কেন কাঁঠাল হল বাংলাদেশের জাতীয় ফল? জানুন ঐতিহ্য ও বিজ্ঞান

জীবনযাপন ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ০২ ১৭:৪৮:১৯
কেন কাঁঠাল হল বাংলাদেশের জাতীয় ফল? জানুন ঐতিহ্য ও বিজ্ঞান

বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় ফলজগতের মধ্যে শতাধিক ফলের বাহারে বিশেষভাবে একটিকে জাতীয় ফল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে কাঁঠাল। বাংলাদেশের জাতীয় ফল হিসেবে কাঁঠাল নির্বাচনের পেছনে রয়েছে জটিল ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও পুষ্টি-সম্পর্কিত বিবেচনা, যা কেবল একটি ফলের মর্যাদা নয়, বরং দেশের প্রকৃতি ও মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে এর গভীর সম্পর্ক প্রতিফলিত করে।

বিশ্বব্যাপী জাতীয় ফলের প্রেক্ষাপট ও কাঁঠালের অবস্থান

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতীয় ফলের নামকরণ তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও উৎপত্তির ইতিহাসের ওপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা দু’দেশই কাঁঠালকে নিজেদের জাতীয় ফল হিসেবে ঘোষণা করেছে, যেখানে আমকে পাকিস্তান, ভারত ও ফিলিপাইন জাতীয় ফল হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক জ্ঞানভিত্তিক তথ্য অনুসারে, আমের আদি নিবাস বাংলাদেশ ও মায়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চল বলে বিবেচিত হলেও কাঁঠালের আদি নিবাস ভারতের পশ্চিম ঘাট বা ওয়েস্টার্ন ঘাট পর্বতমালা। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য, বিশেষ করে কেরালা ও তামিলনাড়ু, কাঁঠালকে তাদের রাজ্য ফল হিসেবে ঘোষণা করেছে, এবং ভারতের পক্ষ থেকে কাঁঠালের জাতীয় ফল হিসেবে দাবি এখনও পুরোদমে বহাল।

তবে কাঁঠালকে বাংলাদেশের জাতীয় ফল করার পেছনে দুই প্রধান কারণ বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়। প্রথমত, কাঁঠাল বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চেনা ও পাওয়া যায়। এটি জনসাধারণের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সহজলভ্য ফল হিসেবে স্বীকৃত। দ্বিতীয়ত, কাঁঠাল বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতি, জীবনধারা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে। বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব, পূজা, সাহিত্য, প্রবাদ-প্রতিমত ও লোকজ সংস্কৃতিতে কাঁঠালের উল্লেখ পাওয়া যায় যা দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ।

কাঁঠালের কৃষি ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য

কাঁঠাল গাছ (উদ্ভিদতত্ত্বীয় নাম: Artocarpus heterophyllus) মোরেসি গোত্রভুক্ত একটি মাঝারি আকারের ফলদায়ী গাছ। এর ডালে সাদা, ঘন ও দুধের মতো আঠালো পদার্থ প্রবাহিত হয়, যা গাছের বিভিন্ন প্রাকৃতিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। বসন্তকালে গাছের ডালে ‘মুছি’ বা পুষ্পমঞ্জরি ফোটে, যেখানে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল আলাদা মঞ্জরিতে থাকে। গাছের পাতা ও ডাল নানা ধরনের কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যে ভরপুর, যা বনজগতের জন্য উপকারী। কাঁঠালের গায়ে যে কাঁটা থাকে তার সংখ্যার সমান সংখ্যক ফুলও থাকে, কিন্তু সব ফুল ফল হয়ে ওঠে না।

বাংলাদেশের গাজীপুরের শ্রীপুর এলাকা ‘কাঁঠালের রাজধানী’ নামে পরিচিত। এখানে বিভিন্ন জাতের কাঁঠালের চাষ হয়, যেমন:

-গলা বা রসা কাঁঠাল: নরম ও রসালো কাঁঠাল, যা তাজা খেতে বিশেষ সুখাদ্য।

-রসখাজা: কিছুটা শক্ত হলেও রসযুক্ত।

-খাজা বা চাউলা: তুলনামূলক শক্ত ও কম রসযুক্ত।

পুষ্টিগুণ ও খাদ্যসংস্কৃতিতে কাঁঠালের স্থান

কাঁঠালকে ‘গরিবের মাংস’ বলা হয়। এর পুষ্টিমূল্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাঁচা কাঁঠালের তরকারি যেমন সুস্বাদু, তেমনি পাকা ফলের সুগন্ধ ও স্বাদ দারুণ। অন্যান্য ফলের তুলনায় কাঁঠালে প্রোটিনের পরিমাণ অনেক বেশি, যা সাধারণত মাছ, মাংস বা ডিমে পাওয়া যায়। কাঁঠালের বিচি (বীজ) রান্না করে, ভাজা বা শুকিয়ে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং এগুলি শক্তি ও পুষ্টির অন্যতম উৎস।

কাঁঠালের বিচি থেকে বিভিন্ন খাদ্য যেমন বেজি, ভর্তা, বাদামের মতো স্ন্যাকস তৈরি করা হয়। এছাড়া কাঁঠালের কোষ থেকে আমসত্ত্বের মতো ‘কাঁঠালসত্ত্ব’ উৎপাদিত হয়, যা বিভিন্ন মিষ্টান্ন ও পানীয় তৈরিতে ব্যবহার হয়। আধুনিক সময়ে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডের মতো দেশেও কাঁঠালের বিশেষ প্রজাতির চিপস তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

কাঁঠালের খোসা ও ভুতরো পশুর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে ভুতরোতে পেকটিন থাকে, যা জেলি তৈরিতেও সহায়ক। কাঁঠালের গাছের পাতা গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে বিখ্যাত, আর কাঠ দিয়ে আসবাবপত্র ও অন্যান্য বস্তু তৈরী করা হয়। গাছ থেকে বের হওয়া আঠালো কষ বিভিন্ন পাত্রের ছিদ্র বন্ধ করার কাজে ব্যবহৃত হয়, যা কাঁঠাল গাছকে বহুমুখী ও অর্থনৈতিকভাবে মূল্যবান করে তোলে।

সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতা

বাংলাদেশের মানুষ কাঁঠালের সঙ্গে দীর্ঘদিনের গভীর সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। কাঁঠালের উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীন সাহিত্য ও কবিতায়। যেমন, খনার বচনে ‘আমের বছর বান, কাঁঠালের বছর ধান’ এই প্রবাদ বহুল প্রচলিত। কবি নওয়াজেশ আহমদ তাঁর ‘মহাবনস্পতি’ গ্রন্থে কাঁঠালের গাছ ও ছায়ার বর্ণনা দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তুলে ধরেছেন। এছাড়াও জীবনানন্দ দাশের কবিতায় কাঁঠালের গাছের ছায়ায় ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা ফুটে ওঠে, যা বাংলার মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ও আবেগীয় দিকের প্রতিফলন।

জাতীয় ফলের মর্যাদা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

কাঁঠাল বাংলাদেশের জাতীয় ফল হওয়ার মাধ্যমে শুধু একটি ফলের মর্যাদা পায়নি, বরং দেশের কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হাজার হাজার পরিবার কাঁঠালের চাষাবাদে জড়িত, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখে।

বর্তমানে কাঁঠালের চারা উৎপাদন আধুনিক কলমপদ্ধতি ও বীজপদ্ধতির মাধ্যমে দ্রুত ফলনশীল হচ্ছে। বিশেষ করে শাখাকলম, দাবাকলম, অঙ্কুর জোড়কলমের মাধ্যমে নতুন জাতের কাঁঠাল চাষাবাদে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

বাংলাদেশে কাঁঠালকে কেন্দ্র করে কৃষি গবেষণা ও বাজারজাতকরণের উন্নতি ভবিষ্যতে দেশি ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁঠালের স্থানকে শক্তিশালী করবে। খাদ্যশিল্পে নতুন নতুন পণ্যের উদ্ভাবন কাঁঠালের জনপ্রিয়তা বাড়াবে এবং দেশের অর্থনীতিতে নতুন দিক তৈরি করবে।

সার্বিকভাবে দেখা যায়, কাঁঠাল বাংলাদেশের মাত্র একটি ফল নয়, এটি দেশের মানুষের জীবনসংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও খাদ্যাভ্যাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর বহুমাত্রিক ব্যবহার ও পুষ্টিগুণ কাঁঠালকে করে তুলেছে ‘গরিবের মাংস’ ও জাতীয় ফল হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ। এ ফলের ইতিহাস, সাংস্কৃতিক গভীরতা এবং বৈজ্ঞানিক পুষ্টিগুণ বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয়, যা আগামীতেও দেশের কৃষি ও খাদ্যসুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ