মতামত

নতুন রাজনৈতিক সমীকরণে কারা টিকে থাকবে, কারা হারিয়ে যাবে?

আরিফুল ইসলাম
আরিফুল ইসলাম
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
২০২৫ মে ২৪ ১৬:১৫:৪৪
নতুন রাজনৈতিক সমীকরণে কারা টিকে থাকবে, কারা হারিয়ে যাবে?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুটি দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। সংখ্যাগত ভোটে এবং জনসমর্থনের দিক থেকেও যুগপৎভাবে তাদের প্রভাব অনস্বীকার্য। তবে ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে।

গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কার্যত নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছে। নেতাকর্মীরা দিশেহারা, অনেকেই আত্মগোপনে; প্রথম সারির অনেক নেতা দেশত্যাগ করেছেন বা নিষ্ক্রিয়ভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। মাঠপর্যায়ে দলটির অস্তিত্ব এখন প্রায় অনুপস্থিত। বাস্তবতা বলছে, এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ গণনার বাইরের একটি শক্তি।

বিপরীতে, বিএনপি অভ্যুত্থানের পরপরই গোটা শক্তি নিয়ে রাজপথে সক্রিয় হয়েছে। দলটির নেতাকর্মীরা আত্মবিশ্বাসে ভাসছে, গণমানসে প্রত্যাশাও জোরদার হচ্ছে—যদি কোনও অপ্রত্যাশিত ‘জাদুকরী ঘটনা’ না ঘটে, তবে অনেকেই মনে করছেন সরকার গঠনের সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি বিএনপির। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নেতৃত্ব এখন অনেক পরিণত ও কৌশলী; আর মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের মধ্যে গভীর আস্থার জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।

গত সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহ থেকে দেখা যায়, বিএনপি সামান্য শক্তি নিয়েই ঢাকা দক্ষিন সিটিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। এই সাফল্য দলীয় সমর্থকদের করেছে আরও উজ্জীবিত। ইশরাক হোসেনের আদালতে জয়লাভের পর সরকারের একাধিক উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনের গতি বেড়েছে।

অন্যদিকে, একই দিন সরকারঘনিষ্ঠ সদ্য-গঠিত রাজনৈতিক সংগঠন এনসিপি নির্বাচন কমিশন ঘেরাওয়ের মাধ্যমে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করতে গিয়ে রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়াত্বের ইঙ্গিত দিয়েছে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, জনসমর্থনবিহীন এনসিপির এই 'ফিডিং-প্রজেক্ট' বাস্তবায়নের পেছনের কারিগররাও হয়তো এখন ব্যাকফুটে। এনসিপির অকাল পচনের অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে এসেছে দলটির এক কর্মসূচিতে যমুনার সামনে একাত্তরের স্মৃতিকে ব্যঙ্গ করা—যা তাদের অন্যতম রাজনৈতিক সহযোগী জাশির সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরিয়েছে। জাশি এখন কর্মী সাপ্লাই বন্ধ করে দিয়েছে, ফলে এনসিপি কার্যত অঙ্কুরেই বিনষ্ট।

সাম্প্রতিক আরেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, উত্তর বঙ্গের প্রভাবশালী প্রশাসনিক কর্মকর্তা তথা "সর্দারজি"র মন্তব্য। তিনি নির্বাচন বিষয়ে নিজের অবস্থান তুলে ধরে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থেকেও এক ধরনের সতর্ক বার্তা দিয়েছেন—যা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, তার বক্তব্য প্রাসঙ্গিক ও জরুরি ছিল; কারণ এতে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নয় বরং গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি—নির্বাচনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

৫ আগস্টের পর অনেকেই নিজেদের মতো করে রাজনৈতিক দোকান খুলে বসেছেন। তবে এখনো সরকারপক্ষ ‘বাজি ধরার মতো’ কোনও সংগঠন খুঁজে পায়নি—এনসিপি ছাড়া আর কেউ সমানভাবে সক্রিয় নয়। এমন প্রেক্ষাপটে এনসিপির পক্ষ থেকেও কিছু উপদেষ্টার পদত্যাগ চাওয়া হয়েছে, যা বিএনপির ছাত্র উপদেষ্টাদের পদত্যাগ দাবির পাল্টা কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে কোন পক্ষই এখনো প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেনি। বরং দ্বৈত নাগরিকত্বধারী কিংবা অতিউৎসাহী উপদেষ্টাদের নিয়েই সমালোচনা চলছে।

রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে গত সপ্তাহের শেষভাগে বিএনপি শুধুমাত্র ঢাকা উত্তরে চাপ বাড়াতেই তরুণদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। অথচ বিএনপি চাচ্ছে একটি সুস্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী রোডম্যাপ—যা মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাও প্রকাশ্যে সমর্থন করছেন।

এদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাংশ জোর প্রচারণা চালাচ্ছে—ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচনবিহীন ক্ষমতায় আনার পক্ষে। এই ‘ভোটবিহীন সংস্কৃতি’ মানুষের মধ্যে যে কতটা প্রোথিত হয়েছে, তা দেখেই হয়তো প্রধান উপদেষ্টা কিছুটা বিব্রত। সেই বিব্রতবোধ থেকেই হয়তো এনসিপি নেতাকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ডেকে সাবধান করেছেন—সংযত না হলে পদত্যাগ করবেন। আর সেই অনুশাসনকেই হয়তো আবেগী এনসিপি নেতা জনসমক্ষে ব্যাখ্যা করেছেন ‘পদত্যাগের ইচ্ছা’ হিসেবে।

বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের সংস্কৃতি নেই বললেই চলে। হয়তো ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সেই সংস্কৃতি তৈরি করতেই মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা নিজেই পদক্ষেপ নিতে চাইছেন। এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠতে পারে।

সবশেষে বলা যায়—চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রধান উপদেষ্টার হাতে। দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে তিনিই হয়তো নিবেন ‘জাদুকরী সিদ্ধান্ত’।


নেপালের গণঅভ্যুত্থান থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা: বৈধতার সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আগামীর চ্যালেঞ্জ

আসিফ বিন আলী
আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
২০২৫ সেপ্টেম্বর ১৪ ২৩:০৪:১৩
নেপালের গণঅভ্যুত্থান থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা: বৈধতার সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আগামীর চ্যালেঞ্জ

সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় একের পর এক গণঅভ্যুত্থান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে রাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামো দুর্বল হলে জনগণই চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিতে পারে। প্রথমে শ্রীলঙ্কা, পরে বাংলাদেশ এবং সবশেষে নেপাল—তিন দেশেই জনবিস্ফোরণ ঘটল। তিন ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা গেল ক্ষমতার কেন্দ্র, রাজনৈতিক নেতাদের সম্পত্তি ও বাসভবন জনগণের আক্রমণের মুখে পড়েছে। মূল অভিযোগ ঘুরপাক খাচ্ছে দুর্নীতি, দমন–পীড়ন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারকে ঘিরে। শ্রীলঙ্কায় তরুণ প্রজন্ম আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছিল, বাংলাদেশ ও নেপালে ছাত্র–যুবকরাই নেতৃত্ব দিয়েছে। এ অভিজ্ঞতাগুলো প্রমাণ করে যে যুবসমাজ যখন সামনে আসে, তখন আন্দোলন কেবল রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং একটি অস্তিত্ববাদী প্রশ্নে রূপ নেয়—রাষ্ট্র কার জন্য?

নেপালের অভ্যুত্থান একটি বিশেষ শিক্ষা দেয়। সেখানে সংসদ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ছিল এবং সরকার গণভোট ও নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। তবু জনরোষে ভেসে যায়। আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিল দুর্নীতি, এবং ক্ষোভের শিকার হয়েছে সরকার ও বিরোধী—উভয় শিবির। অর্থাৎ এটি শুধু regime change নয়, বরং পুরো রাজনৈতিক শ্রেণির প্রতি এক ধরণের অবিশ্বাস। রাজনৈতিক বিজ্ঞানে একে বলা হয় anti-establishment mobilization। এখানে আমরা Lipset-এর legitimacy theory প্রয়োগ করতে পারি। জনগণ যখন দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে রাষ্ট্রের ওপর আস্থা হারায়, তখন সরকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও তার বৈধতা নষ্ট হয়। বৈধতা হারানো সরকার কাগজে কলমে টিকে থাকে, কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতায় মৃতপ্রায় হয়ে যায়।

বাংলাদেশে ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান চূড়ান্ত সমাপ্তি নয়, বরং একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। বিএনপি আশা করছে তারা নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ আপাতত রাজনীতির বাইরে থাকলেও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। ইতিহাস বলে, সংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে রাজনীতি থেকে বাদ রাখা যায় না। Samuel Huntington-এর Political Order in Changing Societies এ প্রসঙ্গেই সতর্ক করেন—ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করলে ভবিষ্যতে আবার সহিংস বিস্ফোরণ ঘটে। অতএব, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরাটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। যদি গণতান্ত্রিক পথে তা সম্ভব না হয়, তবে সহিংসতার মাধ্যমে ফেরার চেষ্টা করবে—এমন সম্ভাবনাকে খাটো করে দেখা যাবে না।

বাংলাদেশের আরেক বাস্তবতা হলো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ব্লকের উত্থান। এখানে মওদুদপন্থী দল থেকে শুরু করে কট্টরপন্থী খিলাফতবাদী গোষ্ঠী পর্যন্ত সক্রিয়। তবে সবচেয়ে সংগঠিত শক্তি হলো জামায়াতে ইসলামি। সংগঠন, অর্থ, রাজনৈতিক ভিত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতায় তারা অন্যদের চেয়ে এগিয়ে। এখনই হয়তো তাদের জাতীয় ক্ষমতা দখলের সামর্থ্য নেই, কিন্তু আগামী কয়েক বছরে শক্তি বহুগুণে বাড়তে পারে। তখন প্রশ্ন থাকবে—তারা গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে সম্মান করবে, নাকি Charles Tilly-এর contentious politics তত্ত্বের মতো বিপ্লবী পথে হাঁটবে? নেপাল–স্টাইলে বিপ্লবী পথে হেঁটেও তারা বিস্ময় তৈরি করবে না।

বর্তমানে বিএনপি–বিরোধীরা সফলভাবে জনগণের মনে প্রতিষ্ঠা করেছে যে বিএনপি একটি দুর্নীতিবাজ দল। এখানে কার্যকর হয়েছে labeling theory। যখন কোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির লেবেল একবার বসে যায়, তখন তা সত্য বা মিথ্যা যাই হোক না কেন, সামাজিক বাস্তবতায় প্রভাব বিস্তার করে। সরকারে গেলে এই ধারণা আরও তীব্র হতে পারে, কারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুর্বল। এই প্রেক্ষাপটে আগামী সরকারকে দুটি অস্তিত্বমূলক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। প্রথমত, প্রতিবেশী দেশের সহায়তায় আওয়ামী লীগ আবার রাজনীতিতে ফিরতে চাইবে। এখানে power transition theory প্রযোজ্য—প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি দীর্ঘমেয়াদে পুনঃপ্রবেশের চেষ্টা করে এবং সেটি স্থিতিশীলতা নষ্ট করে। দ্বিতীয়ত, ক্রমবর্ধমান ইসলামপন্থী চাপ ইসলামি রাষ্ট্র প্রকল্পকে আরও শক্তিশালী করবে। এ প্রেক্ষাপটে social movement theory-এর radical flank effect ব্যাখ্যা করে কীভাবে মাঝারি ইসলামপন্থীরা ধীরে ধীরে চরমপন্থীদের দিকে ঝুঁকতে পারে।

এই দুই চাপে দুর্বল সরকারের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন। নেপাল আমাদের শিক্ষা দেয় যে দুর্নীতি, বৈধতা সংকট এবং জনগণের আস্থা হারানো একটি গণতান্ত্রিক সরকারকেও ধ্বংস করে দিতে পারে। বাংলাদেশও এখন এক অস্বাভাবিক সময়ে দাঁড়িয়ে। বিএনপি যদি ভাবে সরকার গঠন করলেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে, তবে তা হবে ভয়ঙ্কর ভ্রান্তি। প্রশ্ন হলো—বিএনপি কি এই দ্বৈত চাপে (আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন ও ইসলামপন্থী উত্থান) টিকে থাকার মতো রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি নিচ্ছে? নাকি আমরা আবারও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক চক্রে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, যেখানে অস্থিরতা শেষে সামরিক শাসনই হয়ে ওঠে শেষ অবলম্বন? বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন এক সন্ধিক্ষণে। আর এখানেই মূল প্রশ্ন—আমরা কি নেপালের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেব?


তারেক জিয়ার কেন দেশে ফেরা কেন জরুরি? 

আসিফ বিন আলী
আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
২০২৫ সেপ্টেম্বর ১৪ ১২:১৫:৩৩
তারেক জিয়ার কেন দেশে ফেরা কেন জরুরি? 

বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে একধরনের আত্মতুষ্টিতে ছিল যে তারা সহজেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। এই আত্মতুষ্টি তাদের রাজনৈতিক কৌশলকে দুর্বল করেছে। রাজনীতি বিজ্ঞানে একে বলা হয় “Overconfidence Trap”—যেখানে দল মনে করে জনসমর্থন এতটাই শক্ত যে সাংগঠনিক দুর্বলতা তাদের ক্ষতি করবে না। বাস্তবে দেখা গেল, তৃণমূলের অনেক নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠল, আর এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে বিএনপি ৪ হাজারেরও বেশি নেতাকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়। যদিও এটিকে “accountability politics”-এর উদাহরণ বলা যায়, তবে একই সঙ্গে এটি দলের ভেতরের অস্থিরতা ও সাংগঠনিক দুর্বলতাকেও সামনে এনেছে। অন্যদিকে মাঠে যেহেতু “মাইনাস বিএনপি” প্রোজেক্ট চলমান, সেই প্রেক্ষিতে বিএনপি-বিরোধী শিবির বিএনপির বিরুদ্ধে প্রচারণা বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে নিতে থাকে। মানুষের মনে এক ধরনের ধারণা তৈরি করে যে বিএনপির নেতারা দুর্নীতিবাজ, চোর এবং অসৎ।

ডাকসু নির্বাচনের পর বিএনপির হয়তো বোধোদয় হয়েছে যে জামাতকে তারা যতটা দুর্বল ভেবেছিল, তারা ততটা দুর্বল নয়। জামাত সাংগঠনিকভাবে গুছানো, পরিকল্পনামূলক এবং দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। অন্যদিকে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেল যদিও পরাজিত হয়েছে, মাত্র চার সপ্তাহের প্রস্তুতি নিয়েও তারা অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। শিবির যেমন তাদের নিজস্ব সাংগঠনিক সক্ষমতা ও জামাতের সহায়তা কাজে লাগিয়েছে এবং ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকেই ডাকসু নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করেছে। Michels-এর Iron Law of Oligarchy এর সাথে যারা পরিচিত তাড়া জানেন যে সংগঠন টিকে থাকতে হলে নেতৃত্ব ও কাঠামোগত শৃঙ্খলা জরুরি। জামাত সেই শৃঙ্খলা ধরে রেখেছে। অন্যদিকে ছাত্রদল এক ধরনের সমন্বয়হীনতার মুখোমুখি হয়েছিল এবং মাত্র চার সপ্তাহের প্রস্তুতি নিতে পেরেছিল। ছাত্রদলের নির্বাচনী সাফল্যের পেছনে দলের কোনো বিশেষ অবদান নয়, বরং ছাত্রদলের কর্মীদের ব্যক্তিগত পরিশ্রমই বড় কারণ ছিল। কিন্তু আমরা ভালো করেই জানি, নির্বাচনের মতো ঘটনায় শুধু ব্যক্তিগত বা গ্রুপভিত্তিক পরিশ্রম যথেষ্ট নয়, এখানে দরকার পড়ে সাংগঠনিক সক্ষমতা।

ডাকসুর এই পরাজয়ে বিএনপির মধ্যে একটি উপলব্ধি তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়—নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ জামাত। আর এই প্রতিপক্ষের সাংগঠনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা মোকাবেলা করার মতো প্রস্তুতি বিএনপি নিতে পারেনি। কেন পারেনি? এর অন্যতম কারণ হলো, বিএনপি মূলত একটি জনভিত্তিক দল, সংগঠনভিত্তিক দল নয়। এখানেই আসল টুইস্ট। জামাত যেমন নিজেদের সংগঠনকে শক্তিশালী করেছে, পাশাপাশি বিএনপির জনভিত্তিকে দুর্বল করতে গুছানো রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়েছে। বিএনপি বিরোধী ব্লক মানুষের মনে বিএনপিকে দুর্নীতিবাজ, চোর বা টেম্পু-স্ট্যান্ড পার্টি হিসেবে উপস্থাপন করতে তুলনামূলকভাবে সফল হয়েছে।

তাহলে বাকি থাকে সংগঠন। আপাতদৃষ্টিতে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা নাজুক। আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতাকে অনেকে সহানুভূতির চোখে দেখত—ভাবত, আওয়ামী লীগের দমন-নিপীড়নের কারণে বিএনপি দাঁড়াতে পারছে না। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আর এই সহানুভূতির সুযোগ নেই। এখন বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা মানুষ নিপীড়নের ফল হিসেবে নয়, বরং organizational incompetence হিসেবে দেখছে। এটি একধরনের legitimacy crisis—যেখানে মানুষ দলকে অযোগ্য হিসেবে দেখা শুরু করে। আর যদি এই ধারণা স্থায়ী হয়ে যায়, তবে মানুষ বিএনপিকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় ফেরার উপযুক্ত দল হিসেবে বিবেচনা করবে না। এই অনাস্থা ভবিষ্যতের নির্বাচনে বিএনপির জন্য ভয়াবহ বিপদের কারণ হতে পারে। ডাকসু নির্বাচন দেখিয়েছে যে শুধু আবেগ নয়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। Samuel Huntington-এর মতে, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে হলে institutionalization of politics প্রয়োজন। বিএনপি তার রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারছে না।

বিএনপির এই সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটানোর জন্য দলের প্রধান নেতাকে মাঠে নেমে আসতে হবে, কর্মীদের মাঝে অবস্থান নিতে হবে। নিঃসন্দেহে তিনি প্রবাসে থেকে দীর্ঘ ১৫ বছর দলকে একত্রিত করার যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। তখন তাঁর পক্ষে মানুষের সহানুভূতি ছিল। কিন্তু এখন আর সেই সহানুভূতি আগের মতো নেই। ডাকসু নির্বাচন বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর চরম মানসিক চাপ তৈরি করেছে।

ডাকসু নিয়ে সিনিয়র নেতৃবৃন্দের নীরবতা কি কোনো বিশেষ বার্তা বহন করছে? এই নীরবতার কারণ কী? দলের ভেতরে কি কোনো অভিমান তৈরি হচ্ছে যা অবশিষ্ট সংগঠনকেও অকার্যকর করে দিচ্ছে? অথবা দলের ভেতরে কি কোনো সিন্ডিকেট তৈরি হচ্ছে যারা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে? এই প্রশ্নগুলো এখন মানুষকে ভাবাচ্ছে। আর এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য মানুষ যখন নেতৃত্বের উপস্থিতি দেখতে চাইবে, তখন তা কেবল ফেসবুক পোস্ট বা ভিডিও বক্তৃতার মাধ্যমে সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার শারীরিক উপস্থিতি—মাঠে যাওয়া, শহরের গলিতে গলিতে যাওয়া, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাওয়া, কৃষকের সাথে হাত মেলানো, মসজিদে নামাজ পড়া, পূজার মণ্ডপে গিয়ে শুভেচ্ছা জানানো। এক কথায় একে বলে “proximity effect”। এর ফলে জনগণের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাজনৈতিক বৈধতা বাড়ায়। কৃষকের সাথে হাত মেলানো, ক্যাম্পাসে যাওয়া, পূজার মণ্ডপে যাওয়া—এসব কেবল প্রতীকী কাজ নয়, বরং রাজনৈতিক বৈধতা পুনর্গঠনের হাতিয়ার।

বিএনপি যেহেতু এক নেতা-ভিত্তিক দল, সেই নেতার দেশে ফেরা দেরি হলে তা আসলে বিএনপির রাজনৈতিক দুর্বলতাকেই স্পষ্ট করে। তারেক জিয়া হলেন বিএনপির “charismatic authority” (Max Weber)। যদি দীর্ঘদিন তিনি মাঠে অনুপস্থিত থাকেন, তবে দলের ভেতরে গেটকিপার তৈরি করে যারা মূলত সংগঠন ভেতরে বিভক্ত করে ফেলে। এই বিভক্তি শেষ পর্যন্ত charismatic authority কে চ্যালেঞ্জ এর মুখে ফেলে। বাস্তবতা হল, বিএনপি ভুল করবে যদি তারা ভাবে—সিভিল সোসাইটি, ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো বা সাধারণ মানুষ অবিরামভাবে শুধু জামাতের রাজনীতির বিরুদ্ধে তাদের সমর্থন দিয়ে যাবে। বিএনপি একমাত্র বিকল্প নয় ক্ষমতার রাজনীতিতে।

এই সত্য উপলব্ধি করেই তারেক জিয়ার দেশে আসা, দেশের মাটিতে সেজদা করা এখন বিএনপির জন্য সবচেয়ে জরুরি কাজ। প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি এই পথে হাঁটবে?


উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও ভূরাজনীতি: জাপান–বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ সমীকরণ

মো. অহিদুজ্জামান
মো. অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
২০২৫ সেপ্টেম্বর ১২ ২২:৫৪:১৭
উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও ভূরাজনীতি: জাপান–বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ সমীকরণ

ঢাকার ব্যস্ত সড়কে মেট্রোরেল ছুটে যায় দ্রুতগতিতে। হাজারো মানুষের কর্মজীবন বদলে দিচ্ছে প্রতিদিন। অনেকে হয়তো জানেন না, এই আধুনিক ব্যবস্থার পেছনে সবচেয়ে বড় সহায়তা এসেছে দূরপ্রাচ্যের দেশ জাপান থেকে। আবার কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে যে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, সেটিও জাপানের বিনিয়োগ ও কারিগরি সহায়তার ফসল। বলা চলে, বাংলাদেশের প্রতিটি উন্নয়ন অধ্যায়ের পেছনে একবার তাকালে দেখা যাবে—জাপানের নিঃশব্দ অথচ দৃঢ় উপস্থিতি।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে যখন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করছিল, তখন জাপান দ্রুত এগিয়ে আসে। মাত্র এক বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক টোকিও সফর দুই দেশের বন্ধুত্বকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে সেতু, রাস্তা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য—প্রতিটি খাতেই জাপানের সহায়তা বাংলাদেশের জন্য ছিল জীবনদায়ী। আস্থা, সহানুভূতি ও উন্নয়ন সহযোগিতার এই ভিত্তি আজও দুই দেশের সম্পর্কে এক অটুট বন্ধনের প্রতীক।

অতীতের সেই আস্থার উপর দাঁড়িয়ে সম্পর্কের চরিত্র আজ বদলে গেছে। বাংলাদেশ আর শুধু সহায়তার গ্রহীতা নয়; এখন এটি জাপানের কৌশলগত অংশীদার। বিশেষ করে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন দিশা এসেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস “৩৬০ ডিগ্রি কূটনীতি”র যে ধারণা দিয়েছেন, তাতে বহুমুখী সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তার কূটনৈতিক অগ্রাধিকারের তালিকায় জাপান শীর্ষে উঠে এসেছে—কারণ জাপান শুধু উন্নয়ন সহযোগী নয়, ভবিষ্যতের বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের জন্য এক নির্ভরযোগ্য মিত্র।

২০২৫ সালের মে মাসে ড. ইউনূসের টোকিও সফর এই সম্পর্কের নতুন অধ্যায় রচনা করে। প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে বৈঠকে জাপান শুধু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে স্বাগত জানায়নি, বরং ১.০৬৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ ও অনুদান সহায়তা ঘোষণা করেছে। নতুন রেলপথ, জলবায়ু সহনশীলতা এবং শিক্ষাবৃত্তির জন্য এই অর্থ ব্যয় হবে। একই সঙ্গে সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে—যার মধ্যে বিনিয়োগবান্ধব One Stop Service, ডিজিটাল নিরাপত্তা, জাপানি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে নতুন কারখানা স্থাপন এবং দক্ষ কর্মী উন্নয়ন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় ছিল একটি Economic Partnership Agreement (EPA)। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তীর্ণ হবে, তখন শুল্ক সুবিধা হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে। EPA হলে সেই সুবিধা বজায় থাকবে, রপ্তানি বৈচিত্র্য ঘটবে এবং বাংলাদেশ জাপানি বাজারে প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে পারবে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক সুযোগ, যাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন ঘটবে।

তবে জাপান–বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা বিস্তৃত হচ্ছে নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক কৌশলগত সহযোগিতায়। জাপান প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের নৌবাহিনীকে টহল নৌযান সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়ে নীতিগত ঐকমত্যও হয়েছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে জাপান বাংলাদেশকে শুধু উন্নয়ন সহযোগী নয়, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবেও দেখতে শুরু করেছে।

মানবসম্পদ উন্নয়ন এই অংশীদারিত্বের আরেকটি বড় দিক। আগামী পাঁচ বছরে অন্তত এক লক্ষ দক্ষ বাংলাদেশি কর্মী জাপানে যাবে—নার্সিং, কেয়ারগিভিং, আইটি, মেকাট্রনিক্সসহ বিভিন্ন খাতে। এতে একদিকে বাংলাদেশের তরুণরা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে, অন্যদিকে রেমিট্যান্স ও জ্ঞান-প্রবাহ উভয় দেশকেই সমৃদ্ধ করবে। এছাড়া উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় জাপানি বৃত্তি এবং যৌথ কর্মসূচি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।

তবে সামনে কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। বাংলাদেশের প্রশাসনিক জটিলতা ও দুর্নীতি বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় বাধা। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব ও ব্যয়বৃদ্ধি জাপানি আস্থাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং নীতির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা না গেলে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। অন্যদিকে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে বাংলাদেশকে সতর্কভাবে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েনের মাঝে জাপানের সাথে সম্পর্ক গভীর করতে গেলে দক্ষ কূটনীতির প্রয়োজন হবে।

অন্যদিকে, সুযোগও সীমাহীন। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মেট্রোরেল, তৃতীয় টার্মিনাল—এসব মেগা প্রকল্প বাংলাদেশকে আঞ্চলিক লজিস্টিক্স হাবে পরিণত করবে। EPA কার্যকর হলে রপ্তানি বাজার বহুমুখী হবে। জাপানের সবুজ প্রযুক্তি ও জলবায়ু সহায়তা বাংলাদেশের জন্য টেকসই উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। আর মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দক্ষ কর্মী প্রেরণ দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, জাপান–বাংলাদেশ সম্পর্ক আজ একটি উইন–উইন অংশীদারিত্ব। অতীতের আস্থার ভিত্তি, বর্তমানের কৌশলগত সাযুজ্য এবং ভবিষ্যতের অসীম সম্ভাবনা—সবকিছু মিলিয়ে এ সম্পর্ক শুধু দুই দেশের জনগণের জন্য নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের জন্য এটি কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, বরং একটি মর্যাদাপূর্ণ ভবিষ্যতের পথ। আর জাপানের জন্য বাংলাদেশ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির এক নির্ভরযোগ্য মিত্র।


শেখ হাসিনার উত্তরাধিকার প্রশ্ন: আওয়ামী লীগের সামনে এক অমীমাংসিত সংকট

২০২৫ সেপ্টেম্বর ০৮ ১১:৩০:২০
শেখ হাসিনার উত্তরাধিকার প্রশ্ন: আওয়ামী লীগের সামনে এক অমীমাংসিত সংকট

গণঅভ্যুত্থানের মুখে পতনের এক বছর পরে শেখ হাসিনা কি আওয়ামী লীগের ভেতরে তার উত্তরাধিকারীর হাতে দলের নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন? এই প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা আপাতত বাংলাদেশে কঠিন, কারণ যারা ন্যারেটিভ তৈরি করেন তাঁরা এখানে এক অঘোষিত এমবারগো চালু করেছেন। ফলে এ নিয়ে আলোচনা যুক্তির তুলনায় আবেগময় বিরোধিতার মুখে বেশি পড়ে। আমি এই আবেগের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করা এবং জুলাই–আগস্ট মাসে নাগরিকদের ওপর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করা নিঃসন্দেহে কঠিন। তবে আবেগকে সম্মান জানিয়েই আমি এই আলোচনায় প্রবেশ করছি, কারণ একাডেমিক হিসেবে আমার দায়িত্ব সময়ের বিরুদ্ধে গেলেও নিজের চিন্তা প্রকাশ করা। সব চিন্তাই যে সঠিক হবে তা নয়, কিন্তু অন্তত চিন্তাটা প্রকাশ করা জরুরি, যাতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে জটিল রাজনৈতিক ইস্যুগুলো বিশ্লেষণের সুযোগ তৈরি হয়।

শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। একটানা চুয়াল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি দল পরিচালনা করেছেন, একেবারে কঠোর হাতে। দলের মধ্যে তার বিকল্প খোঁজার চেষ্টা হয়নি বললেই চলে। তাই ‘সাকসেশন প্ল্যান’ নিয়ে কোনো প্রকাশ্য আলোচনা হয়নি; যা হয়েছে তা অনেকটাই বন্ধ দরজার আড়ালে। আওয়ামী লীগের দেশি–বিদেশি মিত্ররাও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন, কিন্তু শেখ হাসিনা নীরব থেকেছেন। কেন নীরব থেকেছেন তা তিনি নিজেই ভালো জানেন।২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। প্রথম সারির নেতারা হয় গ্রেফতার হয়েছেন, নয়তো পালিয়েছেন। দ্বিতীয় সারির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। তৃতীয় ও চতুর্থ সারির অনেক নেতা এখন স্থানীয়ভাবে বিএনপি ও জামায়াতের নিরাপত্তার ছায়ায় রয়েছেন—যদিও কেউ প্রকাশ্যে তা স্বীকার করবেন না। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি বোঝেন এমনরা জানেন বাস্তবতা।

আওয়ামী লীগের পতনকে কেবল রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয়, বরং আওয়ামীপন্থী সামাজিক শ্রেণি-জোটের ভেঙে পড়া হিসেবেও দেখা যায়। দলটি মধ্যবিত্তের সমর্থন হারিয়েছে, ছাত্রলীগ অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে, রাজনীতির জন্য প্রয়োজনীয় শ্রেণি-ভিত্তিক সমর্থনের অনেকটাই ক্ষয় হয়েছে। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক দুর্নীতি ও প্যাট্রোনেজ রাজনীতি দলটির ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারের প্রশ্নকে আরও জটিল করে তুলছে।

শেখ হাসিনা অনুপস্থিত থাকায় দলীয় তৃণমূল কোথা থেকে নির্দেশনা পাবে, তার কোনো স্পষ্ট প্রোটোকল আওয়ামী লীগের ছিল না। ফলে গত এক বছরে দলের কমান্ড কাঠামো কার্যত ভেঙে পড়েছে। অন্যদিকে যেসব নেতা–মন্ত্রীদের কারণে আওয়ামী লীগের এই পরিণতি, তাদের হাতে আছে বিপুল অর্থ, যা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত। অথচ জুলাই–আগস্টের আন্দোলন কিংবা ২০১৪ সালের পর থেকে একনায়কতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ার ঘটনাগুলো দল কখনো আত্মসমালোচনার চোখে দেখেনি। বরং ষড়যন্ত্রতত্ত্বকেন্দ্রিক ন্যারেটিভই তৈরি করেছে। এতে সাময়িকভাবে হার্ডকোর সমর্থকেরা সন্তুষ্ট হলেও প্রকৃত লাভবান হচ্ছেন সেই নেতারা, যারা মূলত দলের পতনের জন্য দায়ী। ফলে অর্থ ও ষড়যন্ত্রের জোরে তাদের প্রভাব এখনও টিকে আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো মাঠের আওয়ামী লীগ ভেঙে পড়েছে, নেতৃত্ব শুন্য।

ওবায়দুল কাদের যদি মনে করেন তিনি ভবিষ্যতে এসে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন, তবে তিনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। তার রাজনীতি শেষ। শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কাছে অন্য কোনো নেতার গ্রহণযোগ্যতা নেই। অথচ শেখ হাসিনার পক্ষে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত কোনো নেতা আর রাজনীতিতে ফেরেন না—এটা প্রায় নিয়মের মতো। তাছাড়া তার বয়সও হয়েছে। ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার সময় মানুষ তাঁকে পিতৃহারা কন্যা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ভারতে পালানোর পর তিনি আর সেই কন্যা নন, বরং গণতন্ত্র ধ্বংসকারী ও নাগরিক হত্যার দায়ে অভিযুক্ত এক পরাজিত প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা “শোকাহত কন্যা” থেকে “অধিকৃত একনায়ক” হয়ে উঠলেন, এই ফ্রেমিং থেকে কোনো নেতা বেরোতে পারেন না। ভাগ্যের এক নির্মম পরিহাস।

এই দুর্বলতার সুযোগ যেমন আওয়ামী লীগের ভেতরের অনেকে নিয়েছেন, তেমনি বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক খেলোয়াড়ও নিয়েছেন। এর মানে হলো সময় যত যাবে শেখ হাসিনার ওপর চাপ বাড়বে উত্তরাধিকারীর হাতে নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কে হবেন সেই উত্তরাধিকারী? কোন মডেলে হবে নেতৃত্বের হস্তান্তর? তাঁরা কি আসলেই নেতৃত্ব দিতে পারবেন? আওয়ামী লীগের উত্তরাধিকারের এই অমীমাংসিত প্রশ্নই হবে শেখ হাসিনার জীবনের শেষ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।পাকিস্তানের ভুট্টো পরিবার বা শ্রীলঙ্কার বন্দারনায়েক পরিবার উত্তরাধিকার নির্বাচনে কী করেছিল তা আমরা নিবিড়ভাবে দেখতে পারি। এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক উত্তরাধিকার কীভাবে কাজ করে তা খানিকটা বোঝা যাবে। তবে এই ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের জন্য ভারতের কংগ্রেস মডেল প্রাসঙ্গিক। বিজেপির কাছে পরাজয়ের পর বিলুপ্তির মুখে থাকা কংগ্রেসকে রাহুল গান্ধী–প্রিয়াঙ্কা গান্ধী যৌথ নেতৃত্বে গুছিয়ে তোলে। সফল হয়নি, কিন্তু বিরোধী দল হিসেবে প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখেছে এবং মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা কি এই মডেল অনুসরণ করবেন? আমার মনে হয়, তিনি একক কারো হাতে ক্ষমতা দেবেন না। জয় ও পুতুল—দু’জনকেই সামনে আনবেন। প্রশ্ন হলো, শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির ভূমিকা কী হবে?

আওয়ামী লীগের রাজনীতি বোঝেন এমন অনেককেই আমি এই প্রশ্ন করেছি। আমার যতটুকু বোঝা, তাতে মনে হয় পুতুল এখন সক্রিয় রাজনীতিতে আছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁর নেতৃত্বগুণ জয়ের থেকেও বেশি। দিল্লিতে দর্শনার্থীদের সঙ্গে দেখা করা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক কাজকর্ম ম্যানেজ করা—সবই তিনি করছেন। অন্যদিকে সজীব ওয়াজেদ মার্কিন নাগরিক। তিনি দলের মুখপাত্র হিসেবে থাকলেও মাঠের রাজনীতিতে কতটা নামবেন, তা অনিশ্চিত। তবে রাজনীতিতে তিনিও সক্রিয়।এটাই শেখ পরিবারের বাঁচা–মরার লড়াই। জিততে পারলে নেতৃত্ব শেখ পরিবারের হাতেই থাকবে, হারলে দল ভেঙে ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হবে। বাস্তবতা হলো আওয়ামী লীগকে এখনও পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ রাখতে পেরেছে মুজিবের রক্ত। যেমন বিএনপিকে এক রেখেছে জিয়ার রক্ত। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি “leader–centered” পার্টি, যেখানে প্রতিষ্ঠান দুর্বল। ফলে নেতৃত্বের প্রশ্ন উঠলেই পুরো সংগঠন অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। আর সে কারণেই নেতৃত্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠাতার রক্তের ভূমিকা মুখ্য হয়ে ওঠে।

অনেকেই ভেবেছিলেন ৫ আগস্ট এই সূত্র মুছে দেবে, কিন্তু অভ্যুত্থানের পর বিচারের ব্যর্থতা ও অভ্যুত্থান-নেতাদের ক্রমাগত রাজনৈতিক ভুল মুজিবের রক্তের উত্তরাধিকারকে আরও মূল্যবান করে তুলেছে। অন্যদিকে যারা Elite Succession Theory-এর সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা জানেন ক্ষমতাচ্যুত শাসকরা সাধারণত উত্তরাধিকার প্রশ্নে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টা করেন। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব জয়–পুতুল–রাদওয়ান এই ত্রিমাত্রিক পরিবারের হাতে রাখা হবে, যাতে দলীয় নিয়ন্ত্রণ শেখ পরিবারের বাইরে না যায়।

সেই প্রেক্ষিতে বলা যায়, আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন এখন তিন কেন্দ্র ঘিরে। দিল্লিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ভার্জিনিয়ায় প্রচারণা সামলাচ্ছেন সজীব ওয়াজেদ, আর কলকাতায় শক্তি ও অর্থের সমন্বয় করছেন আসাদুজ্জামান খান কামাল, এ.এফ.এম. বাহাউদ্দিন নাসিম ও জাহাঙ্গীর কবির নানক। অন্তত বিবিসির খবর তাই বলে। ফলে দেখা যাচ্ছে—‘ব্রেইন’ দিল্লিতে, প্রচারণা ভার্জিনিয়ায়, আর ‘মাসল ও মানি’ কলকাতায়।

প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ কি পারবে এই নতুন নেতৃত্ব নিয়ে রাজনীতিতে ফিরে আসতে? এই প্রশ্নের উত্তর এখনই দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ বিষয়টি এখনও বিকাশমান। আওয়ামী লীগের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হবে, ঠিক যে মুহূর্তে তারা ফেরত আসার চেষ্টা করবে, সে মুহূর্তে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি সবাই এক হয়ে যাবে আওয়ামী লীগের বিরোধিতায়। আগামী দশ বছর এই বিরোধিতা টিকে গেলে আওয়ামী লীগের পক্ষে রাজনীতি করা কঠিন হবে, তবে অসম্ভব নয়। ভবিষ্যৎ সরকার যদি সুশাসন দিতে ব্যর্থ হয় এবং বিরোধী দল যদি হিংসাত্মক, অগণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে, তবে আওয়ামী লীগ খুব সহজেই নিজের জন্য রাজনৈতিক স্পেস খুঁজে নেবে। আপাতত মনে হচ্ছে ভবিষ্যৎ সরকার সুশাসন দিতে যথেষ্ট বেগ পাবে ও বিরোধী দল গঠনমূলক রাজনীতিতে তেমন ভূমিকা রাখবে না বরং ধ্বংসাত্মক রাজনীতির দিকে এগবে। আপাতত আমরা এমন কোন লক্ষণ দেখছি না যা আর বাইরে কোন ভবিষ্যৎ এর ধারনা দিচ্ছে। সেই প্রেক্ষিতেই বলা যায়, আওয়ামীলীগ এর রাজনীতির রুম রাজনীতির আপনা নিয়মেই তৈরি হবে হয়তো।

আওয়ামী লীগের বয়স এখন ৭৬ বছর। মুক্তিযুদ্ধের পর এই প্রথম দল এত বড় সংকটে পড়েছে। প্রশ্ন হলো, জয়–পুতুল মডেল কি দলকে ঘুরে দাঁড় করাতে পারবে? শেখ পরিবার কি আবার নিজেদের রাজনৈতিক দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে? না কি দলটির এই নেতৃত্ব মডেল ব্যর্থ হলে মিশরের নাসেরবাদী পার্টির মতো ক্ষমতাচ্যুতির পর ভেঙে পড়বে?


পিনাকি গং-এর কৌশলগত প্রচারণা: বিএনপির বিভাজন ও ডানপন্থার উত্থান

আসিফ বিন আলী
আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
২০২৫ আগস্ট ৩১ ২৩:৩৬:৩০

বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে পিনাকি ও তার সহযোগীদের প্রচারণা এক নতুন ধরনের কৌশলগত বাস্তবতা তৈরি করেছে। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য ও বয়ানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। উদ্দেশ্য একটাই—আওয়ামী লীগের সমর্থকদের আবেগ উত্তেজিত করে তাদের আবারও ন্যারেটিভ স্পেসে সক্রিয় করা। এই প্রচেষ্টার আরেকটি লক্ষ্য হলো বিএনপির সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের ভয় দেখানো: “দেখো, আওয়ামী লীগ আবার ফিরতে চলেছে।” তবে বাস্তবতা হলো আওয়ামী লীগের আর মাঠ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সক্ষমতা নেই। কিন্তু তাদের “জুজু” দেখাতে কোনো ক্ষতি নেই; বরং সেটি কৌশলগতভাবে কাজে দেয়। এই প্রচারণার পেছনে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা আছে—বিএনপির ট্রানজিশনাল গণতন্ত্রে ফেরার চেষ্টা দুর্বল করে দেওয়া।

এই কৌশলের একটি দিক হলো পুরোনো আওয়ামী লীগ বনাম জামায়াত বিতর্ককে নতুন করে সামনে আনা। কারণ এই ইস্যুতে বিএনপির সাধারণ কর্মীরা স্বভাবতই আওয়ামী লীগবিরোধী অবস্থান নেবে। তখন তারা তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে আরও কঠোর বক্তব্য ও অবস্থান আশা করবে। যদি নেতৃত্ব এই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়, তবে সেই ফাঁক কাজে লাগিয়ে পিনাকি গং তাদের বর্তমান কৌশল চালিয়ে যাবে—বিএনপির নেতৃত্বকে ভারতপন্থী বা আওয়ামী লীগসহানুভূতিশীল বলে অভিযুক্ত করবে। তারা ইতোমধ্যেই এই প্রচারণা চালাচ্ছে, যাতে বিএনপির সাধারণ সমর্থকদের বিভ্রান্ত করা যায় এবং তাদের মধ্যে অবিশ্বাস ও বিভাজন তৈরি হয়।

পিনাকি গং ভালোভাবেই জানে যে বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব প্রবল। এই আবেগকে কাজে লাগিয়ে তারা আবারও রাজনীতিতে একটি নতুন ন্যারেটিভ গড়ে তুলতে চাইছে। সেটি হলো—আওয়ামী লীগ বনাম জামায়াত দ্বন্দ্ব। এই কৌশল কার্যকর হলে বিএনপির সাধারণ কর্মীরা একদিকে হতাশ হবে, অন্যদিকে নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

এই প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য তিনভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, বিএনপির সাধারণ সমর্থক ও নেতৃত্বের মধ্যে অবিশ্বাস ও দূরত্ব সৃষ্টি করা। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধপক্ষ বনাম বিরোধী পক্ষের বিতর্ককে ফিরিয়ে এনে আওয়ামী লীগকে নতুন করে প্রাসঙ্গিক করা। তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক উইংকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং জনপরিসরে সক্রিয়ভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে দাঁড় করানো। এর ফলে বিএনপিকে সীমিত অনলাইন সক্ষমতা নিয়ে দুই ফ্রন্টে লড়াই করতে হবে—একদিকে আওয়ামী লীগের প্রচলিত বয়ান, অন্যদিকে পিনাকি গং-এর বিভাজনমূলক প্রচারণা।

সবশেষে বলা যায়, এই ধরনের কৌশলগত প্রচারণার সবচেয়ে বড় উপকারভোগী হবে জামায়াত-শিবির এবং মাহমুদুর রহমানের নেতৃত্বাধীন চরম ডানপন্থি গোষ্ঠীগুলো। কারণ তারা একইসঙ্গে বিএনপিকে দুর্বল করতে পারবে এবং নিজেদের আদর্শিক অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রোপাগান্ডা নতুন কিছু নয়, কিন্তু পিনাকি গং-এর প্রচারণা একটি সুপরিকল্পিত কৌশল, যা শুধু একটি দলকে নয়, বরং পুরো গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রক্রিয়াকেই দুর্বল করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত। বিএনপিকে এ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে—কেবল আওয়ামী লীগ নয়, এখন তাদের লড়াই একটি নতুন শক্তির বিরুদ্ধেও, যারা বিভাজন ও অবিশ্বাসকে হাতিয়ার করে ডানপন্থার পক্ষে মাঠ প্রস্তুত করছে।


প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও বাংলাদেশে রাজনীতির বিপদসংকেত 

আসিফ বিন আলী
আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
২০২৫ আগস্ট ৩১ ২৩:২৪:৩৭

বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় ফেনোমেনন হলো প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। একাধিক রাজনৈতিক বর্গ ও অ্যাক্টর রাজনীতিকে মাঠের বাইরে সরিয়ে এনে নিজেদের ড্রয়িংরুমে সীমাবদ্ধ করেছেন। ঢাকার বিদেশি দূতাবাসগুলো এই প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে—অনেক রাজনৈতিক নেতা সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দূতাবাসে সময় কাটাচ্ছেন, ছক কষছেন, দাবার গুটির মতো চাল দিচ্ছেন। এই মুহূর্তে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের প্রধান শিকার জাতীয় পার্টি। প্রশ্ন হলো, এর পরবর্তী টার্গেট কে হবে? কারা চাইছে বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে অস্থিতিশীল করে ছোট ছোট দলগুলোর এক অস্থায়ী কোয়ালিশনকে ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসতে? এবং শেষ পর্যন্ত এই কোয়ালিশন কার স্বার্থ রক্ষা করবে?

জাতীয় পার্টির প্রতি আমার ব্যক্তিগত কোনো মায়া–মমতা নেই। আমি মনে করি না এই দলের কোনো প্রকৃত রাজনৈতিক দর্শন বা নীতি আছে। বরং দলটির নেতৃত্ব দীর্ঘ সময় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার প্রভাবেই নানা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই কারণেই জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) অভিযোগ তুলেছে যে জাতীয় পার্টি মূলত একটি ফ্যাসিস্ট সহযোগী শক্তি। সন্দেহ নেই, বিগত ১৫ বছরে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে, কখনো শেখ হাসিনার ভয়ে সরকারের সুযোগ–সুবিধা ভোগ করেছে।

তবুও এখানে একটি সম্ভাব্য পথ ছিল: সরকারের অন্যায় ও স্বৈরতান্ত্রিক সিদ্ধান্তে যারা সহযোগী ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচার হতো। সেই পথে না গিয়ে, অভ্যুত্থানের এক বছর পরে পুরো দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠছে—কোন স্বার্থে? কোন দূতাবাস বা জাতিসঙ্ঘ কর্মকর্তা এই নিষেধাজ্ঞার দাবিকে নৈতিক সমর্থন দিচ্ছেন? কেন বাংলাদেশকে ল্যাবরেটরি হিসেবে ব্যবহার করতে তারা এত আগ্রহী? এটি কি কেবল তৃতীয় বিশ্বের এক দেশে রাজনৈতিক এক্সপেরিমেন্ট চালানোর রোমাঞ্চ, যা কিছু তরুণ কূটনীতিকের জীবনের সবচেয়ে বড় অ্যাডভেঞ্চার হয়ে দাঁড়িয়েছে?

কিন্তু প্রশ্ন এখানে শেষ হয় না। আমাদের ছোট ছোট দলগুলোর নেতারাই বা কেন গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আস্থা না রেখে এই প্রকার আন্তর্জাতিক পরীক্ষার সহযোগী হচ্ছেন? তারা কি উপলব্ধি করছেন না, নিষেধাজ্ঞা ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের এই ধারাবাহিকতা কাকে শক্তিশালী করবে আর কাকে দুর্বল করবে? কে প্রকৃত উপকারভোগী হবে, আর এই প্রক্রিয়ার ফলাফল আগামী নির্বাচনে কীভাবে প্রতিফলিত হবে?

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীরা বিশ্বাস করেন—যদি তারা যথেষ্ট আবেগ এবং জুলাই চেতনার প্রতীক ব্যবহার করেন, তবে জনগণ তাদের কার্যক্রমে সমর্থন দেবে। কিন্তু তারা বুঝতে পারছেন না যে, তাদের স্কেপ রুট ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে। তারা যে পথে হাঁটছেন, সেটি জনআস্থার নয়, বরং ক্ষমতার শর্টকাটের পথ। আর যদি নির্বাচন বিলম্বিত হয়, তবে সবচেয়ে বড় বিপদে পড়বেন তারাই—এই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীরা। কারণ জনগণ শেষ পর্যন্ত যে শক্তির ওপর ভরসা করে, তা হলো গণতন্ত্র ও জনগণের অংশগ্রহণ, কোনো দূতাবাসের রাত্রিকালীন ছক নয়।

জাতীয় পার্টি হোক বা অন্য কোনো দল—রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিষিদ্ধ করার সংস্কৃতি আসলে দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র হয়তো কিছু সময়ের জন্য কোনো দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে পারে, কিন্তু তা কখনো স্থায়ী সমাধান দেয় না। আজ জাতীয় পার্টি টার্গেট, কাল অন্য কেউ হতে পারে। এই বাস্তবতাই প্রমাণ করে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার একমাত্র পথ হলো রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, আইনের শাসন ও জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ।


শেখ মুজিব: দেবতা, ভিলেন নাকি রাজনৈতিক ট্রাজেডির নায়ক?

ড. বাতেন মোহাম্মদ
ড. বাতেন মোহাম্মদ
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
২০২৫ আগস্ট ১৫ ১৭:৫১:৫১
শেখ মুজিব: দেবতা, ভিলেন নাকি রাজনৈতিক ট্রাজেডির নায়ক?

শেখ মুজিবুর রহমান দেবতা ছিলেন না। আধুনিক বিশ্বের কোনো জাতীয়তাবাদী নেতাই দেবতা নন। তারা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে জন্ম নেন না; বরং জাতির মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন তারা হয়ে ওঠেন সেই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় ভরসা, নেতৃত্বের প্রতীক এবং সম্মিলিত চেতনার কেন্দ্রবিন্দু। মুজিবও ছিলেন তেমন এক নেতা, যিনি এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন, ঠিক যেমন বিশ্ব ইতিহাসে বহু জাতি তাদের মুক্তির মুহূর্তে একজন মুখপাত্র খুঁজে পেয়েছে।

পোস্ট-কলোনিয়াল রাষ্ট্রব্যবস্থা শুরু হয় মূলত আমেরিকার হাত ধরে। যে আমেরিকার স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন, তাকেও ইতিহাস সমালোচনার মুখে ফেলেছে। তিনি ছিলেন একজন দাস-মালিক, বহু দাসকে অমানবিকভাবে ব্যবহার করতেন। আজকের নৈতিক মানদণ্ডে তাকালে ওয়াশিংটনের চরিত্রের অন্ধকার দিক স্পষ্ট হয়, কিন্তু তবুও তাঁকে অস্বীকার করা যায় না। কারণ তাঁর নেতৃত্বেই মানব ইতিহাস প্রথমবার দেখেছিল, মানুষ নিজের গোত্রীয় পরিচয়ের বাইরে গিয়ে এক নতুন জাতীয় সত্ত্বা গড়ে তুলতে পারে এবং নিজের শাসনের অধিকার অর্জন করতে পারে।

শেখ মুজিবও ছিলেন এক সাধারণ মানুষের মতো, যার মধ্যে ছিল লোভ, তোষামোদে প্রভাবিত হওয়ার প্রবণতা, আত্মীয়তাবাদী দুর্বলতা, এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি সুযোগ পেলে নিজেও ভুল করার সম্ভাবনা। কিন্তু তাঁর মধ্যে ছিল এক অসাধারণ ক্ষমতা, সাধারণ মানুষের মন পড়তে পারার এবং তাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে কয়েকটি সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর শব্দে প্রকাশ করার দক্ষতা। তাঁর উচ্চারণ "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম" হয়ে উঠেছিল কোটি বাঙালির হৃদয়ের অনুবাদ।

১৯৭১ সালের মুজিব কোনো ব্যক্তিমাত্র ছিলেন না। তিনি হয়ে উঠেছিলেন কোটি মুক্তিকামী মানুষের সম্মিলিত সত্তা। এই মানুষগুলোর মধ্যে ছিলেন মসজিদের ইমাম, সৎ ও সদালাপী শিক্ষক, আবার ছিলেন কিছু ঠগ, দুর্নীতিবাজ ও সুযোগসন্ধানীও। এই বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ছিলেন মুজিব। একাত্তরের মুজিব ইতিহাসে এক কালেকটিভ আইডেন্টিটি, একাত্মবোধের প্রতিচ্ছবি। আপনি তাঁকে স্বীকার করুন বা না করুন, এই ঐতিহাসিক সত্য পরিবর্তন হবে না।

তবে ১৯৭২ সালেই জাতি দেখল মুজিবের প্রথম মৃত্যু। একাত্তরের মুক্তির সম্মিলিত সত্তার মুজিব ধীরে ধীরে রূপ নিলেন ব্যক্তি মুজিবে, প্রধানমন্ত্রী মুজিবে। ক্ষমতার কেন্দ্রে এসে তাঁর মধ্যে দেখা দিল স্বজনপ্রীতি, অদূরদর্শিতা, পরিকল্পনাহীনতা এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের প্রবণতা। ইতিহাস তাঁকে এই জায়গায় সাধারণ মানের এক শাসক হিসেবেই চিহ্নিত করবে হয়তো। তবুও তিনি ছিলেন আলাদা এক বিষয়ে, মানুষকে ভালোবাসা, বিশ্বাস করা এবং সহজেই বাঙালির হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়ার জাদুকরী ক্ষমতায়। কিন্তু এই বিশ্বাসই অনেক সময় তাঁকে অস্থির ও সিদ্ধান্তহীন করে তুলত, যা শেষ পর্যন্ত অরাজকতা ও অসন্তোষের জন্ম দেয়। এই পরিস্থিতিতে অনেকের কাছে মুজিব হয়ে উঠলেন অগ্রগতির পথে বাধা। ইতিহাসে এরকম উদাহরণ বিরল নয়, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, জিম্বাবুয়ের মুগাবে কিংবা মুজিব, সবাই যেন স্বাধীনতার নায়ক থেকে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়ে বাধার প্রতীক হয়ে ওঠেন। প্রশ্ন থাকে, তাঁরা কি আসলেই ভিলেন, নাকি রাজনৈতিক ট্রাজেডির শিকার নায়ক।

১৯৭৫ সালের আগস্টে মুজিবের দ্বিতীয় মৃত্যু ঘটল। এবার তাঁর মৃত্যু এল ঘাতকের গুলিতে, যা তাঁর দেহকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করল। যাঁদের কাছে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু, তাঁদের অনেকে এই হত্যার মুহূর্তে নির্বাক হয়ে গেলেন। কেউ হতবাক হয়ে, কেউ আবার দুঃশাসন থেকে মুক্তির আশা নিয়ে। কিন্তু এই মৃত্যু তাঁর সব রাজনৈতিক ভুলকে একরকম রক্তের স্রোতে ভাসিয়ে দিল। এরপর শুরু হল ইতিহাসকে পুনর্লিখনের প্রয়াস, একটি প্রকল্প যা তাঁকে ভিলেন বানানোর চেষ্টা করল। কিন্তু বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় মুজিব বারবার ফিরে এলেন, কারণ প্রকৃত মুক্তির স্বাদ জাতি কোনোদিনই পুরোপুরি পায়নি।

মুজিবের তৃতীয় মৃত্যু সম্ভবত ঘটেছে গত পনের বছরে। এবার তাঁকে খুন করা হয়নি গুলিতে, বরং তিলে তিলে রাষ্ট্রীয় ন্যারেটিভের ভেতরেই তাঁর মৃত্যু ঘটেছে। মুক্তির সম্মিলিত সত্তার মুজিবকে মূর্তির মুজিবে রূপান্তরিত করা হয়েছে। রাষ্ট্র তাঁকে দেবতা বানিয়েছে, যেখানে তাঁর নাম ব্যবহার করে অন্যায়, নিপীড়ন, লুটপাট সবই বৈধতা পেয়েছে। মানুষের আবেগের মুজিব যখন মূর্তির মুজিব হয়ে গেলেন, তখনই তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় মৃত্যু বরণ করলেন।

তাহলে কি শেখ মুজিব সত্যিই মারা গেছেন? ইতিহাস বলছে, তিনি তিনবার মরেছেন, প্রথমবার ব্যক্তি মুজিব হয়ে, দ্বিতীয়বার ঘাতকের গুলিতে, এবং তৃতীয়বার দেবতা বানানোর প্রকল্পে। কিন্তু এসব মৃত্যুই সাময়িক। কারণ বাংলাদেশ যতদিন বিশ্ব মানচিত্রে থাকবে, ততদিন শেখ মুজিব থাকবেন। কখনো নায়ক হয়ে, কখনো বিতর্কিত নেতা হয়ে, আবার কখনো প্রতীক হয়ে। তিনি ফিনিক্সের মতো বারবার ফিরে আসবেন।

আমরা আসলে সবাই শেখ মুজিব। আমাদের ভেতরের সক্ষমতা, লোভ, দুর্বলতা, স্বপ্ন এবং সীমাবদ্ধতা মিলিয়েই শেখ মুজিবের প্রতিচ্ছবি। আমরাই তাঁকে বারবার হত্যা করেছি, আবার আমরাই তাঁকে পুনর্জীবিত করব আমাদের ভেতরে। শেখ মুজিব দেবতা ছিলেন না, ভিলেনও নন। তাঁকে দেবতা বানানো মানেই তাঁর মৃত্যু ঘটানো। আবার ভিলেন বানানোর চেষ্টা করলে তিনি নতুন রূপে ফিরে আসবেন। তাঁকে দেখতে হবে এক সাধারণ বাঙালি হিসেবে, যার মধ্যে যেমন অতিমানবীয় নেতৃত্বের ক্ষমতা আছে, তেমনি আছে মানবিক দুর্বলতা। এই মানবিক মুজিবকেই ইতিহাসে পড়তে হবে, মুক্তির মহানায়ক হিসেবে, যিনি ছিলেন তাঁর সময়ের সর্বাপেক্ষা বড় প্রতীক।

শ্রদ্ধা স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।


চূড়ান্ত বিপ্লবের পথে: চিন্তার পুনর্গঠন ও আত্মার জাগরণ

শামসুল আরেফীন
শামসুল আরেফীন
শিক্ষক ও রাজনৈতিক গবেষক
২০২৫ আগস্ট ১৪ ২২:০৫:৫৩

বাংলাদেশের অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়টি আজ এমন এক জটিল ও বহুমাত্রিক রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে অনিশ্চয়তা, বিভ্রান্তি, ক্ষমতার খণ্ডিত বণ্টন, এবং জনগণের আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব একসাথে বিদ্যমান। এই সময় একদিকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে লুকিয়ে থাকা গভীর সংকটকে উন্মোচিত করছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনাও জাগিয়ে তুলছে। কিন্তু এই সম্ভাবনা এখনো স্পষ্ট কোনো রূপরেখা পায়নি, কারণ রাষ্ট্রের ভরকেন্দ্র কোথায়—এই প্রশ্ন আজ সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী, আমলা, এমনকি ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর মধ্যেও অস্পষ্ট রয়ে গেছে। কখনো ক্ষমতার লাগাম থাকে সরকারিভাবে ঘোষিত প্রশাসনের হাতে, কখনো তা চলে যায় নেপথ্যের ডিপ স্টেইট বা সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে, আবার কখনো অভ্যুত্থানকারী গোষ্ঠীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে সংঘাত, প্রতিযোগিতা ও আপসের সমন্বিত রাজনীতির কাছে। এই অস্থিরতা রাষ্ট্র কাঠামোকে এক বৈষম্যমূলক ও খণ্ডিত ক্ষমতা বিভাজনের পথে ঠেলে দিয়েছে, যেখানে জনগণের প্রতিনিধিত্ব, জবাবদিহিতা বা নৈতিক নেতৃত্বের সুস্পষ্ট চিহ্ন খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে।

অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক ক্ষমতার চূড়ান্ত কাঠামোয় মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি—এটাই বাস্তবতা। প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র, যার একটি বড় অংশ দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছে, তারা আগের মতোই নিজেদের প্রভাব বজায় রেখেছে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে, সিটি কর্পোরেশনগুলো নিস্ক্রিয়তায় ভুগছে, এবং গ্রামীণ পর্যায়ে গণপ্রশাসনের পরিসর সঙ্কুচিত হয়েছে। অথচ রাজনৈতিক বক্তৃতায় “সংস্কার” শব্দটি ক্রমেই বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, যেন এটি একটি অলংকার মাত্র, যার বাস্তব রূপায়ন জনগণ প্রত্যাশা করলেও বাস্তবে তার দেখা মিলছে না। জনগণ যে কাঠামোগত পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিল, তা অধরাই রয়ে গেছে। এই ব্যর্থতা জনগণের মনে ক্ষোভ ও হতাশা জন্ম দিচ্ছে, যা একদিকে গণআকাঙ্ক্ষাকে নিস্তেজ করছে, অন্যদিকে নতুন ধরনের চূড়ান্ত বিপ্লবের দাবি জোরালো করছে।

কিন্তু বিপ্লব কি শুধুমাত্র পুরনো সরকার পতনের মাধ্যমে ঘটে? নাকি প্রকৃত বিপ্লবের রূপ হলো এমন এক নতুন চেতনার বিকাশ, যা সমাজ ও রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে কল্পনা ও নির্মাণ করে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের স্মরণ করতে হয় আলী শরিয়াতীর মতো চিন্তককে, যিনি ইসলামী জাগরণ ও মার্ক্সীয় চিন্তার মধ্যে সংলাপ ঘটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে এক আত্মিক বিপ্লবের তাত্ত্বিক ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। শরিয়াতী প্রমাণ করেছিলেন যে বিপ্লব কেবল রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন নয়; এটি আত্মার পরিবর্তন, নৈতিকতার পুনর্জাগরণ এবং সামাজিক চরিত্রের রূপান্তরের বিষয়ও বটে। তাঁর ভাষায়, “ইসলাম যদি শুধুই আচার হয়, তবে তা মুক্তির পথ নয়; কিন্তু যদি তা ন্যায়ের জন্য দাঁড়ায়, তবে সেই-ই সত্যিকার বিপ্লবের ভাষা।”

বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই আত্মিক ও নৈতিক বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতা আজ অনেক গভীর। আমরা দেখেছি, ধর্মনিরপেক্ষতা কিংবা স্বাধীনতার চেতনার নামে একসময়ের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কীভাবে দীর্ঘদিন ধরে জনগণকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে বঞ্চিত করেছে। এ অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, কেবল আদর্শিক ট্যাগ দিয়েই কোনো রাজনৈতিক শক্তির প্রকৃত চরিত্র নির্ধারণ করা যায় না। “লেফট মানেই প্রগতিশীল” কিংবা “রাইট মানেই প্রতিক্রিয়াশীল”—এই সরলীকৃত বিভাজন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভেঙে পড়েছে। আওয়ামী লীগ একটি তথাকথিত বাম-ঘেঁষা দল হয়েও ডানপন্থী ও বামপন্থী উভয় অংশের সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে কীভাবে ফ্যাসিবাদী শাসন পরিচালনা করেছে, তা দেশবাসী নিজের চোখে দেখেছে।

এই অভিজ্ঞতা আমাদের চিন্তার কাঠামো ভাঙার আহ্বান জানাচ্ছে। এখন প্রয়োজন এমন এক বিপ্লবী রূপরেখা, যেখানে ইসলামী ন্যায়বিচার, সামাজিক সাম্য এবং জনগণের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও আত্মিক অনুভূতিকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। ধর্মকে নিছক গোঁড়ামির প্রতীক বানিয়ে যারা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেন, তারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই সমাজের বাস্তবতাকে অস্বীকার করছেন। অন্যদিকে যারা ধর্মের নামে নিপীড়ন ও বৈষম্যকে বৈধতা দেন, তারাও ইতিহাস, ন্যায়বিচার এবং মানবিকতার মূল দর্শনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন। তাই এই দুই চরমপন্থার বাইরে গিয়ে প্রয়োজন এক আত্মিক-রাজনৈতিক সংলাপ, যা জনগণের বিশ্বাস, অভিজ্ঞতা ও বাস্তব জীবনের চাহিদাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে।

বিশ্বের অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনের উদাহরণ আমাদের এ বিষয়ে শিক্ষা দেয়। মেক্সিকোর জাপাতিস্তারা আদিবাসী, কৃষক ও শ্রমজীবী জনগণকে কেন্দ্র করে এমন এক বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যা কেবল রাজনৈতিক নয় বরং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাকেও সমান গুরুত্ব দিয়েছে। বলিভিয়ার ইভো মোরালেস বা ভেনিজুয়েলার হুগো শাভেজ ঐতিহ্য, শ্রেণি এবং সংস্কৃতির সমন্বয়ে জনগণের আস্থা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছিলেন। বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতিকে যদি সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, তবে স্পষ্ট হবে যে তাদের একটি বড় অংশ এখনও জনগণের সঙ্গে আত্মিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগ তৈরি করতে ব্যর্থ। তারা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, একাডেমিক তত্ত্ব এবং সীমিত শহুরে আন্দোলনের মধ্যে আবদ্ধ থেকে গেছে। ফলে সাধারণ মানুষ তাদের রাজনীতিতে নিজেদের প্রতিফলন দেখতে পায়নি, এবং তা বিশ্বাসও করেনি।

এই যে গণ-সম্পৃক্ততার অভাব, তা দূর না হলে নতুন কোনো বিপ্লবই গণমানুষের শক্তি হয়ে উঠতে পারবে না। বিপ্লবকে মানুষের ভাষায়, তাদের বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক অনুভূতির জায়গায় দাঁড়িয়ে সংগঠিত করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন এক নতুন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কল্পনা, যা রাষ্ট্রের কাঠামো পুনর্গঠন করার পাশাপাশি নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং আত্মিক নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করবে। এই নেতৃত্ব কেবল ক্ষমতা দখলের জন্য নয়, বরং জনগণের জীবনে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবে।

এই মুহূর্তে করণীয় হলো চিন্তার পুনর্গঠন ও বিকল্প তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণ। একদিকে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উপাদানকে মুক্তিকামী ধারায় রূপান্তরিত করতে হবে, যাতে তা মুক্তি ও ন্যায়বিচারের সংগ্রামে সহায়ক হয়। অন্যদিকে বিকেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে, যেখানে জনগণ সরাসরি অংশগ্রহণ করবে। প্রয়োজনে একটি নতুন সাংবিধানিক কাঠামো প্রণয়নের আলোচনায় যেতে হবে, যেখানে শাসকের ক্ষমতার সীমা স্পষ্টভাবে নির্ধারিত থাকবে এবং জনগণের অধিকার ও মর্যাদা হবে রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি।

তবে একটি বিপ্লব কেবল তখনই স্থায়ী হয়, যখন তা জনগণের নৈতিক চেতনায় গভীরভাবে প্রোথিত হয়। এই নৈতিক চেতনা গড়ে তুলতে প্রয়োজন দীর্ঘ সময়, ত্যাগ, সঠিক শিক্ষা এবং নেতৃত্বের আদর্শিক পবিত্রতা। কেবল রাজনৈতিক কৌশল নয়, বিপ্লবকে বাঁচিয়ে রাখতে দরকার সামাজিক সংহতি, সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং আত্মিক পরিশুদ্ধতা। অভ্যুত্থান হয়তো আমাদের সামনে সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে, কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক সাহস, কৌশলগত প্রজ্ঞা এবং নৈতিক দৃঢ়তা। জনগণের আস্থা অর্জন এবং তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো পরিবর্তনই স্থায়ী হতে পারে না।

অতএব, আজ আমাদের সামনে দ্বৈত চ্যালেঞ্জ—একদিকে রাষ্ট্রের খণ্ডিত ক্ষমতা কাঠামো পুনর্গঠন, অন্যদিকে জনগণের অন্তরে ন্যায়ের চেতনা জাগিয়ে তোলা। এই দুইয়ের সমন্বয় ছাড়া কোনো বিপ্লবই তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সামাজিক বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এক নতুন রাজনৈতিক দর্শন তৈরি করতে হবে, যা অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশকে কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং আত্মিক পুনর্জাগরণের পথেও এগিয়ে নেবে। এ পথ সহজ নয়, কিন্তু ইতিহাসের প্রতিটি স্থায়ী পরিবর্তন এমন কঠিন ও দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমেই এসেছে।

লেখক:
শামসুল আরেফীন
শিক্ষক ও গবেষক, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
পিএইচডি গবেষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র।


শেখ হাসিনার পতনের পর কূটনীতি ও নিরাপত্তার কঠিন প্রশ্নগুলো

আলিফ ইফতেখার হোসেন
আলিফ ইফতেখার হোসেন
গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
২০২৫ আগস্ট ০৭ ১৬:২৪:৫৪
শেখ হাসিনার পতনের পর কূটনীতি ও নিরাপত্তার কঠিন প্রশ্নগুলো

বাংলাদেশ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যে রাজনৈতিক ভূমিকম্পের মুখোমুখি হয়েছিল, তা কেবল একটি একদলীয় সরকারের পতনের ঘটনা ছিল না। বরং এটি ছিল একটি যুগান্তকারী মোড়, যেখানে জাতি পুনরায় তার নিরাপত্তা, পররাষ্ট্রনীতি এবং রাষ্ট্রীয় আদর্শের মৌলিক প্রশ্নগুলো নতুনভাবে অনুধাবন করতে বাধ্য হয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের পর উদ্ভূত অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সবচেয়ে কঠিন যে চ্যালেঞ্জগুলো এসেছে, তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক ভারসাম্য পুনর্গঠন।

বিগত কয়েক দশকে আমরা একটি আত্মতুষ্ট রাষ্ট্র হয়ে উঠেছিলাম। ১৯৭১–এর পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর এক ধরনের অনুকূল ভূরাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে অবস্থান করায় আমরা ভুলে গিয়েছিলাম যে নিরাপত্তা হলো উন্নয়নের পূর্বশর্ত। ভারতের প্রভাবমুক্ত ভারসাম্য রক্ষা এবং চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখা—এসব আমরা ‘কৌশল’ মনে করলেও, প্রকৃতপক্ষে তা ছিল স্বস্তিবাদী এবং স্বল্পমেয়াদি কূটনৈতিক খেলাচিত্ত। অথচ, আজ যখন মিয়ানমার সীমান্ত অস্থির, রোহিঙ্গা সংকট এখনও অমীমাংসিত, এবং আঞ্চলিক অস্থিরতা ঘনীভূত, তখন আমরা উপলব্ধি করছি, নিরাপত্তা নিশ্চয়তা ছাড়া উন্নয়নের সমস্ত প্রচেষ্টা জলের বুদবুদের মতো।

বাংলাদেশের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলো ভারতের তুলনায় অনেক বেশি বহুমাত্রিক। ভারতের রয়েছে বিশাল সামরিক শক্তি ও অর্থনৈতিক বলয়, কিন্তু বাংলাদেশ—একটি ছোট, জনবহুল এবং ভূকৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ—বরাবরই এক প্রকার নিরাপত্তাহীনতার বৃত্তে বন্দী থেকেছে। শেখ হাসিনার সরকার এই নিরাপত্তা প্রশ্নকে একটি বাহ্যিক রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করেছিল। ভারতকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি এবং সীমান্তে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু, পানিবণ্টন অসমতা, এবং অবৈধ অনুপ্রবেশের মতো সমস্যা উপেক্ষিত থেকে গেছে। কিন্তু নতুন অন্তর্বর্তী প্রশাসনের সবচেয়ে বড় উপলব্ধি হলো, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এখন আর বিকল্প নয় বরং পরস্পরের পরিপূরক। এই উপলব্ধি থেকেই নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শূন্য সহনশীলতা, অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস নির্মূল এবং সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।

উন্নয়ন কোনো যাদু নয়। এটি দীর্ঘস্থায়ী মৌলিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। এই মৌলিক কাঠামোর প্রথম স্তম্ভ হলো জিরো টলারেন্স নিরাপত্তা নীতি, উগ্রবাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান এবং গঠনমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। শেখ হাসিনার পতনের পর যারা দ্রুত একটি নতুন আদর্শিক রাজনীতির নাম করে পুনরায় বিভাজন তৈরি করতে চায়, তারা এই ভিত্তিকে নড়বড়ে করে তুলছে। গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা এবং নিরাপদ রাষ্ট্র। কিন্তু যখন কোনো রাজনৈতিক নেতা বলেন, “আফগানিস্তান হবে আমাদের মডেল,” তখন সেটা আর কেবল মতামত থাকে না। সেটি হয়ে দাঁড়ায় এক ভয়াবহ বিপদের অশনিসঙ্কেত।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র সচিব এম হুমায়ুন কবির অত্যন্ত যুক্তিযুক্তভাবে বলেছেন, “আমাদের কূটনৈতিক পথ নির্ধারিত হোক ইতিহাস, আবেগ কিংবা রাজনৈতিক পক্ষপাত নয়, বরং জাতীয় স্বার্থ ও জনগণের কল্যাণের ভিত্তিতে।” তাঁর এই বক্তব্যে দ্বিমতের কোনো সুযোগ নেই। তবে এই কথা বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হলো ঘরোয়া রাজনীতিকে পরিশীলিত, সহনশীল এবং জাতীয় স্বার্থকেন্দ্রিক করতে হবে। কারণ, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যদি আদর্শগত সংকীর্ণতায় আক্রান্ত হয়, তাহলে তা কেবল ঘরোয়া সংঘাতে নয় বরং বৈদেশিক কূটনীতিতেও বিভ্রান্তি তৈরি করে। তখন রাষ্ট্রীয় পররাষ্ট্রনীতি হয়ে ওঠে দলীয় প্রপাগান্ডার সম্প্রসারণ মাত্র।

বাংলাদেশ বহু বছর ধরেই পররাষ্ট্রনীতিতে আবেগতাড়িত অবস্থান নিয়েছে। কেউ ১৯৭১-এর উত্তরাধিকারকে রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে, আবার কেউ পশ্চিমা কিংবা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে দলীয় ট্রফিতে পরিণত করেছে। ফলে, আমরা বহুবার বাস্তব কূটনৈতিক সুযোগ হাতছাড়া করেছি। যেমন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের প্রভাব কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার ভারতের পানিবণ্টনে গড়িমসি সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধাচরণ না করে আত্মসমর্পণের কূটনীতি গ্রহণ করেছি।

বাস্তব কূটনীতি এসবের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে কেবল তখনই, যখন দেশের অভ্যন্তরে একটি পরিপক্ব রাজনৈতিক পরিবেশ থাকে, যেটি প্রথমে উন্নয়ন ও নিজ রাষ্ট্রের স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়, কেবল আদর্শকে নয়। অনেক সময়ই আমরা যতটা মনে করি, তার থেকেও বেশি পরিমাণে আদর্শিক রাজনীতি আমাদের পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে। তাই যদি আমরা এমন এক পররাষ্ট্রনীতি চাই, যা সত্যিকারের অর্থে জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত, তাহলে আমাদের প্রথমেই দেশের ভেতরের রাজনীতিকে শুদ্ধ করতে হবে। সেই স্ট্রং ফান্ডামেন্টাল, অর্থাৎ কিছু মৌলিক বিশ্বাস ও মূল্যবোধ গড়তে না পারলে কোনো ধরনের কৌশলগত প্রস্তুতিই দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হবে না।

এখানে আমাদের একটি দ্ব্যর্থহীন অবস্থান নিতে হবে। উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, এমনকি যদি সেটা ‘জনপ্রিয়’ কোনো আদর্শিক কাঠামোর মধ্যে থেকেও আসে। কূটনীতি কোনো রোমান্টিকতা নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের বাস্তববাদী আত্মপরিচয়।

শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে এখনও সময় আছে নিজেদের কূটনৈতিক অবস্থান পুনর্গঠন করার, নিরাপত্তা কাঠামো শক্তিশালী করার এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশকে একটি কার্যকর ও আত্মনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে পুনঃস্থাপন করার। প্রথম ধাপে আমাদের নিতে হবে স্মার্ট নিরাপত্তা কৌশল, যেখানে আধুনিক সেনা, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে থাকবে সাইবার নিরাপত্তা বাহিনী। দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে উগ্র মতবাদ থেকে মুক্ত করে একটি গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক ও স্থিতিশীল কাঠামোয় ফিরিয়ে আনতে হবে। তৃতীয়ত, বহুমুখী কূটনৈতিক জোট গঠনের মাধ্যমে ভারতনির্ভরতা কমাতে হবে এবং বিকল্প কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকা অঞ্চলে। চতুর্থত, অর্থনৈতিক কূটনীতি শক্তিশালী করে রপ্তানি, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও মেগা প্রকল্পে বৈচিত্র্য আনতে হবে। এবং সর্বশেষে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশকে একটি চিন্তাশীল, মানবিক এবং সাহসী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশ এক নতুন সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। এখনই সময় কূটনীতি ও নিরাপত্তার প্রশ্নগুলোকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি পুনর্নির্মাণের। গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়। এটি মানে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে সম্মানজনক অবস্থান। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য এখন প্রয়োজন বাস্তববাদ, ঐক্য এবং দূরদৃষ্টি। আবেগ নয়, এখন প্রয়োজন কঠিন সিদ্ধান্ত এবং স্থির সংকল্প। কেননা ইতিহাস প্রমাণ করে, যখন জাতি একসাথে দাঁড়ায়, তখন পরিবর্তনের অনিবার্যতা কেউ ঠেকাতে পারে না।

-লেখক আলিফ ইফতেখার হোসেন, বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই) এ গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মরত আছেন। ইমেইল:✉️[email protected]

পাঠকের মতামত: