সম্পাদকীয়

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান: রাষ্ট্র নির্মাণের এক উজ্জ্বল প্রতিমূর্তি

মঈন জামান
মঈন জামান
সম্পাদক
২০২৫ মে ৩০ ০০:২০:১৭
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান: রাষ্ট্র নির্মাণের এক উজ্জ্বল প্রতিমূর্তি

৩০ মে—এই তারিখটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক শোকগাথা, এক বেদনাবিধুর অধ্যায়। ১৯৮১ সালের এই দিনে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে এক দেশি-বিদেশি চক্রান্তের শিকার হয়ে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের হাতে শহীদ হন একজন কিংবদন্তি রাষ্ট্রনায়ক—স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার এবং বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।

আজ, তাঁর ৪৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে যখন আমরা ফিরে দেখি তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপ—তখন চোখে পড়ে এক অনন্য জীবনের গাঁথা, যা শৈশবের নিরবতা থেকে শুরু হয়ে পৌঁছায় রাষ্ট্রনায়কত্বের চূড়ান্ত শিখরে। তাঁর শাহাদাৎ শুধু একজন রাষ্ট্রনায়কের জীবনাবসান নয়—এ ছিল আত্মনির্ভর, মর্যাদাশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের সেই স্বপ্নের মৃত্যু, যার রূপকার তিনি নিজেই।

শৈশব, শিক্ষা ও সামরিক যাত্রার সূচনা

১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি, বগুড়া জেলার গাবতলী থানার অন্তর্গত বাগবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন জিয়াউর রহমান। তাঁর জন্ম হয় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। পিতা মনসুর রহমান ছিলেন একজন উচ্চশিক্ষিত ও সম্মানিত সরকারি কেমিস্ট, যিনি কর্মরত ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতাতে।

জিয়ার শৈশব কাটে মূলত গ্রামবাংলার সহজ-সরল পরিবেশে। গ্রামীন জীবনের সরলতা, আত্মীয়তা, সংস্কার ও বাঙালিয়ানার গভীর ছোঁয়া তাকে একটি দৃঢ় মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। তাঁর মা জাহানারা খাতুন ছিলেন ধর্মভীরু, স্নেহময়ী এবং শিক্ষানুরাগী নারী, যিনি পুত্রের চারিত্রিক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

পিতার বদলির কারণে তিনি পরবর্তীতে চলে যান কলকাতা, এবং সেখান থেকেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। এরপর পরিবার চলে যায় করাচি, যেখানে জিয়া মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা শেষ করেন। তরুণ বয়সেই তাঁর মধ্যে নেতৃত্ব, শৃঙ্খলা ও কর্তব্যবোধের প্রবল প্রকাশ দেখা যায়।

সামরিক জীবন: কঠোর অনুশীলন থেকে নেতৃত্বে উত্তরণ

১৯৫৩ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি (পিএমএ), কাকুল-এ ভর্তি হন। কঠোর অনুশীলন, একাগ্রতা ও শৃঙ্খলাবোধের মাধ্যমে ১৯৫৫ সালে তিনি কমিশন প্রাপ্ত হন। তাঁর সামরিক ক্যারিয়ার শুরু হয় সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে, কিন্তু দ্রুতই দক্ষতা, অধ্যবসায় ও সাহসিকতার মাধ্যমে তিনি সিনিয়র অফিসারদের আস্থা অর্জন করেন। তিনি ছিলেন নিরলস প্রশিক্ষক, বলিষ্ঠ কৌশলবিদ এবং একটি মিশন-ভিত্তিক ক্যারিয়ারের ধারক।

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে জিয়াউর রহমান ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তাঁর নেতৃত্বে কোম্পানিটি সীমান্ত যুদ্ধক্ষেত্রে যে সাহসিকতা দেখায়, তা আজও স্মরণীয়। তিনি শত্রুপক্ষের একাধিক আক্রমণ প্রতিহত করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে সেরা কোম্পানি হিসেবে নিজ ইউনিটকে প্রতিষ্ঠা করেন। এই অসাধারণ সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি একটি বিশেষ পিস্তল উপহার পান—যা তাঁর সাহস, দূরদৃষ্টি এবং কৌশলগত দক্ষতার প্রতীক হয়ে ওঠে। তাঁর অধীনস্থ সৈনিকেরা আজও তাঁকে একজন নেতার আদর্শ রূপ হিসেবে স্মরণ করেন।

১৯৭১: স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গভীর রাতে পূর্ব পাকিস্তানের ঘুমন্ত, নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালীদের উপর বর্বর হামলা চালিয়ে হত্যা ও মানুষের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতি শুরু করলে জিয়া দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যুদ্ধে পরাজিত হলে নির্ঘাত মৃত্যু জেনেও সেদিন দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন। স্ত্রী- সন্তানদের জীবন বিপন্ন হতে পারে জানা সত্তেও জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করার জন্য নিজ নামে জেড ফোর্স গঠন করেন। ২৬ মার্চ ভোররাতে তিনি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘোষণা দেন— “আমি মেজর জিয়া বলছি, আমি বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।” এই ঘোষণা ছিল প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক মুক্তিযুদ্ধের ডাক—যা দেশের জনগণকে সংঘবদ্ধ করে, সাহস জোগায়, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে ১নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে বিরত্বপুর্ণ অবদান রাখেন। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হলে লাল সবুজের পতাকায় শোভিত স্বাধীন দেশে তিনি পুনরায় সেনাবাহিনীতে ফিরে যান এবং ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান সরকার জিয়াউর রহমানকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করেন।

ক্ষমতার কেন্দ্রে 'প্রেসিডেন্ট জিয়া'

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সংঘটিতট্রাজেডির পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর ক্যু ও পাল্টা ক্যুর মাধ্যমে দেশ যখন চরম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সংকটে নিপতিত তখন জিয়াউর রহমান আবার দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লব ও সংহতির মধ্যদিয়ে তিনি গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্ত হয়ে জনগনের আশা আকাংখার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রশ্নাতীত জনপ্রিয়তা ও গ্রহনযোগ্যতা তাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পাদপিঠে আসীন করে। জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহন করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালের ২৩ জুন একটি অবাধ, সুষ্ঠ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানিকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

বাংলাদেশ বিনির্মানে'প্রেসিডেন্ট জিয়া'

একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ বিনির্মানে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কিছু গুরুত্ত্বপূর্ন অবদান তরুণ পাঠকদের জন্য নিচে তুলে ধরা হলোঃ

রাষ্ট্রব্যবস্থার পুনর্গঠন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা:

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং পরবর্তী সেনা অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও সাংবিধানিক সংকটের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রযন্ত্র কার্যত ভেঙে পড়ে। জনগণ, প্রশাসন, এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যেও চরম অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে সর্বাগ্রে কাজ শুরু করেন রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক কাঠামোর পুনর্গঠনের দিকে। তিনি সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, শৃঙ্খলিত ও পেশাদার বাহিনী হিসেবে পুনর্গঠন করেন এবং প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্ত অংশকে চিহ্নিত করে দুর্নীতি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। একইসাথে, গ্রাম পর্যায়ে প্রশাসনকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি স্থানীয় সরকার কাঠামোকে গণমুখী করে তোলেন। গ্রামের মানুষের অধিকতর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শহীদ জিয়া ১৯৭৬ সালে ভিডিপি বা গ্রাম প্রতিরক্ষা দল গঠন করেন। সেদিনের সেই বাহিনী আজ গ্রামীন জনগোষ্ঠীর শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা:

স্বাধীনতার পরে একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় গণতন্ত্র প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী তৎকালীন সরকার সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল তথা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করে। মাত্র ৪টি পত্রিকা রেখে সকল পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে। বাকশাল প্রবর্তনে রুষ্ঠ সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনে ব্যাকুল ছিল। রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান সংশোধন করে পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন। জিয়াউর রহমান জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল প্রথা বাতিল করে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন। গণমাধ্যমের উপর থেকে সকল কালাকানুন প্রত্যাহার করে মুক্ত স্বাধীন গণমাধ্যম চালু করেন। শহীদ জিয়া ক্ষমতায় এসে প্রথম যে কাজটি করেন তা হলো—গণতন্ত্রকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা। তিনি রাজনৈতিক দল গঠনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন এবং সকল মত ও পথের মানুষের জন্য রাজনীতির দ্বার খুলে দেন। ১৯৭৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে তিনি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ফের সক্রিয় করে তোলেন। তাঁর সময়েই প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), যা একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের চেহারা পায় এবং বহুদলীয় রাজনৈতিক কাঠামোর ভিত শক্ত হয়।

কৃষি বিপ্লব ও খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন:

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি ছিল কৃষি। জিয়াউর রহমান এই সত্য অনুধাবন করে কৃষিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন। তাঁর শাসনামলে খাল খনন কর্মসূচির মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা হয়। গ্রামে-গ্রামে খাল খনন করে শুকনো মৌসুমে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করা হয়। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সালের মে মাস পর্যন্ত সারা দেশে দেড় হাজারের বেশি খাল খনন করা হয়। দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ হাজার কিলোমিটার খাল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খনন ও পুনঃখনন করা হয়। আর এ খাল খননের সরাসরি প্রভাব পড়েছিল কৃষিতে। এটা অপেক্ষাকৃত স্বল্পমূল্যের সেচসুবিধা ছিল কৃষকদের জন্য। ফলে অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যয় বহন করতে হয়নি কৃষকদের। শুধু সেচের আওতায় বৃদ্ধি নয়, গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচন ও খাদ্য সহায়তারও পথ খুলে দিয়েছিল খাল খনন কর্মসূচি। কার্যত খাল খনন কর্মসূচি একসঙ্গে অনেক সাফল্য অর্জনের একটি পরিকল্পিত কর্মসূচি ছিল। এর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। একইসাথে কৃষকদের জন্য সার, উন্নতমানের বীজ, কৃষি যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সহজলভ্য করা হয়। কৃষকদের উৎসাহিত করতে শুরু হয় প্রণোদনা কার্যক্রম। এই উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে একদিকে খাদ্য উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানির প্রয়োজন হ্রাস পেয়ে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যায়।

কৃষক যেন শস্য সংগ্রহের সময় তার ফসল বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেজন্য তিনি ১৯৭৮ সালে শস্য গুদাম ঋণ কর্মসূচি গ্রহণ করেন। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য খাদ্যের আপদকালীন মজুত গড়ে তোলার ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। কৃষকদের শস্য উৎপাদনে উৎসাহিত করতে তিনি ভালো দামে তাদের কাছ থেকে সরাসরি ধান-চাল ক্রয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। জিয়ার শাসনামলে ১৯৮০-১৯৮১ অর্থবছরে ধান/চাল সংগ্রহ অভিযানে রেকর্ড পরিমাণ (১.০৩ মিলিয়ন টন) চাল সংগ্রহ করা হয় (শাহাব উদ্দিন ও ইসলাম, ১৯৯১)। তার শাসনামলেই ধানের বাম্পার ফলনের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রথম চাল রপ্তানি করা হয়। তার গৃহীত কর্মসূচি ও নীতিমালার সুফল মাত্র দুই বছরের মধ্যেই দেশের মানুষ পেতে শুরু করেছিল; যা দেশের সবুজ বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল।

বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন:

একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে শুধু ভাষাভিত্তিক ‘বাঙালি’ পরিচয়ে রাষ্ট্রীয় আদর্শকে সীমাবদ্ধ না রেখে, তিনি ভূখণ্ড, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সকল নাগরিকের পরিচয়ের ভিত্তিতে “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” দর্শনের প্রবর্তন করেন। এটি ছিল এক ধরনের অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রীয় চেতনা, যেখানে হিন্দু, মুসলিম, উপজাতি, বাঙালি ও অন্যান্য সকল ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠী রাষ্ট্রের সমান নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্রীয় পরিচয় হতে হবে ভূখণ্ডনির্ভর, জাতিগত নয়। এই দর্শনই বহুদলীয় গণতন্ত্র, সাম্প্রদায়িক সহনশীলতা এবং জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি গড়ে দেয়।

অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন পরিকল্পনা:

অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়—এই বিশ্বাস থেকেই জিয়া ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি সড়ক ও মহাসড়ক নির্মাণ, সেতু নির্মাণ, বিদ্যুৎ সরবরাহ উন্নয়ন, গ্রামীণ অবকাঠামো এবং টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসারে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর উদ্যোগে শুরু হয় নদীশাসন, খাল ও নদী পুনঃখননের বৃহৎ প্রকল্প। এর মাধ্যমে পরিবহন খাতে পরিবর্তন আসে, এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নতুন যুগের সূচনা হয়। এছাড়া উপজেলা ভিত্তিক পরিকল্পনা পদ্ধতি চালু করে তিনি প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও সমন্বিত উন্নয়নের ভিত্তি স্থাপন করেন। আজকের শিশু আগামীর রাস্ট্রনায়ক। তাইা শহীদ জিয়া শিশুদের মেধা বিকাশের জন্য ১৯৭৭ সালের ১৫ জুলাই শিশু একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ ও জনগণের দোরগোড়ায় রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা:

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা ছিল সীমিত ও শহরকেন্দ্রিক। গ্রামীণ জনপদের জনগণ ছিল প্রায় স্বাস্থ্যসেবার বাইরে। এই প্রেক্ষাপটে শহীদ জিয়া গ্রহণ করেন জনমুখী স্বাস্থ্যনীতি, যার মূল লক্ষ্য ছিল স্বাস্থ্যসেবাকে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে পৌঁছে দেওয়া। তাঁর শাসনামলে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। পাশাপাশি, তিনি টিকাদান কর্মসূচি, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা, এবং মোবাইল স্বাস্থ্যসেবা ইউনিট চালু করেন, যা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের জন্য স্বাস্থ্যসেবাকে সহজলভ্য করে তোলে। চিকিৎসা ব্যবস্থাকে শুধু শহরকেন্দ্রিক হাসপাতালের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, তিনি চাইতেন প্রতিটি গ্রামে একজন প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বাস্থ্যসেবার প্রাথমিক অবকাঠামো নিশ্চিত হোক। এই উদ্যোগগুলোর ফলে জনগণের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং দেশের স্বাস্থ্য সূচকের উন্নয়ন ঘটতে থাকে।

শিল্প ও বাণিজ্য খাতের বিকাশ:

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের শিল্প খাত প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় ছিল। শহীদ জিয়ার সময়েই এই খাতটি বেসরকারিকরণ, বিনিয়োগ, এবং বাজারমুখী অর্থনীতির দিকে ধাবিত হয়। তিনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে ঋণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করেন। তৈরি পোশাক শিল্প, চামড়া শিল্প এবং হস্তশিল্পের প্রসারে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সহায়তা নিশ্চিত করেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে গঠন করেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড (BOI)। তাঁর সংস্কার পদক্ষেপের ফলেই পরবর্তী এক দশকে তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশে প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হয়।

শিক্ষা, যুব উন্নয়ন ও মানবসম্পদ:

মানবসম্পদ উন্নয়ন ছিল শহীদ জিয়ার আরেকটি মূল অগ্রাধিকার। তিনি মনে করতেন, “শিক্ষা হতে হবে জাতীয় উন্নয়নের সরাসরি সহায়ক শক্তি।” সে উদ্দেশ্যে তিনি কারিগরি শিক্ষা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং গ্রামীণ যুব উন্নয়ন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। নতুন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, এবং গবেষণামূলক শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে তিনি শিক্ষাকে প্রাসঙ্গিক ও বাস্তবভিত্তিক করে তোলেন। তাঁর সময়েই জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়, যেখানে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের পথ তৈরি করা হতো। যুব সমাজকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানোর জন্য ১৯৭৮ সালে তিনি দেশে প্রথমবারের মত যুব মন্ত্রনালয় চালু করেন। জেলায় জেলায় যুব কমপ্লেক্স চালু করে প্রশিক্ষনের মাধ্যমে তাদের স্বকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সাহায়্য করেন।

বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ের ভিত্তি রচনা:

বাংলাদেশের ইতিহাসে বৈদেশিক কর্মসংস্থানকে একটি সংগঠিত রপ্তানি খাতে রূপান্তর করার কৃতিত্ব শহীদ জিয়াউর রহমানের। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, দেশের বিপুল শ্রমশক্তিকে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে পাঠিয়ে শুধু বেকারত্বই হ্রাস করা যাবে না, বরং তা হতে পারে জাতীয় আয়ের একটি অন্যতম উৎস। তাঁর শাসনামলে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, লিবিয়া ও পূর্ব আফ্রিকায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়। এই কর্মসংস্থান প্রক্রিয়াকে সংগঠিত করতে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ ম্যানপাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং ব্যুরো (BMET), যা রেজিস্ট্রেশন, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা যাচাই ও বিদেশে পাঠানোর পূর্ব প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো সমন্বয় করে। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের কল্যাণে বিভিন্ন দূতাবাসে ওয়ার্কার্স উইলফেয়ার সেকশন চালু করা হয়। শহীদ জিয়ার এই উদ্যোগের ফলেই দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহের সূচনা ঘটে, যা আজ বাংলাদেশ অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। বলা যায়, তিনি ছিলেন বাংলাদেশকে শ্রম রপ্তানিকারক দেশে রূপান্তরের পথিকৃৎ।

আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও বৈশ্বিক মর্যাদা:

শহীদ জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে। তিনি ‘Bangladesh First’ নীতির ভিত্তিতে পশ্চিমা ও পূর্বপন্থী বলয়ের বাইরে থেকে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সময়েই বাংলাদেশ OIC, NAM, SAARC, এবং UN-এর বিভিন্ন ফোরামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তিনি আরব বিশ্ব, চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং বিভিন্ন সাহায্য ও বিনিয়োগ আসে।

তিনি ক্ষমতায় এসেই ইন্দে-সোভিয়েত বলয় থেকে বের হয়ে আমেরিকা ও চীনের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাতে তিনি সফলও হয়েছিলেন। তিনি তার সাহসী, চৌকস ও দূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতির কারণে মুসলিম বিশ্বের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তাঁর স্বল্প সময়ের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালে ইরাক-ইরান যুদ্ধে একক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভুমিকা পালন, আল কুদস কমিটির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়া, ফিলিস্তিন জনগণের প্রতি অবিচল সমর্থন, ওআইসিকে একটি কার্যকরি সংগঠনে পরিনত করার ক্ষেত্রে শহীদ জিয়ার ভুমিকা মুসলিম বিশ্ব আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। তিনিই মুলত মুসলিম বিশ্বে শ্রমবাজার সৃষ্টি করে সরকারিভাবে কর্মী প্রেরণ করেন। শহীদ জিয়া দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ভু-রাজনৈতিক ঐক্য সৃষ্টির জন্য সার্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহন করেছিলেন। তাই তাঁকে সার্কের স্বপ্নগ্রষ্টা বলা হয়ে থাকে।

দেশকে যখন তিনি সামনের দিকে নিয়ে চলতে শুরু করেন সেই সময়ে তার বিরুদ্ধে শুরু হয় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। ১৯৮১ সালের ২৯ মে তিনি এক সরকারি সফরে চট্টগ্রামে যান। ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে গভীর রাতে একদল সেনাসদস্য তাকে হত্যা করে। বিপথগামী সেনাসদস্যরা তার লাশ চট্টগ্রামের রাউজানের গভীর জঙ্গলে কবর দেয়। তিন দিন পর ওই লাশ উদ্ধার করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়, লাখ লাখ শোকার্ত মানুষ শেরেবাংলা নগরে তার জানাজায় শরিক হন। পরে জাতীয় সংসদ ভবন চত্বরে তাকে সমাহিত করা হয়।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও রাজনীতিকদের মধ্যে তিনিই অগ্রদূত যিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, মাঠেঘাটে, হেঁটে ছুটে বেড়িয়েছেন—কখনো লাঙল হাতে, কখনো কাস্তে হাতে; আবার কখনো কোদাল হাতে। জিয়া কৃষকের মাঠে গিয়ে কৃষকের সঙ্গে কথা বলেছেন, সমস্যা জেনেছেন, কৃষকের সঙ্গে কাজে অংশ নিয়েছেন, কৃষকদের অনুপ্রাণিত ও জাগ্রত করেছেন। অত্যন্ত সৎ, নির্লোভ ও দূরদর্শী এ রাষ্ট্রনায়কের ডাকে জনগণ সাড়া দিয়েছিল ব্যাপকভাবে। তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে খাদ্য ঘাটতির দেশ পরিণত হয়েছিল খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ হিসেবে। আর এভাবেই জিয়া একজন জনবান্ধব রাজনৈতিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদান শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়, বরং প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিটি স্তরে তার ছাপ অমোচনীয়। তিনি ছিলেন জাতির প্রয়োজনে আবির্ভূত এক বাস্তববাদী, উদ্ভাবনী ও গণমুখী নেতা। তিনি নিজের কর্ম দিয়ে প্রমাণ করেন, শুধু স্বাধীনতা অর্জন নয়—একটি রাষ্ট্রকে গঠন করা, জনগণকে স্বনির্ভর করে তোলা এবং বিশ্বমঞ্চে মর্যাদার আসনে বসানোই প্রকৃত রাষ্ট্রনায়কের কাজ। আজ, ৪৪ বছর পরেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, সিদ্ধান্ত ও উন্নয়ন দর্শন বাংলাদেশে বহুলভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি কেবল একজন নেতা নন, তিনি ছিলেন রাষ্ট্র নির্মাণের এক উজ্জ্বল প্রতিমূর্তি।প্রশ্ন একটাই—শহীদ জিয়ার অবদান, আদর্শ ও রাষ্ট্রদর্শনের উত্তরাধিকার তাঁর উত্তরসূরীরা কি সত্যিই বহন করতে পারবে?


জুলাই আন্দোলনে ভাইরাল হওয়া এক শ্রমজীবীর আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন: সুযোগের দরজা নাকি নতুন শঙ্কা?

মো:রাকিবুল ইসলাম
মো:রাকিবুল ইসলাম
সমাজবিজ্ঞান শিক্ষার্থী, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
২০২৫ নভেম্বর ২১ ১৯:৩৮:২৭
জুলাই আন্দোলনে ভাইরাল হওয়া এক শ্রমজীবীর আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন: সুযোগের দরজা নাকি নতুন শঙ্কা?

জুলাই আন্দোলনের সময় ভাইরাল হওয়া এক রিকশাচালককে আগামী জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার ঘটনাটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, শ্রেণি-বাস্তবতা এবং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কাঠামো নিয়ে এক নতুন আলোচনার সূত্রপাত করেছে। প্রথম দৃষ্টিতে এটি গণতান্ত্রিক অন্তর্ভুক্তির এক চমৎকার উদাহরণ বলে মনে হতে পারে, যেখানে একজন প্রান্তিক মানুষ রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি আরও গভীরভাবে বিচার করলে দেখা যায়, এই প্রতীকী অন্তর্ভুক্তি কেবল সুযোগ নয়, বরং নতুন ধরনের সামাজিক ও নৈতিক শঙ্কাও তৈরি করে।

বাংলাদেশের রাজনীতি ঐতিহাসিকভাবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত এলিট শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে ছিল। শ্রমজীবী মানুষ বা নিম্ন আয়ের শ্রেণি সাধারণত রাজনীতির ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও, নেতৃত্বের জায়গায় তারা প্রায় অনুপস্থিত। এই প্রেক্ষাপটে একজন রিকশাচালকের মনোনয়ন নিঃসন্দেহে প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাইরে এক নতুন বার্তা বহন করে। এটি দেখায় যে, গণতন্ত্রের ক্ষেত্রটি এখন কেবল অর্থবান ও প্রভাবশালীদের জন্য নয়, বরং সাধারণ মানুষের প্রতিও কিছুটা উন্মুক্ত হচ্ছে।

তবে, বাস্তবতা আরও জটিল। একজন শ্রমজীবী মানুষ, যার দৈনন্দিন জীবন নির্ভর করে অল্প আয়ের ওপর, হঠাৎ করে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে চলে গেলে তার জীবনে যে চাপ তৈরি হয় তা কল্পনা করা কঠিন নয়। রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, সামাজিক প্রত্যাশা এবং অর্থনৈতিক টানাপোড়েন মিলিয়ে সে এমন এক অচেনা বাস্তবতায় পড়ে যায়, যেখানে তার পুরনো জীবনের স্থিতি ভেঙে যায়। ফলে, যে মানুষটি সমাজের প্রতিনিধি হওয়ার কথা ছিল, সে হয়ে যায় রাজনৈতিক প্রতীক বা প্রচারণার উপকরণ।

এই প্রতীকীকরণ প্রক্রিয়াই আসলে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। প্রান্তিক মানুষের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায়ন ও সামাজিক উন্নয়নের পথ তৈরি করে। কিন্তু যখন তাদের কেবল ভোট বা প্রচারের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তখন এটি হয়ে দাঁড়ায় একধরনের প্রতারণা। এই প্রক্রিয়ায় প্রান্তিক মানুষ রাজনীতিতে প্রবেশ করলেও প্রকৃত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তার হাতে থাকে না। আর্থিক অনিশ্চয়তা, সামাজিক চাপ, এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝুঁকি তার জীবনে নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি করে।

অন্যদিকে, গণতন্ত্রের মূল দর্শনই হলো অংশগ্রহণের সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা। তাই একজন দরিদ্র মানুষ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারছে, এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক অগ্রগতি। কিন্তু এই সুযোগ তখনই বাস্তব ক্ষমতায় রূপ নেবে, যখন তাকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, আর্থিক সহায়তা, নিরাপত্তা এবং সাংগঠনিক সহায়তা প্রদান করা হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সত্যিই প্রান্তিক শ্রেণিকে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়, তবে তাদের কেবল মনোনয়ন নয়, বরং ক্ষমতায়নের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

এই ঘটনাটি আমাদের সামনে আরও বড় প্রশ্ন তোলে: বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা কি সত্যিই গণতান্ত্রিক হচ্ছে, নাকি কেবল তার প্রতিচ্ছবি তৈরি করা হচ্ছে? একজন শ্রমজীবীর মনোনয়ন গণতন্ত্রের মুখে মানবিক রঙ যোগ করলেও, যদি তার বাস্তব ক্ষমতা, সুরক্ষা ও মর্যাদা নিশ্চিত না হয়, তবে এটি কেবল রাজনৈতিক প্রতারণার আরেক রূপ।

একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দরিদ্র মানুষ শুধু ভোটার নয়, নীতিনির্ধারকও হয়। কিন্তু সেই বাস্তবতা তৈরি করতে হলে দরকার রাজনৈতিক সংস্কৃতির মৌলিক পরিবর্তন, যেখানে আর্থিক সক্ষমতা নয়, যোগ্যতা ও সামাজিক অভিজ্ঞতা হবে নেতৃত্বের মানদণ্ড।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রান্তিক মানুষের অংশগ্রহণ নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিতে পারে, যদি তা প্রকৃত সহায়তা ও নৈতিক দায়বদ্ধতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়। অন্যথায় এই অন্তর্ভুক্তি হয়ে উঠবে সাময়িক উচ্ছ্বাসের প্রতীক, যার অন্তর্গত বাস্তবতা আরও নির্মম।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কি সত্যিকারের অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র চাই, নাকি কেবল তার প্রতীকী উপস্থাপনেই সন্তুষ্ট থাকতে চাই?


কাদিয়ানী ইস্যু ও পাকিস্তানি সংযোগ: বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনীতিতে বিপজ্জনক অস্থিরতার ইঙ্গিত

আসিফ বিন আলী
আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
২০২৫ নভেম্বর ১৪ ২১:০৬:৪৯
কাদিয়ানী ইস্যু ও পাকিস্তানি সংযোগ: বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনীতিতে বিপজ্জনক অস্থিরতার ইঙ্গিত

বাংলাদেশে আহমদিয়া কমিউনিটি সংখ্যায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র। আনুমানিক এক লাখ সদস্যের এই গোষ্ঠী দেশব্যাপী সামাজিক পরিসরে এতটাই অদৃশ্য যে অধিকাংশ সাধারণ নাগরিকের ব্যক্তিগত নেটওয়ার্কে তাদের কাউকে পাওয়া যায় না। ফলে যে সমাজে তাদের অস্তিত্বই প্রায় অদৃশ্য, সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে আন্দোলন শুরু হওয়া স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের জন্ম দেয়। কেন এই ইস্যুটি স্থানীয় বাস্তবতা ছাড়াই এমনভাবে সামনে আনা হলো এবং কারা এর পিছনে সংগঠিতভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৫ নভেম্বর যে আন্তর্জাতিক খতমে নবুওয়ত মহাসম্মেলন হতে যাচ্ছে, তা আয়োজন করছে সম্মিলিত খতমে নবুওয়ত পরিষদ নামে একটি সংগঠন। কওমি ধারার আলেমদের একটি অংশ, হেফাজতপন্থী গোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিকভাবে উগ্রপন্থি মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত কিছু ব্যক্তিরা এই আয়োজনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। তারা অনলাইন এবং অফলাইনে ব্যাপকভাবে প্রচার চালাচ্ছে এবং দাবি তুলছে যে বাংলাদেশে কাদিয়ানি বা আহমদিয়া সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে। বাংলাদেশের ধর্মীয় সংস্কৃতি, সামাজিক সহাবস্থান এবং ঐতিহ্যের আলোকে এই দাবির কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। বরং এটি একটি সংগঠিত রাজনৈতিক পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয়।

এরই মধ্যে ১২ নভেম্বর ঢাকার একটি হোটেলে ইন্তিফাদা বাংলাদেশ আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকের ভিডিও ও ছবি সমাজমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বৈঠকের আয়োজক ও বক্তাদের মধ্যে কয়েকজন পরিচিত আল কায়েদা ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন, যাদের কাউকে দেখা গেছে ৫ আগস্টের পর থানায় অবরোধ, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি এবং প্রথম আলো অফিস ঘেরাওয়ের মতো ঘটনাগুলোতেও। এছাড়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতা জসীমউদ্দিন রহমানীর সঙ্গেও এই গোষ্ঠীর যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে। এই উপস্থাপনাগুলো দেখায় যে দেশের অভ্যন্তরে একটি চরমপন্থি নেটওয়ার্ক পুনরায় সংগঠিত হচ্ছে এবং তারা কাদিয়ানী ইস্যুকে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরির সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে।

এই সম্মেলনে অংশ নিতে পাকিস্তান, ভারত এবং নেপাল থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উলামা বাংলাদেশে এসেছেন। সবচেয়ে আলোচিত নাম হলো পাকিস্তানের জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সংগঠনের সভাপতি ও সংসদ সদস্য মাওলানা ফজলুর রহমান, যিনি পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর সঙ্গে এসেছেন মহাসচিব মাওলানা আবদুল গফুর হায়দারি, মাওলানা আসাদ মাহমুদ এবং আরও কয়েকজন প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা। এছাড়াও রয়েছেন রাওয়ালপিন্ডি, করাচি ও পাঞ্জাবের বিভিন্ন মাদ্রাসার উচ্চপদস্থ শিক্ষক ও বক্তারা। এই ব্যক্তিদের অনেকের বিরুদ্ধেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও মার্কিন ডিপ স্টেটের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ইমরান খানের পতনের সময়ও ধর্মীয় আবেগকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে উঠেছিল। বিশেষ করে পাঞ্জাবের বক্তা মাওলানা ইলিয়াস গুম্মান শিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অব্যাহত বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের জন্য কুখ্যাত।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তরণের এমন সংবেদনশীল মুহূর্তে এইসব বিতর্কিত ব্যক্তিরা কেন একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রচারণায় অংশ নিতে এসেছেন। তাদের এই আগমন মোটেই নিরীহ বা সাধারণ কোনো ধর্মীয় সফর নয়। বরং এটি ইঙ্গিত দেয় যে দেশে অস্থিরতা তৈরিতে ধর্মীয় পরিচয়কে ব্যবহার করা হতে পারে এবং এর পেছনে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক স্বার্থ সক্রিয় থাকতে পারে।

পাকিস্তানের ইতিহাস এই বিষয়ে এক ভয়াবহ শিক্ষা দেয়। দেশটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আহমদিয়া ইস্যু সেখানে বারবার রাজনৈতিক সংকট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৫৩ সালের লাহোর দাঙ্গা ছিল আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে প্রথম বড় আকারের সহিংসতা, যা Munir Commission Report-এর মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে এটি কোনো স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ছিল না, বরং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলোর প্ররোচনায় সংঘটিত হয়। এরপর ১৯৭৪ সালে আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করা এবং ১৯৮৪ সালে Ordinance XX জারি করা হয়। প্রতিটি ঘটনা ছিল সামরিক বা আধা-সামরিক শক্তিগুলোর রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের কৌশল।

মুফতি মাহমুদ, যিনি মাওলানা ফজলুর রহমানের পিতা, ভুট্টো সরকারের বিরুদ্ধে কাদিয়ানী ইস্যুকে ব্যবহার করেছিলেন এবং পাকিস্তানে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছিলেন। আজ তাঁর পুত্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময়ে একই ধরনের ইস্যু নিয়ে ঢাকা সফর করছেন। এটি নিছক ধর্মীয় সফর নয়, বরং পাকিস্তানের অতীত অভিজ্ঞতার ভৌতিক পুনরাবৃত্তি।

বাংলাদেশেও এ কৌশল নতুন নয়। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর যখন গণতান্ত্রিক পথচলা শুরু হয় এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়, তখনই ১৯৯১ সালে আহমদিয়া বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত হয়। খুলনা, রাজশাহীসহ নানা স্থানে হামলা এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়। এর ফলে নবীন সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চাপের মুখে পড়ে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এইবারও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থার কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে সরকার শুরুতে এই সম্মেলনকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। তাদের মনোযোগ এখন নির্বাচন নিয়ে বেশি, এবং হয়তো সমাবেশের ভূরাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে তারা অবহিত ছিলেন না। কিন্তু এখন যেহেতু বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে, সরকারের দায়িত্ব হলো বিদেশি উগ্র মতাদর্শধারী ব্যক্তিদের যেকোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করা। এমন আন্দোলন ও বিদেশি উলামাদের রাজনৈতিক ভূমিকা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য গভীর নিরাপত্তা সংকট তৈরি করতে পারে।

বাংলাদেশ একটি বহুধর্মীয়, সহনশীল এবং মানবিক সমাজ। এখানে ধর্মীয় সহাবস্থান ঐতিহাসিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক। অথচ এখন সেই পরিবেশে বিদেশি প্রভাব ও উগ্র মতাদর্শ প্রবেশ করে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে চাইছে। কাদিয়ানী ইস্যু বাংলাদেশের জন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আলোচ্য বিষয় নয়। এটি মূলত আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক স্বার্থ ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার একটি কৃত্রিম কৌশল। বাংলাদেশের উচিত এখনই সচেতন হওয়া, কারণ ধর্মকে রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের পরিণাম কখনোই শুভ হয় না। পাকিস্তানের ইতিহাসই এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। বাংলাদেশ সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে পারে না এবং করা উচিতও নয়। এখন রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের উচিত সম্মিলিতভাবে এই ধরনের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্থান নেওয়া।


ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গড়তে হলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা পুনরুদ্ধার করতে হবে

মো: রাকিবুল ইসলাম
মো: রাকিবুল ইসলাম
সমাজবিজ্ঞান শিক্ষার্থী, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
২০২৫ নভেম্বর ০৯ ১১:৪৫:৫৭
ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গড়তে হলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা পুনরুদ্ধার করতে হবে

রাষ্ট্রের ধারণাটি একসময় কেবল প্রশাসনিক ক্ষমতা, আইনের শাসন এবং নিরাপত্তা প্রদানের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্রের ভূমিকা এখন বহুমাত্রিক এবং জটিল। রাষ্ট্র কেবল শাসনের প্রতীক নয়, বরং এটি একটি সামাজিক ও নৈতিক সত্তা, যার মূল উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ, মর্যাদা এবং ন্যায্যতা নিশ্চিত করা। অথচ আজ আমরা এমন এক সময় পার করছি, যখন রাষ্ট্রের এই নৈতিক দায়বদ্ধতা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ক্রমশ বাজারের যুক্তি ও পুঁজির অগ্রাধিকারের সঙ্গে অদ্ভুত এক সমঝোতায় আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে রাষ্ট্রের পরিমণ্ডল নাটকীয়ভাবে পাল্টে গেছে। এখন রাষ্ট্রের সফলতা মাপা হয় জিডিপি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, অবকাঠামোগত প্রকল্প বা বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ দিয়ে। কিন্তু এই তথাকথিত উন্নয়ন সূচকগুলো প্রায়ই মানবিক উন্নয়ন বা সামাজিক ন্যায়বিচারের বাস্তব প্রতিফলন ঘটায় না। যখন একজন নাগরিক মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা বা নিরাপদ জীবনযাপনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তখন রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের যুক্তিতে রাষ্ট্র এখন প্রায়শই কর্পোরেট স্বার্থে বেশি সংবেদনশীল হয়ে পড়েছে এবং সাধারণ নাগরিকের চাহিদায় তুলনামূলকভাবে উদাসীন। এর ফলেই ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আয়-বৈষম্য বেড়েছে, সামাজিক শ্রেণি বিভাজন গভীর হয়েছে, শ্রমজীবী মানুষ তাদের পরিশ্রমের ন্যায্য মূল্য পায় না, কৃষক উৎপাদনের দাম না পেয়ে ঋণের জালে জড়ায়, শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় সেবার বাইরে থেকে যায়।

এই বৈষম্য কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি নৈতিক বৈষম্যেরও প্রতিফলন। রাষ্ট্র যখন বাজারের যুক্তিকে মানবিক দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে স্থান দেয়, তখন নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় কাঠামো এক ধরনের নৈতিক সংকটে পড়ে যায়, যেখানে উন্নয়নের অর্থ হয়ে দাঁড়ায় কেবল ধনীদের আরও ধনী হয়ে ওঠা এবং দরিদ্রদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।

রাষ্ট্রকে কেবল প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে দেখা হলে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য হারিয়ে যায়। রাষ্ট্র হলো এমন এক প্রতিষ্ঠান যার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা উচিত মানুষ, তার জীবন, মর্যাদা এবং ন্যায়বিচারের অধিকার। রাষ্ট্রের অস্তিত্বের মূল দর্শনই হলো জনকল্যাণ। একটি মানবিক রাষ্ট্র কেবল আইন প্রয়োগ করে না, বরং এটি নাগরিকদের জন্য আশ্রয়, নিরাপত্তা এবং সম্মানের নিশ্চয়তা দেয়। সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রকে বলা যায় একটি নৈতিক সম্প্রদায়, যা সমাজের দুর্বলতম ও প্রান্তিক শ্রেণির প্রতি দায়বদ্ধ। কারণ একটি সমাজের সভ্যতা বিচার করা হয় তার সবচেয়ে দুর্বল মানুষটির প্রতি আচরণের মাধ্যমে।

রাষ্ট্রের নৈতিক পুনর্জাগরণ মানে হলো রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানবিকতার চেতনায় পুনর্গঠন করা। যেখানে উন্নয়নের মানে হবে না কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ন্যায়, সংস্কৃতি, পরিবেশ এবং সমতার বিকাশ। এই দৃষ্টিভঙ্গির অভাবই আজকের রাষ্ট্রকে ধীরে ধীরে মানবিকতার শূন্যতায় ঠেলে দিচ্ছে।

একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য রাষ্ট্রকে তার দায়িত্ব নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। উন্নয়ন ও কল্যাণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় কিছু মৌলিক দিক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর কার্যকারিতা ও বিস্তৃতি বাড়াতে হবে। দরিদ্র, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, নারী ও শিশুদের জন্য কার্যকর নিরাপত্তা নেট তৈরি করা দরকার। এগুলোকে রাজনৈতিক প্রদর্শন নয়, বরং বাস্তব কল্যাণে রূপ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিকতা ও ন্যায়বোধের বিকাশ ঘটাতে হবে। মানসম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা হলো মানবিক রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি। শিক্ষা কেবল চাকরির উপকরণ নয়, এটি মূল্যবোধ, যুক্তি, সহানুভূতি ও নৈতিকতার প্রশিক্ষণ। তাই রাষ্ট্রের উচিত গবেষণা, সৃজনশীলতা ও সামাজিক চিন্তার বিকাশে বিনিয়োগ বাড়ানো, যাতে নাগরিকরা শুধু দক্ষ নয়, সচেতনও হয়।

তৃতীয়ত, স্বাস্থ্যসেবাকে নাগরিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটি মানবিক রাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবা কখনোই বাণিজ্যিক পণ্য হতে পারে না। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে, প্রান্তিক অঞ্চলে চিকিৎসক নিয়োগ ও ওষুধপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে, এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। চতুর্থত, শ্রমজীবী মানুষের জন্য ন্যায্য মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা ও সংগঠিত হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়ন তখনই অর্থবহ, যখন তা শ্রমিকের ঘামে নয়, মর্যাদায় দাঁড়িয়ে থাকে।

পঞ্চমত, রাষ্ট্রের নীতি প্রণয়নে নাগরিক অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। স্থানীয় সরকার, নাগরিক ফোরাম, যুবসংগঠন ও সিভিল সোসাইটির সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে নীতি প্রণয়ন, বাজেট বরাদ্দ ও বাস্তবায়নে। এতে জনগণ নিজেদের রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে অনুভব করবে। ষষ্ঠত, পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র মানে কেবল মানুষের ন্যায় নয়, প্রকৃতির প্রতিও দায়িত্বশীলতা।

মানবিক রাষ্ট্র কোনো আদর্শিক কল্পনা নয়, এটি টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। একটি রাষ্ট্র তখনই স্থিতিশীল ও উন্নত হয়, যখন তার নাগরিকরা বিশ্বাস করে যে তাদের জীবন রাষ্ট্রের কাছে মূল্যবান। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তখনই অর্থবহ, যখন তা সামাজিক সমতা ও মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করে। অন্যথায় রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন হয়ে ওঠে অন্যায় প্রবৃদ্ধি, যা কেবল কিছু মানুষের হাতে ক্ষমতা ও সম্পদ কেন্দ্রীভূত করে।

যখন রাষ্ট্র তার নৈতিক দায়বদ্ধতা হারায়, তখন নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক হয়ে যায় লেনদেনমূলক, আস্থাভিত্তিক নয়। মানুষ তখন রাষ্ট্রকে নিজের বলে অনুভব করে না। এই বিচ্ছিন্নতাই শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সামাজিক অসন্তোষ ও সহিংসতার জন্ম দেয়। তাই রাষ্ট্রের নৈতিক পুনর্জাগরণ প্রয়োজন তিনটি স্তরে। প্রথমত, নীতিগত স্তরে মানবিকতা, স্বচ্ছতা ও ন্যায়কে সর্বাগ্রে স্থান দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থায় জবাবদিহিতা এবং নৈতিক প্রশিক্ষণকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তৃতীয়ত, সাংস্কৃতিক স্তরে সমাজে সহানুভূতি, দানশীলতা ও সামাজিক সংহতির চর্চা বাড়াতে হবে এবং গণমাধ্যম ও সংস্কৃতির মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।

ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গঠন কোনো বিলাসিতা নয়, এটি রাষ্ট্র ও সমাজের অস্তিত্বের অপরিহার্য শর্ত। রাষ্ট্র যদি তার নৈতিক দায়িত্ব ভুলে যায়, তবে তার উন্নয়ন অবশেষে হয়ে উঠবে এক নির্মম শোষণের প্রক্রিয়া। তাই এখন সময় রাষ্ট্রের আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির। রাষ্ট্রকে ফিরতে হবে সেই মৌলিক দর্শনে, যেখানে নাগরিকই উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু, আর শাসকগোষ্ঠী কেবল সেই উন্নয়নের তত্ত্বাবধায়ক।

একটি রাষ্ট্র তখনই প্রকৃত অর্থে সফল হয়, যখন তার প্রতিটি নাগরিক বিশ্বাস করতে পারে যে এই রাষ্ট্র আমার, এই সমাজ আমার, এবং এখানে আমার জীবনের মর্যাদা আছে। ন্যায়, সমতা এবং মানবিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রই পারে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়ন ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে। রাষ্ট্রের এই নৈতিক পুনর্জাগরণই হতে পারে আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ও নৈতিক বিজয়, একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের জন্য।


গবেষণা ভিত্তিক শিক্ষা: বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এক নতুন দিগন্ত

মো. রাকিবুল ইসলাম
মো. রাকিবুল ইসলাম
সমাজবিজ্ঞান শিক্ষার্থী, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
২০২৫ নভেম্বর ০৫ ২০:৪০:০০
গবেষণা ভিত্তিক শিক্ষা: বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এক নতুন দিগন্ত

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠদান, দীর্ঘদিন ধরে পাঠ্যপুস্তকনির্ভর শিক্ষা ও পরীক্ষাকেন্দ্রিক মূল্যায়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাভাবনা এবং বাস্তব জীবনে জ্ঞানের প্রয়োগের ক্ষেত্র ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। অথচ আজকের পৃথিবী জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবননির্ভর সমাজের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যেখানে গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা হচ্ছে উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি। তাই সময় এসেছে আমাদের উচ্চশিক্ষার কাঠামো ও দর্শনকে পুনর্বিন্যাস করার, যেখানে গবেষণা হবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু।

বিশ্বের ইতিহাসে যেকোনো মৌলিক পরিবর্তন এসেছে গবেষণার মাধ্যমে। বিজ্ঞানের অগ্রগতি, নতুন প্রযুক্তির বিকাশ, কৃষি ও স্বাস্থ্যখাতে উদ্ভাবন, কিংবা সমাজ ও রাষ্ট্রনীতির সংস্কারসব ক্ষেত্রেই গবেষণা জ্ঞানের উৎস হিসেবে কাজ করেছে। গবেষণা শুধু তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া নয়, এটি এক গভীর চিন্তা, অনুসন্ধান ও সৃষ্টিশীলতার যাত্রা। তাই একটি জাতিকে সত্যিকার অর্থে জ্ঞানসমৃদ্ধ করতে হলে গবেষণাকে শিক্ষার ভিত্তিতে পরিণত করা ছাড়া বিকল্প নেই।

বিশ্ববিদ্যালয় কেবল ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি জাতির চিন্তা, মেধা ও নেতৃত্ব গঠনের কারখানা। এখানেই গড়ে ওঠে নতুন ভাবনা, প্রশ্ন ও অনুসন্ধান। উন্নত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা পাঠদানের পাশাপাশি গবেষণাকে মূল ভিত্তি হিসেবে নিয়েছে। হার্ভার্ড, এমআইটি, কেমব্রিজ বা অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ যেভাবে বিশ্বজুড়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তার মূল কারণ হলো তাদের গবেষণানির্ভর শিক্ষা ও উদ্ভাবনী সংস্কৃতি।

সেখানে শিক্ষার্থীরা শুধু ক্লাসরুমের পাঠে সীমাবদ্ধ থাকে না; তারা গবেষণার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকে। কেউ গবেষণা সহকারী হিসেবে (Research Assistant) কাজ করে, কেউ শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য শিক্ষাদানে সহায়তা করে (Teaching Assistant)এতে তারা একদিকে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করে, অন্যদিকে আত্মবিশ্বাস, বিশ্লেষণক্ষমতা এবং নেতৃত্বের দক্ষতা গড়ে তোলে।

দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো গবেষণানির্ভর সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। বিশেষ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা গবেষণায় সরাসরি যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায় না। শিক্ষাদানের সহকারী হিসেবেও তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। ফলে তারা কেবল ডিগ্রি অর্জন করলেও বাস্তব দক্ষতা, আত্মবিশ্বাস এবং সৃজনশীল চিন্তায় পিছিয়ে থাকে। এই ঘাটতি শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং পুরো উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতাকে প্রকাশ করে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য উচ্চশিক্ষায় কাঠামোগত সংস্কার অপরিহার্য। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা চালু করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের রিসার্চ ও টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এজন্য দরকার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, আলাদা বাজেট, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা এবং নিয়মিত মূল্যায়ন। শুরুতে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে এটি চালু করে ফলাফল বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। সফল হলে তা ধাপে ধাপে জাতীয় পর্যায়ে বিস্তৃত করা সম্ভব।

আজকের শিক্ষার্থীকে কেবল পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে আবদ্ধ রেখে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তাকে হতে হবে অনুসন্ধিৎসু, চিন্তাশীল ও উদ্ভাবনী। গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা সেই পথই তৈরি করতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থী কেবল তথ্যের ভান্ডার নয়, বরং নতুন জ্ঞানের স্রষ্টা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।

আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা শুধু সনদপ্রাপ্ত কর্মী তৈরি করবে না, বরং সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে নেতৃত্ব দিতে পারবে এমন চিন্তাশীল নাগরিক তৈরি করবে। কারণ গবেষণানির্ভর শিক্ষাই একমাত্র পথ, যা বাংলাদেশকে বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষার নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিতে পারে।


সংষ্কারের নামে বিরাজনীতিকরণ: বিএনপির বাস্তববাদী অবস্থান ও এন্টি পলিটিক্সের ফাঁদ

ড. বাতেন মোহাম্মদ
ড. বাতেন মোহাম্মদ
শিক্ষক ও রাজনৈতিক গবেষক
২০২৫ নভেম্বর ০৩ ১৫:২৫:৫৬

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সংষ্কার প্রসঙ্গটি এখন এক ধরনের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় বিএনপির অবস্থান নিয়ে আমার ব্যক্তিগত দ্বিমত থাকলেও, পুরো প্রক্রিয়ায় দলটি অন্তত সৎ থাকার চেষ্টা করেছেএ কথাটি অস্বীকার করার উপায় নেই। বিএনপি সে মাত্রায়ই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকেছে, যতটা তার মতো একটি বুর্জোয়া ড্রিভেন ও পার্টি ক্যাপিটালিস্ট দলের পক্ষে বাস্তবিকভাবে সম্ভব। বিএনপি কখনোই আদর্শবাদী দল নয়, বরং এটি বাস্তববাদী দল, যে দল রাজনৈতিক তত্ত্বের চেয়ে রাজনৈতিক বাস্তবতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়।

চাইলেই বিএনপি সব সংষ্কার প্রস্তাবে “হ্যাঁ” বলে ক্ষমতায় গিয়ে নিজের সুবিধামতো যা পারত বাস্তবায়ন করত, আর যা পারত না সেটাকে নানা যুক্তি ও ব্যাখ্যার ভেতর লুকিয়ে রাখত। অর্থাৎ সুযোগ ছিল সহজ পথে হেঁটে লোকদেখানো সংস্কারে অংশ নেওয়ার। কিন্তু দলটি সেই ইজি রাউট নেয়নি। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি মূলত “ইন্সট্রুমেন্টাল র‍্যাশনাল” অর্থাৎ যে যুক্তিবোধ ক্ষমতার ব্যবহার ও রিসোর্স একুমুলেশনকেই কেন্দ্রে রাখে।

বাংলাদেশের মতো ইনফরমাল অর্থনীতিনির্ভর রাষ্ট্রে এমন দলের কাঠামোতে র‌্যাডিকাল বা গভীর সংস্কারে রাজি হওয়া শুধু কঠিনই নয়, অনেক ক্ষেত্রেই প্রায় অসম্ভব। তবু বিএনপি তার সামর্থ্যের চেয়ে বেশি এগিয়েছে। একটা বিশাল দল, যার এখনো দলীয় পরিচালনার জন্য সংগঠিত কোনো অর্থনৈতিক কাঠামো নেই, সেই দলের কাছ থেকে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি আশা করাটা অবাস্তব। তার ওপর দেশের ভঙ্গুর প্রাতিষ্ঠানিক উত্তরাধিকারের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার অতিরিক্ত বিকেন্দ্রীকরণ নতুন ক্ষমতাকেন্দ্র বা পকেট তৈরি করতে পারে, এটাও এক বাস্তব ঝুঁকি।

এই ঝুঁকি জেনেও বিএনপি সংষ্কারে যতটুকু রাজি হয়েছে, সেটিকে যদি কেবল পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মনের প্রত্যাশার ভিত্তিতে বিচার না করে, বরং এক গড়পড়তা শিক্ষিত, নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চিত চাকরিজীবী বা দলীয় কর্মীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, তাহলে বোঝা যাবে বিএনপি আসলে নিজের সামর্থ্যের চেয়েও বেশি অগ্রসর হয়েছে। তবু যারা সংষ্কারভীতি ছড়িয়ে দলটিকে দুর্বল করতে চাইছে, তাদের আচরণ শেষ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ারই ক্ষতি করছে।

বিএনপি ক্ষমতাকেন্দ্রিক দল, এটা নতুন কিছু নয়। তবে এই সংষ্কার আলোচনায় তার ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা অন্য যেকোনো দলের তুলনায় বহুগুণ বেশি ছিল। সাধারণত যার পাওয়ার এসেন্ডিং প্রোবাবিলিটি বেশি, সে নিজের শর্তে দরকষাকষি করে, আর যাদের সম্ভাবনা কম তারা দরকষাকষি করে যতটা আদায় করা যায় সেই যুক্তিতে। এই বাস্তবতা মাথায় রেখেও বিএনপি সংষ্কারের আলোচনাকে এগিয়ে নিয়েছে, এটিই তার বড় রাজনৈতিক পরিণতিবোধের পরিচায়ক।

অবশ্যই আমাদের প্রত্যাশা ছিল বিএনপি আরও উদার হবে। কিন্তু যতটুকু উদার হয়েছে, সেটিও স্বীকার করতে হবে। বিএনপি যদি সত্যিই রিজিড হতো, তবে সংষ্কার প্রক্রিয়া এত দূর অগ্রসর হতো না। এই প্রেক্ষিতে দলটির “নোট অব ডিসেন্ট” বা ভিন্নমত প্রকাশের বিষয়টি যদি রাজনৈতিক অহংকার হিসেবে দেখা হয় এবং সেই সুযোগটিও না দেওয়া হয়, তবে সেটি হবে একপ্রকার এন্টি পলিটিক্স ট্রিক, যেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই অকার্যকর করে ফেলা হয়। কারণ নির্বাচনী রাজনীতিতে ইগো ও রেটরিক অনেক সময় রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হয়।

আজকের সংষ্কার প্রক্রিয়া যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেটাকে রাজনীতি বলা যাচ্ছে না। এটা এখন হয়ে উঠছে এক ধরনের বিরাজনীতিকরণ বা এন্টি পলিটিক্স। বিএনপির মতো একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল যদি নিজেও এই ধরনের এন্টি পলিটিকাল টুল প্রয়োগ শুরু করে, তাহলে যতটুকু সংষ্কার অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, ঠিক ততটাই পেছনে চলে যাবে। এর লাভ কারো হবে না, বরং দেশের রাজনৈতিক কাঠামো ও গণতন্ত্রেরই ক্ষতি হবে শেষ পর্যন্ত।

এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জাগে, আমরা আসলে রাজনীতি করছি, নাকি রাজনীতিকে ধ্বংস করছি? যে সংষ্কার কার্যক্রমকে এতদিন রাজনৈতিক পুনর্গঠন বলে গলা ফাটানো হলো, সেটাই কি শেষ পর্যন্ত এক এন্টি পলিটিক্স মেশিন হয়ে উঠছে না? সমাজবিজ্ঞানী জেমস ফার্গুসনের ভাষায়, যে প্রক্রিয়া রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক করার কথা ছিল, সেটিই যখন রাজনীতিকেই নির্বিষ ও অচল করে তোলে, তখন সেটি আর সংষ্কার নয়, এক ধরনের নীরব বিরাজনীতিকরণ।

এটাই আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংষ্কারের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। সংষ্কারের নামে রাজনীতির মৃত্যু, আর রাজনীতির নামে সংষ্কারের অনন্তঅপূর্ণতা

লেখক: ড. মোহাম্মদ আব্দুল বাতেন, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।


বিএনপি ও সংস্কারের রাজনীতি: ম্যান্ডেট, কূটচাল ও টেকসই বৈধতার পরীক্ষায় বাংলাদেশ

আসিফ বিন আলী
আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
২০২৫ অক্টোবর ৩০ ০৮:৫৬:১০
বিএনপি ও সংস্কারের রাজনীতি: ম্যান্ডেট, কূটচাল ও টেকসই বৈধতার পরীক্ষায় বাংলাদেশ

বিএনপির অনেক নেতা–কর্মী মনে করছেন জামাত, সরকার ও এনসিপি মিলে তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তিন ধরনের দল আছে, A, B ও C। A বড় দল, এই গ্রুপে আছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। B মাঝারি দল, এই গ্রুপে আছে জামাত ও জাতীয় পার্টি। C হলো বাকি দল—যেমন এনসিপি, এবি পার্টি, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ ও অন্যান্য বামপন্থি দল। সাম্প্রতিক সময়ে যে সার্ভেগুলো হয়েছে তাতে যদিও দেখা যাচ্ছে জামাতের অবস্থান আওয়ামী লীগের থেকে ভালো, তবু আওয়ামী লীগ যদি ভয়হীন পরিবেশে নিজের মতামত দিতে পারে, নিঃসন্দেহে তাদের অবস্থান জামাতের থেকে বেশি হবে। যাই হোক, সেই বিতর্কে না যাই। এই শক্তির মাত্রা মাথায় রেখেই বিএনপি গুড ফেইথে রাজনৈতিক ঐকমতের আলোচনায় অংশ নিয়েছে, অন্তত বিএনপি তাই মনে করে বলে আমার মনে হয়েছে। এবং আমরা দেখেছি, জুলাই সনদ ও ঘোষণা নিয়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এক ধরনের ঐকমতে এসেছে, যদিও এনসিপি তার বাইরে থেকেছে।

বাস্তবতা হলো, দেড় বছর ধরে সরকারের এই পরীক্ষামূলক সংস্কারে বিএনপি অংশ নিয়েছে মূলত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফেরার আশায়। ঠিক এই প্রত্যাশাকেই বিএনপির দুর্বলতা ভেবে জামাত, এনসিপি ও নব্য এলিটরা দরকষাকষি করেছে, বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপে এমন ধারণাই পাওয়া যায়। কিন্তু এই দরকষাকষির সীমানা কোথায়? সীমানা ছিল, নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র না করা, নির্বাচন না পেছানো এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের আয়োজন না করা। বিএনপি বারবার বলেছে, সংবিধান সংস্কার হবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে। যে কোনো সভ্য দেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার করেন। অনির্বাচিত কোনো সরকার, তা যেভাবেই আসুক, এই অধিকার রাখে না। জোর করে করা যায়, কিন্তু জোর কেটে গেলে সেই সংস্কার টেকে না, তা যতই মহৎ হোক। জনগণের ম্যান্ডেট অপরিহার্য, আর সেই ম্যান্ডেট পাওয়ার পথ হলো নির্বাচন।এখন যে সব সংস্কার প্রস্তাব উঠছে, সেগুলোর প্রতিটিতে হ্যাঁ–না ভোটে জনমত নেওয়া একদিকে কষ্টসাধ্য, অন্যদিকে ত্রুটিপূর্ণ। প্রশ্ন কীভাবে ফ্রেম হবে, তথ্য কে দেবে, প্রশাসন কতটা নিরপেক্ষ থাকবে, সবকিছুই বিতর্কিত হতে পারে। এমন অবস্থায়, যেখানে আওয়ামী লীগ–সমর্থক ভোটাররা এই সংস্কারে তেমন সমর্থন দেবেন না, সেখানে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ ছিল বাকিদের সমর্থন নিশ্চিত করা, খানিকটা ছাড় দিয়ে হলেও যেন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ম্যান্ডেট দাঁড়ায়। নিঃসন্দেহে জামাত, বিএনপি, এনসিপি ও বামপন্থি দলগুলো মিলে এমন একটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি হতে পারত, যা এই ধরনের সাংবিধানিক পরিবর্তনকে জনগণের ম্যান্ডেটের বৈধতা দিত। কিন্তু সেই পথে না হেঁটে সংস্কার কমিশন যে পথে হাঁটলেন, তা রাজনৈতিক ভুল বলেই মনে হতে পারে। এর ফলে হয়তো তারা বিএনপির সমর্থন হারানোর পথে।

আরও স্পষ্ট করে বলি, বাংলাদেশের বৈধতার কেন্দ্র A গ্রুপে। B–C গ্রুপ চাপ দিতে পারে, কিন্তু টেকসই বৈধতা বানাতে পারে না। তাই বিএনপি যদি সনদ থেকে সমর্থন ফিরিয়ে নেয়, জামাত–এনসিপি–সরকার মিলে চেষ্টা করলেও গণভোটে “জনগণের রায়” বলে যা দেখাতে চাইবেন, তা বাস্তবে টেকসই বৈধতা তৈরি করবে না। বিএনপি নব্য এলিট ও বিপ্লবীদের কাছে “সংস্কার–বিরোধী” তকমা পেতেই পারে; কিন্তু গণভোটের হার–জিতের ক্ষেত্রে সেই ফ্রেমিং বড় ভূমিকা নাও রাখতে পারে। কারণ, ম্যান্ডেটের রাজনীতি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের রাজনীতি, এটি পাশ কাটানো যায় না।

আবার, রাজনৈতিক দল ও সরকারের ভেতরের যে অংশ নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে চায়, তাদের পক্ষে দীর্ঘদিন এই প্রক্রিয়া ধরে রাখা সম্ভব নয়। আজকের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে কোনো শক্তিই তা রাজনৈতিক দল, আর্মি কিংবা অন্য কেউ, নির্বাচন ছাড়া সরকার গঠন করে টেকসই থাকতে পারবে না। এর শেষ পরিণতি ভয়াবহ। এই জটিল পরিস্থিতিতে সংস্কার কমিশনের উচিত ছিল রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখানো, সম্মতি জোগাড় করা, সীমা ঠেলে দেখা নয়। তারা উল্টোটা করেছেন, কতটা বাউন্ডারি পুশ করা যায়, বিএনপিকে কতটা বাঁধা দেওয়া যায়, এটাই যেন পরীক্ষা, অন্তত বিএনপির নেতা কর্মীরা তাই মনে করছেন।

প্রশ্ন এখন স্পষ্ট, এই রাজনৈতিক খেলায় বিএনপি কি পারবে নিজের অবস্থান শক্তভাবে জানাতে, না কি আরও ক্ষতির শিকার হবে? বিএনপি যদি আরও ছাড় দিতে থাকে, তৃণমূল এটাকে ভালোভাবে নেবে না; বরং একে দুর্বলতা হিসেবে পড়বে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও বিএনপির দুর্বলতা নিয়ে মজা নেবে। রাজনীতিতে ইমেজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই এখানে বিএনপির দায়িত্ব, রেডলাইন স্পষ্ট করা: নির্বাচন পেছানো যাবে না; সংবিধান–সংস্কার নির্বাচিত সংসদের ম্যান্ডেটে হবে। ইস্যুর ক্রম ঠিক করা: আগে নির্বাচন, তারপর সংসদীয় প্রক্রিয়ায় সংস্কার; প্রয়োজনে সীমিত, নির্দিষ্ট ধারায় গণভোট। এবং জোটের অঙ্ক কংক্রিট করা: বিচারব্যবস্থা, ইসি–রিফর্ম, মৌলিক অধিকার, ৩–৫টি কমন–মিনিমাম বিষয়ে সমঝোতা, বাকিগুলো সংসদে।

শেষ কথা, বিএনপি আজ ভেটো প্লেয়ার। বিএনপি আউট থাকলে গণভোটের রাস্তা বৈধতা আনতে পারবে না; বরং অনিশ্চয়তা বাড়াবে। তাই বিএনপির এখন দরকার পরিষ্কার সিগনাল, এক লাইনের বার্তা: আগে ম্যান্ডেট, পরে সংস্কার, কিন্তু আরও ভালোভাবে। নির্বাচন ছাড়া এই সঙ্কটের টেকসই সমাধান নেই; এবং নির্বাচন–পূর্ব যেকোনো শর্টকাট শেষতক নিজেই নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।

(আমি শুরু থেকেই নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছি। আমি মনে করি না, নির্বাচনের মাধ্যমে দেয়া জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া কারও সংবিধান সংস্কারের অধিকার আছে। তাই এই লেখায় আমার অবস্থানগত পক্ষপাত থাকতে পারে।)


রাজনীতি, নির্বাসন ও নৈতিকতা: শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতাকে কোথায় নিচ্ছে

মো. অহিদুজ্জামান
মো. অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
২০২৫ অক্টোবর ৩০ ০৮:৩৭:১৬
রাজনীতি, নির্বাসন ও নৈতিকতা: শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতাকে কোথায় নিচ্ছে

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। নির্বাসনে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকাকে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে তিনি ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের বিষয়ে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন সরাসরি নাকচ করেছেন। তাঁর ভাষায়, “The question of apology does not arise. My government acted to preserve order and stability.” এই বক্তব্য শুধু একটি রাজনৈতিক মন্তব্য নয়, বরং এটি তাঁর সমগ্র নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন।

শেখ হাসিনার এই বক্তব্য প্রকাশের সময় এবং প্রেক্ষাপট একে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। কারণ জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তাঁর সরকারের সময় ঘটে যাওয়া দমননীতিকে “brutal and systematic repression” বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বিক্ষোভ দমনে এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং নিহতদের প্রায় ৭৮ শতাংশ গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। জাতিসংঘের হাইকমিশনার ভলকার টার্কের ভাষায়, “Top echelons of the previous government were aware and involved in very serious violations, including enforced disappearances, arbitrary detentions and violent suppression of protests.” এই মন্তব্যগুলো আন্তর্জাতিকভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে শেখ হাসিনার সরকারের সময় সংঘটিত ঘটনাগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

এই দুই বাস্তবতা এখন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে একটি বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। একজন অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী, যিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত, তিনি এখন ভারতের আশ্রয়ে অবস্থান করছেন এবং সেখান থেকেই রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন। ভারত কি কেবল মানবিক কারণে তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে, নাকি এটি বাংলাদেশের ওপর কৌশলগত চাপ প্রয়োগের একটি নতুন পদ্ধতি?

ভারত দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মিত্র। তাঁর সময়েই ভারত সীমান্তনিরাপত্তা, ট্রানজিট, নদী ব্যবহার, জ্বালানি বাণিজ্য ও সংযোগনীতিতে বড় ধরনের সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পর এই ভারসাম্য ভেঙে যায়। শেখ হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গেই দিল্লি তাঁকে আশ্রয় দেয় এবং দ্রুত একটি বিশেষ সুরক্ষিত ভবনে তাঁর জন্য রাজনৈতিক সচিবালয় গঠন করে। এই সচিবালয়ের কার্যক্রম এখন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও কিছু কূটনৈতিক উপদেষ্টার তত্ত্বাবধানে চলছে। সেখানে নিয়মিতভাবে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক হয় এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দিল্লি কি শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের ওপর একধরনের নরম রাজনৈতিক চাপ বজায় রাখতে চাইছে? বিশেষ করে যখন বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন ও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে, তখন দিল্লির উদ্বেগ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভারত মনে করছে, হাসিনার পতনের ফলে তারা বাংলাদেশের ওপর আগের মতো প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। তাই শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে তারা একদিকে নিজেদের পুরোনো মিত্রকে ধরে রাখছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্বের ওপর কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।

দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টে দেওয়া শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারটি তাই কেবল তাঁর ব্যক্তিগত মত নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক বার্তা। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো নির্বাচন বৈধ নয় এবং বর্তমান সরকারের মেয়াদে তিনি দেশে ফিরবেন না। এই বক্তব্য স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তিনি এখনো নিজেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপরিহার্য ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে চান। তবে এই বক্তব্যের সময়কাল এবং ভারতের সক্রিয় ভূমিকা ইঙ্গিত করছে যে এটি একটি পরিকল্পিত প্রচারণার অংশ। ভারত হয়তো চায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অবস্থানকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে, যাতে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে কেন্দ্র করে একটি নতুন কূটনৈতিক মডেল গড়ে তুলছে। জাতিসংঘের সহযোগিতায় গঠিত ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশন ইতিমধ্যেই জুলাই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শুরু করেছে। সরকার ভুক্তভোগী পরিবারের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি এবং প্রশাসনিক সংস্কারের পরিকল্পনা নিয়েছে। এই উদ্যোগগুলো আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ওআইসি বাংলাদেশকে একটি নতুন গণতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করছে।

এই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার ক্ষমা অস্বীকারের বক্তব্য তাঁর নৈতিক অবস্থানকে আরও দুর্বল করেছে। এটি তাঁকে একটি অপ্রায়শ্চিত্ত রাজনৈতিক চরিত্রে পরিণত করেছে, যার কাছে মানবিক সংবেদনশীলতা ক্ষমতার চেয়ে ছোট হয়ে গেছে। ভারত এই অবস্থানকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে চাইছে কিনা, সেটিই এখন মূল প্রশ্ন। যদি সত্যিই দিল্লি মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত এক সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আশ্রয় দিয়ে কূটনৈতিক প্রভাব বজায় রাখতে চায়, তবে এটি দক্ষিণ এশিয়ার নীতিগত রাজনীতির জন্য একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস প্রমাণ করেছে, জনগণের ইচ্ছাশক্তি যেকোনো কূটনৈতিক চাপে বেশি শক্তিশালী। শেখ হাসিনার ক্ষমা অস্বীকৃতি ও ভারতের কৌশলগত দ্বৈততা হয়তো সাময়িক প্রভাব ফেলতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে ন্যায়, গণতন্ত্র ও মানবিক মূল্যবোধ।

দক্ষিণ এশিয়ার সামনে এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আছে। কোনো রাষ্ট্র বা নেতা যদি জনগণের আস্থা হারায়, তবে তাকে আশ্রয় বা সমর্থন দিয়ে কৌশলগত প্রভাব বজায় রাখা কখনো স্থায়ী হয় না। শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার ও ভারতের বর্তমান ভূমিকা সেই সত্যটিকেই আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।


অভিভাবকতন্ত্রের প্রলোভন: জেনারেল ভূঁইয়ার বয়ান ও গণতন্ত্রের ঘড়ি থামানোর বিপদ

আসিফ বিন আলী
আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
২০২৫ অক্টোবর ১৮ ১৬:৪৩:৩১

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া সম্প্রতি তাঁর ফেসবুক পেজে লিখছেন ধারাবাহিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী পোস্ট, যার শিরোনাম “আগামী পাঁচ বছরে আমরা কোথায় যাচ্ছি?” এর পঞ্চম অংশে তিনি আলোকপাত করেছেন “বিএনপি ক্ষমতায় এলে সম্ভাব্য চিত্র” বিষয়ে। অভিজ্ঞ সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর পর্যবেক্ষণ নিঃসন্দেহে মনোযোগ দাবি করে। তবে তাঁর লেখার রাজনৈতিক ফ্রেমিং ও বিশ্লেষণের অন্তর্নিহিত ধারা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার প্রয়োজন আছে, বিশেষ করে যখন সেই বয়ানে নির্বাচিত রাজনীতিকদের “সমস্যা” এবং অ-নির্বাচিত এলিট বা উপদেষ্টাদের “সমাধান” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

এই ফ্রেমটি প্রথমেই একটি মৌলিক অস্বস্তি তৈরি করে, কারণ এটি প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে কার্যকারিতাকে একমাত্র গুণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। যেন গণতন্ত্রের মূল যুক্তি, অর্থাৎ ভোটের মাধ্যমে ম্যান্ডেট অর্জন, অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে এবং তার জায়গা নেয় “যোগ্য” অ-নির্বাচিত অভিভাবকদের শাসন। এটি একটি বিপজ্জনক স্লিপারি স্লোপ, যেখানে জনগণের ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের পরিবর্তে অভিভাবকতন্ত্রকে বৈধতা দেওয়া হয়। ইতিহাস বলছে, একবার যদি এই পথে যাত্রা শুরু হয়, নির্বাচনী রাজনীতির প্রাণশক্তি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায়।

জেনারেল ভূঁইয়ার লেখায় একটি স্পষ্ট কৌশল দেখা যায়, সেটি হলো ভয়কে রাজনৈতিক মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা। তিনি ভারতীয় চাপ, অর্থনৈতিক সংকট, পুলিশের অকার্যকারিতা, রাস্তার সহিংসতা ইত্যাদি উদাহরণ টেনে এনে বলেছেন যে এসব কারণেই হয়তো অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় বাড়াতে হবে বা “বিশেষ ব্যবস্থা” নিতে হতে পারে। এই ভয়নির্ভর বয়ান জনমনে এমন ধারণা তৈরি করে যে নির্বাচন অনিশ্চিত, ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিলম্বই নিরাপদ পথ। ফলত একটি “ইলেকশন-অপশনাল” মানসিকতা জন্ম নেয়, যেখানে নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে ঐচ্ছিক হয়ে ওঠে। এটি গণতন্ত্রের শিকড় ক্ষয়ে দেওয়ার এক নীরব উপায়।

যখন তিনি লেখেন “রিফর্ম আগে, নির্বাচন পরে”, সেটি আসলে এক বিপরীত রাজনৈতিক সিকোয়েন্সের প্রচলন। টেকসই গণতন্ত্রে সংস্কারের বৈধতা আসে নির্বাচনের ম্যান্ডেট থেকে, কিন্তু তিনি উল্টো বলছেন নির্বাচনের আগেই সংস্কার হোক। বাস্তবে এর অর্থ দাঁড়ায় জনগণের ম্যান্ডেটহীন শক্তির হাতে রাজনৈতিক সংস্কারের দায়িত্ব তুলে দেওয়া। “রিফর্ম-ফার্স্ট” চিন্তাধারা অচিরেই “ইলেকশন-লেটার” হয়ে যায়, আর পিছিয়ে দেওয়া ভোট খুব কম ক্ষেত্রেই ফিরে আসে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসই তার প্রমাণ।

আরও উদ্বেগজনক হলো, জেনারেল ভূঁইয়া তাঁর লেখায় নিরাপত্তা কাঠামোকে এক ধরনের “নিরপেক্ষ ম্যানেজার” হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। পুলিশকে “অলস ঘোড়া” আখ্যা দিয়ে সেনাকে মাঠে রাখার বিষয়টি তিনি নিছক ম্যানেজমেন্ট ইস্যু হিসেবে দেখেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি বেসামরিক জবাবদিহির প্রশ্নকে আড়াল করে এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে ডি-ফ্যাক্টো রাজনৈতিক রেফারিতে রূপান্তরিত করে। গণতন্ত্রে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কখনোই রাজনীতির ভারসাম্যরক্ষাকারী হতে পারে না, কারণ তাতে নির্বাচিত নেতৃত্বের জবাবদিহি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ সরে যায় অদৃশ্য ব্যবস্থাপক মহলের হাতে।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জেনারেল ভূঁইয়া সম্ভাব্য বিএনপি সরকারের প্রতি আগেভাগেই অবিশ্বাস প্রকাশ করেছেন। তাঁর পূর্বাভাসে দেখা যায়, বিএনপি ক্ষমতায় এলে দুর্নীতি বাড়বে, ভারতীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটবে, রাস্তায় সহিংসতা হবে। এই ধরনের পূর্বাভাস আসলে রাজনৈতিক আগাম অবমূল্যায়ন, যা একটি বিপজ্জনক বার্তা দেয় যে “ভুল দল” জিতলে সেটিকে “ম্যানেজ” করা ন্যায্য। এতে নির্বাচনী গণতন্ত্রের মৌলিক শর্ত, অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার পালাবদল, শর্তাধীন হয়ে পড়ে।

তাঁর বয়ানে নাগরিকরা নায়ক নয়, বরং “ঝুঁকি”। সমাধান খোঁজা হয় এলিট মহলের ভেতরে, “যোগ্য উপদেষ্টা” বা “সমঝোতার সরকার”-এর মধ্যে। এটি একধরনের ক্লাসিক এলিট সাবস্টিটিউশন, যেখানে জনসম্মতি সরিয়ে পেছনের দরজার চুক্তি সামনে আনা হয়। এতে রাজনৈতিক দল, ভোটার ও নীতির স্বাভাবিক সংযোগ দুর্বল হয়ে পড়ে; আস্থা কমে, অংশগ্রহণও হ্রাস পায়। ফলত গণতন্ত্র কেবল আনুষ্ঠানিক কাঠামোয় সীমিত থেকে যায়।

আরেকটি বিষয় হলো, তাঁর লেখায় বারবার “বহির্দেশের ভেটো”, বিশেষ করে ভারতের প্রভাব, একটি অনিবার্য বাস্তবতা হিসেবে হাজির হয়। এতে ইঙ্গিত মেলে যে নীতি-প্রসঙ্গগুলোতে বাইরের “রেড লাইন” অতিক্রম করা যায় না। এটি আসলে সার্বভৌম ভোটের অস্বীকৃতি, যেখানে জনমতকে আগে থেকেই সঙ্কুচিত বৃত্তে বন্দি করে ক্ষমতাবান এলিটরা সিদ্ধান্ত নেন কী সম্ভব আর কী নয়।

সব মিলিয়ে, জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়ার লেখার অন্তর্নিহিত বার্তা হলো ভয়নির্ভরতা, “রিফর্ম-ফার্স্ট” সিকোয়েন্স, এলিট ও টেকনোক্র্যাটিক সমাধান, এবং নিরাপত্তা কাঠামোর রাজনৈতিক ভূমিকার স্বাভাবিকীকরণ। এগুলো মিলে এক নতুন প্রকারের অভিভাবকতন্ত্রের ধারণা তৈরি করে, যেখানে জনগণ নয়, “দক্ষ ব্যবস্থাপক”-ই রাজনীতির নিয়ামক।

কিন্তু রাষ্ট্র কোনো ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প নয়, এটি জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতিফলন। প্রজাতন্ত্র স্থিতি পায় ব্যালটের ঘড়িতে, যে ঘড়ির কাঁটা কারও ইচ্ছেমতো থামানো যায় না। নির্বাচনের সময়, গতি বা ফলাফল নিয়ে ভয় দেখানোর পরিবর্তে আমাদের দায়িত্ব হলো সেই ঘড়িটিকে সচল রাখা, যাতে জনগণই হয় ক্ষমতার একমাত্র উৎস।

জেনারেল ভূঁইয়ার প্রস্তাবিত “প্রাগম্যাটিক” পথটি যতই বাস্তবসম্মত মনে হোক, তার ভেতরে নিহিত আছে গণতন্ত্রের স্থবিরতার বীজ। আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সেই স্থবিরতা থেকে মুক্ত থাকা, ব্যালটের ঘড়িকে চালু রাখা, এবং সব রাজনৈতিক শক্তিকে সেই সময়ের অধীন আনতে সক্ষম হওয়া। কারণ শেষ পর্যন্ত জনগণের ভোটই এই প্রজাতন্ত্রের প্রাণ, আর সেটিকে স্থগিত রাখা মানেই জাতির হৃদস্পন্দন থামিয়ে দেওয়া।


নেপালের গণঅভ্যুত্থান থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা: বৈধতার সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আগামীর চ্যালেঞ্জ

আসিফ বিন আলী
আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
২০২৫ সেপ্টেম্বর ১৪ ২৩:০৪:১৩
নেপালের গণঅভ্যুত্থান থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা: বৈধতার সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আগামীর চ্যালেঞ্জ

সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় একের পর এক গণঅভ্যুত্থান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে রাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামো দুর্বল হলে জনগণই চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিতে পারে। প্রথমে শ্রীলঙ্কা, পরে বাংলাদেশ এবং সবশেষে নেপাল—তিন দেশেই জনবিস্ফোরণ ঘটল। তিন ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা গেল ক্ষমতার কেন্দ্র, রাজনৈতিক নেতাদের সম্পত্তি ও বাসভবন জনগণের আক্রমণের মুখে পড়েছে। মূল অভিযোগ ঘুরপাক খাচ্ছে দুর্নীতি, দমন–পীড়ন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারকে ঘিরে। শ্রীলঙ্কায় তরুণ প্রজন্ম আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছিল, বাংলাদেশ ও নেপালে ছাত্র–যুবকরাই নেতৃত্ব দিয়েছে। এ অভিজ্ঞতাগুলো প্রমাণ করে যে যুবসমাজ যখন সামনে আসে, তখন আন্দোলন কেবল রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং একটি অস্তিত্ববাদী প্রশ্নে রূপ নেয়—রাষ্ট্র কার জন্য?

নেপালের অভ্যুত্থান একটি বিশেষ শিক্ষা দেয়। সেখানে সংসদ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ছিল এবং সরকার গণভোট ও নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। তবু জনরোষে ভেসে যায়। আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিল দুর্নীতি, এবং ক্ষোভের শিকার হয়েছে সরকার ও বিরোধী—উভয় শিবির। অর্থাৎ এটি শুধু regime change নয়, বরং পুরো রাজনৈতিক শ্রেণির প্রতি এক ধরণের অবিশ্বাস। রাজনৈতিক বিজ্ঞানে একে বলা হয় anti-establishment mobilization। এখানে আমরা Lipset-এর legitimacy theory প্রয়োগ করতে পারি। জনগণ যখন দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে রাষ্ট্রের ওপর আস্থা হারায়, তখন সরকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও তার বৈধতা নষ্ট হয়। বৈধতা হারানো সরকার কাগজে কলমে টিকে থাকে, কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতায় মৃতপ্রায় হয়ে যায়।

বাংলাদেশে ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান চূড়ান্ত সমাপ্তি নয়, বরং একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। বিএনপি আশা করছে তারা নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ আপাতত রাজনীতির বাইরে থাকলেও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। ইতিহাস বলে, সংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে রাজনীতি থেকে বাদ রাখা যায় না। Samuel Huntington-এর Political Order in Changing Societies এ প্রসঙ্গেই সতর্ক করেন—ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করলে ভবিষ্যতে আবার সহিংস বিস্ফোরণ ঘটে। অতএব, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরাটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। যদি গণতান্ত্রিক পথে তা সম্ভব না হয়, তবে সহিংসতার মাধ্যমে ফেরার চেষ্টা করবে—এমন সম্ভাবনাকে খাটো করে দেখা যাবে না।

বাংলাদেশের আরেক বাস্তবতা হলো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ব্লকের উত্থান। এখানে মওদুদপন্থী দল থেকে শুরু করে কট্টরপন্থী খিলাফতবাদী গোষ্ঠী পর্যন্ত সক্রিয়। তবে সবচেয়ে সংগঠিত শক্তি হলো জামায়াতে ইসলামি। সংগঠন, অর্থ, রাজনৈতিক ভিত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতায় তারা অন্যদের চেয়ে এগিয়ে। এখনই হয়তো তাদের জাতীয় ক্ষমতা দখলের সামর্থ্য নেই, কিন্তু আগামী কয়েক বছরে শক্তি বহুগুণে বাড়তে পারে। তখন প্রশ্ন থাকবে—তারা গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে সম্মান করবে, নাকি Charles Tilly-এর contentious politics তত্ত্বের মতো বিপ্লবী পথে হাঁটবে? নেপাল–স্টাইলে বিপ্লবী পথে হেঁটেও তারা বিস্ময় তৈরি করবে না।

বর্তমানে বিএনপি–বিরোধীরা সফলভাবে জনগণের মনে প্রতিষ্ঠা করেছে যে বিএনপি একটি দুর্নীতিবাজ দল। এখানে কার্যকর হয়েছে labeling theory। যখন কোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির লেবেল একবার বসে যায়, তখন তা সত্য বা মিথ্যা যাই হোক না কেন, সামাজিক বাস্তবতায় প্রভাব বিস্তার করে। সরকারে গেলে এই ধারণা আরও তীব্র হতে পারে, কারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুর্বল। এই প্রেক্ষাপটে আগামী সরকারকে দুটি অস্তিত্বমূলক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। প্রথমত, প্রতিবেশী দেশের সহায়তায় আওয়ামী লীগ আবার রাজনীতিতে ফিরতে চাইবে। এখানে power transition theory প্রযোজ্য—প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি দীর্ঘমেয়াদে পুনঃপ্রবেশের চেষ্টা করে এবং সেটি স্থিতিশীলতা নষ্ট করে। দ্বিতীয়ত, ক্রমবর্ধমান ইসলামপন্থী চাপ ইসলামি রাষ্ট্র প্রকল্পকে আরও শক্তিশালী করবে। এ প্রেক্ষাপটে social movement theory-এর radical flank effect ব্যাখ্যা করে কীভাবে মাঝারি ইসলামপন্থীরা ধীরে ধীরে চরমপন্থীদের দিকে ঝুঁকতে পারে।

এই দুই চাপে দুর্বল সরকারের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন। নেপাল আমাদের শিক্ষা দেয় যে দুর্নীতি, বৈধতা সংকট এবং জনগণের আস্থা হারানো একটি গণতান্ত্রিক সরকারকেও ধ্বংস করে দিতে পারে। বাংলাদেশও এখন এক অস্বাভাবিক সময়ে দাঁড়িয়ে। বিএনপি যদি ভাবে সরকার গঠন করলেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে, তবে তা হবে ভয়ঙ্কর ভ্রান্তি। প্রশ্ন হলো—বিএনপি কি এই দ্বৈত চাপে (আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন ও ইসলামপন্থী উত্থান) টিকে থাকার মতো রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি নিচ্ছে? নাকি আমরা আবারও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক চক্রে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, যেখানে অস্থিরতা শেষে সামরিক শাসনই হয়ে ওঠে শেষ অবলম্বন? বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন এক সন্ধিক্ষণে। আর এখানেই মূল প্রশ্ন—আমরা কি নেপালের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেব?

পাঠকের মতামত:

ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গড়তে হলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা পুনরুদ্ধার করতে হবে

ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গড়তে হলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা পুনরুদ্ধার করতে হবে

রাষ্ট্রের ধারণাটি একসময় কেবল প্রশাসনিক ক্ষমতা, আইনের শাসন এবং নিরাপত্তা প্রদানের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্রের ভূমিকা এখন... বিস্তারিত