জলবায়ু পরিবর্তন

কচ্ছপের চোখে জল: সৈকত হারিয়ে যাচ্ছে, বাস্তু হারাচ্ছে প্রাণী

পরিবেশ ও জলবায়ু ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ০১ ১১:০৩:০১
কচ্ছপের চোখে জল: সৈকত হারিয়ে যাচ্ছে, বাস্তু হারাচ্ছে প্রাণী

গভীর রাতে সুরিনামের রাজধানী পারামারিবোর ব্রামস্পুন্ট সমুদ্রসৈকতে বালির নিচ থেকে সদ্য ফোটা শিশু সামুদ্রিক কচ্ছপেরা কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে আসে। তারা ছটফট করে, পাখনা ছুঁড়ে দৌড়ায় সাগরের দিকে। বহু বছর ধরে এই সৈকতেই বিপন্ন প্রজাতির লেদারব্যাক ও গ্রিন টার্টল ডিম পাড়তে আসছে, কিন্তু এখন এই জায়গাটাই বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর তারই সরাসরি প্রভাব পড়ছে এই উপকূলে। ঢেউয়ের ধারাবাহিক আঘাতে তীব্র ক্ষয় ধরে গেছে ব্রামস্পুন্টে। "হয়তো আর এক মৌসুম বাকি আছে," আফসোস করে বলেন স্থানীয় পরিবেশগাইড কিরন সোকু বালরামপার্সাদ। "তারপর হয়তো এই সৈকতটাই থাকবে না।"

দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে ছোট দেশ সুরিনাম এখন বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলবর্তী দেশের তালিকায়। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ বাস করে সমুদ্রপৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি এলাকায়।

"প্রতিদিন নিজের জমির একটা অংশ হারিয়ে যেতে দেখি," বলেন ৫৬ বছর বয়সী কৃষক গানদাত শেইন্ডারপেসাদ, যিনি ইতিমধ্যে তার ৯৫ শতাংশ চাষযোগ্য জমি সমুদ্রে হারিয়েছেন।

ক্ষয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও ব্যর্থ প্রচেষ্টা

সুরিনামের সরকার বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা করে চলেছে সাগরের ভাঙন রোধে। গণপূর্তমন্ত্রী রিয়াদ নূরমোহামেদ বলেন, "কিছু এলাকায় ৫ থেকে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত ম্যাংগ্রোভ বন আছে যা ঢেউকে ঠেকাতে সাহায্য করে। কিন্তু পারামারিবোর কাছে এই পরিমাণ মাত্র এক কিলোমিটার, যা একেবারেই অরক্ষিত।"

২০২০ সালে রাজধানীর উপকূলীয় এলাকায় ম্যাংগ্রোভ পুনর্গঠনের একটি প্রকল্প চালু হয়। ২০২২ সালে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস নিজ হাতে কাদার মধ্যে নেমে চারা রোপণ করেন এই উদ্যোগে উৎসাহ দিতে।

কিন্তু প্রকল্পের কয়েক বছর পর দৃশ্যপট সম্পূর্ণ বদলে গেছে। সমুদ্রের ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে পলিমাটি, ম্যাংগ্রোভের শিকড় উঠে এসেছে বাইরে, সব চারা মরে গেছে। প্রকল্পের প্রধান বিশেষজ্ঞ সিন্বনাথ নাকাল বলছেন, "জোয়ারের জলে সব ভেসে গেছে।" এর পেছনে নৌযান চলাচলের জন্য নদীর মোহনায় বালু খননের পাশাপাশি কৃষিজমি বানানোর জন্য ম্যাংগ্রোভ বন কেটে ফেলার মতো মানবসৃষ্ট কারণও রয়েছে।

নতুন লড়াই: বাঁধই শেষ আশ্রয়?

পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তখন সরকার নতুন কৌশলে ফিরছে— সমুদ্রতট ঘেঁষে বাঁধ নির্মাণ।একজন কৃষক বলেন, "বাঁধই আমার শেষ ভরসা। যাওয়ার আর জায়গা নেই। কিন্তু তাও জানি না, সেটা কতদিন স্থায়ী হবে।"

প্রথম ধাপে ৪.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ডাইক বা বাঁধ নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার, যা সরকার নিজস্ব তহবিল থেকেই দেবে। মন্ত্রী নূরমোহামেদ বলেন, "অনুদান চাইতে গেলে কয়েক বছর লেগে যাবে। কিন্তু আমাদের সময় নেই, আমরা ডুবে যাব।"

তবে একটি বাঁধ দিয়ে পুরো ৩৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। পুরো উপকূলজুড়ে প্রতিরক্ষামূলক বাঁধের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে—যার জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিকভাবে বিশাল বিনিয়োগ।

ভবিষ্যতের আশায় তাকিয়ে থাকা সরকার এখন সম্ভাবনা দেখছে সাগরতলের নতুন আবিষ্কৃত তেলক্ষেত্রে। ২০২৩ সালে ফরাসি কোম্পানি TotalEnergies ঘোষণা দেয়, তারা সুরিনামের উপকূলে এক বিশাল প্রকল্পে বছরে ২২০,০০০ ব্যারেল তেল উত্তোলন করবে—যার সম্ভাব্য বাজারমূল্য ১০.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

-এম জামান, নিজস্ব প্রতিবেদক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ