বাংলাদেশে সেনা-সরকার উত্তেজনা ও ‘কু’ এর গুঞ্জন: নেপথ্যে কি? 

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ২৩ ২৩:৫৭:৫৫
বাংলাদেশে সেনা-সরকার উত্তেজনা ও ‘কু’ এর গুঞ্জন: নেপথ্যে কি? 

সম্প্রতি বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি স্পর্শকাতর গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে—সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অস্থিরতা এবং সরকার ও সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে একটি সম্ভাব্য সংঘাতের ইঙ্গিত। এই পরিস্থিতিকে ঘিরে যে বিশ্লেষণটি ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ জিয়া হাসান, তা শুধুমাত্র গুঞ্জনের বাইরে গিয়েই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যালোচনা হয়ে উঠেছে। এই প্রতিবেদন সেই বিশ্লেষণ এবং সংশ্লিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষাপটকে ভিত্তি করে রচিত।

ঘটনার সূত্রপাত: এক ‘অদৃশ্য সংঘাতের’ জন্ম

জিয়া হাসানের স্ট্যাটাস অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় ও অনুচ্চারিত ঘটনাটি ঘটেছে সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন ওয়াকারের সম্ভাব্য অপসারণ সংক্রান্ত গুঞ্জন ঘিরে। দাবি করা হয়, এক রাতে একটি গোপনীয় নোট রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পাঠানো হয়, যাতে সেনাপ্রধানকে সরানোর সুপারিশ করা হয়। এই গুজব এতটাই বাস্তব মনে করা হয় যে, জেনারেল ওয়াকার নিজ দপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও বিদায় নেন।

এটি সেই রাতের ঘটনা, যেদিন রাজধানীর একটি এলাকায় ৪০ মিনিটের জন্য ইন্টারনেট বন্ধ ছিল—অস্বাভাবিক এই ঘটনা আরও প্রশ্নের জন্ম দেয়। একই সময়ে সেনাবাহিনীর কয়েকটি ইউনিটকে তৎপর হতে নির্দেশ দেওয়া হয়, যা অনেকেই সেনা প্রস্তুতির প্রতীক হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।

বেসামরিক সরকার বনাম সামরিক কাঠামো: ক্ষমতার পর্দার আড়ালের সংঘাত

ঘটনার গভীরে গেলে দেখা যায়, মূল সংঘাত শুরু হয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানের নিয়োগ ও কার্যক্রম ঘিরে। তিনি সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা পিএসও ওয়ান জেনারেল কামরুল–এর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যাকে সেনাবাহিনী অভ্যন্তরীণভাবে একটি “পিনাকি-খলিল-ইউনূস” গ্রুপের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করে।

এই সম্পর্ককে সামরিক অভ্যন্তরে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্টকারী ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত বলে মনে করা হয়। সেনাপ্রধান ওয়াকার ও তার অনুগত শিবির জেনারেল কামরুলকে সরানোর প্রস্তাব দেন। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে বারবার সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়।

এমন প্রেক্ষাপটে একটি গভীর অনাস্থার জন্ম হয়, যার পরিণতিতে ওয়াকারের অপসারণের গুজব, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ নাড়াচাড়া, এবং পরবর্তীতে সেনা প্রধানের দরবার বক্তৃতায় রাজনৈতিক ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য—সবকিছু একে একে পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে।

মতপ্রকাশের আতঙ্ক ও নীরবতা: মিডিয়ার ব্যর্থতা?

জিয়া হাসান যে প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ—কেন এই জাতীয় একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মূলধারার কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়নি? কেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংবাদিক, এমনকি ইউটিউবভিত্তিক তথ্যানুসন্ধানী প্ল্যাটফর্মগুলোকেও এড়িয়ে যেতে দেখা গেছে?

এই নীরবতা হয়ত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের চাপে ঘটেছে, অথবা এদেশের মিডিয়াকে পর্যবেক্ষণকারী ও নিয়ন্ত্রণকারী ক্ষমতার অদৃশ্য কাঠামোকে ইঙ্গিত করছে, যেটা গণতান্ত্রিক বিকাশে অন্যতম অন্তরায়।

বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ও ‘কু’ সংস্কৃতি: প্রেক্ষাপটের মূল্যায়ন

বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ১৯৯০-এর পর থেকে গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি অনুগত থেকেছে। ২০০৭ সালে একটি সামরিক-পৃষ্ঠপোষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলেও, পরবর্তী সময়ে সরাসরি সেনা শাসনের দিকে আর অগ্রসর হয়নি।

পাকিস্তান, মিশর বা থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, সেনাবাহিনীর মধ্যে যখন সেনাপ্রধানকে সরানোর চেষ্টা হয়—তখন তা প্রায়শই সরকার পতনের সূচক হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানে ১৯৯৯ সালে নওয়াজ শরিফ মুশাররফকে সরাতে গিয়ে ক্ষমতা হারান, এবং মিশরে মোরসি সিসির হাতে একই পরিণতির শিকার হন।

বাংলাদেশে এখনো তেমন কিছু ঘটেনি, কিন্তু সেনাপ্রধানের এমন সরাসরি বক্তব্য এবং পূর্ববর্তী ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতা দেখে এটিকে এক প্রকার নরম অভ্যুত্থান বা প্রতিরোধমূলক প্রদর্শন হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যৎ শঙ্কা

এই ঘটনার একটি সম্ভাব্য fallout হলো, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামোর মধ্যে দ্বৈত নেতৃত্ব ও অনাস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠা। ড. ইউনূসের “রিজাইন প্রসঙ্গে” যে তথ্য জিয়া হাসান উত্থাপন করেন, তা এই টানাপোড়েনের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। যদি রাষ্ট্রের ভেতরের দুই বা ততোধিক পাওয়ার ব্লক পরস্পরের প্রতি সংশয় পোষণ করে, তাহলে নীতিগত সিদ্ধান্তগ্রহণ, নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বড় ধরনের চাপে পড়ে যেতে পারে।

গণতন্ত্রের নীরব হুমকি?

এখন প্রশ্ন হলো—এমন একটি গোপন দ্বন্দ্বকে জনগণের কাছ থেকে গোপন রাখা কি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি চরম অবজ্ঞা নয়? জিয়া হাসান যথার্থই প্রশ্ন করেছেন—একজন অর্থনীতিবিদ কেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সবচেয়ে স্পর্শকাতর সংকট বিষয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হচ্ছেন, যখন মূলধারার মিডিয়া নিশ্চুপ? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের মিডিয়া কাঠামো, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যকার দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সম্পর্কের ভেতরেই নিহিত।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই প্রতিবেদনটি একটি প্রকাশিত মতামতের উপর ভিত্তি করে রচিত। এতে উল্লিখিত তথ্য ও ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নয়।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।... বিস্তারিত