মতামত
প্রস্তাবিত জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি): একটি প্রশ্নবিদ্ধ ধারণা

হাবিবুর রহমান
অ্যাডভোকেট, ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশন

জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি গঠনের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয় যে, এই কাঠামো বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং শাসনতান্ত্রিক ভারসাম্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রস্তাবিত কাঠামো অনুযায়ী এনসিসির সদস্য হবেন মোট নয়জন—রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, উচ্চ ও নিম্নকক্ষের স্পিকার, বিরোধী দল মনোনীত দুইজন ডেপুটি স্পিকার, উভয় কক্ষের সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে একজন নির্বাচিত সদস্য (যিনি সরকারি ও প্রধান বিরোধী দল ব্যতীত হবেন), এবং প্রধান বিচারপতি।
এই কাঠামোয় দেখা যাচ্ছে, একটি সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করেও সরকারি দল এনসিসিতে মাত্র তিনটি পজিশন পাচ্ছে—প্রধানমন্ত্রী, নিম্নকক্ষের স্পিকার এবং উচ্চকক্ষের স্পিকার। অন্যদিকে, বিরোধী দল পাচ্ছে চারটি পজিশন—বিরোধীদলীয় নেতা, দুইজন ডেপুটি স্পিকার এবং একজন সংসদ সদস্য। বিস্ময়করভাবে, বিরোধী দলকে এই চারটি পজিশন পাওয়ার জন্য কোনো ন্যূনতম ভোটের হার বা আসনসংখ্যা অর্জনের শর্তও রাখা হয়নি। সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব যতই সীমিত হোক না কেন, এনসিসিতে তারা সরকারি দলের তুলনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যেতে পারে। এমনকি, মাত্র পাঁচ শতাংশ আসন পেলেও এই কাঠামো অনুযায়ী বিরোধী দল এনসিসিতে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করতে পারবে।
এখানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে নিরপেক্ষ সদস্য হিসেবে ধরা হলেও, বাস্তবে রাষ্ট্রপতি সবসময় সরকারি দলের মনোনীত হন না। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের মোদি সরকারের প্রথম মেয়াদে রাষ্ট্রপতি ছিলেন কংগ্রেসের প্রণব মুখার্জি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এরকম হলে এনসিসির নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি বিরোধী দলের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার, যদি রাষ্ট্রপতি সরকারি দলের হয়েও থাকেন, তাহলে এনসিসিতে সরকারি ও বিরোধী উভয়পক্ষের সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় চার-চার। এই ভারসাম্য আসলে সবচেয়ে বিপজ্জনক, কারণ এতে সিদ্ধান্তগ্রহণকারী বা টাই-ব্রেকিং অবস্থানে চলে আসেন প্রধান বিচারপতি।
প্রধান বিচারপতি হলেন রাষ্ট্রের একটি সাংবিধানিক অঙ্গের প্রধান। তার ওপর এমন একটি প্রশাসনিক কাঠামোর সিদ্ধান্ত নির্ভর করলে, তিনি বিচার বিভাগীয় নিরপেক্ষতা হারাবেন। যদি তিনি সরকারি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন, তবে তাকে দলীয় বলে অভিযুক্ত করা হবে, আর বিরোধী দলের পক্ষে গেলে বলা হবে তিনি বিরোধীপন্থী। এতে করে বিচার বিভাগ রাজনৈতিক বিতর্কে জড়াবে এবং তাদের নিরপেক্ষতা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক বিরোধিতার কেন্দ্রবিন্দুতে এনে দাঁড় করানো হবে একটি ভয়ানক বিপর্যয়।
নির্বাচনে জয়ী রাজনৈতিক দলকে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে যদি এমনভাবে প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে হয়, তবে প্রধানমন্ত্রী কার্যত একটি খোঁড়া অবস্থানে পড়ে যাবেন। এনসিসি যেসব সিদ্ধান্ত নেবে, তা জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে উঠবে—চাই তিনি তা পছন্দ করুন বা না করুন। অথচ, এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়ভার পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীর কাঁধেই পড়বে। এই কাঠামো নির্বাচিত প্রধান নির্বাহীর কার্যকারিতা ও দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা খর্ব করবে।
সবচেয়ে ভয়ংকর দিকটি হলো, এই এনসিসি রাষ্ট্রপতির কাছে অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সেনাবাহিনীর প্রধানদের নিয়োগের জন্য নাম প্রস্তাব করবে। একটি নির্বাচিত সরকারের জন্য এটি স্পষ্টভাবে জাতীয় নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বাধীনতার জন্য হুমকিস্বরূপ। সরকার ও বিরোধী দলের নীতি ও কৌশলে যেহেতু মৌলিক পার্থক্য থাকে, তাই সরকারের অধীনে থাকা প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগে সরকারের মতামতই চূড়ান্ত হওয়া উচিত।
সেনাপ্রধান একজন সরকারি আমলা, আর প্রধান বিচারপতি একজন সাংবিধানিক কর্মকর্তা—এই দুই ভূমিকাকে এক করে দেখা যাবে না। তাদের দায়বদ্ধতা ও কার্যক্রমের ক্ষেত্র আলাদা। সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে যাকে নিয়োগ দেওয়া হবে, তিনি সরকারের কৌশল বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। আর প্রধান বিচারপতির ভূমিকা সংবিধানের ব্যাখ্যাকারী হিসেবে রাষ্ট্রীয় ভারসাম্য রক্ষা করা। কাজেই সেনাপ্রধান নিয়োগে বিরোধী দলের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা একান্তই অগ্রহণযোগ্য।
এছাড়া অ্যাটর্নি জেনারেল সরকারের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন। রিট ও ক্রিমিনাল মামলায় রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হিসেবে সরকারকেই দাঁড় করানো হয়। এই বাস্তবতায়, সরকার তার হয়ে কে মামলা পরিচালনা করবেন, তা বিরোধী দলের পরামর্শে ঠিক করা কতটা যুক্তিযুক্ত? যদি এনসিসিতে সরকার ও বিরোধী দলের সদস্য সংখ্যা সমান হয়, তাহলে কে অ্যাটর্নি জেনারেল হবেন তা নির্ধারণ করবেন প্রধান বিচারপতি। অর্থাৎ, একজন বিচারপতি নিজেই নির্ধারণ করবেন সরকার পক্ষের আইনজীবী কে হবেন। এটি বিচার বিভাগীয় নিরপেক্ষতার গুরুতর লঙ্ঘন।
এনসিসির এই কাঠামো একদিকে যেমন নির্বাচিত সরকারের কর্তৃত্বকে খর্ব করে, অন্যদিকে প্রধান বিচারপতিকে রাজনীতির কাদায় টেনে আনে। এতে করে আমলাতন্ত্র ও সাংবিধানিক পদে প্রফেশনালিজম ও জবাবদিহিতার যে ন্যূনতম ভিত্তি থাকা উচিত, তা ভেঙে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট তার প্রশাসন গঠনে দলীয় ব্যক্তিদের নিয়ে এলেও, যোগ্যতা, মেধা ও পেশাদারিত্ব নিয়ে সেখানে কোনো আপস করা হয় না। আমাদেরও সেই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, যেখানে দক্ষতা ও দায়িত্ববোধের ওপর ভিত্তি করে নিয়োগ হবে—নয় যে, বিরোধী দলের প্রাধান্যে পরিচালিত একটি ছায়া সরকার নির্বাচিত সরকারের কর্তৃত্বের ওপর ছায়া ফেলে রাখবে।
অতএব, একজন কার্যকর ও জনগণের কাছে জবাবদিহিতাপূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর মাথার ওপর বিরোধী দল-নির্ভর একটি সাংবিধানিক কাউন্সিল চাপিয়ে দিয়ে নির্বাচিত সরকারকে পঙ্গু করে তোলার এই ধারণা কোনো সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারক হতে পারে না।
শেখ হাসিনার পতনের পর কূটনীতি ও নিরাপত্তার কঠিন প্রশ্নগুলো

আলিফ ইফতেখার হোসেন
গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বাংলাদেশ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যে রাজনৈতিক ভূমিকম্পের মুখোমুখি হয়েছিল, তা কেবল একটি একদলীয় সরকারের পতনের ঘটনা ছিল না। বরং এটি ছিল একটি যুগান্তকারী মোড়, যেখানে জাতি পুনরায় তার নিরাপত্তা, পররাষ্ট্রনীতি এবং রাষ্ট্রীয় আদর্শের মৌলিক প্রশ্নগুলো নতুনভাবে অনুধাবন করতে বাধ্য হয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের পর উদ্ভূত অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সবচেয়ে কঠিন যে চ্যালেঞ্জগুলো এসেছে, তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক ভারসাম্য পুনর্গঠন।
বিগত কয়েক দশকে আমরা একটি আত্মতুষ্ট রাষ্ট্র হয়ে উঠেছিলাম। ১৯৭১–এর পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর এক ধরনের অনুকূল ভূরাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে অবস্থান করায় আমরা ভুলে গিয়েছিলাম যে নিরাপত্তা হলো উন্নয়নের পূর্বশর্ত। ভারতের প্রভাবমুক্ত ভারসাম্য রক্ষা এবং চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখা—এসব আমরা ‘কৌশল’ মনে করলেও, প্রকৃতপক্ষে তা ছিল স্বস্তিবাদী এবং স্বল্পমেয়াদি কূটনৈতিক খেলাচিত্ত। অথচ, আজ যখন মিয়ানমার সীমান্ত অস্থির, রোহিঙ্গা সংকট এখনও অমীমাংসিত, এবং আঞ্চলিক অস্থিরতা ঘনীভূত, তখন আমরা উপলব্ধি করছি, নিরাপত্তা নিশ্চয়তা ছাড়া উন্নয়নের সমস্ত প্রচেষ্টা জলের বুদবুদের মতো।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলো ভারতের তুলনায় অনেক বেশি বহুমাত্রিক। ভারতের রয়েছে বিশাল সামরিক শক্তি ও অর্থনৈতিক বলয়, কিন্তু বাংলাদেশ—একটি ছোট, জনবহুল এবং ভূকৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ—বরাবরই এক প্রকার নিরাপত্তাহীনতার বৃত্তে বন্দী থেকেছে। শেখ হাসিনার সরকার এই নিরাপত্তা প্রশ্নকে একটি বাহ্যিক রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করেছিল। ভারতকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি এবং সীমান্তে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু, পানিবণ্টন অসমতা, এবং অবৈধ অনুপ্রবেশের মতো সমস্যা উপেক্ষিত থেকে গেছে। কিন্তু নতুন অন্তর্বর্তী প্রশাসনের সবচেয়ে বড় উপলব্ধি হলো, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এখন আর বিকল্প নয় বরং পরস্পরের পরিপূরক। এই উপলব্ধি থেকেই নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শূন্য সহনশীলতা, অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস নির্মূল এবং সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।
উন্নয়ন কোনো যাদু নয়। এটি দীর্ঘস্থায়ী মৌলিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। এই মৌলিক কাঠামোর প্রথম স্তম্ভ হলো জিরো টলারেন্স নিরাপত্তা নীতি, উগ্রবাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান এবং গঠনমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। শেখ হাসিনার পতনের পর যারা দ্রুত একটি নতুন আদর্শিক রাজনীতির নাম করে পুনরায় বিভাজন তৈরি করতে চায়, তারা এই ভিত্তিকে নড়বড়ে করে তুলছে। গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা এবং নিরাপদ রাষ্ট্র। কিন্তু যখন কোনো রাজনৈতিক নেতা বলেন, “আফগানিস্তান হবে আমাদের মডেল,” তখন সেটা আর কেবল মতামত থাকে না। সেটি হয়ে দাঁড়ায় এক ভয়াবহ বিপদের অশনিসঙ্কেত।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র সচিব এম হুমায়ুন কবির অত্যন্ত যুক্তিযুক্তভাবে বলেছেন, “আমাদের কূটনৈতিক পথ নির্ধারিত হোক ইতিহাস, আবেগ কিংবা রাজনৈতিক পক্ষপাত নয়, বরং জাতীয় স্বার্থ ও জনগণের কল্যাণের ভিত্তিতে।” তাঁর এই বক্তব্যে দ্বিমতের কোনো সুযোগ নেই। তবে এই কথা বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হলো ঘরোয়া রাজনীতিকে পরিশীলিত, সহনশীল এবং জাতীয় স্বার্থকেন্দ্রিক করতে হবে। কারণ, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যদি আদর্শগত সংকীর্ণতায় আক্রান্ত হয়, তাহলে তা কেবল ঘরোয়া সংঘাতে নয় বরং বৈদেশিক কূটনীতিতেও বিভ্রান্তি তৈরি করে। তখন রাষ্ট্রীয় পররাষ্ট্রনীতি হয়ে ওঠে দলীয় প্রপাগান্ডার সম্প্রসারণ মাত্র।
বাংলাদেশ বহু বছর ধরেই পররাষ্ট্রনীতিতে আবেগতাড়িত অবস্থান নিয়েছে। কেউ ১৯৭১-এর উত্তরাধিকারকে রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে, আবার কেউ পশ্চিমা কিংবা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে দলীয় ট্রফিতে পরিণত করেছে। ফলে, আমরা বহুবার বাস্তব কূটনৈতিক সুযোগ হাতছাড়া করেছি। যেমন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের প্রভাব কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার ভারতের পানিবণ্টনে গড়িমসি সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধাচরণ না করে আত্মসমর্পণের কূটনীতি গ্রহণ করেছি।
বাস্তব কূটনীতি এসবের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে কেবল তখনই, যখন দেশের অভ্যন্তরে একটি পরিপক্ব রাজনৈতিক পরিবেশ থাকে, যেটি প্রথমে উন্নয়ন ও নিজ রাষ্ট্রের স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়, কেবল আদর্শকে নয়। অনেক সময়ই আমরা যতটা মনে করি, তার থেকেও বেশি পরিমাণে আদর্শিক রাজনীতি আমাদের পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে। তাই যদি আমরা এমন এক পররাষ্ট্রনীতি চাই, যা সত্যিকারের অর্থে জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত, তাহলে আমাদের প্রথমেই দেশের ভেতরের রাজনীতিকে শুদ্ধ করতে হবে। সেই স্ট্রং ফান্ডামেন্টাল, অর্থাৎ কিছু মৌলিক বিশ্বাস ও মূল্যবোধ গড়তে না পারলে কোনো ধরনের কৌশলগত প্রস্তুতিই দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হবে না।
এখানে আমাদের একটি দ্ব্যর্থহীন অবস্থান নিতে হবে। উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, এমনকি যদি সেটা ‘জনপ্রিয়’ কোনো আদর্শিক কাঠামোর মধ্যে থেকেও আসে। কূটনীতি কোনো রোমান্টিকতা নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের বাস্তববাদী আত্মপরিচয়।
শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে এখনও সময় আছে নিজেদের কূটনৈতিক অবস্থান পুনর্গঠন করার, নিরাপত্তা কাঠামো শক্তিশালী করার এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশকে একটি কার্যকর ও আত্মনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে পুনঃস্থাপন করার। প্রথম ধাপে আমাদের নিতে হবে স্মার্ট নিরাপত্তা কৌশল, যেখানে আধুনিক সেনা, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে থাকবে সাইবার নিরাপত্তা বাহিনী। দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে উগ্র মতবাদ থেকে মুক্ত করে একটি গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক ও স্থিতিশীল কাঠামোয় ফিরিয়ে আনতে হবে। তৃতীয়ত, বহুমুখী কূটনৈতিক জোট গঠনের মাধ্যমে ভারতনির্ভরতা কমাতে হবে এবং বিকল্প কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকা অঞ্চলে। চতুর্থত, অর্থনৈতিক কূটনীতি শক্তিশালী করে রপ্তানি, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও মেগা প্রকল্পে বৈচিত্র্য আনতে হবে। এবং সর্বশেষে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশকে একটি চিন্তাশীল, মানবিক এবং সাহসী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশ এক নতুন সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। এখনই সময় কূটনীতি ও নিরাপত্তার প্রশ্নগুলোকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি পুনর্নির্মাণের। গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়। এটি মানে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে সম্মানজনক অবস্থান। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য এখন প্রয়োজন বাস্তববাদ, ঐক্য এবং দূরদৃষ্টি। আবেগ নয়, এখন প্রয়োজন কঠিন সিদ্ধান্ত এবং স্থির সংকল্প। কেননা ইতিহাস প্রমাণ করে, যখন জাতি একসাথে দাঁড়ায়, তখন পরিবর্তনের অনিবার্যতা কেউ ঠেকাতে পারে না।
-লেখক আলিফ ইফতেখার হোসেন, বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই) এ গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মরত আছেন। ইমেইল:✉️[email protected]
গণঅভ্যুত্থানের এক বছর: মুক্তির স্বপ্ন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের চ্যালেঞ্জ

মো. অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
আজ ৫ আগস্ট ২০২৫। এক বছর আগে, ঠিক এই দিনে, বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছিল ছাত্র-জনতার এক রক্তস্নাত কিন্তু অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান—যা প্রায় ষোল বছরের দীর্ঘস্থায়ী আওয়ামী একদলীয় শাসনের অবসান ঘটায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই আওয়ামী লীগ তাদের একদলীয় শাসনের কাঠামো তৈরি শুরু করেছিল। সেই প্রক্রিয়ার প্রথম বড় পদক্ষেপ ছিল ২০০৯ সালের কুখ্যাত বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৫৭ জন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা। এই কর্মকর্তারা ছিলেন ১/১১–পরবর্তী দুই বছরের অন্তর্বর্তী প্রশাসনে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত এবং প্রভাবশালী, যাদের ক্ষমতায় এসে আওয়ামী সরকার সচেতনভাবে তৎকালীন বিডিআরে বদলি করে দেয়। ঘটনার পর সেনাবাহিনীর যে অফিসাররা এই হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ করেছিলেন, তাদের সবাইকে চাকরিচ্যুত করা হয়। অভ্যুত্থান-পরবর্তী তদন্ত ও বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে এই হত্যাকাণ্ড কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না; বরং এটি ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের একটি সুপরিকল্পিত ও অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সাজানো নকশার অংশ।
পরবর্তী বছরগুলোতে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি শাহবাগ আন্দোলনের উত্থান, জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, বিএনপির বহু নেতার বিচার ও দণ্ডাদেশ, বিরোধী দলের লাখো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার, তৎকালীন প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কারাবন্দি হওয়া, শত শত গুম, এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে নজিরবিহীন দলীয়করণের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। একদলীয় শাসন সুসংহত করতে প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচারব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রের সব অঙ্গ দলীয় স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। সর্বশেষে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ একদলীয় ক্ষমতার চূড়ান্ত ধাপ সম্পন্ন করে।
এই সময়কালে ভিন্নমতকে দমন, সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ, এবং সরকারের সমালোচকদের কারাবন্দি করার প্রবণতা ছিল স্পষ্ট। সরকার সমালোচনার প্রতিটি আওয়াজ কঠোরভাবে দমন করেছে। অথচ, ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে—ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে, জনগণের কণ্ঠরোধ করে, সীমাহীন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করা যায় না। ২০২৪ সালের গণআন্দোলন সেই ঐতিহাসিক সত্যকে আবারও স্পষ্ট করে দিয়েছে।
সেই সময়ের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে এক পুলিশ কর্মকর্তার ভাইরাল মন্তব্য—“গুলি করি, মরে একটা… বাকিটা যায় না, স্যার”—ছিল জনবিক্ষোভের বিস্ফোরিত ক্ষোভের প্রতীক। এই উক্তি ছিল বিদ্রোহী চেতনার বাস্তব প্রতিফলন, যা কার্ল মার্ক্সের ভাষায় “class in itself” থেকে “class for itself”-এ উত্তরণের মুহূর্ত এবং মিশেল ফুকোর বর্ণনায় ক্ষমতার দমনমূলক কাঠামো থেকে প্রতিরোধ সৃষ্টির প্রক্রিয়ার নিদর্শন।
যারা ২০২৪ সালের এই গণঅভ্যুত্থানক কেবল ৩৬ দিনের আন্দোলনের ফল হিসেবে দেখেন, তারা প্রকৃত ইতিহাসকে অস্বীকার করছেন। বাস্তবে, দীর্ঘ ষোল বছরের সঞ্চিত ক্ষোভ ও প্রতিরোধের বীজ ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত ৩৬ দিনের আন্দোলনে তা পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। এটিকে আমরা মার্ক্সের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সেই রূপান্তর হিসেবে দেখতে পারি, যেখানে ক্রমাগত পরিমাণগত পরিবর্তন একসময়ে গুণগত পরিবর্তনে রূপ নেয়, এবং গোটা ব্যবস্থায় আমূল রূপান্তর ঘটায়।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাস্তবতা: মুক্তির স্বপ্ন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের চ্যালেঞ্জ
৫ আগস্ট ২০২৪-এর অভ্যুত্থানের পর সারাদেশে একদিকে ছিল মুক্তির উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে অরাজকতার তীব্র বিস্তার। শত শত প্রাণহানি, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল, যা বেদনাদায়ক হলেও এমন এক রক্তক্ষয়ী পরিবর্তনের পর অস্বাভাবিক ছিল না। এই অরাজক পরিস্থিতির মধ্যেই নোবেলজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকারের মূল দায়িত্ব ছিল—দেশে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু করা, রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় সংস্কার এগিয়ে নেওয়া, এবং একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনরুদ্ধার করা।
একই সময়ে এই সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়ার তীব্র প্রপাগান্ডা মোকাবিলা করা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা—এই দুই ফ্রন্টে সমানভাবে কাজ করতে হয়েছে এই প্রশাসনকে।
গত এক বছরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও তা আশানুরূপ নয়। মব জাস্টিস, চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই—এসব অপরাধ এখনো নিয়মিত ঘটছে। একাধিক ঘটনায় দেখা গেছে, রাষ্ট্রযন্ত্র ইচ্ছাকৃতভাবে নিষ্ক্রিয় থেকেছে, যা জনরোষ ও অপরাধপ্রবণতাকে উস্কে দিয়েছে। ষোল বছরের দলীয় শৃঙ্খলার ছাপ এখনো প্রশাসনে গভীরভাবে রয়ে গেছে। একইভাবে, রাজনৈতিক দলগুলোও অনেকাংশে নিজেদের দলীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি নিরপেক্ষ সহযোগিতা করছে সেটিও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকেও একটি নতুন রাজনৈতিক দলের প্রতি নীরব সমর্থনের অভিযোগ উঠেছে, যা নীতিগত নিরপেক্ষতার প্রশ্নে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
জুলাই হত্যাকাণ্ড দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন, বিবিসি ও আল জাজিরার অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ উঠে এসেছে, যা বিচার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হতে পারে। যদিও শুরু থেকেই একাধিক ট্রাইব্যুনাল কার্যকর করা হলে প্রক্রিয়াটি দ্রুত এগোতে পারত। এর পরেও রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বিচার প্রক্রিয়া সরাসরি সম্প্রচার করার সিদ্ধান্ত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের উদ্যোগ এ সময়ে সবচেয়ে ইতিবাচক দিক। দীর্ঘ আলোচনার পর আজ ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ বা ‘জুলাই সনদ’ প্রকাশিত হচ্ছে। যদিও কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে, তা সত্ত্বেও বড় ও ছোট, ডানপন্থী ও বামপন্থী সব রাজনৈতিক দল অধ্যাপক আলী রিয়াজের নেতৃত্বে একটি অভিন্ন কাঠামোয় একমত হয়েছে—যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরল এক নজির। এই ঐক্যমত্য ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের পথে একটি শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।
আগামী নির্বাচনকে ঘিরে যে অনিশ্চয়তা ছিল, তা অনেকটাই কেটে গেছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের সুনির্দিষ্ট ঘোষণা পরিস্থিতিকে আরও স্পষ্ট করবে। তবে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানামূখী চাপ সামাল দিয়ে একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
দীর্ঘ দেড় দশকের ভারতনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে এসে একটি স্বাধীন ও স্বার্থকেন্দ্রিক কূটনৈতিক নীতি গঠন সহজ কাজ নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। ভারতের মিডিয়ার প্রপাগান্ডা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রত্যাশিত প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং সদ্য সমাপ্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থান অর্জন করেছে, যা ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি আশঙ্কাজনক মাত্রায় পৌঁছায়নি। শেয়ারবাজার ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং পূর্ববর্তী সরকারের রেখে যাওয়া প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণের বোঝা সত্ত্বেও অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি, বরং কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। এটি নিঃসন্দেহে সরকারের একটি ইতিবাচক সাফল্য।
সামগ্রিকভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ বলা যাবে না। ইতিহাসের এক সংকটময় মুহূর্তে বিপুল জনআকাঙ্ক্ষা মাথায় নিয়ে তারা অন্তত একটি প্রাথমিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। তবে গণতান্ত্রিক উত্তরণ এখনো বহুদূরের পথ—এবং তা মোটেও সহজ হবে না।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় না; নির্বাচন হলো গণতান্ত্রিক যাত্রার সূচনাবিন্দু। সংবিধানে সংস্কার অন্তর্ভুক্ত করলেই গণতন্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে না, যদি না দেশে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, এবং নাগরিকদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটে। প্রকৃত গণতন্ত্রের অর্থ যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা নয়; বরং অন্যের মতামতকে শ্রদ্ধা ও মূল্যায়ন করা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলা, এবং সুশাসনের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাওয়া।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট প্রমাণ করেছিল—দমন, নিপীড়ন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মধ্যেও জনগণ একসময় উঠে দাঁড়ায়। সেই অভ্যুত্থানের এক বছর পর বাংলাদেশের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ হলো—এই অর্জনকে ধরে রাখা এবং তাকে একটি স্থায়ী, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রে রূপ দেওয়া। ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে, ক্ষমতা যেমন চিরস্থায়ী নয়, তেমনি গণআন্দোলনের সাফল্যও ক্ষণস্থায়ী হতে পারে, যদি জনগণ, নেতৃত্ব ও রাষ্ট্র একসঙ্গে সেই পথকে রক্ষা না করে।
-লেখক মো. অহিদুজ্জামান ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ এর গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গভর্ন্যান্স বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। পাশাপাশি তিনি অনলাইন সংবাদমাধ্যম "সত্য নিউজ"-এর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের মনোবিশ্লেষণমূলক পাঠ: একটি প্রজন্মের অবচেতনের বিস্ফোরণ

ড. হাসান সাইমুম ওয়াহাব
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাই মাস এক গভীর, বেদনাবিধুর অথচ তাৎপর্যময় অধ্যায় হয়ে থাকবে। এই সময়টিতে দেশজুড়ে ছাত্র-যুবকদের নেতৃত্বে যে গণ-আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তা নিছক একটি রাজনৈতিক প্রতিবাদ ছিল না—বরং তা ছিল একটি প্রজন্মের অবচেতনে সঞ্চিত ক্ষোভ, বঞ্চনা ও আত্মপরিচয় সংকটের বিস্ফোরণ। এই আন্দোলনকে বিশ্লেষণ করতে গেলে আমাদের চোখ রাখতে হবে কেবল রাজনীতির মাঠে নয়, বরং মনস্তত্ত্বের গভীর স্তরেও। তাই এ প্রবন্ধে আমরা এই অভ্যুত্থানকে বোঝার চেষ্টা করবো মনোবিশ্লেষণধর্মী ইতিহাসচর্চা (psychoanalytical historiography)–এর আলোকে, যা মূলত সিগমুন্ড ফ্রয়েড এবং তাঁর শিষ্যদের বিকাশিত তত্ত্বসমূহ দ্বারা অনুপ্রাণিত।
মনোবিশ্লেষণধর্মী ইতিহাসচর্চার পরিপ্রেক্ষিত
মনোবিশ্লেষণধর্মী ইতিহাসচর্চা একটি পদ্ধতি, যা ইতিহাসের ঘটনাবলি, নেতৃত্ব, সামাজিক আন্দোলন ও আচরণের নেপথ্যে থাকা অবচেতন প্রেরণা, দ্বন্দ্ব, ভয়, আকাঙ্ক্ষা ও দমনচর্চাকে অন্বেষণ করে। এটি আমাদের দেখায় কীভাবে ব্যক্তিগত মানসিক কাঠামো সামষ্টিক রূপ ধারণ করে এবং তা সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। হিটলারের উন্মত্ততা বা মুসোলিনির ফ্যাসিবাদকে ব্যাখ্যা করতে যে ধরণের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রাসঙ্গিক ছিল, বাংলাদেশেও কিছু ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হয়ে উঠেছে—বিশেষত বর্তমান সময়ের মতো সংকটকালীন মুহূর্তে।
দমন ও তার প্রত্যাবর্তন: অবচেতনের বিস্ফোরণ
ফ্রয়েড তাঁর বিখ্যাত তত্ত্বে বলেছেন, কোনো অভিজ্ঞতা যদি চেতনায় স্থান না পায়, তাহলে তা হারিয়ে যায় না; বরং অবচেতনে জমা থেকে একসময় সহিংসভাবে ফিরে আসে। বাংলাদেশের তরুণ সমাজ বহু বছর ধরে যে অবহেলা, অনিশ্চয়তা ও নিরাশার মধ্যে বাস করছিল, তা দমন হয়ে অবচেতনে জমা হচ্ছিল। রাষ্ট্র, শিক্ষা ব্যবস্থা, কর্মসংস্থান—সবই যেন তাদের জন্য এক অনুপ্রেরণাহীন ব্যবস্থার নামান্তর।
২০২৪ সালের আন্দোলন ছিল সেই দীর্ঘস্থায়ী দমনচর্চার সম্মিলিত মানসিক প্রতিক্রিয়া। “আমাদের কথা শোনো”—এই শ্লোগান ছিল একটি আর্তনাদ, একটি স্বীকৃতি দাবি, একটি আত্মমুক্তির প্রয়াস। এই গণ-আন্দোলন ছিল নিছক রাজনৈতিক দাবি-দাওয়ার সংগ্রাম নয়; এটি ছিল মানসিক মুক্তির এক সমষ্টিগত প্রক্রিয়া।
রাজনীতিতে 'গদফাদারের’ প্রতিচ্ছবি
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতৃবৃন্দের চরিত্র অনেকাংশেই একধরনের প্রতাপশালী 'গডফাদার'-এর অনুরূপ—যিনি কঠোর, কর্তৃত্ববাদী, দমনকারী এবং প্রায়শই অনির্বাচিত শাসকসুলভ। এই রূপকল্পে তরুণদের আন্দোলন ছিল এক প্রকার প্রতীকী 'পিতৃহত্যা'।
ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণ মতে, পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হলো আত্মপরিচয়ের সন্ধানে সন্তানের স্বতন্ত্র স্বরূপ গঠনের প্রচেষ্টা। এই আন্দোলনে যুবকরা যেন ঘোষণা করেছিল—“আমরা আর শিশু নই, আমাদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর আছে।” এই বক্তব্যের মধ্যে নিহিত ছিল একটি স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিশ্বাস ও একটি প্রজন্মের পরিচয় চর্চা।
প্রক্ষেপণের মনোবিজ্ঞান ও ঘৃণার উৎস
ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানে 'প্রক্ষেপণ' (projection) একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা—যেখানে কোনো ব্যক্তি তার নিজের ভয়, অযোগ্যতা বা দোষ অন্যের ওপর আরোপ করে। ২০২৪ সালের আন্দোলনে, তরুণ সমাজ রাজনীতিবিদ, প্রশাসক ও শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিনিধিদের ওপর একধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রক্ষেপণ ঘটিয়েছে।
তারা নিজেদের ব্যর্থতা বা অসন্তোষকে যাদের জন্য দায়ী করেছে, তাদের বিরুদ্ধে উগ্রতা দেখিয়েছে—যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। এই ক্ষোভের প্রকাশ একটি প্রতিক্রিয়াশীল সুরে হলেও, তার মূলে ছিল দীর্ঘদিনের অপমান, আত্মসম্মানবোধের পতন এবং জীবনের অর্থহীনতার অনুভব।
বিপ্লব না মনস্তাত্ত্বিক পশ্চাদপসরণ?
এই প্রশ্নও অবধারিত: এই আন্দোলন কি ছিল একটি বিপ্লব, নাকি এটি ছিল একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশৃঙ্খলার বহিঃপ্রকাশ? হয়তো উভয়ই। ফ্রয়েড বলেছিলেন, যখন কোনো সমাজে সুস্থ নৈতিক কাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়, তখন মানুষের ভিতরের আদিম প্রবৃত্তি (id) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান ছিল এক ধরনের “অদৃশ্য সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণ”, যা সামাজিক শৃঙ্খলার নামে গড়ে তোলা হয়েছিল। এই ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও এক প্রজন্মের মধ্যে গড়ে উঠেছিল আত্মপরিচয়ের জন্য এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা। তাই এই আন্দোলন একই সাথে ছিল একটি আত্ম-অন্বেষণের চেষ্টা এবং বিপ্লবী মানসিকতার প্রাথমিক প্রতিফলন।
প্রয়োজন জাতীয় মনস্তাত্ত্বিক সংলাপ
২০২৪ সালের এই অভ্যুত্থান নিয়ে এখনো যতটা আলোচনা হচ্ছে, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক এবং আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু প্রয়োজন জাতীয় মানসিকতার বিশ্লেষণ, প্রয়োজন ‘collective catharsis’ বা সম্মিলিত মানসিক পরিশুদ্ধি। আমাদের কিছু মৌলিক প্রশ্ন এখন অনিবার্যঃ
- আমরা কি দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রজন্মের ক্ষোভ-আকাঙ্ক্ষাকে অবদমন করেছি?
- বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার কেন তাদের নিজের জনগণের ওপর এতটা নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে?
- কেন এক শ্রেণির মানুষ কেবল ব্যক্তিগত সম্পদের পেছনে ছুটেছে—একটি বৈষয়িক সত্তার বাইরে কিছু ভাবতে পারেনি?
- কেন বিগত ফ্যাসিবাদীরা আজও দায় স্বীকার করতে নারাজ?
- নেতৃত্ব ও সৃজনশীল চিন্তা একসঙ্গে সহাবস্থান করতে না পারার কারণ কী?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের কেবল নীতিনির্ধারকদের দিকে নয়, বরং আমাদের সামষ্টিক মানসিক কাঠামোর দিকেও তাকাতে হবে।
ইতিহাসের ক্যানভাসে অবচেতনের রেখাচিত্র
২০২৪ সালের জুলাইয়ের উত্তাল রাস্তাগুলো যেন একেকটি বিশাল ‘ক্যানভাস’—যেখানে একটি নিঃসঙ্গ, ক্ষুব্ধ ও প্রত্যাখ্যাত প্রজন্ম তাদের অনুভূতি, ক্ষোভ, ভয় ও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছে। এই ক্ষোভকে যদি আমরা শুধুই ‘উচ্ছৃঙ্খলতা’ হিসেবে প্রত্যাখ্যান করি, তাহলে আগামী দিনে এই দমন আবারও ফিরে আসবে, হয়তো আরও ভয়ঙ্কর রূপে।
এই আন্দোলনের মধ্যে আমরা দেখেছি এক ধরনের ‘psycho-social awakening’—যা নিছক সামাজিক বা রাজনৈতিক নয়, বরং মানসিক অবরুদ্ধতার মুক্তি। তাই জাতীয় স্বার্থে আমাদের প্রয়োজন এই আন্দোলনের মনোবিশ্লেষণমূলক পাঠ, প্রয়োজন গবেষণা, সংলাপ এবং আত্মসমালোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
বাংলাদেশের রাজনীতিকে যদি আমরা সত্যিকারের গণতন্ত্রমুখী ও প্রগতিশীল করতে চাই, তাহলে জনগণের অবচেতন ক্ষোভের ভাষা শোনা শিখতে হবে। কারণ রাজনীতি শুধু আইন-কানুন নয়, এটি মানুষ ও মানসিকতার প্রতিফলন—আর সেই মানসিকতার স্বরূপ বোঝাই আগামী বাংলাদেশের সবচেয়ে জরুরি কাজ।
-
ড. হাসান সাইমুম ওয়াহাব
তেজগাও, ঢাকা।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ: আত্মপরিচয়ের নবতর ব্যাখ্যা ও আগামী রাষ্ট্র নির্মাণের ভিত্তি

মো. অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাই মাস এক অনন্য রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ হয়ে থাকবে। এই সময়টায় সংঘটিত ছাত্র ও তরুণদের নেতৃত্বাধীন গণআন্দোলন কেবল একটি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল না, বরং এটি ছিল জাতির আত্মপরিচয়কে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার এক শক্তিশালী প্রয়াস। যখন রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগ, পুলিশি হামলা এবং শাসক দলের ছাত্রসংগঠনের সহিংসতায় তরুণদের রক্ত ঝরে, তখন সেই রক্ত ইতিহাসের পাতায় লিখে যায় এক প্রজন্মের অধিকার সচেতনতার গৌরবগাথা। এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে তীব্রভাবে সামনে আসে তা হলো—আজকের বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ মানে কী? আমরা কি কেবল ‘বাঙালি’? না কি ‘বাংলাদেশী’? এই পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কেবল ভাষা ও সংস্কৃতির আবেগ, না কি নাগরিক অধিকার, মর্যাদা এবং রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার একটি বাস্তব কাঠামো?
জাতীয়তাবাদ—একটি রাষ্ট্রে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর নিজস্ব পরিচয়, অধিকার, এবং কর্তৃত্বের স্বীকৃতি চাওয়া ও পাওয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক দাবি। বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের মূল দুটি ধারা আমরা দেখতে পাই—একটি ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’, অপরটি ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। এই দুই ধারার মাঝে রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য, আদর্শিক ভিন্নতা, এবং বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভিন্ন পরিণতি। ‘বাঙালি’ পরিচয় প্রধানত ভাষা, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক আত্মপরিচয়; অপরদিকে ‘বাংলাদেশী’ পরিচয় একটি ভূখণ্ডকেন্দ্রিক, নাগরিকত্বভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক চেতনা।
‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত প্রতিরোধের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। ভাষা আন্দোলন, একুশে ফেব্রুয়ারি, এবং পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ—এই ধারার মূল স্তম্ভ। এ জাতীয়তাবাদ একসময় ছিল সংগ্রামের শক্তি, অসাম্প্রদায়িকতা ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের চালিকাশক্তি। তবে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে বিগত দুই দশকে, এই জাতীয়তাবাদ একটি রাজনৈতিক দলের করায়ত্ত আদর্শে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ‘বাঙালি’ পরিচয়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে একমাত্র বৈধ পরিচয়ে পরিণত করে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে রাষ্ট্রীয়ীকরণ করা হয়, যা একসময় ছিল মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা, আজ হয়ে উঠেছে দলীয় রাজনীতির অস্ত্র।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই রাজনৈতিক দখলদারিত্বের ফল কতটা ভয়াবহ হতে পারে। তরুণ ছাত্রদের রাস্তায় নামা ছিল কেবল রাজনৈতিক সংস্কার বা দাবির জন্য নয়—তারা চেয়েছিল সম্মান, নিরাপত্তা, এবং নাগরিক মর্যাদার স্বীকৃতি। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় দেখা গেল রাষ্ট্রের নির্মম দমননীতি। পুলিশের গুলি, ছাত্রদের হত্যাকাণ্ড, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট—এগুলো যেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের আবরণে বৈধতা পেতে থাকে। যে স্লোগান একসময় ছিল এক মুক্ত জাতির আকাঙ্ক্ষা, সেটিই হয়ে দাঁড়ায় শাসকের দমনযন্ত্রের প্রতীক। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির নিচে যখন ছাত্রদের রক্ত ঝরে, তখন জাতীয়তাবাদ আর কেবল অতীতের গৌরবগাঁথা থাকে না—তা হয়ে যায় এক বিভ্রান্তি, এক প্রশ্নবিদ্ধ স্লোগান।
এই বাস্তবতায় নতুন করে গুরুত্ব পায় রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। এটি একটি আলাদা দর্শন, যা নাগরিকত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নির্ধারণ করে। শহীদ জিয়া তার সময়কালেই উপলব্ধি করেছিলেন, ভাষা বা জাতিসত্তাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ একটি নির্দিষ্ট পর্বে কার্যকর হলেও, একটি নবীন রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি—যেখানে সকল নাগরিক, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে, রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের অংশীদার হতে পারেন। তিনি বলেন, “আমরা বাংলাদেশী। আমাদের ইতিহাস আলাদা, আমাদের অভিজ্ঞতা আলাদা, আমাদের দেশ ভিন্ন এক প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠেছে।”
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক আদর্শ। এখানে হিন্দু, মুসলমান, আদিবাসী, বিহারী, পাহাড়ি, কওমি কিংবা মূলধারার শিক্ষার্থী—সবাই রাষ্ট্রের সমান মর্যাদার অধিকারী। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক আদর্শ নয়; এটি এক সামাজিক চুক্তি, যেখানে রাষ্ট্র তার জনগণকে চেনে তাদের নাগরিকতা দিয়ে—not their language, race, or faith. এই জাতীয়তাবাদ জাতিকে বিভক্ত করে না; বরং সংহত করে। এটি এমন এক আদর্শ, যা শাসকের নয়, জনগণের রাষ্ট্র নির্মাণ করে।
তরুণদের চোখে এই ‘বাংলাদেশী’ পরিচয় ছিল একটি প্রত্যয়—যেখানে তারা শুধুমাত্র ভোটার বা উপাত্ত নয়, রাষ্ট্রের মর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক। ২০২৪ সালের আন্দোলনে ছাত্রদের কণ্ঠে যখন উচ্চারিত হয়েছিল “আমরা বাংলাদেশী”—তারা আসলে ঘোষণা করেছিল একটি সিভিক ন্যাশনালিজমের সূচনা। এটি ছিল নাগরিক চেতনার আত্মঘোষণা, যেখানে রাষ্ট্র কেবল কর্তৃত্ব নয়, বরং দায়িত্বের প্রতীক। এটি ছিল এমন এক জাতীয়তাবাদের দাবি, যা বলছে—তুমি যদি এই ভূখণ্ডের নাগরিক হও, এই দেশের আইন ও সংবিধানকে মান্য করো, তবে তুমি এই রাষ্ট্রের মর্যাদার অংশীদার।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একটি গণতান্ত্রিক দর্শন। এটি ব্যক্তি অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় সহাবস্থান ও ন্যায়বিচারের পক্ষে অবস্থান নেয়। এখানে পাহাড়ি জনপদের শিক্ষার্থী, উত্তরবঙ্গের কৃষক, চট্টগ্রামের হিন্দু ব্যবসায়ী কিংবা ঢাকার কওমি তরুণ—সবাইকে রাষ্ট্র এক দৃষ্টিতে দেখে। এটি নাগরিক পরিচয়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা তৈরি করে, এবং নাগরিকদের অধিকার রক্ষার জন্য রাষ্ট্রকে বাধ্য করে।
তরুণদের এই চেতনা আসলে এক নতুন জাতীয়তাবাদের ঘূর্ণি, যা দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে। এটি এমন এক চেতনা, যা ভবিষ্যতের বাংলাদেশের মূল ভিত্তি গড়ে তুলতে চায়। যেখানে জাতীয়তাবাদ কেবল অতীত গৌরব নয়, বরং একটি ভবিষ্যতমুখী সামাজিক নকশা। যে কাঠামোতে উন্নয়ন, প্রযুক্তি, অর্থনীতি—সবকিছু গঠিত হবে অন্তর্ভুক্তি, মর্যাদা, এবং জবাবদিহিতার ভিত্তিতে।
বাংলাদেশ আজ এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। যেখানে রাষ্ট্রের মধ্যে বিভাজন, বৈষম্য, দমননীতির প্রভাব স্পষ্ট, সেখানে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মর্যাদাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ সময়ের দাবি। রাজনৈতিক মেরুকরণ, প্রযুক্তিগত বৈষম্য, জলবায়ু সংকট, এবং বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মোকাবেলায় প্রয়োজন এমন একটি জাতীয় পরিচয়, যা জনগণকে সংহত করে, অনুপ্রাণিত করে এবং রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার কাঠামোয় আবদ্ধ রাখে।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সেই উত্তর হতে পারে—যা অতীতের শিক্ষা থেকে গড়ে ওঠা, বর্তমানের অন্তর্দৃষ্টিতে নির্মিত এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার ভিত্তিতে বিকাশমান। এই দর্শন রাষ্ট্রকে জনগণের দিকে ফিরিয়ে দেয়; এই দর্শন বলে, জাতীয়তাবাদ কেবল জাতীয় সংগীত বা পতাকার ছায়ায় আবেগ নয়—এটি নাগরিকের জীবনমান, অধিকার, নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রের প্রতি আস্থার প্রশ্ন।
শেষ কথা হলো—বাংলাদেশ যদি সত্যিই একটি সম্মানিত, ন্যায়ভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্রে রূপ নিতে চায়, তবে তা কেবল উন্নয়ন পরিসংখ্যান দিয়ে নয়—মানবিকতা, মর্যাদা এবং অন্তর্ভুক্তির নতুন সংজ্ঞা দিয়ে সম্ভব। এই সংজ্ঞাটি রয়েছে শহীদ জিয়ার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শনের মধ্যেই—যেখানে সকল নাগরিক রাষ্ট্রের অভিন্ন সন্তান। সেই রাষ্ট্র কখনও জনগণের ওপর গুলি চালায় না, বরং তাদের কণ্ঠকে মূল্য দেয়। আর যে জাতীয়তাবাদ জনগণের মুখে ভাষা দেয়, তাদের অন্তরে সম্মান জাগায়—সেই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদই আগামীর জাতির পথনির্দেশক হয়ে উঠতে পারে।
-লেখক মো. অহিদুজ্জামান ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ এর গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গভর্ন্যান্স বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। পাশাপাশি তিনি অনলাইন সংবাদমাধ্যম "সত্য নিউজ"-এর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আবু সাইদ: এক জনতার মহানায়ক

শামসুল আরেফীন
শিক্ষক ও রাজনৈতিক গবেষক
সম্প্রতি আলজাজিরা টেলিভিশনের একটি ৪৯ মিনিটের অনুসন্ধানী ডকুমেন্টারি দেখার সুযোগ হয়েছিল। এই ডকুমেন্টারিটি যেন আমাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল ২০২৪ সালের সেই উত্তাল জুলাইয়ের দিনগুলোতে। সেই রক্তমাখা বিকেল, চোখ ভিজিয়ে দেওয়া রাত আর বুক কাঁপানো প্রতিরোধের দৃশ্যপট যেন আবার সামনে ভেসে উঠলো। স্টোরিটেলিং ও ডকুমেন্টেশনের দিক থেকে এটি ছিল নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ সাংবাদিকতামূলক কাজ। তবু, একজন প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী হিসেবে, এতে কিছু পক্ষপাত আমার চোখে লেগেছে। বিশেষত, যারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন — নাহিদ, মাহফুজ, হাসনাত — তাঁদের অনুপস্থিতি গোটা প্রতিবেদনের এক অপূর্ণতা তৈরি করেছে।
যদিও সাদিক কায়েমের বক্তব্য রয়েছে, তবুও আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংগঠনিক চালিকাশক্তির দিকটি আরও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এটি হয়তো প্রতিবেদকের রাজনৈতিক পছন্দের প্রতিফলন, কিংবা সীমিত সময় ও পরিসরের মধ্যে সব কণ্ঠ অন্তর্ভুক্ত করতে না পারার ব্যর্থতা। তবে একটি দিক ডকুমেন্টারিটি নিঃসন্দেহে স্পষ্ট করে দিয়েছে — এই আন্দোলনের সবচেয়ে প্রতীকী ও গুরুত্বপূর্ণ চেহারায় রূপ নিয়েছেন শহীদ আবু সাইদ।
এই নামটির সঙ্গে আজকের বাংলাদেশ জড়িয়ে গেছে গভীরভাবে। ইতিহাসের রক্তক্ষরণ, প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবি ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যেন আবু সাইদের ভেতর সন্নিবেশিত হয়ে আছে। রাষ্ট্র যেভাবে তাঁকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে, তা কেবল একটি ব্যক্তির মৃত্যু নয় — এটি ছিল প্রতীকীভাবে একটি প্রজন্মের সাহস, আত্মজিজ্ঞাসা ও প্রতিবাদের ওপর আঘাত। কিন্তু সেই আঘাতই হয়ে ওঠে বিদ্রোহের জ্বালানি।
জুলাই মাসের মাঝামাঝি, যখন শিক্ষার্থীরা কোটার সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নামে, তখন ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করতেই পুলিশ টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ছুড়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে থাকে। এই দমনমূলক পরিস্থিতির মধ্যে পুলিশের হাতে পড়ে যান আবু সাইদ। একা, রক্তাক্ত, কিন্তু সাহসিকতায় অটল।
তাঁকে পুলিশ মাথায় আঘাত করে রক্তাক্ত করে তোলে। কিন্তু তিনি পালান না, ভীত হন না। বরং দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেন, “Shoot me! Shoot me!”
একজন ছাত্র সাংবাদিক তাঁকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “আপনার নাম কী?” আবু সাইদ গর্বভরে উত্তর দেন, “আবু সাইদ, ইংরেজি বিভাগ, ১২তম ব্যাচ।” এই উত্তর ছিল আত্মপরিচয়ের ঘোষণা, একটি প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার সাহসী ঘোষণা। তারপরের দৃশ্য আমাদের সবার জানা — দুই হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে আবার বলেন, “Shoot me!” এবং পুলিশ গুলি চালায়।
সেই মুহূর্তেই যেন গণ-অভ্যুত্থানের জন্ম হয়ে যায়। তাঁর রক্তাক্ত শরীর পড়ে থাকলেও, তাঁর আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে শহরের অলিতে গলিতে, গ্রামে-গঞ্জে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের ঘরে। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী মুখোশ যেন খুলে পড়ে জনতার সামনে। আবু সাইদের মৃত্যু শুধুমাত্র একটি হত্যাকাণ্ড ছিল না, তা ছিল দীর্ঘকাল জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ, একটি মৌলিক প্রশ্নের জাগরণ।
“Shoot me” উচ্চারণটি হয়ে ওঠে এক জাতীয় চেতনার প্রতীক। যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মতাদর্শিক ভিত্তি হিসেবে আবু সাইদের সাহস, আত্মত্যাগ ও প্রতিবাদের ভাষা নতুন মাত্রা যোগ করে। তিনি দেখিয়ে দেন যে প্রতিরোধ কেবল অস্ত্র দিয়ে হয় না — তা হয় চেতনা, আত্মপরিচয় এবং আত্মদান দিয়ে। রাষ্ট্রযন্ত্র যেখানে কণ্ঠরোধ করে, সেখানেই দাঁড়িয়ে তিনি হয়ে ওঠেন এক প্রেরণার উৎস।
আমাদের দায়িত্ব হলো এই ইতিহাস সংরক্ষণ করা। বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে, যেখানে ন্যায়বিচার নেই, শাসনব্যবস্থার স্বচ্ছতা নেই, এবং রাষ্ট্রচিন্তা ধ্বংসপ্রায়, সেখানে আবু সাইদ শুধু আবেগের প্রতীক নন — তিনি এক রাজনৈতিক আদর্শের নাম। তাঁর স্মরণ শুধু আবেগ নয়, বরং রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা।
এখন আমাদের সামনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রথমত, এই ইতিহাস দলীয় রাজনীতির বাইরে গিয়ে রক্ষা করা। দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানো — কীভাবে একজন শিক্ষার্থী রাষ্ট্রশক্তির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারেন। তৃতীয়ত, তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ ও মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
আবু সাইদ সেদিন একা ছিলেন, কিন্তু ইতিহাসে তিনি একা নন। তিনি হয়ে উঠেছেন একটি জনতার উচ্চারণ, সাহস ও প্রতিরোধের প্রতীক। তাঁর জীবন আমাদের শিখিয়েছে, সত্যের জন্য লড়াই কখনো বৃথা যায় না। তাঁর মৃত্যু এক নতুন রাজনৈতিক ভাষা তৈরি করেছে — যা আমাদের এখন ধারণ করতে হবে, রক্ষা করতে হবে এবং এগিয়ে নিতে হবে।
আবু সাইদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে, আমাদের সেই বাংলাদেশ গড়তে হবে যেখানে পুলিশের হাতে আর কোনো শিক্ষার্থী নিহত হবে না, যেখানে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বদলে প্রতিষ্ঠিত হবে গণতান্ত্রিক শাসন, এবং যেখানে “Shoot me” উচ্চারণ হবে না আর একটি জীবন শেষ হওয়ার মুহূর্তের অভিব্যক্তি, বরং হবে আত্মমর্যাদার শুদ্ধতম উচ্চারণ।
লেখক: শামসুল আরেফিন, শিক্ষক ও গবেষক, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়পিএইচডি গবেষক, ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়, অ্যামহার্স্ট, যুক্তরাষ্ট্র।
“সুশীল” শব্দটি কেন আজও গালি?

আলিফ ইফতেখার হোসেন
গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
৫ আগস্টের ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে একটি অদ্ভুত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। অতীতে যেসব শব্দ অবমাননার প্রতীক ছিল, সময়ের প্রবাহে তাদের কেউ কেউ কলঙ্ক ঝেড়ে ফেলে গৌরবের আসনে স্থান করে নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, “শিবির” শব্দটি একসময় ভয়ের, ঘৃণার এবং দমননীতির প্রতীক ছিল, যেটি শাসকগোষ্ঠী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত। কিন্তু আজ অনেক তরুণই আর সেই শব্দে আগের ভয় খুঁজে পায় না। বরং তারা এর পেছনের রাজনৈতিক নির্যাতনের ইতিহাস বোঝে। অথচ একটি শব্দ এখনও অপমানের তীর হিসেবে সমাজে ব্যবহৃত হয়, আর সেটি হলো “সুশীল”।
“সুশীল” শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘সভ্য’, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Civil’। সুশীল সমাজ অর্থাৎ ‘Civil Society’ — এরা হলেন সেই নাগরিক বুদ্ধিজীবী ও সচেতন অংশ, যারা রাষ্ট্রশক্তি, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে। ন্যায়ের পক্ষে কথা বলে, ক্ষমতার মুখোমুখি দাঁড়ায়। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে “সুশীল” হয়ে উঠেছে বিদ্রূপের, তাচ্ছিল্যের এবং ঘৃণার সমার্থক শব্দ। এই শব্দটিকে ব্যঙ্গ করে উচ্চারণ করেছেন স্বয়ং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি একবার বলেছিলেন, “সুশীলদের চোখের ডাক্তার দেখানো উচিত।” শুধু শেখ হাসিনা নন, গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেই “সুশীল” শব্দটি মানে হয়ে দাঁড়িয়েছে দলছুট, দুর্বল, বিদেশি দালাল কিংবা মিথ্যা শুভবোধের ধারক। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এই বিদ্রূপের মাত্রা কমেনি, বরং বেড়েছে।
এই বিদ্রূপের পেছনে কেবল রাজনীতি দায়ী নয়, দায় আমাদের সবার। কারণ আমরা — আপনি, আমি, আমরা সবাই — নিজেদের নৈতিক ও চিন্তার জায়গায় যথেষ্ট প্রস্তুত হতে পারিনি। ন্যায়-অন্যায়ের বিভাজন, সত্য-মিথ্যার সীমারেখা, ক্ষমতা ও বিবেকের পার্থক্য আজও আমাদের সামাজিক মানচিত্রে স্পষ্ট নয়। আমরা এমন এক সমাজে বাস করি, যেখানে যুক্তির বৈধতা নির্ধারিত হয় উচ্চকণ্ঠতা ও সমর্থকের সংখ্যা দিয়ে। ফলে সত্য বললেও যদি তা সংখ্যাগরিষ্ঠের অপছন্দ হয়, তাহলে সেটি বিদ্রূপের শিকার হয়। এভাবেই “সুশীল” হয়ে গেছে গালির সমার্থক।
একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এখানে প্রাসঙ্গিক। আমি বিপুল ব্যয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। অনেকদিন ভাবতাম — এর দরকার ছিল কি? ক্যারিয়ারে কী পেলাম? কিন্তু পরে বুঝেছি, সমাজের জটিল রূপের ভেতরে ভালো আর খারাপের পার্থক্য বুঝতে পারাই ছিল সবচেয়ে বড় অর্জন। তাই বহু আগেই সিজিপিএ নিয়ে ভাবা ছেড়েছি। মননচর্চা আর যুক্তির ভিত্তিতে একটি সমাজে নিজের জায়গা খুঁজে পাওয়াটাই হয়তো শিক্ষার চূড়ান্ত রূপ।
আমরা চোখের সামনে রাষ্ট্রীয় হত্যা দেখেছি, কিন্তু প্রশ্ন তুলিনি। নয়ন বন্ড হত্যাকাণ্ড তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাকে ক্রসফায়ারে হত্যা করে রাষ্ট্র বাহবা কুড়িয়েছে। এমনকি আমার শিক্ষিত মা-ও বলেছিলেন, “ভালোই হয়েছে।” তার মৃতদেহ প্রদর্শনের জন্য পুলিশ জনগণকে লাইনে দাঁড় করিয়েছিল। একধরনের নাটকীয় জনতুষ্টিবাদকে রাষ্ট্র কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছিল। তখন কতজন প্রশ্ন করেছিলাম — একজন মানুষকেও কি আইনের বাইরে হত্যা করা যায়? আমরা কি জানতাম না, আইনের দীর্ঘসূত্রতা সমস্যা হলেও, ন্যায়বিচার মানে কখনোই হত্যা নয়?
তখন কিছু মানুষ প্রশ্ন তুলেছিলেন — বর্তমানে যাঁদের নাম আমরা জানি। যেমন: ডা. জাহেদুর রহমান, সহুল আহমদসহ আরও অনেকে। কিন্তু আমরা তাঁদের কথা শুনতে চাইনি। কেউ কেউ আজও শুনতে চায় না। কারণ, তাঁরা “সুশীল” নামে গালির পাত্র।
২০২৫ সালে এসে কেউ যদি বলে, “আমি চাই শেখ হাসিনারও ন্যায়বিচার হোক” — আমাদের কানে সেটি কেমন শোনায়? কেউ যদি বলেন, “আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উপর হামলা নয়, প্রতিশোধ নয়, বরং আইনের মধ্য দিয়ে বিচার” — তখনও কি আমরা তাকে “সুশীল” বলে গালি দিতে চাই না? কিন্তু আসল সত্য এটিই — ন্যায়বিচার মানে প্রতিশোধ নয়, বরং আইনসিদ্ধ জবাবদিহি। ইনসাফ প্রতিষ্ঠার অর্থ হচ্ছে, অপরাধীর পক্ষ হলেও তার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। কারণ আইন না থাকলে বিচার নির্ভর করবে জনরোষ, রাজনৈতিক চাপ বা ক্ষমতার উপর, যা কোনোভাবেই সভ্য সমাজের মানদণ্ড হতে পারে না।
শেখ হাসিনার সরকারের সময় “সুশীল” শব্দটি পরিকল্পিতভাবে গালি বানানো হয়। এটি ছিল রাজনৈতিক ভাষাগত এক মিথ্যাচার। যেখানে যুক্তি, বিবেচনা ও নৈতিকতাকে চক্রান্ত হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। কয়েকদিন আগে ফ্রান্সে বসবাসকারী এক ইনফ্লুয়েন্সার একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি গালি দিই, কারণ সমাজের উচ্চশ্রেণি সম্মানের ভয় পায়।” তাঁর এই বক্তব্যেই বোঝা যায়, আমাদের সমাজ কোন মানসিকতায় আটকে আছে। গালি বা সহিংসতা যেন হয়ে উঠেছে নতুন শ্রেণি-রাজনীতির ভাষা।
এটি শুধু রাজনৈতিক শোষণের কৌশল ছিল না, এটি ছিল পুরো গণতান্ত্রিক পরিসরকে সংকুচিত করার এক সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। শুরুতে যারা প্রশ্ন তুলেছে, তাদের বিদেশি দালাল বলা হয়েছে। এরপর নির্বাচিত কিছু “সুশীল” দলে টেনে নেওয়া হয়েছে, বাকিদের করা হয়েছে চরিত্রহরণের শিকার। ফলে নাগরিক সমাজের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্রমেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে সমাজের বিবেক গঠনের প্রক্রিয়াকে।
দুঃখজনকভাবে, আমাদের সুশীল সমাজের কিছু প্রতিনিধি নিজেরাও এই কৌশলের অংশ হয়ে গেছেন — সচেতনভাবে বা অজান্তেই। কেউ কেউ সুবিধা নিয়েছেন, কেউ কেউ ভয় পেয়েছেন, কেউ কেউ আত্মরক্ষার কৌশলে চুপ থেকেছেন। এর ফলে “সুশীল সমাজ” নামক ধারণাটির উপর নেমে এসেছে আস্থার সংকট, আর সেই ফায়দা নিয়েছে রাজনৈতিক শ্রেণি।
তবে এখনও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। আপনি যদি আজ বলেন, “আইনের চোখে সবাই সমান” — আপনি কি নিশ্চিত থাকবেন যে, আপনাকে গালি দেওয়া হবে না? আপনি কি তখনো “পিন্ডির দালাল”, “দিল্লির দালাল” বা সরাসরি “সুশীল” আখ্যা পাবেন না? এখনো কি আপনি সামাজিক বিদ্রূপের কবলে পড়বেন না? উত্তর হচ্ছে — হ্যাঁ, পড়বেন।
তবুও সত্য বলতে হবে। সমাজে যারা চিন্তা করে, প্রশ্ন তোলে, তারা নিঃসন্দেহে সমাজের মেরুদণ্ড। তাদের নাম “সুশীল” হোক বা কিছুই না হোক — তাদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কারণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে হলে চিন্তার স্বাধীনতা ও ন্যায়বোধসম্পন্ন মানুষ দরকার। যাঁরা অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়াবেন এবং বলবেন, “আমি চাই ন্যায়বিচার।”
“সুশীল” হয়ে উঠেছে এক ভয়ংকর প্রতীক — যেখানে প্রশ্ন তোলা অপরাধ, যুক্তি প্রদর্শন করা ষড়যন্ত্র, আর ন্যায়বিচার চাওয়া কপটতা। এই রাজনৈতিক অপপ্রয়োগকে প্রতিহত করতে হলে আমাদের আবার “সুশীল” হতে হবে — অর্থাৎ সভ্য, ন্যায়নিষ্ঠ, যুক্তিনির্ভর। এই সময়ের চাহিদা একজন নতুন নাগরিক — যিনি ভয় নয়, বিবেক দিয়ে সমাজ গড়বেন।
যতদিন না আমরা এ সত্য বুঝতে পারি, ততদিন “সুশীল” শব্দটি গালি হয়েই থাকবে। কিন্তু ততদিনও, কেউ না কেউ দাঁড়াবেই। কারণ সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোই তো সভ্যতার আসল পরিচয়।
- লেখক আলিফ ইফতেখার হোসেন, বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই) এ গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মরত আছেন। ইমেইল:✉️ [email protected]
সঠিক প্রশ্ন করা জরুরি: আমাদের শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি প্রসঙ্গে

রাইয়ান হোসেন
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও রাজনৈতিক গবেষক
বাংলাদেশের ইতিহাসে সাম্প্রতিক একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা গোটা জাতিকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। রাজধানী ঢাকার একটি স্কুল-কলেজ প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে (সরকারি হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত এই সংখ্যাটি প্রায় ৩০)। এই মৃত্যু শুধুমাত্র একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি আমাদের জাতীয় বিবেকের ওপর এক কঠিন আঘাত। এই তরুণ প্রাণগুলো ভবিষ্যতে হয়ে উঠতে পারত এই দেশের সম্ভাবনাময় নাগরিক। কেউ হয়তো হতো চিকিৎসক, কেউ হয়তো উদ্ভাবক, কেউ হয়তো সমাজ সংস্কারক। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল, এমন দুর্ঘটনার প্রতিটি স্তরে দায় চিহ্নিত করে দ্রুত, মানবিক ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
এই শোকাবহ প্রেক্ষাপটে জাতি যখন দিশেহারা এবং রাষ্ট্র যখন প্রশাসনিক ও নৈতিক পরীক্ষার মুখে, তখন পত্রিকার পাতায় হঠাৎ একটি দাবি উঠে আসে। শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আব্রার-এর পদত্যাগ চাওয়া হয়েছে। প্রথমে বিষয়টি বিস্ময়কর মনে হলেও, পরে দেখা গেল কিছু তরুণ, কিছু গোষ্ঠী এবং কিছু প্রচারমাধ্যমে এই দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করা হচ্ছে। প্রশ্ন জাগে, কেন এই দাবি? এবং কে বা কারা এই দাবি করছে? এটি কি নিছক আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া, না কি সুপরিকল্পিত কোনো প্রচেষ্টা?
এইচএসসি পরীক্ষার মতো একটি উচ্চমার্গের পাবলিক পরীক্ষার ঠিক আগের দিন এমন একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেলে, শিক্ষার্থীদের পক্ষে পরদিনই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা নিছক মানসিক নির্যাতন ছাড়া আর কিছু নয়। যারা নিজেদের চোখের সামনে সহপাঠীর মৃত্যু দেখেছে, যাদের চারপাশে এখনো পোড়া দেহের গন্ধ মিশে আছে বাতাসে, তাদের পক্ষে কলম ধরা কঠিন। রাষ্ট্র এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল, আগেই পরীক্ষা স্থগিতের মানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া। মধ্যরাতে নেওয়া সিদ্ধান্ত দেরিতে আসা এবং অনেকটা দায়সারা মনে হয়েছে।
তবে এই দেরির দায় কি সম্পূর্ণভাবে একজন সদ্য নিয়োজিত উপদেষ্টার কাঁধে চাপানো যুক্তিসঙ্গত? অধ্যাপক সি. আর. আব্রার মাত্র ৫ মার্চ ২০২৫ তারিখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। এখনো ছয় মাসও হয়নি তার দায়িত্ব গ্রহণের। এমন বাস্তবতায়, এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য তাকে এককভাবে দায়ী করা কতটা বাস্তবসম্মত, তা গভীরভাবে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে।
আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নই এবং অধ্যাপক আব্রার আমার শিক্ষকও নন। কিন্তু একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এবং রাজনৈতিক-সামাজিক গতিপ্রবাহ পর্যবেক্ষণকারী হিসেবে আমি তার কার্যক্রম, অবস্থান ও ভূমিকার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তিনি একজন শিক্ষাবিদ হওয়ার পাশাপাশি মানবাধিকার আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর। তিনি অধিকার নামক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যেটি গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, দমন-পীড়ন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে।
বিশেষ করে, তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন। যখন দেশের বহু বুদ্ধিজীবী নীরব ছিলেন, তখন অধ্যাপক আব্রার ছিলেন স্পষ্টবাদী ও আপসহীন। এই প্রেক্ষাপটে হঠাৎ করে তার বিরুদ্ধে পদত্যাগের দাবি উঠা নিছক দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়া নয়। বরং এটি সুপরিকল্পিত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত একটি প্রচেষ্টা বলেই সন্দেহ হয়।
এই দাবি কারা তুলছে, সেটিও ভাবার বিষয়। দেখা যাচ্ছে, কিছু তরুণ গোষ্ঠী এই দাবি উপস্থাপন করছে। তবে এটি কি শিক্ষার্থীদের আত্মিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, না কি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্ররোচনার ফল, সে প্রশ্নও উঠছে। মন্ত্রিসভার আরও অনেক উপদেষ্টার কার্যকারিতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থাকলেও, তাদের কারও বিরুদ্ধে এমন দাবি দেখা যাচ্ছে না। তাহলে অধ্যাপক আব্রার-এর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেন?
তাঁর অপরাধ যদি কিছু থাকে, তবে তা হলো—তিনি ফ্যাসিবাদবিরোধী, মানবাধিকারপন্থী এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তিনি ছিলেন জুলাই-আগস্ট মাসের ছাত্র-যুব অভ্যুত্থানের নৈতিক চেতনার ধারক ও বাহক। এই অবস্থান তাকে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর চোখে সন্দেহজনক করে তুলেছে। ফলে তাকে টার্গেট করা শুরু হয়েছে।
একজন শিক্ষক কেবল পাঠ্যবই পড়ান না, তিনি সমাজ নির্মাণের কাজ করেন। যিনি রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন তুলতে শেখান, তিনিই প্রকৃত শিক্ষকের ভূমিকায় আছেন। অধ্যাপক আব্রার সেই ভূমিকায় আছেন বলেই তিনি রাজনৈতিকভাবে অস্বস্তিকর ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে, তাদের কাছে যাদের কাছে আনুগত্যই মূল মাপকাঠি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমালোচনার ফাঁদে আটকে থাকব, নাকি কাঠামোগত ব্যর্থতার দিকে নজর দেব? কেন সেনাবাহিনীর ট্রেনিং এমন জনবহুল এলাকায় হচ্ছিল? কেন নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি? কেন প্রশাসনিক সমন্বয়ের অভাব দেখা গেল? এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন না তুলে যদি আমরা একজন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত মানবাধিকারপন্থী উপদেষ্টাকে ঘায়েল করার চেষ্টা করি, তাহলে তা হবে ভবিষ্যতের প্রতি ভয়াবহ অবিচার।
আমরা যদি সত্যিই এই দুর্ঘটনায় ব্যথিত হই, তবে আমাদের উচিত সিস্টেমকে দায়ী করা, ব্যক্তি নয়। অধ্যাপক আব্রার তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং মানবিকতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি শ্রেণিকক্ষে মুক্তচিন্তা চর্চার পক্ষে, রাজনৈতিক পক্ষপাতের বিপক্ষে। তাকে আক্রমণ করা মানে, এই চেতনার বিরুদ্ধেই অবস্থান নেওয়া।
গণতন্ত্র কেবল নির্বাচন নয়, এটি একটি মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ কাঠামোর নির্মাণ। অধ্যাপক আব্রার সেই মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করেন। তার মতো একজন শিক্ষক, চিন্তক ও মানবাধিকারকর্মীর বিরুদ্ধে আজ পদত্যাগের দাবি তোলা মানে মুক্তচিন্তাকে রুদ্ধ করে দেওয়া এবং প্রতিবাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে ফেলা।
এই অবস্থায় আমাদের করণীয় একটাই—আমরা যেন সঠিক প্রশ্ন করি। যদি এখন না করি, তাহলে কবে করব?
-লেখক রাইয়ান হোসেন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি,বাংলাদেশ (আইইউবি) এর গ্লোবাল স্টাডিজ ও গভার্নেন্স বিভাগে লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত। তবে তিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্যের নটিংহাম ইউনিভার্সিটিতে "রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক" নিয়ে পিএইচডি করছেন। ইমেইল: [email protected]
ফ্যাসিবাদ, শিক্ষকতা ও প্রতিরোধের সমাজতত্ত্ব

শামসুল আরেফীন
শিক্ষক ও রাজনৈতিক গবেষক
ফ্যাসিবাদ কেবল রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে সীমাবদ্ধ নয়; এটি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, জ্ঞান এবং নৈতিকতাকেও বন্দী করে ফেলে। বিগত ষোলো বছরের অভিজ্ঞতায় আমি প্রত্যক্ষ করেছি, কীভাবে একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা নাগরিকদের অস্তিত্বকে রাজনৈতিক আনুগত্যের মানদণ্ডে বিচার করে। ব্যক্তির নৈতিকতা, মতপ্রকাশ কিংবা পেশাগত স্বাধীনতা তখন আর নিরপেক্ষ থাকে না; বরং তা নির্ধারিত হয় ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে তার সম্পর্কের উপর।
আমি গোপালগঞ্জের মানুষ, যা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় অনেকের কাছে একধরনের সুবিধাজনক পরিচয় বলে বিবেচিত। অথচ এই পরিচয় রাষ্ট্র ও সমাজ যখন রাজনৈতিক আনুগত্যের মাপকাঠিতে যাচাই করতে থাকে, তখন তা হয়ে ওঠে এক বিপজ্জনক দায়। গত কয়েক বছরে আমাকে "শিবির" ট্যাগ নিয়ে চলতে হয়েছে, যদিও কোনো পর্যায়েই আমার সেই রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততা ছিল না। এটি নিছক কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ ছিল না; বরং এটি ছিল একটি বৃহত্তর সাংগঠনিক ফ্যাসিজমের উপসর্গ, যেখানে পরিচয়, আনুগত্য এবং কথিত "জাতীয় স্বার্থ" ব্যবহার করে ভিন্নমতের মানুষদের সামাজিক ও পেশাগতভাবে নির্বাসনে পাঠানো হয়।
আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষকতা একটি মুক্ত পেশা। এখানে বিবেকবোধ এবং সত্য বলার স্বাধীনতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, আমি রাজনৈতিক পরিচয়ের আশ্রয় নেইনি। এমন একটি সমাজে, যেখানে পিয়ের বুরদিয়ুর "academic field" ধারণা আর প্রযোজ্য থাকে না, সেখানে সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক পুঁজির বদলে রাজনৈতিক পুঁজি নিয়োগের মূল নির্ধারক হয়ে ওঠে। বোর্ডে প্রবেশের পর বুঝতে পারি, মেধা নয়, আনুগত্যই এখানে মূল্যবান। নিয়োগ পান সেই ব্যক্তি, যার একাডেমিক যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও রাজনৈতিক অবস্থান ছিল ‘সঠিক’।
গোপালগঞ্জের একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের সিদ্ধান্ত ছিল আত্মিক দায়বদ্ধতা থেকে। নিজের মাটিতে, নিজের সমাজে মানুষ গড়ার বাসনায় সেখানে যাই। কিন্তু গিয়ে দেখি, শিক্ষার পরিবেশটি যেন একটি ক্ষুদ্রায়ত ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি। উপাচার্য নিজেকে কর্তৃত্ববাদী ঘোষণা করেন, প্রশাসন সরাসরি একটি রাজনৈতিক দলের অনুগত, আর শিক্ষক সমাজ বিভক্ত ও বিভ্রান্ত। গ্রামসির ভাষায়, এখানে ‘consent’ ও ‘coercion’ মিলিয়ে একটি আধিপত্যবাদী কাঠামো তৈরি হয়েছে, যা প্রশ্নহীন আনুগত্যকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উৎসাহিত করে।
এই প্রেক্ষাপটে আমি শ্রেণিকক্ষে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের বলতাম, "তোমরা হুকুমের গোলাম নও, গেইম চেঞ্জার।" এটি কেবল অনুপ্রেরণামূলক বাক্য নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাঠামোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক প্রতিরোধী শিক্ষার ভাষ্য। আমি শিক্ষার্থীদের শেখাতাম, শিক্ষকের কাজ শুধু তথ্য সরবরাহ নয়, বরং সমাজ, রাষ্ট্র এবং ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করার সক্ষমতা তৈরি করা। পাউলো ফ্রেইরের “Pedagogy of the Oppressed” আমার এই দৃষ্টিভঙ্গিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, যেখানে শিক্ষা নিজেই হয়ে ওঠে মুক্তির হাতিয়ার।
কিন্তু একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই শিক্ষাদর্শনই হয়ে ওঠে হুমকিস্বরূপ। আমার রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা, প্রশাসনের অপছন্দ এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মুক্ত আলোচনার সংস্কৃতি মিলিয়ে আমাকে ‘অপর’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আমাকে "হাফ গোপালী" বলা হয়, যেন আমি আংশিকভাবে বৈধ, পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নই। এটি একধরনের সাংস্কৃতিক ও আঞ্চলিক বর্গীকরণের কৌশল, যা ফ্যাননের "colonial mimicry" ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। উপনিবেশিত আত্মা কখনো পুরো স্বীকৃতি পায় না; বরং চিরকাল সীমান্তবর্তী এক অবস্থানে থেকে যায়।
এক সময়ের বন্ধু, বর্তমানে ছাত্রলীগের নেতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা ফোন করে অভিযোগ করেন, "সে শিবির সিম্পেথাইজার। কেন এখানে চাকরি করছে?" এটি শুধু একটি চাকরি ছিনিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র ছিল না; বরং একজন মানুষকে সামাজিক ও একাডেমিকভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার একটি সচেতন প্রয়াস। Judith Butler যেভাবে “social death” ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন, সেটি এখানে বাস্তব রূপ নিয়েছে, যেখানে সন্দেহভাজন রাজনৈতিক অবস্থানের মানুষদের পেশাগত এবং নৈতিকভাবে অদৃশ্য করে দেওয়া হয়।
তবুও আমি থেমে থাকিনি। আমি বিশ্বাস করি, একাডেমিক শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তিতে মানুষকে সম্মান দেওয়া যায়, রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়। ঢাকায় যাঁরা একাডেমিকভাবে সমৃদ্ধ, তাঁদের—ডান, বাম বা লিগ নির্বিশেষে—গোপালগঞ্জে এনে শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি। আমার বিশ্বাস, অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে শ্রেণিকক্ষই হতে পারে মুক্তচিন্তার একমাত্র ক্ষেত্র।
আমার অবস্থানের কারণে আমার পরিবারকেও মূল্য দিতে হয়েছে। আমার স্ত্রী, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন, তিনি আমার অ্যাক্টিভিজমের কারণে পেশাগতভাবে বাঁধার সম্মুখীন হন। আমেরিকায় পিএইচডি করতে আসার আগে তাঁকে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ীভাবে শিক্ষকতা করতে দেওয়া হয়নি। এটি প্রমাণ করে, ফ্যাসিবাদ ব্যক্তি নয় শুধু, তার পরিবার, সম্পর্ক ও পরিসরকেও গ্রাস করে।
২০২৪ সালের জুলাইয়ের ছাত্র ও যুব অভ্যুত্থানে আমি সক্রিয়ভাবে অংশ নিই। এই আন্দোলন কেবল শাসকবিরোধী ছিল না; বরং এটি ছিল একটি নতুন সমাজ ও ভবিষ্যতের কল্পনার ভিত্তি। আমি চাইনি এই বিপ্লব প্রতিশোধমূলক হোক। কারণ ফ্যাসিবাদ ভাঙার নামে যদি নতুন ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তা হবে এক নিষ্ফল বিজয়। আমি বিশ্বাস করি, গণতন্ত্র কেবল সরকার পরিবর্তনের প্রক্রিয়া নয়; বরং এটি সমাজের কাঠামোগত ও নৈতিক পুনর্গঠনের এক দীর্ঘ সংগ্রাম।
আমার অবস্থান খুবই স্পষ্ট। কোনো ব্যক্তিকে যদি “লীগ” পরিচয় দিয়ে হত্যা করা হয়, তবে আমি তার প্রতিবাদ করব। প্রতিহতের নামে আরেকটি অনাচার হলে, তা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা নয়। কোনো পিতাকে তার পুত্রের অপরাধের দায়ে শাস্তি দেওয়া হলে, তাতেও আমি প্রতিবাদ জানাব। আমি এমন একটি রাষ্ট্র চাই, যেখানে মানুষকে তার ধর্ম, অঞ্চল কিংবা রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে নয়; বরং মানবিক মর্যাদা, সুবিচার এবং নৈতিক অবস্থানের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে।
বাংলাদেশকে আমি কল্পনা করি একটি সহানুভূতিশীল, গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে। এখানে শিক্ষক ভয় না পেয়ে মুক্তভাবে চিন্তা করবেন, ছাত্ররাও হবে সজাগ ও চিন্তাশীল নাগরিক। এই কল্পনা শুধু একটি রাজনৈতিক স্বপ্ন নয়; এটি আমার শিক্ষকতা, চিন্তা এবং বেঁচে থাকার নৈতিক ভিত্তি।
এটাই আমার সমাজতাত্ত্বিক প্রতিরোধ।
-লেখক শামসুল আরেফীন, শিক্ষক ও রাজনৈতিক গবেষক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন সমাজবিজ্ঞানে।
ব্রেক্সিট, ফেসবুক ও গণতন্ত্রের ছায়াযুদ্ধ: বাংলাদেশের জন্য সতর্কবার্তা

মো. অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
২০১৬ সালের জুন মাসে যুক্তরাজ্য একটি ঐতিহাসিক গণভোটের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত শুধু রাজনৈতিক নয়; এটি জাতিগত বিভাজন, ভৌগোলিক বৈষম্য এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে গভীর প্রশ্ন তোলে। ওই ভোটের পরপরই এক ব্রিটিশ সাংবাদিক ফিরে যান ওয়েলসের দক্ষিণাঞ্চলের শহর ইব্বু ভেইল-এ, যেখানে প্রায় ৬২ শতাংশ মানুষ "Leave" অর্থাৎ EU ত্যাগের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। অথচ এই শহরটি ছিল ইউরোপীয় অনুদানের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগীদের একটি। উন্নত কলেজ, ক্রীড়া কমপ্লেক্স, রাস্তা, রেললাইনসহ অবকাঠামোগত প্রতিটি স্তরে ছিল EU অর্থায়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
এই দৃশ্যমান উন্নয়নের বিপরীতে স্থানীয় জনগণের অনুভূতিতে ছিল অবজ্ঞা ও উপেক্ষার একধরনের ক্ষত। এখানে তৈরি হয় এক মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। উন্নয়ন চোখে দেখা গেলেও জনগণ অনুভব করছিল একধরনের প্রান্তিকতা। তারা মনে করছিল, বিদেশি অভিবাসীদের কারণে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়েছে। অথচ সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ইব্বু ভেইল ছিল যুক্তরাজ্যের অভিবাসী কম সংখ্যক অঞ্চলগুলোর একটি।
এই অযৌক্তিক ভয় ও ক্ষোভ ছড়িয়ে দিতে বড় ভূমিকা রাখে সামাজিক মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক। এক স্থানীয় নারীর ভাষ্যমতে, গণভোটের আগের সপ্তাহগুলোতে তার ফেসবুক নিউজফিডে এমন বহু ভীতিকর পোস্ট আসে যেখানে বলা হচ্ছিল তুরস্ক শিগগির EU সদস্য হতে যাচ্ছে, লক্ষ লক্ষ মুসলিম ইউরোপে ঢুকে পড়বে, এবং ব্রিটিশ সমাজ ভেঙে পড়বে। ভোটের পর সেই পোস্টগুলো আর দেখা যায়নি। কারণ এগুলো ছিল তথাকথিত "ডার্ক অ্যাড", যা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ব্যবহারকারীর নিউজফিডে একবারের জন্য প্রদর্শিত হয়, পরবর্তীতে তা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে এক অদৃশ্য ডিজিটাল ছায়াজগতে বাস্তবায়িত হয় যুক্তরাজ্যের একটি যুগান্তকারী গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত।
এই তথ্য-নির্ভর ছায়াযুদ্ধের পেছনে ছিল ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা নামক এক রাজনৈতিক পরামর্শক সংস্থা, যারা ৮৭ মিলিয়নেরও বেশি ফেসবুক প্রোফাইল থেকে অবৈধভাবে তথ্য সংগ্রহ করে। এই তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা তৈরি করে মনস্তাত্ত্বিক প্রোফাইল এবং প্রতিটি ব্যক্তির ব্যক্তিগত ভয়, দুশ্চিন্তা ও অসন্তোষকে টার্গেট করে বিভ্রান্তিকর বার্তা পাঠায়।
একইসাথে ‘Vote Leave’ নামক অফিসিয়াল প্রচার সংস্থা নির্বাচন কমিশনের নিয়ম ভেঙে গোপনে প্রায় ৭.৫ লক্ষ পাউন্ড ব্যয় করে, যা নির্বাচনী কমিশনের তদন্তে অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই অর্থে তৈরি হয় অসংখ্য বিভ্রান্তিকর ডিজিটাল বিজ্ঞাপন, যার মধ্যে তুরস্ক-সংক্রান্ত ভিত্তিহীন তথ্যও ছিল। ডিজিটাল প্রযুক্তির এমন অপব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, এবং জনমত গঠিত হয় বিভ্রান্তিকর তথ্যের ভিত্তিতে।
আরও গভীর উদ্বেগের বিষয় হলো, এই পুরো ঘটনাপ্রবাহে ফেসবুক, গুগল এবং ইউটিউবের মতো প্রযুক্তি জায়ান্টগুলো রয়ে যায় জবাবদিহির বাইরে। যুক্তরাজ্যসহ নয়টি দেশের সংসদ মার্ক জুকারবার্গকে সাক্ষ্যদানের জন্য আহ্বান জানালেও তিনি উপস্থিত হননি। কেউ জানে না কে বিজ্ঞাপন দিয়েছে, কী তথ্য ব্যবহার করেছে, কত খরচ হয়েছে কিংবা এই প্রচারণার পেছনে কোন দেশের অর্থ ছিল। এই জবাবদিহিহীন প্রযুক্তি ব্যবহার শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং এক ভয়ঙ্কর নৈতিক শূন্যতার প্রতিচ্ছবিও।
এই অভিজ্ঞতা কেবল যুক্তরাজ্য বা ব্রেক্সিট ঘিরেই সীমাবদ্ধ নয়। ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, ব্রাজিল, মায়ানমার কিংবা নিউজিল্যান্ডেও দেখা গেছে একই ধরণের ডিজিটাল প্রচারণা ও মিথ্যাচার গণতান্ত্রিক কাঠামোকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশে বর্তমানে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটির বেশি। এই বিশাল সংখ্যক ব্যবহারকারী একটি নতুন তথ্য-রাজনীতির ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে। ফেসবুক এখন আর শুধু যোগাযোগ বা বিনোদনের মাধ্যম নয়; এটি হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দলের প্রচার ও জনমত গঠনের একটি মুখ্য হাতিয়ার। রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তিগত গোষ্ঠীগুলোও এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করছে মত প্রভাবিত করতে।
২০২৪ সালের জুলাই মাসের ছাত্র ও যুব অভ্যুত্থান এবং তার পরবর্তী সময়ে ফেসবুকে গুজব, বিকৃত তথ্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচারের স্রোত ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তথাকথিত ‘সাইবার বাহিনী’ বা ‘ডিজিটাল অ্যাক্টিভিস্ট’রা, যারা শুধু সমালোচক, সাংবাদিক কিংবা বিরুদ্ধমতের মানুষদের নয়, বরং সাধারণ নাগরিকদের প্রতিও ট্রলিং, হুমকি এবং তথ্য বিকৃতির মাধ্যমে ডিজিটাল নিপীড়ন চালাচ্ছে।
নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে। নির্বাচন কমিশনের উপর জনসচেতনতা, স্বচ্ছতা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করার যে দায়িত্ব, তা কতটা কার্যকরভাবে পালন করা হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। একই সঙ্গে সংশোধিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কতটা ভারসাম্যপূর্ণ হবে এবং বহুজাতিক টেক কোম্পানিগুলোর প্রতি কতটা জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা যাবে, সে প্রশ্নগুলোও গুরুত্বপূর্ণ।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের সামনে রয়েছে কিছু জরুরি করণীয়। প্রথমত, রাজনৈতিক ডিজিটাল প্রচারের ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত তথ্য যাচাইয়ের জন্য আইনি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। তৃতীয়ত, বহুজাতিক প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে স্থানীয়ভাবে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সর্বোপরি, নাগরিকদের মধ্যে তথ্য বিশ্লেষণের সক্ষমতা ও ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।
গণতন্ত্র কোনো স্থায়ী বা প্রাকৃতিক অধিকার নয়। এটি সচেতনতা, দায়িত্ব ও লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জন ও রক্ষা করতে হয়। ব্রেক্সিট আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে প্রযুক্তি যেমন জনগণকে সংযুক্ত করতে পারে, তেমনি সেটি বিভ্রান্তিও ছড়িয়ে দিতে পারে। এখন সিদ্ধান্ত আমাদের — আমরা কি এই অনিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তি শক্তির সামনে দাঁড়াব, নাকি চুপচাপ আমাদের ভবিষ্যৎ তাদের হাতে তুলে দেব?
-লেখক মো. অহিদুজ্জামান ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ এর গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গভর্ন্যান্স বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। পাশাপাশি তিনি অনলাইন সংবাদমাধ্যম "সত্য নিউজ"-এর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
জনপ্রিয় ব্রিটিশ সাংবাদিক ক্যারল ক্যাডওয়ালাডারের এক উন্মুক্ত বক্তৃতা থেকেই এই লেখার অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়েছে।
পাঠকের মতামত:
- গাজা দখল রুখতে ওআইসির জরুরি সভার ঘোষণা
- শেখ হাসিনা বারোটা বাজিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার চব্বিশটা: মির্জা আব্বাস
- মাত্র ১৯ দিন হাতে, অর্থনৈতিক আঘাত এড়ানোর উপায় খুঁজছে ভারত
- ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলেন সিইসি
- ড. মইন খান: ২০২৪ সালের বিপ্লব লুটেরাদের জন্য নয়
- নাটোরে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের অনুষ্ঠান বয়কট করলো জেলা বিএনপি
- পার্বত্য এলাকায় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সালাহউদ্দিন আহমদের সতর্কবার্তা
- দীপু মনির ভাগ্নে রিয়াজ উদ্দীন আটক হল যেভাবে
- ছাত্রলীগমুক্ত হল - শিক্ষার্থীদের বিজয়ের রাতের গল্প
- ক্ষমতায় গেলে ৩১ দফা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হবে: তারেক রহমান
- লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাংয়ের হুমকি, প্রাণ সংকটে কপিল শর্মা
- যারা নির্বাচনে ভয় পায়, তারাই পিআর পদ্ধতি চান: শামসুজ্জামান দুদু
- তারেক রহমানই দেশের আগামী প্রধানমন্ত্রী: মির্জা ফখরুল
- গাজায় তীব্র খাদ্য সংকটের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে
- মাসিক আয় থেকে সঞ্চয় করার সহজ ছয়টি উপায়
- অন্তর্বর্তী সরকারের আট উপদেষ্টার দুর্নীতির তথ্য প্রমাণ আছে:সাবেক সচিব সাত্তার
- রাজশাহীতে ১২টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করলেন উপদেষ্টা সজীব ভূঁইয়া
- ফেসবুক প্রেমে ফাঁদ, ৯ কোটি রুপি হারালেন বৃদ্ধ
- গাজীপুরে সাংবাদিক তুহিন হত্যায় সাতজন গ্রেফতার
- বড় কিছু নিয়ে ফিরছেন শাকিব খান, ভক্তদের জন্য বিশেষ বার্তা দিলেন
- নাসির উদ্দিন: মানুষের আস্থা হারিয়েছে নির্বাচন ব্যবস্থা
- আওয়ামী লীগ ও ভারতের স্বার্থে বাংলাদেশে দাঙ্গা দরকার: গয়েশ্বর চন্দ্র রায়
- ছবিতে প্রথমে যা দেখলেন, সেটাই বলে দেবে আপনার চরিত্র
- সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে সরকারের নির্ধারিত ২৭ টাকার সার বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়
- উপেক্ষার জবাব হ্যাটট্রিকের মাধ্যমে দিলেন রোনালদো
- আলাস্কায় পুতিন-ট্রাম্প সাক্ষাৎ: কূটনৈতিক ইতিহাসের নতুন অধ্যায়
- দুই কারণ সামনে রেখে গাজীপুরে সাংবাদিক হত্যা ঘটনায় তদন্ত
- চীনে প্রথমবার হিউম্যানয়েড রোবট পিএইচডিতে ভর্তি
- হাইপোথাইরয়েডিজম নিয়ন্ত্রণ করে জীবনে ফিরুন প্রাণবন্ততা
- ইসরায়েলি দখল পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিল ইরাক
- বেতন বৈষম্য দূরীকরণে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আন্দোলনের ঘোষণা
- নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কমিশনের সম্পৃক্ততা নেই: আলী রীয়াজ
- ছয় বছর পর ড্যাবের ভোটযুদ্ধ আজ, চিকিৎসক মহলে উত্তেজনা
- ১৮ হল কমিটি গঠনের পর বিক্ষোভ, ঢাবি উপাচার্যের কড়া বার্তা
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: ধ্বংসের ছায়া থেকে নতুন বিশ্বব্যবস্থার উত্থান
- মোদিকে গোপন পরামর্শ দেবেন নেতানিয়াহু
- খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিদ্রুপকারী পেলেন ছাত্রদলের পদ
- আসন্ন নির্বাচনে গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ার অঙ্গীকার তারেক রহমানের
- জামায়াতের ‘পিআর’ কৌশলে নির্বাচন বিলম্বের অভিযোগ হাফিজ উদ্দিনের
- সুরা আল-বাকারার উল্লেখযোগ্য ঘটনা ও বিষয়বস্তু বিস্তারিত জানুন
- কিশমিশের পানির বহুমুখী উপকারিতা: স্বাদের সঙ্গে স্বাস্থ্যের সঙ্গী
- ভক্তদের উদ্দেশ্যে রহস্যময় বার্তা শাকিব খানের
- ক্রিকেটের তীর্থক্ষেত্রের স্মৃতি ঘরে তোলার বিরল সুযোগ
- চীনের রোবোটিক অঙ্গ পেলেন জুলাই বিপ্লবের আহতরা
- কানাডায় কপিল শর্মার রেস্তোরাঁয় ফের গুলিবর্ষণ
- যানবাহন পানিতে পড়লে বাঁচার উপায়: বিশেষজ্ঞের জরুরি পরামর্শ
- গাজীপুরে সাংবাদিক তুহিন হত্যাকাণ্ডের আপডেট
- বয়স থেমে গেছে ৪০-এ! আর মাধবনের ২১ দিনের তারুণ্যের গোপন রহস্য
- নিজের আয়ের হিসাব দিলেন এনসিপি নেতা হান্নান মাসউদ
- শেখ হাসিনার প্রেতাত্মা এখনো সক্রিয়: জয়নুল আবদিন ফারুক
- শেখ হাসিনার পতনের পর কূটনীতি ও নিরাপত্তার কঠিন প্রশ্নগুলো
- গণঅভ্যুত্থানের এক বছর: মুক্তির স্বপ্ন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের চ্যালেঞ্জ
- ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের মনোবিশ্লেষণমূলক পাঠ: একটি প্রজন্মের অবচেতনের বিস্ফোরণ
- জামায়াতের ‘পিআর’ কৌশলে নির্বাচন বিলম্বের অভিযোগ হাফিজ উদ্দিনের
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: ধ্বংসের ছায়া থেকে নতুন বিশ্বব্যবস্থার উত্থান
- ভারতের ওপর ২৫% শুল্ক বৃদ্ধিতে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ
- ৫ আগস্ট ছুটি ঘোষণা: কোন কোন সেবা পাবেন, কোনগুলো বন্ধ থাকবে
- প্রধান উপদেষ্টা: "জুলাই শহীদদের স্বপ্নই হবে আমাদের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের ভিত্তি"
- চীনের অর্থনৈতিক নীরব বিপ্লব: পশ্চিমা একপক্ষীয় বিশ্বনীতির অবসানের সংকেত
- যুক্তরাষ্ট্রে শাকিব-বুবলীর সময় কাটানো নিয়ে মুখ খুললেন অপু বিশ্বাস
- বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ‘জুলাই জাগরণ’-এ জনতার ঢল
- শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের মাথায় হাত!
- কলাপাড়ার ইলিশ মোকামে ফের গর্জন, ঘাটে জমে উঠল ক্রেতার ভিড়
- ডিএসই তালিকাভুক্ত দুই কোম্পানির সময়মতো ডিভিডেন্ড
- মৃত ৮ মিনিট, জীবনের সন্ধান: এক নারীর অতিলৌকিক অভিজ্ঞতা