিলোমিটার নিচে নেমে গেছে দুর্গম একটি পথ, যা অনেক জায়গায় রেলিংবিহীন এবং কুয়াশার চাদরে ঢাকা। সামান্য ভুল চোখ মানেই গভীর খাদে পতন। একসময় এই আঁকাবাঁকা পথেই চা বোঝাই কাফেলা যাতায়াত করত, আর আজ এটা দুঃসাহসী চালকদের সাহসের চরম পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পথের ধারে পাথরের উপরে খোদাই করা অসংখ্য বৌদ্ধ মন্ত্রপাঠের মনি পাথর নীরবে যাত্রীদের মঙ্গল কামনা করে যাচ্ছে।
লাল পাহাড় ও দুর্গম মঠ: প্রধান সড়ক ছেড়ে এক নিঝুম পথে এগোতেই চারপাশের গ্রাম শেষ হয়ে হারিয়ে যায়। এমন সময় দিগন্তে দেখা দেয় টকটকে লাল রঙের এক পাহাড় শ্রেণী। লোহার খনিজের রাঙা হওয়া এই পাহাড়গুলো স্থানীয়দের কাছে পবিত্র বলে শত শত বছর ধরে পরিচিত। তাদের বিশ্বাস, এই লাল পাহাড়েই দেব-দেবীদের আত্মার বাস। এই পাহাড়ের বুকেই প্রায় ৫০০০ মিটার উচ্চতায় একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ যেন পাথরের গায়ে ঝুলে আছে, যা পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম ও উচ্চতম মঠগুলোর মধ্যে একটি। শীতকালে তুষারপাত হলে এই মঠের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
তিব্বতের সুইজারল্যান্ড: নিংচি: তিব্বত তার সমস্ত চমক এখানেই শেষ করে দেয়নি। সামনে আছে এক সবুজ উপত্যকা—নিংচি, যা যেন রুক্ষ তিব্বতের বুকে এক টুকরো স্বর্গ এবং তিব্বতের সুইজারল্যান্ড। তুলনামূলক কম উচ্চতার কারণে এখানকার জলবায়ু মৃদু। এখানে ঘন সবুজ বন আর পাহাড়ের কোলজুড়ে রঙিন ফুলের সমারোহ দেখা যায়। এই অঞ্চল দিয়ে বয়ে গেছে ইয়ারলুং সাংপো নদী, যা পাহাড়ের ফাঁকে তৈরি করেছে বিশ্বের গভীরতম গিরিখাতগুলোর একটি।
পৃথিবীর ছাদেরও ছাদ: আলী অঞ্চল: নিংচির এই বনাঞ্চল পেরিয়ে পশ্চিমে প্রকৃতি আবার কঠিন ও বিবর্ণ রূপ ধারণ করেছে। এখানে দেখা মেলে এক বিরাট উচ্চ মালভূমির আলী অঞ্চল, যাকে বলা হয় 'পৃথিবীর ছাদেরও ছাদ'। ৪০০০ থেকে ৪৫০০ মিটার উচ্চতায় বিস্তৃত এই ভূখণ্ডে জনবসতি নেই বললেই চলে। এখানে দিগন্তজোড়া শূন্যতা আর হিমশীতল হাওয়ার শব্দ ছাড়া কিছু নেই। এই নিঃসঙ্গ প্রান্তরে হঠাৎ চোখে পড়ে এক অদ্ভুত প্রাকৃতিক দৃশ্য—মাটির তৈরি এক বন, যা দূর থেকে যেন কোনো প্রাচীন নগরীর ভগ্নপ্রাসাদ মনে হয়।
গুগ সাম্রাজ্যের নিদর্শন: এই মাটির বন এবং পাথরের গুহাগুলোতেই লুকিয়ে আছে এককালের গৌরবময় গুগ সাম্রাজ্যের নিদর্শন। লাল পাহাড়ের গায়ে গুহা মন্দিরগুলোর দেয়ালে এখনো ঝাপসা রঙে আঁকা আছে শত সহস্র বছরের পুরনো বৌদ্ধ চিত্রকর্ম। আজ এই পরিত্যক্ত গুহা নগরীর নিস্তব্ধ ধ্বংসাবশেষ বাতাসে নিঃশব্দে গল্প বলে যায়, মনে করিয়ে দেয় যে, শক্তিশালী সাম্রাজ্যও একদিন ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
পবিত্র কৈলাশ পর্বত ও মানস সরোবর: গুগের ধ্বংসাবশেষ পেছনে ফেলে আরও উঁচু প্রান্তরের দিকে যাত্রা করলে দেখা মেলে অসামান্য আকৃতির এক পর্বত, যা পবিত্র কৈলাশ পর্বত। ৬৬৩৮ মিটার উঁচু কৈলাশ পর্বত হিমালয়ের সর্বোচ্চ না হলেও হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন এবং বন—এই চার ধর্মের মানুষ একে পৃথিবীর আধ্যাত্মিক কেন্দ্র মনে করেন। এই শুভ্র শৃঙ্গ এখনো কারো পদস্পর্শে অপবিত্র হয়নি। কৈলাশের পাশেই রয়েছে মানস সরোবর, স্বচ্ছ নীল জলের এক হ্রদ, যা হিন্দু এবং বৌদ্ধ উভয় ধর্মের অনুসারীদের কাছেই পরম পবিত্র।
তিব্বতের রাজধানী: লাসা: শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া যায় তিব্বতের রাজধানী লাসা শহরে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৬৫০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত লাসা নামের অর্থই 'দেবতার বাসস্থান'। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এই শহরটা তিব্বতের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র। লাসার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত জোখাং মন্দির তিব্বতের সবচেয়ে পবিত্র বৌদ্ধধাম। লাসার পাহাড়চূড়ায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তিব্বতের প্রতীক পোতালা প্রাসাদ, যা একসময় দালাই লামার বাসভবন এবং তিব্বতের শাসন কেন্দ্র ছিল।
তিব্বতের এই বিচিত্র রূপের যাত্রা আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে, সময় বদলালেও বিশ্বাস আর ঐতিহ্য মুছে যায় না।
সমুদ্রের মাঝে সভ্যতা: ইতিহাস, ঐতিহ্য, জলবায়ু ও কূটনীতির মিলনে মালদ্বীপের টিকে থাকার গল্প
ভারত মহাসাগরের নীলাভ ঢেউয়ের বুকে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রবালদ্বীপের এই দেশ—মালদ্বীপ—বিশ্বের কাছে একদিকে স্বপ্নের পর্যটন গন্তব্য, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে টিকে থাকার এক গভীর বাস্তব সংগ্রামের প্রতীক। বাহ্যিক সৌন্দর্যের আড়ালে এটি এক জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার দেশ—যেখানে ধর্মীয় প্রভাব, গণতান্ত্রিক রূপান্তর, অর্থনৈতিক নির্ভরতা ও ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা একসঙ্গে কাজ করছে। এই প্রবন্ধে মালদ্বীপের ভূগোল, ইতিহাস, শাসনব্যবস্থা, সংস্কৃতি, ধর্ম, রাজনীতি, প্রাকৃতিক সম্পদ, অর্থনীতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জসমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে।
ভৌগলিক অবস্থান:
মালদ্বীপ একটি দ্বীপমালা রাষ্ট্র, যা শ্রীলঙ্কা ও ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারত মহাসাগরে অবস্থিত। এটি প্রায় ১,১৯২টি প্রবালদ্বীপ নিয়ে গঠিত, যা ২৬টি প্রাকৃতিক এটলে (atoll) ছড়িয়ে আছে। উত্তর থেকে দক্ষিণে দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০০ কিলোমিটার হলেও মোট স্থলভাগ মাত্র ২৯৮ বর্গকিলোমিটার। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে নিচুভূমি দেশ, যার গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১.৫ মিটার। রাজধানী মালে (Malé) বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর।
মানচিত্র-মালদ্বীপ
মালদ্বীপের আবহাওয়া উষ্ণ ও আর্দ্র, মূলত দুই মৌসুমে বিভক্ত—দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বৃষ্টি (মে থেকে অক্টোবর) এবং উত্তর-পূর্ব শুকনো মৌসুম (নভেম্বর থেকে এপ্রিল)। দেশটির ভূগোল যতটা মনোমুগ্ধকর, ততটাই ভঙ্গুর—সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, প্রবাল বিবর্ণতা (coral bleaching) এবং উপকূল ক্ষয় মালদ্বীপের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলছে।
ইতিহাস
মালদ্বীপের ইতিহাস প্রাচীন বাণিজ্যপথের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালের দিকেই ভারতীয় উপমহাদেশ ও শ্রীলঙ্কা থেকে আগত দ্রাবিড় ও আর্য বংশোদ্ভূত জেলেরা প্রথম এখানে বসতি স্থাপন করে। পরবর্তী এক হাজার বছর ধরে বৌদ্ধ ধর্ম এই দ্বীপগুলিতে প্রধান ধর্ম হিসেবে বিকশিত হয়।
১১৫৩ খ্রিস্টাব্দে শেষ বৌদ্ধ রাজা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে মালদ্বীপ একটি ইসলামী সালতানাতে রূপ নেয়। ঐতিহ্য অনুযায়ী, আরব বণিক আবু আল-বারকাত আল-বারবারি রাজাকে ইসলাম গ্রহণে প্রভাবিত করেন। এই ধর্মান্তরই মালদ্বীপের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি স্থাপন করে।
১৬শ শতকে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে। ১৫৫৮ সালে পর্তুগিজরা মালদ্বীপ দখল করে নেয়, কিন্তু স্থানীয় নায়ক মুহাম্মদ ঠাকুরুফানু-এর নেতৃত্বে ১৫৭৩ সালে বিদ্রোহের মাধ্যমে তাদের উৎখাত করা হয়। পরবর্তীতে ডাচ ও ব্রিটিশরা বিভিন্ন সময় প্রভাব বিস্তার করে। ১৮৮৭ সালে মালদ্বীপ ব্রিটিশ প্রটেক্টরেট হয়, যদিও অভ্যন্তরীণ শাসন সালতানাতের অধীনেই ছিল।
১৯৬৫ সালে মালদ্বীপ ব্রিটিশ শাসন থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে, এবং ১৯৬৮ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। স্বাধীনতার পর ইব্রাহিম নাসির ও পরবর্তীতে মাওমুন আবদুল গাইয়ুম (১৯৭৮–২০০৮) দেশ পরিচালনা করেন। গাইয়ুমের তিন দশকের শাসন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দিলেও স্বৈরাচারী চরিত্রে সমালোচিত ছিল।
২০০৮ সালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মালদ্বীপ নতুন যুগে প্রবেশ করে। মোহাম্মদ নাশিদ প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিবেশ–কূটনীতি ও জলবায়ু ইস্যুতে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন। তবে ২০১২ সালে এক বিতর্কিত অভ্যুত্থানে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এরপর থেকে দেশটি বারবার গণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী ধাঁচের সরকারের পালাবদল দেখেছে। সর্বশেষ ২০২৩ সালে ক্ষমতায় আসেন মোহাম্মদ মুয়িজ্জু, যিনি চীনমুখী পররাষ্ট্রনীতির কারণে নতুন ভূরাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন।
শাসনব্যবস্থা
মালদ্বীপ একটি একক রাষ্ট্রব্যবস্থার (unitary) প্রেসিডেন্সিয়াল প্রজাতন্ত্র, যেখানে রাষ্ট্রপতি একই সঙ্গে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান। ২০০৮ সালের সংবিধান গণতান্ত্রিক নির্বাচন, মানবাধিকার এবং বহু দলীয় রাজনীতির নিশ্চয়তা দেয়। আইনসভা একক কক্ষবিশিষ্ট—পিপলস মাজলিস (People’s Majlis)—যেখানে সদস্যরা সরাসরি নির্বাচিত হন।
দেশটি প্রশাসনিকভাবে ২০টি এটল ও একটি শহরে (মালে) বিভক্ত। তবুও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ উচ্চমাত্রায় রয়ে গেছে। জনসংখ্যা মাত্র ৫ লক্ষ ২০ হাজার, ফলে রাজনীতিতে পরিবার, আত্মীয়তা ও ব্যক্তিগত প্রভাব অত্যন্ত প্রবল। বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা সীমিত এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এখনো বড় সমস্যা।
সংস্কৃতি
মালদ্বীপের সংস্কৃতি হলো দক্ষিণ এশিয়া, আরব, আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় প্রভাবের সংমিশ্রণ। দিভেহি (Dhivehi) ভাষা দেশটির সরকারি ভাষা, যা একটি অনন্য লিপি থানা (Thaana)-তে লেখা হয়।সংগীতে আফ্রিকান প্রভাবপ্রবণ বোদু বেরু (BoduBeru) ঢাক মালদ্বীপের ঐতিহ্যের অংশ। লোককাহিনি, সমুদ্রকেন্দ্রিক কিংবদন্তি ও মৌখিক কবিতা মালদ্বীপীয় জীবনধারায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।খাবারে মাছ (বিশেষ করে টুনা), নারিকেল ও চাল প্রধান উপাদান। পারিবারিক বন্ধন, আতিথেয়তা ও ইসলামী শালীনতা সামাজিক জীবনের মূল ভিত্তি।
ধর্ম
মালদ্বীপ একটি ইসলামী রাষ্ট্র, যেখানে ইসলামই রাষ্ট্রধর্ম এবং নাগরিকত্ব লাভের জন্য মুসলিম হওয়া বাধ্যতামূলক। ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনত সীমিত; অমুসলিম ধর্মচর্চা প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ। ইসলামের শাফিঈ মাজহাবভিত্তিক সুন্নি ধারা এখানে প্রভাবশালী। ঐতিহাসিকভাবে ইসলাম ছিল সহনশীল ও সংস্কৃতিবান্ধব, তবে সাম্প্রতিক দশকে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থায়নে সেলাফি ও উগ্র ইসলামী প্রবণতা বেড়েছে। ধর্ম সামাজিক ঐক্যের উৎস হলেও, এর মধ্যকার কঠোরতা ও উগ্রতা দেশের নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজনীতি
২০০৮ সালের পর থেকে মালদ্বীপে গণতন্ত্রের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি হয়ে উঠেছে অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও দলীয়ভাবে বিভক্ত। প্রধান দুটি রাজনৈতিক শক্তি হলো—
মালদ্বিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি (MDP): উদারনৈতিক, প্রগতিশীল ও পরিবেশমুখী দল, যার নেতৃত্বে ছিলেন মোহাম্মদ নাশিদ।
প্রগ্রেসিভ পার্টি অব মালদ্বীপ (PPM): রক্ষণশীল ও ইসলামপন্থী দল, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট গাইয়ুম ও আবদুলা ইয়ামিনের নেতৃত্বাধীন।
ক্ষমতা পরিবর্তন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগীয় পক্ষপাত ও বিদেশি প্রভাব দেশটির গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দিয়েছে। তবুও মালদ্বীপ দক্ষিণ এশিয়ার একটি সক্রিয় বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা ধরে রেখেছে।
প্রাকৃতিক সম্পদ
মালদ্বীপের প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত হলেও সমুদ্রই এর প্রকৃত সম্পদভান্ডার।মৎস্যশিল্প, বিশেষত টুনা মাছ, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আয় উৎস। প্রবালপ্রাচীর ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য পর্যটন ও পরিবেশের মূল ভিত্তি। ভূমি ও মিষ্টি পানির অভাব দেশটিকে আমদানি ও পানিশোধন প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে। অতিরিক্ত বালু উত্তোলন ও প্রবাল আহরণ উপকূলীয় ভারসাম্যকে নষ্ট করছে, যা ভবিষ্যতে বড় পরিবেশগত সংকট তৈরি করতে পারে।
অর্থনীতি
মালদ্বীপের অর্থনীতি মূলত পর্যটননির্ভর, যা জাতীয় আয়ের প্রায় ৩০% এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ৬০%-এর বেশি যোগান দেয়। প্রতি বছর প্রায় ১৫ লক্ষেরও বেশি পর্যটক এই দ্বীপপুঞ্জে আসে। বিলাসবহুল রিসোর্ট, সামুদ্রিক ক্রীড়া ও পরিবেশবান্ধব পর্যটন মালদ্বীপের অর্থনীতির প্রাণ। মৎস্য, নির্মাণ ও সেবা খাতও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। দেশের মাথাপিছু আয় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম উচ্চ, তবে আয়ের বৈষম্য ও অঞ্চলভিত্তিক বৈপরীত্য স্পষ্ট।অর্থনীতির মূল চ্যালেঞ্জ হলো—পর্যটনের অতিনির্ভরতা, বৈদেশিক ঋণ, এবং জলবায়ু অভিযোজন ব্যয়। বিশেষ করে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর আওতায় নেওয়া অবকাঠামো প্রকল্পগুলির কারণে মালদ্বীপের ঋণের পরিমাণ দ্রুত বেড়েছে। সরকার এখন সবুজ জ্বালানি, টেকসই পর্যটন ও ডিজিটাল রূপান্তরকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করার জন্য।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য
মালদ্বীপ প্রকৃতির এক জীবন্ত শিল্পকর্ম। নীল লেগুন, সাদা বালির সৈকত, প্রবাল প্রাচীর ও সমুদ্রের স্বচ্ছতা দেশটিকে “পৃথিবীর স্বর্গ” হিসেবে পরিচিত করেছে। হানিফারু বে, আদ্দু এটল ও বা-অ্যাটল বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য।
ছবি:হানিফারু বে
ছবি:বা-অ্যাটল বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকেও মালদ্বীপ অনন্য। হুকুরু মিসকিয় মসজিদ, প্রাচীন বৌদ্ধ নিদর্শন, এবং ঐতিহ্যবাহী ধোনি নৌকা নির্মাণশৈলী মালদ্বীপীয় সভ্যতার বহুবর্ষীয় উত্তরাধিকার বহন করে।
আন্তর্জাতিক সদস্যপদ ও পররাষ্ট্রনীতি
মালদ্বীপ জাতিসংঘ (UN), কমনওয়েলথ, অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন (OIC), সার্ক (SAARC), বিশ্বব্যাংক ও IMF-এর সদস্য।পররাষ্ট্রনীতিতে দেশটি ঐতিহাসিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ ও অ-জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে এসেছে। ভারত হলো মালদ্বীপের ঐতিহ্যবাহী নিরাপত্তা সহযোগী, যিনি ১৯৮৮ সালের ‘অপারেশন ক্যাকটাস’–এ অভ্যুত্থান দমন করে দেশকে রক্ষা করেছিল।চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশাল বিনিয়োগ ও অবকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে প্রভাব বাড়িয়েছে—যেমন সিনামালে ব্রিজ।পশ্চিমা দেশগুলো জলবায়ু অভিযোজন ও টেকসই উন্নয়ন খাতে প্রধান সহযোগী।
তবে ভারত–চীন প্রতিযোগিতা মালদ্বীপকে একটি ভূরাজনৈতিক মঞ্চে পরিণত করেছে। কূটনৈতিকভাবে এই ছোট দেশটিকে এখন ভারত ও চীনের মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখতে হচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
মালদ্বীপের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো জলবায়ু পরিবর্তন। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর সামান্য বৃদ্ধি পেলেও তা একশ বছরের মধ্যে দেশটির বেশিরভাগ দ্বীপ ডুবিয়ে দিতে পারে। পাশাপাশি রাজনৈতিক মেরুকরণ, ঋণনির্ভরতা, এবং ধর্মীয় উগ্রবাদ সামাজিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
তবুও সম্ভাবনা অনেক। মালদ্বীপ যদি টেকসই পর্যটন, ব্লু ইকোনমি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে পারে, তবে এটি একটি সবুজ উন্নয়ন মডেল রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে জলবায়ু নেতৃত্ব বজায় রেখে এবং আঞ্চলিক কূটনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা করে দেশটি তার সার্বভৌমত্ব ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দুই-ই ধরে রাখতে পারবে।
মালদ্বীপ এক আশ্চর্য বৈপরীত্যের নাম—যেখানে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য ও অস্তিত্বের সংগ্রাম পাশাপাশি অবস্থান করছে। একদিকে এটি বিশ্বপর্যটনের নন্দনকানন, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে এক বাস্তব সংকট। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক নির্ভরতার মধ্যেও মালদ্বীপ প্রমাণ করেছে তার অভিযোজনক্ষমতা ও মানবিক দৃঢ়তা। ভবিষ্যতে টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশ সচেতনতা ও কৌশলগত পররাষ্ট্রনীতি যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তবে মালদ্বীপ শুধু টিকে থাকবে না—বরং ছোট রাষ্ট্রগুলোর জন্য এক অগ্রগামী উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।
তথ্যসূত্র:
United Nations Development Programme (UNDP). (2023). Maldives Human Development Report.
World Bank. (2024). Maldives Economic Update: Resilience in the Blue Economy.
Commonwealth Secretariat. (2022). Governance and Climate Adaptation in Small Island States.
Transparency Maldives. (2023). State of Democracy in the Maldives.
Ministry of Foreign Affairs, Maldives. (2024). Foreign Policy Framework.
Paskal, C. (2021). The Indo-Pacific and the Strategic Future of the Maldives. Chatham House Report.
Mohamed, N. (2018). Maldives: A Historical Overview. Indian Ocean Studies Journal.
ট্যাঙ্গো, পাম্পাস আর বিপ্লবের দেশ: আর্জেন্টিনার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সম্ভাবনার প্রতিচ্ছবি
আর্জেন্টিনা—দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত এক বিস্ময়কর দেশ, যার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও রাজনীতি মিলেমিশে তৈরি করেছে লাতিন বিশ্বের এক অনন্য রূপকথা। ট্যাঙ্গোর আবেগ, আন্দেসের উচ্চতা, পাম্পাস তৃণভূমির বিস্তৃতি, প্যাটাগোনিয়ার শীতল নীরবতা এবং ফুটবলের অগ্নিশিখা—সব মিলিয়ে আর্জেন্টিনা কেবল একটি দেশ নয়, বরং এক অনন্য সাংস্কৃতিক সত্তা। এই দেশ ইউরোপীয় ঐতিহ্যের সূক্ষ্ম শৃঙ্খলা আর লাতিন আমেরিকার আবেগময় আত্মাকে একত্রিত করে গড়ে তুলেছে নিজস্ব জাতীয় পরিচয়।
ভৌগলিক অবস্থান:
আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ (ব্রাজিলের পর) এবং বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশ, আয়তন প্রায় ২.৭৮ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার। উত্তরে বলিভিয়া ও প্যারাগুয়ে, পূর্বে ব্রাজিল ও উরুগুয়ে, পশ্চিমে চিলি এবং দক্ষিণে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর দ্বারা বেষ্টিত এই দেশ ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ুর দিক থেকে অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়।
পশ্চিমে উঁচু আন্দেস পর্বতশ্রেণি, কেন্দ্রে উর্বর পাম্পাস তৃণভূমি, উত্তরে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চল, এবং দক্ষিণে প্যাটাগোনিয়ার শীতল ও শুষ্ক মরুভূমি অঞ্চল—সব মিলিয়ে এটি এক ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের দেশ। আকনকাগুয়া পর্বত (৬,৯৬০ মিটার) দক্ষিণ আমেরিকার সর্বোচ্চ চূড়া। প্রধান নদীগুলোর মধ্যে প্যারানা, উরুগুয়ে, ও কলোরাডো নদী উল্লেখযোগ্য।
এই ভূগোল আর্জেন্টিনাকে একদিকে কৃষি ও খনিশিল্পে শক্তিশালী করেছে, অন্যদিকে পর্যটন ও জীববৈচিত্র্যের দিক থেকেও অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
ইতিহাস
ঔপনিবেশিক যুগ ও স্বাধীনতা আন্দোলন: বর্তমান আর্জেন্টিনা অঞ্চলে স্প্যানিশ আগমনের আগে বসবাস করত গুয়রানি, ডায়াগুয়িতা, ও মাপুচে জাতিগোষ্ঠী। ১৫৮০ সালে স্প্যানিশ অভিযাত্রী হুয়ান দে গারায় বুয়েনোস আইরেস প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮১০ সালের মে বিপ্লব (May Revolution) ছিল স্পেনীয় শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সূচনা।
জোসে দে সান মার্তিন, আর্জেন্টিনার জাতীয় বীর, ১৮১৬ সালে তুকুমান কংগ্রেস–এর মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং আন্দেস পেরিয়ে চিলি ও পেরু মুক্ত করেন। তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম আন্তর্জাতিক অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে।
রাষ্ট্রগঠন ও আধুনিকীকরণ: স্বাধীনতার পর দেশটি বারবার গৃহযুদ্ধ, সামরিক অভ্যুত্থান ও কেন্দ্র–প্রদেশ দ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়। ১৮৬২ সালে বার্তোলোমে মিত্রের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯শ শতকের শেষ দিকে ইউরোপীয় অভিবাসন, বিশেষত ইতালি ও স্পেন থেকে আগমন, দেশটির জনসংখ্যা ও অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করে। সেই সময়েই আর্জেন্টিনা “Grain and Beef Empire” হিসেবে ইউরোপের খাদ্য সরবরাহকারীতে পরিণত হয়।
২০শ শতক: পারোনিজম, সামরিক শাসন ও ফকল্যান্ড যুদ্ধ
১৯৪৬ সালে হুয়ান দোমিঙ্গো পারোন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং শ্রমিক কল্যাণ, শিল্পায়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের নীতি গ্রহণ করেন। তাঁর স্ত্রী ইভা পারোন (এভিতা) দরিদ্র জনগণের মুক্তির প্রতীক হয়ে ওঠেন। তবে ১৯৫৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে পারোন ক্ষমতাচ্যুত হন। পরবর্তী কয়েক দশক জুড়ে আর্জেন্টিনা বারবার সামরিক শাসনের মুখে পড়ে, যা culminate হয় ১৯৭৬–১৯৮৩ সালের “Dirty War”–এ—এক সময় যখন হাজারো নাগরিক গুম ও নির্যাতনের শিকার হন।
এই সময়েই ঘটে ফকল্যান্ড যুদ্ধ (Falklands War, 1982)—যা আর্জেন্টিনার জাতীয় গৌরব ও কূটনৈতিক পরাজয়ের প্রতীক হয়ে আছে। ১৯৮২ সালের ২ এপ্রিল, সামরিক শাসনের চরম দুরবস্থায় থাকা আর্জেন্টাইন সরকার জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে সরাতে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ (Islas Malvinas) দখল করে নেয়। দ্বীপটি ১৮৩৩ সাল থেকে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে ছিল, তবে আর্জেন্টিনা বরাবরই এটিকে তাদের ঐতিহাসিক ভূখণ্ড দাবি করে আসছিল।
প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার অবিলম্বে ব্রিটিশ নৌবাহিনী প্রেরণ করেন। ৭৪ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শেষে ১৪ জুন আর্জেন্টাইন সেনারা আত্মসমর্পণ করে। এই যুদ্ধে ৬৫৫ জন আর্জেন্টাইন ও ২৫৫ জন ব্রিটিশ সেনা নিহত হয়। যুদ্ধ শেষে আর্জেন্টিনার সামরিক সরকার পতিত হয়, এবং দেশটি ১৯৮৩ সালে গণতন্ত্রে ফিরে আসে। যদিও সামরিকভাবে পরাজিত হয়েছিল, “Malvinas son Argentinas” (মালভিনাস আর্জেন্টিনার)—এই স্লোগান আজও জাতীয় চেতনার অংশ হয়ে আছে।
গণতন্ত্র ও সমসাময়িক যুগ
১৯৮৩ সালে রাউল আলফনসিন–এর মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০১ সালের ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের পর আর্জেন্টিনা ঋণ পুনর্গঠন ও সামাজিক নীতির মাধ্যমে পুনরুদ্ধার শুরু করে। নেস্তর কির্শনার ও ক্রিস্টিনা ফার্নান্দেজ দে কির্শনার যুগে সমাজকল্যাণ, রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ও শ্রমিক অধিকার বৃদ্ধি পায়। আজও আর্জেন্টিনা গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সংস্কার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের সংলাপে নিজের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছে।
শাসনব্যবস্থা
আর্জেন্টিনা একটি ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, যেখানে রাষ্ট্রপতি একইসঙ্গে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান। দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ—চেম্বার অব ডেপুটিজ ও সেনেট—গণতান্ত্রিক নীতি অনুযায়ী পরিচালিত হয়। ১৯৯৪ সালের সংবিধান নাগরিক অধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করে দেশটি ২৩টি প্রদেশ এবং একটি স্বায়ত্তশাসিত শহর, বুয়েনোস আইরেস, নিয়ে গঠিত।
সংস্কৃতি
আর্জেন্টিনার সংস্কৃতি ইউরোপীয় প্রভাব ও লাতিন আমেরিকান প্রাণবন্ত ঐতিহ্যের মিশ্রণে গঠিত।
সঙ্গীত ও নৃত্য: ট্যাঙ্গো আর্জেন্টিনার জাতীয় আবেগ, ১৯শ শতকের বুয়েনোস আইরেস বন্দরের শ্রমজীবী মানুষের ভালোবাসা ও দুঃখের প্রতিচ্ছবি। আজ এটি ইউনেস্কো ঘোষিত অমূর্ত বিশ্ব ঐতিহ্য।
ছবি-ট্যাঙ্গো নৃত্য
সাহিত্য: হোর্হে লুইস বোর্হেস, হুলিও কোর্তাসার, রিকার্দো পিগলিয়া–এর মতো সাহিত্যিকরা আর্জেন্টিনাকে বিশ্বসাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে গেছেন।
খাদ্য ও জীবনধারা: আসাদো (গ্রিলড মাংস), এম্পানাদা, ও মাতে আর্জেন্টাইন সংস্কৃতির প্রতীক।
খেলাধুলা: ফুটবল কেবল খেলা নয়—এটি জাতীয় পরিচয়ের অংশ। দিয়েগো মারাদোনা ও লিওনেল মেসি এই দেশকে বিশ্বমঞ্চে গৌরব এনে দিয়েছেন।
ছবি: বিশ্বকাপ জয়ীদিয়েগো মারাদোনা (ডানে) ও লিওনেল মেসি (বামে)
ধর্ম:আর্জেন্টিনার প্রায় ৯০% মানুষ রোমান ক্যাথলিক, তবে ধর্মীয় সহনশীলতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা দেশটির রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। পোপ ফ্রান্সিস, আধুনিক যুগের প্রথম লাতিন আমেরিকান পোপ, আর্জেন্টিনার নাগরিক—যা দেশের ধর্মীয় ঐতিহ্যের আন্তর্জাতিক প্রতীক।
রাজনীতি:আর্জেন্টিনার রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে পেরোনিজম বনাম অ্যান্টি-পেরোনিজম–এর দ্বন্দ্বে বিভক্ত। পেরোনিজম সমাজতান্ত্রিক ও শ্রমিকবান্ধব নীতি অনুসরণ করে, আর বিরোধী ধারা বাজারমুখী উদারনীতির পক্ষে। বর্তমান সরকার (২০২3-) অর্থনৈতিক উদারীকরণ, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক ঋণ পুনর্গঠনের দিকে মনোনিবেশ করছে। তবে রাজনৈতিক মেরুকরণ ও দুর্নীতি এখনো গণতন্ত্রের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রাকৃতিক সম্পদ
আর্জেন্টিনা প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর।
- কৃষি: সয়াবিন, গম, ভুট্টা ও গরুর মাংস প্রধান রপ্তানি পণ্য।
- খনিজ: লিথিয়াম, ইউরেনিয়াম, তামা, সোনা ও রূপা দেশের প্রধান সম্পদ।
- জ্বালানি: ভাকা মুয়ার্তা (Vaca Muerta) অঞ্চল বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শেল তেল ও গ্যাসের উৎস।
এই সম্পদ দেশটিকে বৈশ্বিক সবুজ জ্বালানি অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত করতে পারে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য
আর্জেন্টিনা প্রকৃতির বিস্ময়ে পরিপূর্ণ:
ইগুয়াজু জলপ্রপাত: বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও মনোমুগ্ধকর জলপ্রপাত।
ছবি-ইগুয়াজু জলপ্রপাত
প্যাটাগোনিয়া: হিমবাহ, পর্বত, হ্রদ ও বন্যপ্রাণীতে সমৃদ্ধ অঞ্চল।
ছবি-প্যাটাগোনিয়া
আন্দেস পর্বতমালা: স্কি, ট্রেকিং ও অভিযানের জন্য বিখ্যাত।
বুয়েনোস আইরেস: “South America’s Paris”—স্থাপত্য, সংগীত ও জীবন্ত রাতের শহর হিসেবে পরিচিত।
ছবি- রাজধানী "বুয়েনোস আইরেস"
আন্তর্জাতিক সদস্যপদ
আর্জেন্টিনা জাতিসংঘ (UN), G20, MERCOSUR, UNASUR, CELAC, ও WTO–এর সদস্য। দেশটি দক্ষিণ আমেরিকার আঞ্চলিক একীকরণ ও জলবায়ু পরিবর্তন আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০২৪ সাল থেকে আর্জেন্টিনা BRICS সম্প্রসারণ সদস্যপদ নিয়েও আলোচনায় রয়েছে।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অর্থনৈতিক অস্থিরতা, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, ও বৈদেশিক ঋণ সংকট। রাজনৈতিক মেরুকরণ, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও দুর্নীতি উন্নয়নকে ধীর করছে। তবে সম্ভাবনা অগণিত। দেশটির বিশাল লিথিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস ভাণ্ডার, শক্তিশালী কৃষি উৎপাদন, শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব আর্জেন্টিনাকে দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে পরিণত করতে পারে। সবুজ জ্বালানি, প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি ও পর্যটন খাতের বিকাশ আর্জেন্টিনাকে আবারও স্থিতিশীল ও টেকসই উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে সক্ষম।
আর্জেন্টিনা এমন একটি দেশ, যেখানে ইউরোপীয় সুষমা ও লাতিন আবেগ একাকার হয়ে গেছে। ইতিহাসের আঘাত, অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন সত্ত্বেও আর্জেন্টিনা আজও ট্যাঙ্গোর ছন্দে, ফুটবলের উন্মাদনায় এবং সংস্কৃতির মহিমায় জীবন্ত। ফকল্যান্ডের গৌরব, আন্দেসের উচ্চতা আর পাম্পাসের প্রশান্তি মিলিয়ে এই দেশটি আজও এক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জাতি—যা প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে, পতন নয়, পুনর্জাগরণই আর্জেন্টিনার প্রকৃত ইতিহাস।
তথ্যসূত্র:
Rock, D. (2011). Argentina, 1516–1987: From Spanish Colonization to Alfonsín. University of California Press.
Lewis, P. H. (2009). The Crisis of Argentine Capitalism. University of North Carolina Press.
Romero, L. A. (2013). A History of Argentina in the Twentieth Century. Penn State University Press.
World Bank. (2024). Argentina Economic Update: Inflation, Debt and Growth Outlook.
UNESCO. (2023). World Heritage Sites in Argentina.
G20 Reports. (2024). Argentina’s Green Energy Transition.
আন্দেসের হৃদয়ে এক বিপ্লবী দেশ: বলিভিয়ার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
দক্ষিণ আমেরিকার অন্তরে অবস্থিত বলিভিয়া এক অনন্য বৈপরীত্যের দেশ—পাহাড়ে ঘেরা অথচ জীবনে উন্মুক্ত, সম্পদে ভরপুর অথচ দারিদ্র্যের বাস্তবতায় ক্লান্ত। এটি এমন এক ভূমি, যেখানে আন্দেস পর্বতের তুষার, আমাজন বনের সজীবতা, লবণ মরুভূমির রহস্য, এবং বিপ্লবী রাজনীতির তীব্রতা একই সঙ্গে মিলেমিশে এক গভীর জাতীয় আত্মপরিচয় তৈরি করেছে।
ভৌগলিক অবস্থান:
বলিভিয়া দক্ষিণ আমেরিকার একটি স্থলবেষ্টিত দেশ, যার পশ্চিমে পেরু ও চিলি, দক্ষিণে আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ে, এবং পূর্বে ব্রাজিল। আয়তন প্রায় ১১ লক্ষ বর্গকিলোমিটার, যা লাতিন আমেরিকার পঞ্চম বৃহত্তম দেশ।
ছবি:মানচিত্রে বলিভিয়া
ভূপ্রকৃতি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়—পশ্চিমে বিশাল আন্দেস পর্বতমালা, মাঝখানে উঁচু মালভূমি আল্টিপ্লানো, আর পূর্ব দিকে আমাজন অববাহিকার ঘনবন। বলিভিয়া বিশ্বের অন্যতম উচ্চতম রাজধানীর দেশ; প্রশাসনিক রাজধানী লা পাজ ৩,৬০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত, আর সাংবিধানিক রাজধানী সুক্রে ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের প্রতীক। বিশ্বের বৃহত্তম লবণ মরুভূমি সালার দে উয়ুনি (Salar de Uyuni) এখানেই, যা আজ বৈশ্বিক পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ এবং লিথিয়াম সম্পদের আধার।
ইতিহাস
বলিভিয়ার ইতিহাস এক দীর্ঘ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের আখ্যান।
প্রাচীন যুগ: আন্দিয়ান সভ্যতার উত্থান
খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ সালের পর থেকেই এই অঞ্চলে মানব বসতি গড়ে ওঠে। তিওয়ানাকু সভ্যতা (Tiwanaku Civilization), যা খ্রিষ্টাব্দ ৩০০–১০০০ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল, বলিভিয়ার উচ্চ মালভূমিতে এক উন্নত নগরসভ্যতা গড়ে তোলে। তিওয়ানাকুর স্থাপত্য, সূর্যদ্বার (Gateway of the Sun) এবং জ্যোতির্বিদ্যাগত জ্ঞান আজও গবেষকদের বিস্মিত করে। পরে ইনকা সাম্রাজ্য এই অঞ্চল দখল করে এবং বলিভিয়া হয় ইনকাদের দক্ষিণ প্রদেশ।
ছবি: প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ
ঔপনিবেশিক যুগ: রূপার অভিশাপ
১৬শ শতকে স্প্যানিশরা বলিভিয়া দখল করে এবং পোটোসি শহরকে করে তোলে বিশ্বের অন্যতম ধনী রূপার খনি। “Potosí worth a mint”—এই প্রবাদ বলিভিয়ার রূপার ঐশ্বর্যকেই বোঝায়। তবে এই ঐশ্বর্য এসেছিল অগণিত আদিবাসীর শ্রম, শোষণ ও মৃত্যুর বিনিময়ে। তিনশ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে বলিভিয়া ছিল সম্পদের শোষণের এক করুণ প্রতিচ্ছবি।
স্বাধীনতা ও উনিশ শতক
৬ আগস্ট ১৮২৫ সালে সিমন বলিভার ও অ্যান্টোনিও হোসে দে সুক্রে–এর নেতৃত্বে বলিভিয়া স্পেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। দেশের নামকরণ করা হয় “বলিভিয়া”—লাতিন আমেরিকার মুক্তিদাতা বলিভারের নামানুসারে। কিন্তু স্বাধীনতার পরও বলিভিয়া বারবার সামরিক অভ্যুত্থান ও সীমান্তযুদ্ধে জর্জরিত হয়।
১৮৭৯–১৮৮৪ সালের প্যাসিফিক যুদ্ধে চিলির হাতে উপকূল হারিয়ে বলিভিয়া স্থলবেষ্টিত হয়ে পড়ে, যা আজও তার বাণিজ্যিক বিকাশে বড় বাধা।
২০শ শতাব্দী: বিপ্লব ও পুনর্গঠন
১৯৫২ সালের বলিভিয়ান জাতীয় বিপ্লব (Bolivian National Revolution) ছিল দেশের ইতিহাসে মোড় ঘোরানো ঘটনা। বিপ্লবের ফলে ভূমি সংস্কার, শ্রমিক সংগঠন, ও সার্বজনীন ভোটাধিকারের সূচনা হয়।২০০৬ সালে এভো মোরালেস, প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি, ক্ষমতায় এসে সম্পদ জাতীয়করণ ও সামাজিক সমতার নীতি গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনে বলিভিয়া উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে, যদিও পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও প্রতিবাদে দেশটি পুনরায় অস্থির হয়ে পড়ে।
ছবি: Villa Imperial de Potosí,বলিভিয়া
শাসনব্যবস্থা
বলিভিয়া একটি গণতান্ত্রিক ও বহুজাতিক প্রজাতন্ত্র (Plurinational State)। ২০০৯ সালের সংবিধান আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়—যা লাতিন আমেরিকার মধ্যে প্রথম। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান উভয় পদে আসীন, এবং সংসদীয় ব্যবস্থা দুই কক্ষে বিভক্ত—ক্যামারা দে সেনাদোরেস (Senate) ও ক্যামারা দে ডিপুটাদোস (Chamber of Deputies) বর্তমানে শাসনকারী দল Movimiento al Socialismo (MAS), যার প্রতিষ্ঠাতা এভো মোরালেস। রাজনৈতিকভাবে বলিভিয়া এক বহুত্ববাদী গণতন্ত্র, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও নির্বাচনী স্বচ্ছতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
ছবি: পালাসিও কে্যমাদো (Palacio Quemado), যাকে বলিভিয়ার প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস নামেও ডাকা হয়। এটি বলিভিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী লা পাজ (La Paz) শহরে অবস্থিত। এটি হলো বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন ও দপ্তর। ১৮৭৫ সালে এক বিদ্রোহের সময় ভবনটি অগ্নিকাণ্ডে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেই কারণেই এর নাম হয়েছে পালাসিও কে্যমাদো বা "পোড়া প্রাসাদ"। বর্তমানে এটি বলিভিয়ার রাজনীতি ও ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক।
সংস্কৃতি
বলিভিয়া বিশ্বের সবচেয়ে সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময় দেশগুলোর একটি। দেশটির ৩৬টিরও বেশি স্বীকৃত আদিবাসী ভাষা রয়েছে—যার মধ্যে স্প্যানিশ, কেচুয়া, আয়মারা ও গুয়ারানি সর্বাধিক প্রচলিত।
সঙ্গীত ও নৃত্য: আন্দিয়ান বাঁশি (zampoña), চারাঙ্গো (ছোট গিটার জাতীয় বাদ্যযন্ত্র) ও ড্রামের তালে বলিভিয়ান সঙ্গীত প্রকৃতি ও দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যুক্ত।
উৎসব ও ঐতিহ্য
- Carnaval de Oruro — ধর্মীয় ও লোকজ উৎসবের সংমিশ্রণ, যা ইউনেস্কো ঘোষিত অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
- Día del Mar (Sea Day) — উপকূল হারানোর ঐতিহাসিক ক্ষত স্মরণে জাতীয় দিবস।
- Todos Santos ও Pachamama উৎসব — আদিবাসী ও খ্রিষ্টান ঐতিহ্যের মিশ্র প্রতিফলন।
ছবি: Carnaval de Oruro
রন্ধনশৈলী: বলিভিয়ার খাবারে পাহাড়ি ও বনাঞ্চলীয় উপকরণের মিশ্রণ দেখা যায়। জনপ্রিয় খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছে salteñas (বলিভিয়ান পেস্ট্রি), llajwa (টমেটো-চিলির সস) এবং api morado (বেগুনি ভুট্টার পানীয়)।
ধর্ম:জনসংখ্যার প্রায় ৭০% রোমান ক্যাথলিক, ২০% প্রোটেস্ট্যান্ট, এবং বাকিরা আদিবাসী আধ্যাত্মিক বিশ্বাসে বিশ্বাসী। অনেক বলিভিয়ান ধর্মীয়ভাবে ক্যাথলিক হলেও সাংস্কৃতিকভাবে পাচামামা (Mother Earth) পূজাকে সম্মান করে। এই ধর্মীয় সমন্বয় বলিভিয়ান সমাজের মানবিকতা ও প্রকৃতিনির্ভর আধ্যাত্মিকতার প্রতিফলন।
রাজনীতি
বলিভিয়ার রাজনীতি লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে গতিশীল ও তর্কিত ক্ষেত্রগুলোর একটি। সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ও আদিবাসী পুনর্জাগরণের মিশ্রণে গড়ে ওঠা এই রাজনীতির কেন্দ্রে রয়েছে সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা।
এভো মোরালেসের শাসনকাল (২০০৬–২০১৯) ছিল সামাজিক রূপান্তরের যুগ। তাঁর সরকার প্রাকৃতিক গ্যাস, খনি ও টেলিযোগাযোগ খাত জাতীয়করণ করে রাষ্ট্রীয় আয় বৃদ্ধি করে এবং দারিদ্র্য ৬০% থেকে ৩৫%-এ নামিয়ে আনে (World Bank, 2020)। তবে দীর্ঘ শাসনকালের পর ক্ষমতা ধরে রাখার প্রচেষ্টা ও নির্বাচনী বিতর্ক দেশটিকে রাজনৈতিক অস্থিরতায় ফেলে দেয়।বর্তমান প্রেসিডেন্ট লুইস আর্সে একই দলের হলেও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। রাজনীতির মেরুকরণ এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রাকৃতিক সম্পদ
বলিভিয়া বিশ্বের অন্যতম খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ দেশ। এতে রয়েছে বিশাল লিথিয়াম, টিন, সোনা, রূপা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল–এর ভাণ্ডার। বিশেষ করে সালার দে উয়ুনি অঞ্চলটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ লিথিয়াম রিজার্ভের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যা বৈদ্যুতিক গাড়ি ও নবায়নযোগ্য শক্তির যুগে বলিভিয়াকে ভবিষ্যতের শক্তিধর দেশে পরিণত করতে পারে (Bocca, 2020)। কৃষিও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে; প্রধান পণ্য সয়াবিন, কফি, ভুট্টা ও কুইনোয়া।প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য
বলিভিয়া প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের এক জীবন্ত উদাহরণ। সালার দে উয়ুনি, লেক টিটিকাকা, মাদিদি ন্যাশনাল পার্ক ও আন্দেস পর্বতমালার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেশটিকে পর্যটনের স্বর্গে পরিণত করেছে।
ছবি: লেক টিটিকাকা
লেক টিটিকাকা, বিশ্বের সর্বোচ্চ নৌযানযোগ্য হ্রদ, স্থানীয় পুরাণে ইনকা সভ্যতার জন্মভূমি বলে বিবেচিত। পোটোসি শহর, এক সময়ের রূপার রাজধানী, আজ ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য। স্থাপত্য, রঙিন বাজার, এবং পুরনো ঔপনিবেশিক শহরগুলো বলিভিয়ার ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে।
অর্থনীতি
বলিভিয়ার অর্থনীতি লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ও সম্পদনির্ভর অর্থনীতিগুলোর একটি। দেশটি বিপুল লিথিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস, টিন, রূপা ও সোনা সম্পদের কারণে “রিসোর্স ইকোনমি”-র অন্যতম উদাহরণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার প্রাকৃতিক সম্পদ জাতীয়করণ, সামাজিক ব্যয় বৃদ্ধি ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। কৃষি ও খনিজ রপ্তানি, বিশেষ করে প্রাকৃতিক গ্যাস, সয়াবিন, বাদাম ও কুইনোয়া—বলিভিয়ার বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎস। তবুও অর্থনীতি এখনো বৈদেশিক বাজারের ওপর অতিনির্ভরশীল, এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা, মূল্যস্ফীতি ও দারিদ্র্য এর স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করছে। ভবিষ্যতে লিথিয়াম খাতের উন্নয়ন, টেকসই পর্যটন ও নবায়নযোগ্য শক্তি বলিভিয়ার অর্থনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
বলিভিয়ার বর্তমান উন্নয়ন যাত্রা যেমন সম্ভাবনাময়, তেমনি নানা কাঠামোগত চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ। দেশটির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সম্পদনির্ভর প্রবৃদ্ধির সীমাবদ্ধতা। শহর ও গ্রামাঞ্চলের আয় ও জীবনমানের পার্থক্য এখনও স্পষ্ট, বিশেষ করে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে দারিদ্র্যের হার তুলনামূলক বেশি। দারিদ্র্যের হার এখনও ৩০%–এর বেশি, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে। রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং দলীয় সংঘাত দীর্ঘমেয়াদী নীতিনির্ধারণে বাধা সৃষ্টি করছে। জলবায়ু পরিবর্তন, হিমবাহ গলে যাওয়া ও বনাঞ্চল ধ্বংস কৃষি ও পানিসম্পদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অন্যদিকে, বলিভিয়ার সম্ভাবনাও বিশাল। বিশ্বের বৃহত্তম লিথিয়াম ভাণ্ডার দেশটিকে ভবিষ্যতের “সবুজ শক্তির কেন্দ্র” করে তুলতে পারে। নবায়নযোগ্য শক্তি, খনিজ শিল্প, পর্যটন এবং টেকসই কৃষিতে বিনিয়োগ দেশের প্রবৃদ্ধিকে স্থায়ী রূপ দিতে পারে। আঞ্চলিক সংহতি, বিশেষত MERCOSUR ও UNASUR-এর সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানো গেলে বলিভিয়া দক্ষিণ আমেরিকার বাণিজ্যিক সংযোগস্থল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে সক্ষম হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শিক্ষা ও অবকাঠামো উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারলে বলিভিয়া একবিংশ শতাব্দীতে একটি টেকসই, সমৃদ্ধ ও সামাজিকভাবে ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রে রূপ নিতে পারে।
বলিভিয়া শুধু একটি দেশ নয়—এটি এক ধারাবাহিক সংগ্রাম ও পুনর্জাগরণের প্রতীক। প্রাচীন আন্দেস সভ্যতার উত্তরাধিকার, ঔপনিবেশিক শোষণ, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং আধুনিক বৈশ্বিক পরিবর্তনের মাঝে বলিভিয়া তার নিজস্ব পথ খুঁজছে। এটি এমন এক দেশ, যেখানে পাহাড়ের নির্জনতায় লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের শক্তির সম্ভাবনা, আর জনগণের মনে জাগ্রত আছে আত্মমর্যাদার অদম্য আগুন।
তথ্যসূত্র :
Bocca, M. (2020). Lithium Dreams: Bolivia and the Global Battery Revolution. Foreign Policy Journal.
Farthing, L. C. (2019). Revolution and Reaction: Bolivia’s Political Transformation. Latin American Perspectives, 46(3), 4–22.
Klein, H. S. (2011). A Concise History of Bolivia (2nd ed.). Cambridge University Press.
Kohl, B., & Farthing, L. C. (2011). From the Mines to the Streets: A Bolivian Activist's Life. University of Texas Press.
World Bank. (2023). Bolivia Economic Update: Opportunities in Green Energy and Inclusive Growth.
UNESCO. (2022). World Heritage Sites in Bolivia.
CIA World Factbook. (2024). Bolivia Profile.
মুক্তা থেকে রিয়েল এস্টেট: যেভাবে ৫০ বছরে মরুভূমিকে সম্পদে পরিণত করলো দুবাই
দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত – আজ যেখানে মরুভূমির বুকে শপিং মলের ভেতরে আইস স্কেটিং চলে এবং উবারের মতো অ্যাপে হেলিকপ্টার ভাড়া করা যায়, সেই দুবাইয়ের উত্থানের গল্প যেকোনো কল্পনাকেও হার মানায়। মাত্র অর্ধশতাব্দীর ব্যবধানে মুক্তা আহরণকারী জেলেদের একটি সাধারণ বসতি থেকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার পেছনে রয়েছে এক অবিশ্বাস্য রূপান্তরের ইতিহাস। এটি কোনো দেশের রাজধানী নয়, এমনকি একটি স্বতন্ত্র দেশও নয়; কেবল একটি আমিরাত বা রাজ্য হয়েও দুবাই নিজেকে এক গ্লোবাল ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা ও তেলের বাস্তবতা
একসময় পুরো আরব উপদ্বীপ ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন তারা এই বিশাল অঞ্চল শাসনের ব্যয়ভার বহন করতে অপারগ হয়। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে এই অঞ্চল স্বাধীনতা লাভ করে এবং সাতটি আমিরাত মিলে গঠিত হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE)।
অনেকেরই একটি সাধারণ ধারণা হলো, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মতো দুবাইও তেলের টাকায় ধনী হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ঠিক তার উল্টো। প্রতিবেশী কাতার, সৌদি আরব বা এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবির অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তেল হলেও, ১৯৭১ সালে দুবাইয়ের জিডিপিতে তেলের অবদান ছিল শূন্য শতাংশ। বর্তমানেও তা মাত্র ১ শতাংশের কাছাকাছি। তেলের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকায় স্বাধীনতার পর অনেকেই দুবাইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ ছিলেন এবং উন্নত জীবনের আশায় বহু মানুষ আবুধাবি বা অন্যান্য রাজ্যে পাড়ি জমান।
শেখ রশিদের দূরদর্শী পরিকল্পনা ও চার স্তম্ভের কৌশল
এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই দৃশ্যপটে আসেন দুবাইয়ের আধুনিক রূপকার শেখ রশিদ বিন সাঈদ আল মাকতুম। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে টিকে থাকতে হলে দুবাইকে ভিন্ন পথে হাঁটতে হবে। তিনি মুক্তা বা মাছের অর্থনীতির ওপর নির্ভর না করে চারটি মূল স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে এক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
১. বিশ্বমানের অবকাঠামো: শেখ রশিদের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য ছিল অবকাঠামো নির্মাণ। ১৯৬০ সালে তিনি ঋণ করে দুবাই বিমানবন্দর নির্মাণ করেন। তখন অনেকেই উপহাস করে বলেছিল, এই মরুভূমিতে কে আসবে? কিন্তু তার দূরদৃষ্টি ছিল স্পষ্ট। তিনি জানতেন, বিশ্বকে সংযুক্ত করতে না পারলে অগ্রগতি অসম্ভব। বিমানবন্দরের পাশাপাশি মরুভূমির বুকে গড়ে তোলা হয় আধুনিক রাস্তা, সেতু এবং ফ্লাইওভার।
২. ব্যবসা ও বিনিয়োগের স্বর্গরাজ্য: শুধু উন্নত রাস্তাঘাট বা বিমানবন্দর ব্যবসা আনার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় জেবেল আলি ফ্রি জোন (Jafza)। বিদেশী কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করতে এখানে কর ছাড়, শুল্কমুক্ত বাণিজ্য এবং শতভাগ মালিকানার মতো যুগান্তকারী সব সুবিধা দেওয়া হয়। এই মডেলটি এতটাই সফল হয় যে পরবর্তীতে দুবাইতে ৩০টিরও বেশি ফ্রি জোন গড়ে ওঠে। কেবল জাফজা থেকেই বর্তমানে বার্ষিক ৮০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রাজস্ব আসে এবং সেখানে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ কাজ করে।
৩. নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা: শেখ রশিদ জানতেন, ব্যবসার প্রসারের জন্য নিরাপত্তা অপরিহার্য। দুবাইকে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ শহরগুলোর একটি হিসেবে গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়। এর ফলও মিলেছে হাতেনাতে। গত সাত বছরে, সাধারণ অপরাধের হার ক্রমাগত কমেছে। বর্তমানে শহরটির সেফটি ইনডেক্স ৮৩.৭৩, যা বিশ্বের সর্বোচ্চগুলোর মধ্যে একটি। আইন প্রয়োগে কঠোরতা এবং উন্নত নজরদারি ব্যবস্থা বিনিয়োগকারী ও বাসিন্দা উভয়ের মধ্যেই আস্থা তৈরি করেছে।
৪. রিয়েল এস্টেট ও পর্যটন: ২০০২ সালে দুবাই তার রিয়েল এস্টেট খাত বিদেশীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়, যা ছিল আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে বিনিয়োগকারীরা দুবাইতে সম্পত্তি কেনার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর ফলে এক বিশাল নির্মাণযজ্ঞ শুরু হয়; এক পর্যায়ে বিশ্বের মোট নির্মাণ ক্রেনের ২৫ শতাংশই দুবাইতে কর্মরত ছিল। এই সময়ে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক এই নির্মাণ কাজে যোগ দেন, যদিও তাদের কর্মপরিবেশ এবং অধিকার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনাও হয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি প্রতিটি প্রকল্পকে একটি পর্যটন আকর্ষণে পরিণত করার কৌশল নেওয়া হয়। কেবল উঁচু ভবন নয়, বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন (বুর্জ খলিফা); কেবল বড় শপিং মল নয়, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শপিং মল (দুবাই মল) তৈরি করা হয়। দুবাইয়ের লক্ষ্য ছিল সাধারণ পর্যটক নয়, বরং উচ্চ-ব্যয়কারী পর্যটকদের আকৃষ্ট করা, যারা বিলাসবহুল জীবনযাত্রা এবং কেনাকাটার জন্য আসবেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: মেধা ও উদ্ভাবনের কেন্দ্র
আজ দুবাই মাথাপিছু আয়ের হিসাবে বিশ্বের তৃতীয় ধনী শহর। তবে তারা এখানেই থেমে নেই। তাদের বর্তমান লক্ষ্য হলো বিশ্বের সেরা মেধাবী, উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবকদের জন্য একটি আদর্শ কেন্দ্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা। ০% ব্যক্তিগত ও কর্পোরেট ট্যাক্স, এক ঘণ্টার মধ্যে কোম্পানি গঠন এবং উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ভিসার মতো উদ্যোগগুলো সেই লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে।
দুবাইয়ের এই ৫০ বছরের যাত্রা প্রমাণ করে যে, সঠিক নেতৃত্ব, দূরদর্শী পরিকল্পনা এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে যেকোনো প্রতিকূলতাকেই সম্ভাবনায় পরিণত করা সম্ভব।
/আশিক
সভ্যতার সঙ্গমস্থল আফগানিস্তান: ইতিহাস, সংগ্রাম ও পুনর্জাগরণের এক দীর্ঘ যাত্রা
আফগানিস্তান—এক নাম, যেখানে ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সংঘর্ষ এক জটিল সিম্ফনিতে গেঁথে আছে। একদিকে এটি এশিয়ার হৃদয়ে অবস্থিত সভ্যতার সংযোগস্থল, অন্যদিকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি যুদ্ধ, বিদেশি আগ্রাসন ও অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু। ভৌগোলিক অবস্থান এটিকে যেমন বাণিজ্য ও সংস্কৃতির কেন্দ্র বানিয়েছে, তেমনি করেছে এক অস্থির রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপের প্রতীক।
ভৌগলিক অবস্থান:
আফগানিস্তান (আনুষ্ঠানিক নাম: Islamic Emirate of Afghanistan) দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার মিলনবিন্দুতে অবস্থিত একটি স্থলবেষ্টিত দেশ। এর পূর্ব ও দক্ষিণে পাকিস্তান, পশ্চিমে ইরান, উত্তরে তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান এবং উত্তর–পূর্ব কোণে চীনের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে। আয়তন প্রায় ৬,৫২,০০০ বর্গকিলোমিটার, যার অধিকাংশ অংশজুড়ে বিস্তৃত হিন্দুকুশ পর্বতমালা।
ছবি:মানচিত্রে আফগানিস্তান
দেশটির ভূপ্রকৃতি কঠিন ও শুষ্ক, পাহাড়, উপত্যকা ও মরুভূমি মিলিয়ে এক বৈচিত্র্যময় ভূদৃশ্য তৈরি করেছে। খাইবার পাস ও সালাং পাস শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার সংযোগপথ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আফগানিস্তানের জলবায়ু প্রধানত শুষ্ক; গ্রীষ্মে গরম ও শীতকালে হিমশীতল। আমু দরিয়া, হেলমান্দ ও কাবুল নদী কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জলসম্পদ।
ইতিহাস
আফগানিস্তানের ইতিহাস মানবসভ্যতার প্রাচীন অধ্যায় পর্যন্ত প্রসারিত। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানব বসতির প্রমাণ পাওয়া যায়, আর খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে এটি ছিল আকেমেনীয় পারস্য সাম্রাজ্যের অংশ। পরে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এর অভিযান, কুশান সাম্রাজ্য, গজনবী ও গুরিদ রাজবংশ, এবং ইসলামী যুগে বহু রাজবংশের উত্থান-পতন এই ভূখণ্ডকে বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার দিয়েছে (Dupree, 1973)।
১৯শ শতকে এটি ছিল তথাকথিত “গ্রেট গেম”–এর কেন্দ্র—ব্রিটিশ ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে এক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। দীর্ঘ প্রতিরোধের পর ১৯১৯ সালের তৃতীয় অ্যাংলো–আফগান যুদ্ধ স্বাধীনতা এনে দেয় রাজা আমানুল্লাহ খান–এর নেতৃত্বে। রাজতন্ত্র টিকে ছিল ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত, এরপর শুরু হয় এক অস্থির রাজনৈতিক অধ্যায়—সোভিয়েত আগ্রাসন (১৯৭৯–৮৯), গৃহযুদ্ধ, তালেবান শাসন (১৯৯৬–২০০১), এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন দখল (২০০১–২০২১)। অবশেষে আগস্ট ২০২১–এ মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসে, প্রতিষ্ঠিত হয় Islamic Emirate of Afghanistan।
শাসনব্যবস্থা
আফগানিস্তানের শাসন কাঠামো ইতিহাস জুড়ে বারবার পরিবর্তিত হয়েছে—রাজতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, সমাজতান্ত্রিক শাসন থেকে শুরু করে ইসলামী আমিরাত পর্যন্ত। বর্তমানে দেশটি তালেবানদের অধীনে একটি ধর্মভিত্তিক আমিরাত, যেখানে শাসনের মূল ভিত্তি হলো শরিয়াহ আইন। সর্বোচ্চ ক্ষমতা আমির আল মুমিনিন (Hibatullah Akhundzada)–এর হাতে কেন্দ্রীভূত।
সংবিধান, সংসদ বা নির্বাচনী কাঠামো অনুপস্থিত; সিদ্ধান্ত আসে ধর্মীয় নেতৃত্বের পরামর্শ ও ফতোয়ার ভিত্তিতে। প্রশাসনিকভাবে দেশটি প্রদেশ ও জেলায় বিভক্ত, যেখানে গভর্নর ও আলেম কাউন্সিল দায়িত্ব পালন করে। তবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অভাব ও অভ্যন্তরীণ বৈচিত্র্যের কারণে শাসনব্যবস্থা কার্যকারিতা অর্জন করতে পারছে না।
সংস্কৃতি
আফগান সংস্কৃতি মধ্য এশিয়া, পারস্য, ভারত ও আরব সভ্যতার সংমিশ্রণ। দেশটির প্রধান জাতিগোষ্ঠী হলো পশতুন, তাজিক, হাজারাস ও উজবেক। প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষা, পোশাক, সংগীত ও আচার-অনুষ্ঠান আফগান পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কবিতা ও মৌখিক কাহিনিচর্চা আফগান সংস্কৃতির প্রাণ। জালালউদ্দিন রুমি ও আবদুল কাদির বেদিলের মতো কবিরা এখানকার সাহিত্যঐতিহ্যের গর্ব। সংগীতে রুবাব, তবলা ও দোলক ব্যবহৃত হয়, আর আফগান কার্পেট ও সূচিশিল্প আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত। আতিথেয়তা (melmastia) ও সম্মানবোধ (nang) পশতুন সমাজে সামাজিক মূল্যবোধের কেন্দ্র।
ধর্ম
জনসংখ্যার প্রায় ৯৯ শতাংশ মুসলিম; এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ সুন্নি (হানাফি) ও ১০ শতাংশ শিয়া (প্রধানত হাজারা সম্প্রদায়)। ইসলাম আফগান সমাজের আইনি, শিক্ষাগত ও পারিবারিক কাঠামোর ভিত্তি।
ইসলাম আগমনের আগে এই ভূখণ্ডে বৌদ্ধ, জরাথুস্ত্রী ও হিন্দুধর্মের চিহ্ন পাওয়া যায়। বামিয়ান বুদ্ধ মূর্তি, যদিও ২০০১ সালে ধ্বংস করা হয়, এই প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষ্য। আজকের আফগানিস্তানে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা প্রবল, বিশেষত নারীর শিক্ষা ও সামাজিক অংশগ্রহণ সীমিত।
রাজনীতি
আধুনিক আফগানিস্তানের রাজনীতি মূলত অনিশ্চয়তা ও সংঘর্ষের ইতিহাস। ২০০৪–২০২১ সাল পর্যন্ত Islamic Republic of Afghanistan ছিল একটি নির্বাচিত সরকারব্যবস্থা, কিন্তু দুর্নীতি ও বৈদেশিক নির্ভরতা এর স্থায়িত্ব নষ্ট করে। ২০২১ সালে তালেবানের পুনরাগমনের পর দেশটি আবারও একক দলীয় ইসলামী শাসনে ফিরে যায়।
ছবি- তালেবান শাসনের তৃতীয় বর্ষ উদযাপন
রাজনৈতিক বহুত্ববাদ বা বিরোধী দলের কার্যকারিতা নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতির অভাবে কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা গভীর হয়েছে, যা অর্থনীতি ও মানবাধিকার পরিস্থিতিকে আরও সংকটে ফেলেছে।
অর্থনীতি
আফগানিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক গতিশীলতা এক জটিল বৈপরীত্যের মধ্যে অবস্থান করছে। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, বৈদেশিক সহায়তা বন্ধ হওয়া এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্থবিরতায় অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি আঞ্চলিক বাণিজ্য, সীমিত কর আদায় এবং খনিজ সম্পদ উত্তোলন থেকে কিছুটা স্থিতিশীলতা খুঁজছে। কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসা এখনো জনজীবনের প্রধান অবলম্বন। তবে বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্যনিরাপত্তা সংকট এবং নারীর কর্মসংস্থান নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে বাধাগ্রস্ত করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে আফগানিস্তানের লিথিয়াম ও খনিজ সম্পদের সম্ভাবনা অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত খুলতে পারে, যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়।
প্রাকৃতিক সম্পদ
আফগানিস্তান বিশ্বের অন্যতম খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ দেশ। এতে রয়েছে বিপুল পরিমাণ লিথিয়াম, তামা, লোহা, সোনা, কোবাল্ট ও রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস—যার সম্ভাব্য বাজারমূল্য প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার (USGS, 2010)। এই সম্পদ বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
কৃষিই দেশের মূল পেশা; জনগণের প্রায় ৬০% কৃষিকাজে নিয়োজিত। প্রধান ফসল গম, বাদাম, আঙুর, ডালিম ও আফিম। দীর্ঘ যুদ্ধ, খরা ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা কৃষি উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করেছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আফগানিস্তান অপূর্ব। হিন্দুকুশ ও পামির পর্বতমালার তুষারাচ্ছন্ন চূড়া, বামিয়ানের বন্দে আমির হ্রদসমূহ, এবং দূরবর্তী ওয়াখান করিডর—সবই মনোমুগ্ধকর দৃশ্যপটে ভরপুর।
ছবি:বন্দে আমির হ্রদ
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকেও দেশটি অনন্য। হেরাত, বালখ ও কান্দাহার ইতিহাসে জ্ঞানের ও বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। জামের মিনার (UNESCO বিশ্ব ঐতিহ্য) মধ্যযুগীয় ইসলামি স্থাপত্যের এক অমূল্য নিদর্শন। বামিয়ানের মূর্তিগুলির ধ্বংসাবশেষ আজও স্মরণ করিয়ে দেয়, কেমনভাবে ইতিহাস ও বিশ্বাসের সংঘাত এক জাতির স্মৃতিকে রূপান্তরিত করেছে।
ছবি:জামের মিনার
আন্তর্জাতিক সদস্যপদ
২০২১ সালের আগে আফগানিস্তান জাতিসংঘ (UN), ইসলামিক কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (OIC), দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (SAARC) ও ইকোনমিক কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (ECO)-এর সদস্য ছিল।
বর্তমানে তালেবান সরকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়, ফলে কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নিয়ে দ্বৈততা তৈরি হয়েছে। বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক সংস্থায় পূর্বতন সরকারের প্রতিনিধিরাই আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তানের আসন ধরে রেখেছে। তবুও চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান ও ইরানের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলো কৌশলগত কারণে তালেবান সরকারের সঙ্গে সীমিত যোগাযোগ বজায় রেখেছে।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
আফগানিস্তানের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো—দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের পরিণতি, অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্যসংকট, ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। বিশেষত নারীর শিক্ষা নিষিদ্ধ, কর্মসংস্থান সীমিত, এবং গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণাধীন—যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথে বড় বাধা।
তবু সম্ভাবনাও অমলিন। ভৌগোলিক অবস্থান আফগানিস্তানকে এশিয়ার বাণিজ্য ও শক্তি সংযোগের কেন্দ্র করতে পারে। TAPI গ্যাস পাইপলাইন ও CASA–1000 বিদ্যুৎ প্রকল্প দেশটিকে আঞ্চলিক সহযোগিতার সেতুতে পরিণত করতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন ও নারীর শিক্ষা ও অধিকারের নিশ্চয়তা।
আফগানিস্তান ইতিহাসের এক বিস্ময়কর প্যারাডক্স—অসীম সম্পদ ও গৌরবময় ঐতিহ্যের দেশ, অথচ অনন্ত সংঘর্ষ ও অনিশ্চয়তার আবাস। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই ভূমি যেমন সাম্রাজ্যের কবরস্থান, তেমনি সভ্যতার জন্মভূমি। আফগান জনগণের সহনশীলতা, কবিত্ব ও সাহস এই দেশকে এখনও টিকিয়ে রেখেছে।
যদি আফগানিস্তান একদিন ধর্ম ও স্বাধীনতা, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে সামঞ্জস্য খুঁজে পায়, তবে এটি আবারও হয়ে উঠতে পারে সেই ঐতিহাসিক ভূমি—যেখানে সভ্যতাগুলো মিলিত হয়, ধ্বংস নয়।
তথ্যসূত্র:
Dupree, L. (1973). Afghanistan. Princeton University Press.
U.S. Geological Survey (USGS). (2010). Afghanistan Nonfuel Mineral Resources Map.
Barfield, T. (2010). Afghanistan: A Cultural and Political History. Princeton University Press.
Rashid, A. (2021). Taliban: Militant Islam, Oil and Fundamentalism in Central Asia (3rd ed.). Yale University Press.
Rubin, B. R. (2013). Afghanistan from the Cold War through the War on Terror. Oxford University Press.
United Nations Development Programme (UNDP). (2023). Afghanistan: Socioeconomic Outlook 2023.
World Bank. (2024). Afghanistan Development Update: Challenges and Prospects.
আফ্রিকার হৃদয়ে পাথরের রাজ্য: জিম্বাবুয়ের প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও আত্মার গল্প
আফ্রিকার মানচিত্রে এমন একটি দেশ রয়েছে, যার নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার আত্মপরিচয়—জিম্বাবুয়ে, অর্থাৎ “পাথরের ঘর।” এক সময় আফ্রিকার অন্যতম সমৃদ্ধ সভ্যতার কেন্দ্র, আজ নানা সংকট, সংগ্রাম ও আশার প্রতীকে পরিণত এই দেশ। প্রাচীন ইতিহাস, বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ, অনন্য সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মিশেলে জিম্বাবুয়ে এক আশ্চর্য জটিল অথচ প্রাণবন্ত রাষ্ট্রচিত্র উপস্থাপন করে।
ভৌগলিক অবস্থান
জিম্বাবুয়ে (আনুষ্ঠানিক নাম: রিপাবলিক অব জিম্বাবুয়ে) আফ্রিকার দক্ষিণ অংশে অবস্থিত একটি স্থলবেষ্টিত দেশ। এর উত্তর-পশ্চিমে জাম্বিয়া, পূর্বে মোজাম্বিক, দক্ষিণে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং পশ্চিমে বোতসোয়ানা সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র। প্রায় ৩,৯০,৭৫৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটির ভূপ্রকৃতি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়—উচ্চভূমি, পাহাড়, সমতল ও নদী উপত্যকার সমন্বয়ে গঠিত। দেশের কেন্দ্রীয় উচ্চভূমি বা “হাইভেল্ড” অঞ্চল কৃষি উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র, যার গড় উচ্চতা প্রায় ১,২০০ মিটার। প্রধান দুটি নদী হলো জাম্বেজি (উত্তর সীমান্তে) ও লিম্পোপো (দক্ষিণ সীমান্তে)।
ছবি: জিম্বাবুয়ের ভৌগলিক অবস্থান
জিম্বাবুয়ের জলবায়ু মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় হলেও উচ্চতার কারণে তুলনামূলকভাবে শীতল ও সহনীয়। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বর্ষাকাল এবং এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুম থাকে। দেশের সবচেয়ে পরিচিত প্রাকৃতিক বিস্ময় হলো ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত (মোসি-ওয়া-তুনইয়া অর্থাৎ “ধোঁয়া যে গর্জে ওঠে”)—যা বিশ্বের বৃহত্তম ও মনোমুগ্ধকর জলপ্রপাতগুলোর একটি, জাম্বেজি নদীর উপর অবস্থিত।
ইতিহাস
জিম্বাবুয়ের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। প্রস্তর যুগ থেকেই এই অঞ্চলে মানব বসতির প্রমাণ পাওয়া যায়। মধ্যযুগে এই ভূখণ্ডে গড়ে উঠেছিল একাধিক শক্তিশালী রাজ্য—যেমন মাপুংগুবুয়ে রাজ্য (১১–১৩ শতক) এবং গ্রেট জিম্বাবুয়ে রাজ্য (১৩–১৫ শতক)। পরবর্তী রাজ্যের নাম থেকেই বর্তমান রাষ্ট্রের নামকরণ। গ্রেট জিম্বাবুয়ের ধ্বংসাবশেষ আজও ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে আফ্রিকার প্রাচীন সভ্যতা, স্থাপত্য ও বাণিজ্য নেটওয়ার্কের প্রতীক হয়ে আছে।
ঊনবিংশ শতকে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী সেসিল রোডস-এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সাউথ আফ্রিকা কোম্পানি এই অঞ্চল দখল করে এবং এর নাম দেয় সাউদার্ন রোডেশিয়া। ১৯২৩ সালে এটি স্বশাসিত ব্রিটিশ উপনিবেশে রূপ নেয়। দীর্ঘ শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু শাসন ও আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পর মুক্তিযুদ্ধ (সেকেন্ড চিমুরেঙ্গা) শেষে ১৮ এপ্রিল ১৯৮০ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রবার্ট মুগাবে স্বাধীন জিম্বাবুয়ের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং দেশের নাম রাখা হয় জিম্বাবুয়ে, যার অর্থ “পাথরের ঘর”।
শাসনব্যবস্থা
জিম্বাবুয়ে একটি একক রাষ্ট্রীয় প্রেসিডেন্সিয়াল প্রজাতন্ত্র। রাষ্ট্রপতি একইসঙ্গে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন পাঁচ বছরের জন্য। ২০১৩ সালের সংবিধান অনুযায়ী দেশটি একটি বহুদলীয় গণতন্ত্র, যেখানে নির্বাহী, আইনসভা ও বিচার বিভাগের পৃথক কাঠামো রয়েছে। তবে বাস্তবে ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ, স্বচ্ছতার অভাব ও নির্বাচন ঘিরে বিতর্ক জিম্বাবুয়ের গণতন্ত্রকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রদেশ ও জেলা পর্যায়ে গঠিত, যেখানে স্থানীয় পরিষদগুলো উন্নয়ন ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। সংবিধানে বিকেন্দ্রীকরণের নিশ্চয়তা থাকলেও রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা কার্যকর স্থানীয় শাসনকে দুর্বল করে রেখেছে।
সংস্কৃতি
জিম্বাবুয়ের সংস্কৃতি বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ। এখানে ১৬টিরও বেশি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো শোনা ও নদেবেলে। শোনা জনগোষ্ঠী দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ জনসংখ্যা গঠন করে এবং পাথরের ভাস্কর্য, সংগীত ও মৌখিক কাহিনিচর্চায় সমৃদ্ধ। নদেবেলে জনগোষ্ঠী তাদের রঙিন নকশা, দেয়ালচিত্র ও অলঙ্কার শিল্পের জন্য বিখ্যাত।
সঙ্গীত ও নৃত্য জিম্বাবুয়ের সমাজজীবনের অপরিহার্য অংশ। মবিরা (thumb piano) শোনা ঐতিহ্যের অন্যতম বাদ্যযন্ত্র, যা আত্মিক যোগাযোগের প্রতীক। জনপ্রিয় সংগীতধারার মধ্যে রয়েছে সুংগুরা, চিমুরেঙ্গা ও আরবান গ্রুভস। সাহিত্যে ও চিত্রকলায় প্রতিরোধ, পরিচয় ও আশার প্রতিফলন দেখা যায়। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান লেখকদের মধ্যে দামবুজো মারেচেরা ও ৎসিৎসি দাঙ্গারেম্বগা উল্লেখযোগ্য।
ধর্ম
জিম্বাবুয়ের জনগণের প্রায় ৮৫ শতাংশই খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। রোমান ক্যাথলিক, অ্যাংলিকান, মেথডিস্ট, পেন্টেকোস্টালসহ নানা সম্প্রদায়ের উপস্থিতি রয়েছে। পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী আফ্রিকান বিশ্বাস, বিশেষত পূর্বপুরুষ পূজা ও আত্মিক যোগাযোগের সংস্কার আজও জীবিত। ইসলাম, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে। ধর্ম সামাজিক সংহতি, নৈতিক শিক্ষা ও সমাজজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রাজনীতি
স্বাধীনতার পর থেকেই জিম্বাবুয়ের রাজনীতিতে প্রভাবশালী দল জানু-পিএফ (ZANU–PF), যার নেতৃত্বে ছিলেন রবার্ট মুগাবে। স্বাধীনতার পর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে সাফল্য অর্জনের জন্য তিনি প্রশংসিত হলেও পরবর্তী সময়ে দুর্নীতি, একনায়কতন্ত্র ও অর্থনৈতিক পতনের কারণে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। ২০১৭ সালে সামরিক হস্তক্ষেপের পর তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন। তাঁর উত্তরসূরি এমারসন মনাঙ্গাগওয়া “দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র”-এর ঘোষণার মাধ্যমে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন, যদিও রাজনৈতিক মেরুকরণ ও নির্বাচনী স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে মুভমেন্ট ফর ডেমোক্রেটিক চেঞ্জ (MDC) বিকল্প শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়, যা গণতান্ত্রিক সংস্কার ও অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের পক্ষে আন্দোলন করে। কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দলীয় বিভাজন গণতন্ত্রের বিকাশকে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে।
প্রাকৃতিক সম্পদ
জিম্বাবুয়ে আফ্রিকার অন্যতম সম্পদশালী দেশ। দেশে রয়েছে প্লাটিনাম, স্বর্ণ, হীরা, কয়লা, নিকেল, লিথিয়াম ও ক্রোমসহ বহু খনিজ সম্পদ। দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ৫৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ গ্রেট ডাইক ভূ-গঠনটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্লাটিনাম ও ক্রোমের ভাণ্ডার। কৃষি এখনো অর্থনীতির মূল ভিত্তি; ভুট্টা, তামাক ও তুলা প্রধান বাণিজ্যিক ফসল। তবে ২০০০ সালের পর ভূমি সংস্কার নীতি কৃষি উৎপাদন ও বিদেশি বিনিয়োগে বড় ধরনের ধাক্কা দেয়।
জলসম্পদের মধ্যে জাম্বেজি ও লিম্পোপো নদী গুরুত্বপূর্ণ, যা জলবিদ্যুৎ, সেচ ও মৎস্যসম্পদের উৎস। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনা সম্পদ আহরণকে অনিরাপদ ও অসম করে তুলেছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য
জিম্বাবুয়ে প্রকৃতির অনন্য সৌন্দর্যে ভরপুর দেশ। ভিক্টোরিয়া ফলস, হোয়াঙ্গে ন্যাশনাল পার্ক, মানা পুলস, ও মাতোবো হিলস—সবই বিশ্বমানের প্রাকৃতিক ও জীববৈচিত্র্যমণ্ডিত স্থান। দেশের ইস্টার্ন হাইল্যান্ডস অঞ্চলে পাহাড়, ঝরনা ও চা বাগানের শান্তিপূর্ণ সৌন্দর্য মুগ্ধ করে।
ছবি: সাফারি পার্ক, জিম্বাবুয়ে
গ্রেট জিম্বাবুয়ে ধ্বংসাবশেষ, খামি রুইন্স, ও মাতোবো পাহাড়ের প্রাগৈতিহাসিক শিলাচিত্র এই জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মানব সভ্যতার ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। এসব স্থান শুধু পর্যটনের আকর্ষণই নয়, বরং জাতির আত্মপরিচয় ও গৌরবের প্রতীক।
ছবি: গ্রেট জিম্বাবুয়ে জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ, "পাথরের দেশ"
আন্তর্জাতিক সদস্যপদ
জিম্বাবুয়ে জাতিসংঘ (UN), আফ্রিকান ইউনিয়ন (AU), দক্ষিণ আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট কমিউনিটি (SADC), কমেসা (COMESA) ও আফ্রিকান কনটিনেন্টাল ফ্রি ট্রেড এরিয়া (AfCFTA)-এর সদস্য। একসময় দেশটি কমনওয়েলথ অব নেশনস-এরও সদস্য ছিল, তবে ২০০৩ সালে মানবাধিকার ও শাসনব্যবস্থা ইস্যুতে দ্বন্দ্বের কারণে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুনরায় যোগদানের প্রচেষ্টা চলছে, যা আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পুনর্গঠনের ইঙ্গিত দেয়।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
জিম্বাবুয়ের প্রধান চ্যালেঞ্জ অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ও দুর্নীতি। ভূমি সংস্কারের বিতর্কিত ফলাফল, রাজনৈতিক মেরুকরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেশটির টেকসই উন্নয়নকে ব্যাহত করছে। মেধাপাচার বা brain drain এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতাও বড় বাধা।
তবে সম্ভাবনাও বিশাল। দেশের তরুণ ও শিক্ষিত জনশক্তি, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কৌশলগত অবস্থান ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করে। খনিজ, কৃষি ও পর্যটন খাতে নতুন বিনিয়োগ এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা কাঠামো (SADC ও AfCFTA)-এর সুযোগ কাজে লাগানো গেলে অর্থনৈতিক পুনরুত্থান সম্ভব। সুশাসন, প্রযুক্তি বিনিয়োগ ও শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে জিম্বাবুয়ে আবারও আফ্রিকার অন্যতম সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে।
ছবি: জিম্বাবুয়ের রাজধানী 'হারারে'
জিম্বাবুয়ের ইতিহাস এক অনন্য সহনশীলতা, সংগ্রাম ও পুনর্জাগরণের কাহিনি। প্রাচীন গ্রেট জিম্বাবুয়ে সভ্যতা থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বর্তমান পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা—এই দেশ আফ্রিকার সংগ্রামী আত্মার প্রতীক। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য ও মানুষের দৃঢ় মনোবল জিম্বাবুয়েকে আশার আলোয় আলোকিত করে রেখেছে। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বলা যায়—জিম্বাবুয়ে আবারও উত্থান ঘটাতে পারে, এক স্বাধীন, ন্যায়ভিত্তিক ও সমৃদ্ধ আফ্রিকান জাতি হিসেবে।
তথ্যসূত্র:
Beach, D. N. (1994). The Shona and Zimbabwe 900–1850: An Outline of Shona History. Heinemann.
Meredith, M. (2002). Our Votes, Our Guns: Robert Mugabe and the Tragedy of Zimbabwe. Public Affairs.
Raftopoulos, B. (2013). The hard road to reform: The politics of Zimbabwe’s global political agreement. Weaver Press.
Ndlovu-Gatsheni, S. J. (2009). Do 'Zimbabweans' exist? Trajectories of nationalism, national identity formation and crisis in a postcolonial state. Peter Lang.
Richardson, C. (2005). The Loss of Property Rights and the Collapse of Zimbabwe. Cato Journal, 25(3), 541–565.
Commonwealth Secretariat. (2022). Zimbabwe’s re-admission dialogue. Retrieved from https://thecommonwealth.org/
World Bank. (2023). Zimbabwe Economic Update: Harnessing Technology for Growth.
পাঠকের মতামত:
- নাহিদ ইসলামের তীব্র সমালোচনা: পিআর নিয়ে জামায়াতকে একহাত নিলেন এনসিপি নেতা
- মানব সভ্যতায় মুসলিম বিজ্ঞানীদের ৫ যুগান্তকারী অবদান
- আন্দোলনরত শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষা উপদেষ্টার বার্তা
- ১৮ বছরের গণনা: যে আবিষ্কার বিশ্বকে বোঝালো আমরা মিল্কি ওয়েতে একা নই
- জুলাই সনদের ৫ দফা দাবিতে জামায়াতসহ সমমনা দলগুলোর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা
- সুখবর: ৯ মাস বন্ধ থাকার পর খুলছে সেন্ট মার্টিন
- পা ফাটা দূর করুন: ঘরোয়া উপায়ে মসৃণ গোড়ালি পাওয়ার সহজ কৌশল
- শোয়েব আখতারের রেকর্ড ভাঙা! স্টার্কের ১৭৬.৫ কিমি গতির বল নিয়ে তোলপাড়
- ১৯ অক্টোবর ডিএসই লেনদেনের সারসংক্ষেপ
- ১৯ অক্টোবরের ডিএসই লেনদেনে শীর্ষ লুজার তালিকা প্রকাশ
- ১৯ অক্টোবরের ডিএসই লেনদেনে শীর্ষ গেইনার তালিকা প্রকাশ
- পরিকল্পিত আগুন: কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ড নিয়ে বড় অভিযোগ
- ইসি জঙ্গলীয় কায়দায় চলছে: নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী
- ‘বক্তব্য কাট করে বিকৃত করা হয়েছে’: জুলাই যোদ্ধা নিয়ে সালাহউদ্দিন আহমদের ব্যাখ্যা
- এনসিপি’র হুঁশিয়ারি: নির্বাচন কমিশন ‘স্বৈরাচারী কায়দায়’ চলছে
- ফ্রান্স: সভ্যতা, প্রজাতন্ত্র ও মানবমুক্তির দীপ্ত ইতিহাস
- বাংলাদেশ জলসীমায় অনুপ্রবেশ: বঙ্গোপসাগর থেকে ভারতীয় ১৪ জেলে আটক
- মেথি পানির ম্যাজিক: নিয়মিত ১৫ দিন পান করলে শরীরে আসে যে ৬ পরিবর্তন
- সাবধান! কম ঘুম ছোট করে দিতে পারে মস্তিষ্ককে, নতুন গবেষণার ভয়াবহ তথ্য
- এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া ভাতা বাড়াল সরকার
- ঘূর্ণিঝড়ের শঙ্কা: বঙ্গোপসাগরে নতুন লঘুচাপ সৃষ্টির পূর্বাভাস দিল আবহাওয়া অধিদপ্তর
- ইয়েমেনে জাতিসংঘ ভবনে হুথি অভিযান: সব কর্মী নিরাপদে
- গণভোটের দিনক্ষণ: নির্বাচনের দিন হবে না আগে? সিদ্ধান্ত সরকারের ওপর
- রক্ষণ থেকে আক্রমণে জাদু: আরাউহোর গোলে লা লিগার শীর্ষে বার্সা
- মেসির জাদুতে ইন্টার মায়ামির দুর্দান্ত জয়: হ্যাটট্রিকে এমএলএস গোল্ডেন বুট প্রায় নিশ্চিত
- ‘আমরা রাজা নই, আমরা জনগণ’: যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল জনতা
- রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর যুদ্ধবিরতি: দোহায় পাকিস্তান-আফগান সমঝোতা
- শাহজালালে আগুনে ছাই ব্যবসায়িক আশা: বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির আশঙ্কা
- ১৯ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধান অঞ্চলের নামাজের সময়সূচি
- কার্গো ভিলেজে আগুন: ক্ষতির আশঙ্কা বিলিয়ন ডলার
- ভারতের বিরুদ্ধে নতুন সামরিক হুমকি দিলেন পাক সেনাপ্রধান
- সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডগুলো জননিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি: তারেক রহমান
- পায়ে সামান্য ব্যথা বা ঘা: নীরব ঘাতক ‘রক্তনালির ব্লকের’ সংকেত নয়তো?
- রাতে ফ্লাইট চালুর চেষ্টা চলছে: কার্গো ভিলেজের আগুন পরিদর্শনে উপদেষ্টা
- রিশাদ ম্যাজিক স্পিনে উড়ে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ
- ঢাকার বিমানবন্দর অচল: ভয়াবহ আগুনে পুড়ছে কার্গো ভিলেজ, ৫ ঘণ্টায়ও নেভেনি
- ৪০-৪৫ দিনের রেণুবিন্দু: বিজ্ঞান বনাম কোরআন, গর্ভের শিশুর নিয়তি কখন লেখা হয়?
- চিকিৎসা বিজ্ঞানে বড় সাফল্য,রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখবে কৃত্রিম কিডনি
- সিইসি: ‘বিগত দিনের মতো নির্বাচন হবে না, হবে সম্পূর্ণ আলাদা’
- বিলাসবহুল জীবন থেকে জনকল্যাণ: দুবাইয়ের রাজকন্যা শেখ মাহরার যত কীর্তি
- সিন্ধু সভ্যতা থেকে পরমাণু পাকিস্তান: প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ভূরাজনীতি, ধর্ম ও টিকে থাকার পূর্ণাঙ্গ আখ্যান
- রক্ত দেওয়ার সময় আমরা, ক্ষমতার সময় অন্যেরা: হাসনাত আবদুল্লাহ
- শখের পোশাক বারবার ধোয়ার পরেও উজ্জ্বল থাকবে যে ৮ উপায়ে
- টেলিগ্রাম নিয়ে ভয়াবহ তথ্য! আপনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কি ঝুঁকিতে?
- জুলাই সনদ সইয়ের মতো অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে এগোই: মির্জা ফখরুল
- অভিভাবকতন্ত্রের প্রলোভন: জেনারেল ভূঁইয়ার বয়ান ও গণতন্ত্রের ঘড়ি থামানোর বিপদ
- আগুন নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা: বাড়ছে আগুনের তীব্রতা,সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বিমান
- যুদ্ধবিরতির ভয়াবহ লঙ্ঘন: গাজায় এক ফিলিস্তিনি পরিবারের ১১ সদস্য নিহত
- বদহজম ও গ্যাসের সমস্যা? মুক্তি দেবে এই ৮টি ঘরোয়া টোটকা
- মাইগ্রেনের সমস্যা: যে ৬টি অভ্যাস আজই আপনাকে পরিবর্তন করতে হবে
- হিটলার কেন ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছিলেন? নেপথ্যের কারণ কী?
- বিনিয়োগকারীদের আস্থায় ভর করে চাঙ্গা রাজধানীর শেয়ারবাজার
- ফ্রান্স: সভ্যতা, প্রজাতন্ত্র ও মানবমুক্তির দীপ্ত ইতিহাস
- পূর্বাচল প্লট অনিয়ম মামলা: শেখ হাসিনা ও পরিবারের বিরুদ্ধে পাঁচজনের সাক্ষ্য
- ১৩ অক্টোবরের ডিএসই লেনদেনে শীর্ষ গেইনার তালিকা প্রকাশ
- জায়ান-শমিতকে নিয়েই একাদশ, বেঞ্চে বসলেন দলের অন্যতম তারকা
- সাবধান! আপনার হোয়াটসঅ্যাপ কি অন্য কেউ ব্যবহার করছে? বুঝবেন যেভাবে
- শি জিনপিং: সমাজে প্রকৃত সমতা চাইলে নারীর নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে হবে
- খাবার খেয়েই বসে আছেন? এটি হতে পারে ধূমপানের মতোই মারাত্মক অভ্যাস
- মাইগ্রেন কি শুধু মাথাব্যথা? জেনে নিন এর ৫টি ভিন্ন ধরন
- আজ বাংলাদেশের বাঁচা-মরার লড়াই, টিভিতে নয় ২৫ টাকায় দেখুন অনলাইনে
- ১৪ অক্টোবরের ডিএসই লেনদেনে শীর্ষ গেইনার তালিকা প্রকাশ
- পরমাণু ইস্যুতে কঠোর ইরান: আইএইএ-এর সঙ্গে চুক্তি স্থগিত, কারণ কী?
- শিক্ষক আন্দোলনের মোড়বদল: ‘লংমার্চ টু যমুনা’ স্থগিত, নতুন কর্মসূচি ঘোষণা
- শীতকাল আসছে: সুস্থ থাকতে এখনই বর্জন করুন এই ৫টি অভ্যাস