রেমিটেন্সে রেকর্ড, শ্রমবাজারে ধস! সমস্যা কোথায়?

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ২২ ০৮:৪৮:০২
রেমিটেন্সে রেকর্ড, শ্রমবাজারে ধস! সমস্যা কোথায়?

বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখা দিলেও, অভিবাসী কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। দেশের বৈদেশিক আয় গত এক বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়লেও, একই সময়ের মধ্যে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর হার প্রায় ২২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এই পরস্পরবিরোধী চিত্র অভিবাসন খাতে একটি গভীর কাঠামোগত সমস্যার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

রেমিট্যান্সে রেকর্ড, কিন্তু বাজার সংকুচিত

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রবাসী আয় দাঁড়িয়েছে ২,১৭৮ কোটি ডলারে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৭.৬০% বেশি। মার্চ মাসে ৩২৯ কোটি ডলার পাঠিয়ে প্রবাসীরা এক মাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্সের রেকর্ডও গড়েছে।

কিন্তু এই সাফল্যের আড়ালে রয়েছে একটি অস্বস্তিকর বাস্তবতা বিদেশে কর্মী পাঠানোর সংখ্যা কমছে। ২০২৩ সালে ১৩ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন, অথচ ২০২৪ সালে তা নেমে এসেছে মাত্র ১০ লাখ ১১ হাজারে। এক বছরের ব্যবধানে প্রায় তিন লাখ কর্মী কম পাঠানো হয়েছে, অর্থাৎ ২২ শতাংশ হ্রাস।

শ্রমবাজার সংকোচনের বাস্তবতা

বাংলাদেশের বিভিন্ন কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার কার্যত বন্ধ বা সীমিত হয়ে পড়েছে। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজার অঘোষিতভাবে বন্ধ রয়েছে। মালয়েশিয়া, যা ২০২৩ সালে রেকর্ড সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী নিয়েছিল, সেখানে এজেন্সির সিন্ডিকেট ও অতিরিক্ত জনবল পাঠানোর অভিযোগে ২০২৪ সালের ৩১ মে থেকে ভিসা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

ওমান ২০২৩ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশি কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয়, ফলে ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত মাত্র ২৪ জন কর্মী সেখানে যেতে পেরেছেন। ইতালির চিত্রও হতাশাজনক, ২০২৩ সালে যেখানে ১৬,৮৭৯ জন গিয়েছিলেন, ২০২৪ সালে তা কমে মাত্র ১,১৬৪ জনে নেমে এসেছে। দক্ষ কর্মী চাহিদা থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০ হাজার কোটা থাকলেও ২০২৪ সালে গিয়েছেন মাত্র ৩ হাজার ৩৮ জন।

এছাড়া বাহরাইন, লিবিয়া, সুদান, মিশর, মরিশাস ও ব্রুনাইয়ের মতো এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজারগুলোও বর্তমানে কার্যত বন্ধ হয়ে রয়েছে। এই বাস্তবতা দেশের জনশক্তি রপ্তানি খাতে বড় ধরনের সংকেত দিচ্ছে এবং এটি ভবিষ্যতের কৌশল নির্ধারণে গভীর মূল্যায়নের দাবি রাখে।দালাল সিন্ডিকেট ও অনৈতিক অভিবাসন চর্চার ছায়া।

বিশেষজ্ঞ ও অভিবাসনকর্মীদের মতে, এই সংকোচনের অন্যতম কারণ হলো বাংলাদেশের অভিবাসন ব্যবস্থার অনৈতিক চর্চা। মালয়েশিয়া, ওমান, ইতালি, কুয়েতসহ অনেক দেশ ফ্রি ভিসার নামে অতিরিক্ত লোক পাঠানো এবং ভুয়া আবেদন জমা দেওয়ার কারণে ক্ষুব্ধ। ফলে একের পর এক দেশ বাজার বন্ধ করে দিচ্ছে।

শাকিরুল ইসলাম, সভাপতি, ওকাপ: “ইতালিতে নাম-পরিচয়হীন কোম্পানিতে ভুয়া আবেদন পাঠানোয় ১ লাখ ১০ হাজার লোক যেতে পারেনি। এমন পরিস্থিতি মালয়েশিয়া, ওমানেও ঘটেছে।”

দক্ষতার ঘাটতি- আন্তর্জাতিক মানে প্রশিক্ষণ নয়

শুধু দুর্নীতিই নয়, অভিবাসী শ্রমিকদের দক্ষতার অভাবও প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা না থাকায় বাংলাদেশি কর্মীরা কাজ পাচ্ছেন না।

তাসনিম সিদ্দিকী, রামরু: “টিটিসিগুলোর প্রশিক্ষণ আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে ছয় মাসের নিচে প্রশিক্ষণ গ্রহণযোগ্য না হলেও আমাদের এখানে তিন মাসের কোর্স চলে।”

সৌদি আরব ও কাতার- সংখ্যা বাড়লেও সংকটও বেড়েছে

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবে ২০২৪ সালে প্রায় ৬ লাখ ৩০ হাজার শ্রমিক পাঠানো হয়েছে, কিন্তু কাজের অভাব ও বৈধতার জটিলতায় বহু শ্রমিক বেকার অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।

একই পরিস্থিতি কাতারেও ৭৪ হাজার ৪২২ জন গিয়েছেন ২০২৪ সালে, কিন্তু বহু শ্রমিক কাজ না পেয়ে দেশে ফিরে এসেছেন।

নতুন বাজারে অগ্রগতি নেই

রাশিয়া, রোমানিয়া, পোল্যান্ড, লাওস, তুরস্ক, নর্থ সাইপ্রাসের মতো নতুন সম্ভাব্য বাজারে বাংলাদেশ সরকার উদ্যোগী হলেও দৃশ্যমান অগ্রগতি খুবই সীমিত। অনেক দেশে এমওইউ (সমঝোতা স্মারক) না থাকার কারণে শ্রমিক পাঠানো জটিল হয়ে পড়েছে।

সরকারি অবস্থান ও প্রতিশ্রুতি

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবদুল হাই স্বীকার করেছেন নীতিগত দুর্বলতার কথা। তিনি জানিয়েছেন- “আমাদের পলিসিগত দুর্বলতা রয়েছে। অনেক দেশের সঙ্গেই এমওইউ নেই। এগুলো সমাধান করতে পারলে বাজার বড় হবে।” তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সরাসরি শ্রমিক আবেদন প্রক্রিয়া থাকলে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করা যেত।

সমাধান কী হতে পারে?

বাংলাদেশের শ্রমবাজার সংকোচনের বর্তমান বাস্তবতা থেকে উত্তরণের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধান সামনে এসেছে। প্রথমত, দক্ষতা উন্নয়নের দিকটি জোরদার করা জরুরি। দেশের কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোকে (TTC) আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে। বর্তমানে প্রচলিত তিন মাসের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের পরিবর্তে বাস্তবভিত্তিক ও গভীর ছয় মাসব্যাপী কোর্স চালু করা প্রয়োজন, যাতে শ্রমিকরা বৈশ্বিক চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, অভিবাসন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দালাল সিন্ডিকেট ও ভুয়া কোম্পানির মাধ্যমে অতিরিক্ত বা অযোগ্য জনবল পাঠানো বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অপরিহার্য। এটি শ্রমবাজারে বাংলাদেশের সুনাম পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।

তৃতীয়ত, নতুন শ্রমবাজার খোঁজা ও কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, লাওস, নর্থ সাইপ্রাসের মতো দেশে এমওইউ স্বাক্ষর করে শ্রমিক পাঠানোর পথ সুগম করা যেতে পারে। একই সঙ্গে এসব দেশের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা উন্নয়নেও জোর দিতে হবে।

চতুর্থত, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। একটি কেন্দ্রীয় ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু করলে নিয়োগপ্রাপ্তি, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা যাচাই, ভিসা ও বিদেশ যাত্রাসহ পুরো অভিবাসন প্রক্রিয়াটি ট্র্যাকযোগ্য ও স্বচ্ছ হবে। এই আধুনিকীকরণ অভিবাসী শ্রমিকদের হয়রানি কমাবে এবং বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নত করবে।

রেমিট্যান্সের প্রবাহ যে গতিতে বাড়ছে, তা অর্থনীতির জন্য স্বস্তিদায়ক হলেও, শ্রমবাজার সংকোচন ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ সংকেত। স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক লাভের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বিনিয়োগ, দক্ষতা উন্নয়ন, রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতা এবং অভিবাসন ব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার এখন সময়ের দাবি।

বাংলাদেশকে প্রবাসী আয়ের উপর নির্ভরশীল অর্থনীতি থেকে দক্ষ মানবসম্পদের উপর ভিত্তি করে টেকসই অভিবাসন অর্থনীতির দিকে যাত্রা শুরু করতে হবে এখনই।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ