ভাষান্তর

শতাব্দীর প্রভাবশালী দলিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র—তৃতীয় পর্বের প্রথমাংশ

ইতিহাস ও দর্শন ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২১ ২০:২৮:৫০
শতাব্দীর প্রভাবশালী দলিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র—তৃতীয় পর্বের প্রথমাংশ

রাজনৈতিক দর্শনের ইতিহাসে এক অনন্য দলিল হলো কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। জার্মান ভাষায় এর মূল নাম “Manifesto der Kommunistischen Partei”, অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার। বিখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালে এই এটি লিখেন, যা প্রথম প্রকাশিত হয় লন্ডনে। ১৮৪৮ সালে যখন এটি ইউরোপে প্রকাশিত হয়, তখনকার বিপ্লবাত্মক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি ছিল এক যুগান্তকারী লেখা। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-কে আজও বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলিলগুলোর অন্যতম বলে বিবেচনা করা হয়।

এই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির চারটি অধ্যায় রয়েছে। ধারাবাহিক ভাবে আমরা এর ভাবানুনাদ পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি। আজ আমরাতৃতীয় পর্ব “Socialist and Communist Literature”-এর প্রথম তিনটি উপধারা (Reactionary Socialism: Feudal Socialism, Petty-Bourgeois Socialism, এবং German or “True” Socialism) এর সরল, পরিশীলিত ও ব্যাখ্যামূলক ভাষান্তর পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করছি।আশাকরি পাঠকরা সহজভাবে এর মূল ভাবনা ও তাৎপর্য বুঝতে পারবেন।

III. সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট সাহিত্য

১. প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্র

ক. সামন্তবাদী সমাজতন্ত্র

তাদের ঐতিহাসিক অবস্থানের কারণে, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের অভিজাত শ্রেণির জন্য আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজের বিরুদ্ধে পামফ্লেট লেখাই হয়ে ওঠে একধরনের নৈতিক কর্তব্য। ১৮৩০ সালের ফরাসি জুলাই বিপ্লবে এবং ইংল্যান্ডের সংস্কার আন্দোলনে এই অভিজাতরা পুঁজিবাদের নবাগত উত্থানের কাছে আবারও পরাজিত হয়। এর পর থেকে রাজনৈতিক সংগ্রামের আর কোন বাস্তব সম্ভাবনা ছিল না—শুধু সাহিত্যিক যুদ্ধই অবশিষ্ট ছিল।

কিন্তু সাহিত্যক্ষেত্রেও পূর্ববর্তী পুনঃস্থাপন যুগের স্লোগানগুলো ছিল অচল ও অচলিত। সহানুভূতি জাগানোর জন্য, এই অভিজাত শ্রেণি নিজেদের স্বার্থকে আড়াল করে ফেলতে বাধ্য হয় এবং তাদের সমালোচনার লক্ষ্য হিসেবে নিপীড়িত শ্রমজীবী শ্রেণির স্বার্থকে সামনে তুলে ধরে। এক অর্থে, অভিজাতরা তাদের প্রতিশোধ নেয় বিদ্রুপপূর্ণ ব্যঙ্গকাব্যের মাধ্যমে এবং ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের গোপন ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করে।

এইভাবেই ‘সামন্তবাদী সমাজতন্ত্র’-এর উদ্ভব ঘটে—অর্ধেক শোকগাথা, অর্ধেক ব্যঙ্গকাব্য; একদিকে অতীতের প্রতিধ্বনি, অন্যদিকে ভবিষ্যতের ভীতি; মাঝে মাঝে এর তীব্র ও বুদ্ধিদীপ্ত সমালোচনা পুঁজিবাদকে গভীরভাবে আঘাত করে, কিন্তু আধুনিক ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি না বোঝার অক্ষমতা একে সর্বদা হাস্যকর করে তোলে।

অভিজাত শ্রেণি জনগণকে নিজের পক্ষে টানার জন্য শ্রমজীবী শ্রেণির দান থলের প্রতীককে নিজেদের পতাকা বানায়। কিন্তু যতবারই জনগণ তাদের সঙ্গে একাত্ম হতে চায়, ততবারই তাদের পিছনে পুরোনো সামন্ততান্ত্রিক প্রতীকচিহ্ন দেখতে পায় এবং উচ্চকণ্ঠে, অশ্রদ্ধাভরে তাদের ত্যাগ করে।

ফ্রান্সের ‘লেজিতিমিস্ট’ দল ও ইংল্যান্ডের ‘ইয়ং ইংল্যান্ড’ গোষ্ঠী এই ছবিটিই উপস্থাপন করেছিল।

পুঁজিবাদীদের শোষণপ্রণালী থেকে নিজেদের আলাদা দেখাতে গিয়ে সামন্তবাদীরা ভুলে যায় যে, তারা এক ভিন্ন সময়, ভিন্ন বাস্তবতায় শোষণ করত, যেগুলো আজ বিলুপ্তপ্রায়। তারা যখন বলে যে, তাদের শাসনে আধুনিক প্রলেতারিয়ানের অস্তিত্ব ছিল না, তারা ভুলে যায় যে, আধুনিক পুঁজিবাদ তো তাদেরই সমাজব্যবস্থার ঐতিহ্যিক ফল।

সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো—তাদের সমালোচনার মূল বক্তব্য এটাই যে, পুঁজিবাদ এমন এক শ্রেণি তৈরি করছে, যা ভবিষ্যতে সম্পূর্ণভাবে পুরাতন সমাজব্যবস্থাকে উৎখাত করবে। তারা শুধু প্রলেতারিয়ানের জন্মেই রুষ্ট নয়, বরং এই প্রলেতারিয়ান শ্রেণির বিপ্লবী চরিত্র নিয়েই তারা সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত।

রাজনৈতিক বাস্তবতায়, এই শ্রেণি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দমনমূলক ব্যবস্থার সমর্থক হয়ে দাঁড়ায়। আর ব্যক্তিগত জীবনে, তাদের উচ্চাভিলাষী বক্তৃতার বিপরীতে তারা শিল্পবৃক্ষ থেকে ঝরে পড়া সোনার ফল কুড়িয়ে নেয়, এবং সত্য, প্রেম ও মর্যাদাকে ত্যাগ করে উল্টে পশম, বিট চিনির ও আলুর মদে লেনদেন করে।

যেভাবে পুরোহিত সর্বদা জমিদারের সঙ্গী হয়ে চলে, তেমনি ধর্মীয় সমাজতন্ত্রও সামন্তবাদী সমাজতন্ত্রের এক অঙ্গ। খ্রিস্টীয় সংযমবাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের রঙ মেশানো খুব সহজ। খ্রিস্টধর্ম কি ব্যক্তি সম্পত্তি, বিবাহ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রচার করেনি? তারা কি দানের বদলে দারিদ্র্য, দাম্পত্যের বদলে ব্রহ্মচর্য, শরীরের ত্যাগ, গির্জার জীবন প্রচার করেনি?

এই 'খ্রিস্টীয় সমাজতন্ত্র' কেবলমাত্র সেই পবিত্র জল, যা দিয়ে পুরোহিত অভিজাতদের হৃদয়ের জ্বালা প্রশমন করে।

খ. ক্ষুদ্র-মধ্যবিত্ত সমাজতন্ত্র

সামন্তবাদীদের মতো ক্ষুদ্র-মধ্যবিত্ত শ্রেণিও পুঁজিবাদ দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মধ্যযুগীয় বুর্জোয়া শ্রেণি ও ক্ষুদ্র কৃষকরা ছিল আধুনিক পুঁজিবাদের পূর্বসূরি। যেসব দেশে শিল্প বা বাণিজ্যে উন্নতি কম, সেখানে এখনো এই শ্রেণিগুলো নবগঠিত পুঁজিবাদের সঙ্গে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।

আধুনিক সভ্যতাপ্রাপ্ত দেশগুলোয় গঠিত হয়েছে এক নতুন ক্ষুদ্র-মধ্যবিত্ত শ্রেণি—প্রলেতারিয়ান ও বুর্জোয়ার মাঝামাঝি, যা বারবার প্রতিযোগিতার চাপে প্রলেতারিয়ানে পরিণত হয়। আধুনিক শিল্প যতই বিকশিত হচ্ছে, ততই এই শ্রেণির সদস্যরা তাদের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে কারখানার তত্ত্বাবধায়ক, জমির বেয়লিফ বা দোকান কর্মচারীতে পরিণত হচ্ছে।

ফ্রান্সের মতো দেশ, যেখানে অধিকাংশ জনগণ কৃষিজীবী, সেখানে প্রলেতারিয়ানের পক্ষ অবলম্বনকারী লেখকরা কৃষক ও ক্ষুদ্র-মধ্যবিত্তদের মানদণ্ডেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সমালোচনা করেন, এবং এই মধ্যবর্তী শ্রেণির দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রমিক শ্রেণির পক্ষ সমর্থন করেন। এর থেকেই জন্ম নেয় ক্ষুদ্র-মধ্যবিত্ত সমাজতন্ত্র। এই ধারার শ্রেষ্ঠ চিন্তক ছিলেন সিসমন্ডি, শুধু ফ্রান্সে নয়, ইংল্যান্ডেও।

এই সমাজতন্ত্র অত্যন্ত সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করেছে আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতির বৈপরীত্যগুলো—যন্ত্রপাতির ধ্বংসাত্মক প্রভাব, শ্রমবিভাগ, মূলধন ও জমির কেন্দ্রীকরণ, অতিরিক্ত উৎপাদন ও অর্থনৈতিক মন্দা; প্রলেতারিয়াতের দারিদ্র্য, পুঁজির অসাম্য বণ্টন, নৈতিক বন্ধনের অবসান এবং জাতিগুলোর মধ্যে শিল্প যুদ্ধ—সবই একে একে উন্মোচন করেছে।

তবে এর ইতিবাচক লক্ষ্য ছিল হয় পুরাতন উৎপাদন ও বিনিময়ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা (সেইসঙ্গে পুরনো সম্পত্তির সম্পর্কও), অথবা আধুনিক উৎপাদনকে পুরাতন সম্পত্তি কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা—যা আদতে প্রতিক্রিয়াশীল এবং কল্পনাবিলাসী (Utopian)।

এর চূড়ান্ত অবস্থান দাঁড়ায়—শিল্পে কর্পোরেট গিল্ড ব্যবস্থা, কৃষিতে পিতৃতান্ত্রিক সম্পর্ক।

শেষ পর্যন্ত, ইতিহাসের কঠোর বাস্তবতা তাদের আত্মপ্রবঞ্চনার নেশা কাটিয়ে দিলে, এই ধারা এক বিষণ্ন হতাশায় পতিত হয়।

গ. জার্মান বা “সত্য” সমাজতন্ত্র

ফ্রান্সে, যেখানে সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট সাহিত্য রচিত হয়েছিল ক্ষমতাসীন বুর্জোয়ার শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অংশ হিসেবে, সেই সাহিত্যের অনুবাদ যখন জার্মানিতে আসে, তখন দেশটির বুর্জোয়ারা মাত্রই ফিউডাল একনায়কত্বের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছে।

জার্মান দার্শনিক, লেখক এবং সৌখিন চিন্তাবিদরা এই সাহিত্য উদ্দীপনা সহকারে গ্রহণ করেন, কিন্তু ভুলে যান যে ফরাসি সামাজিক বাস্তবতা তখনও জার্মানিতে আগমন করেনি। ফলে ফরাসি সাহিত্য জার্মান প্রেক্ষাপটে তার বাস্তব তাৎপর্য হারিয়ে নিছক সাহিত্যিক এক রূপ ধারণ করে।

ফলে ফরাসি বিপ্লবের দাবি তাদের কাছে হয়ে ওঠে “বাস্তব যুক্তিবোধ”-এর এক সাধারণ দাবি মাত্র, এবং ফরাসি বিপ্লবীদের রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রকাশ তাদের চোখে হয়ে ওঠে “বিশুদ্ধ ইচ্ছা”-র আইন, মানবজাতির সার্বজনীন ইচ্ছা, বাস্তবহীন বিমূর্ততা।

জার্মান সাহিত্যিকদের কাজ ছিল এই নতুন ফরাসি চিন্তাগুলোকে নিজেদের পুরাতন দার্শনিক বিবেকের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো, বা ফরাসি ভাবনার দখল নেওয়া, নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি না ত্যাগ করেই।

এই দখল গ্রহণ হয়েছিল বিদেশি ভাষা শেখার মতো, অনুবাদের মাধ্যমে। যেমন মধ্যযুগীয় সন্ন্যাসীরা প্রাচীন গ্রিক-পাগান লেখার ওপর ক্যাথলিক সেন্টদের হাস্যকর জীবনকাহিনী লিখতেন, জার্মান পণ্ডিতেরা ঠিক তার বিপরীত পথে হেঁটেছেন—তারা ফরাসি সমাজতান্ত্রিক লেখার নিচে তাদের “দার্শনিক আবর্জনা” বসিয়ে দিয়েছেন। যেমন, অর্থনীতির সমালোচনার নিচে লিখেছেন “মানবতার বিচ্ছিন্নতা”, বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সমালোচনার নিচে লিখেছেন “সাধারণতত্ত্বের অপসারণ”।

এইভাবে তারা একে আখ্যা দিল—“কার্যতত্ত্বের দর্শন”, “সত্য সমাজতন্ত্র”, “জার্মান সমাজতান্ত্রিক বিজ্ঞান”, “দর্শনভিত্তিক সমাজতন্ত্র” ইত্যাদি।

ফলত, ফরাসি সমাজতান্ত্রিক সাহিত্য সম্পূর্ণভাবে বিকৃত ও নির্বিষ হয়ে পড়ে। শ্রেণি-সংগ্রামের ভাষ্য হারিয়ে সে পরিণত হয় এক শ্রেণিবিহীন, বাস্তবহীন “মানব প্রকৃতি”র কল্পরাজ্যে। এই “সত্য” সমাজতন্ত্র স্কুলের মতো শিশুরা এতই গুরুত্ব সহকারে তাদের পাঠ গ্রহণ করত যে, একসময় তারা তাদের নিজস্ব রক্ষণশীল স্বার্থে এটি ব্যবহার করতে শুরু করে।

এই ধারার সমাজতন্ত্র পরিণত হয় জার্মান সরকারের হাতিয়ার হিসেবে—তাদের পক্ষে পুঁজিবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালাতে সাহায্য করে, বিশেষ করে প্রুশিয়ান বুর্জোয়ার বিরুদ্ধে। তারা তখন প্রচার করতে থাকে—পুঁজিবাদী গণতন্ত্র, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, বুর্জোয়া আইন, ব্যক্তিস্বাধীনতা—সবই শ্রমজীবী জনগণের জন্য ক্ষতিকর।

তারা ভুলে যায়, যেই ফরাসি সমালোচনার তারা অনুকরণ করছিল, তা জন্ম নিয়েছিল এমন একটি সমাজে যেখানে পুঁজিবাদ ও তার অর্থনৈতিক কাঠামো বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। জার্মানিতে যার জন্য তখনও সংগ্রাম চলছিল।

সেই সময়, সরকারের কাছে এটি এক প্রিয় ভূতের মতো হয়ে ওঠে—একদিকে শ্রমিকদের বিদ্রোহ দমন করতে কামানের গোলা, আর অন্যদিকে বুর্জোয়ার ভয় দেখাতে এই “সত্য” সমাজতন্ত্র।

এই ধারাটি বাস্তবে জার্মান ক্ষুদ্র-মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে—যা ষোড়শ শতাব্দীর রূপে উদ্ভূত হয়েছিল এবং এখনো নানা রূপে বিদ্যমান।

চলবে…

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

আমেরযত কাহিনি

আমেরযত কাহিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ ‘আম’ শুধু একটি ফল নয়, বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত এক... বিস্তারিত