মতামত

প্রস্তাবিত জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি): একটি প্রশ্নবিদ্ধ ধারণা

হাবিবুর রহমান
হাবিবুর রহমান
অ্যাডভোকেট, ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশন
২০২৫ জুন ১৯ ০০:৩৬:১৬
প্রস্তাবিত জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি): একটি প্রশ্নবিদ্ধ ধারণা

জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি গঠনের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয় যে, এই কাঠামো বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং শাসনতান্ত্রিক ভারসাম্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রস্তাবিত কাঠামো অনুযায়ী এনসিসির সদস্য হবেন মোট নয়জন—রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, উচ্চ ও নিম্নকক্ষের স্পিকার, বিরোধী দল মনোনীত দুইজন ডেপুটি স্পিকার, উভয় কক্ষের সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে একজন নির্বাচিত সদস্য (যিনি সরকারি ও প্রধান বিরোধী দল ব্যতীত হবেন), এবং প্রধান বিচারপতি।

এই কাঠামোয় দেখা যাচ্ছে, একটি সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করেও সরকারি দল এনসিসিতে মাত্র তিনটি পজিশন পাচ্ছে—প্রধানমন্ত্রী, নিম্নকক্ষের স্পিকার এবং উচ্চকক্ষের স্পিকার। অন্যদিকে, বিরোধী দল পাচ্ছে চারটি পজিশন—বিরোধীদলীয় নেতা, দুইজন ডেপুটি স্পিকার এবং একজন সংসদ সদস্য। বিস্ময়করভাবে, বিরোধী দলকে এই চারটি পজিশন পাওয়ার জন্য কোনো ন্যূনতম ভোটের হার বা আসনসংখ্যা অর্জনের শর্তও রাখা হয়নি। সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব যতই সীমিত হোক না কেন, এনসিসিতে তারা সরকারি দলের তুলনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যেতে পারে। এমনকি, মাত্র পাঁচ শতাংশ আসন পেলেও এই কাঠামো অনুযায়ী বিরোধী দল এনসিসিতে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করতে পারবে।

এখানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে নিরপেক্ষ সদস্য হিসেবে ধরা হলেও, বাস্তবে রাষ্ট্রপতি সবসময় সরকারি দলের মনোনীত হন না। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের মোদি সরকারের প্রথম মেয়াদে রাষ্ট্রপতি ছিলেন কংগ্রেসের প্রণব মুখার্জি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এরকম হলে এনসিসির নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি বিরোধী দলের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার, যদি রাষ্ট্রপতি সরকারি দলের হয়েও থাকেন, তাহলে এনসিসিতে সরকারি ও বিরোধী উভয়পক্ষের সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় চার-চার। এই ভারসাম্য আসলে সবচেয়ে বিপজ্জনক, কারণ এতে সিদ্ধান্তগ্রহণকারী বা টাই-ব্রেকিং অবস্থানে চলে আসেন প্রধান বিচারপতি।

প্রধান বিচারপতি হলেন রাষ্ট্রের একটি সাংবিধানিক অঙ্গের প্রধান। তার ওপর এমন একটি প্রশাসনিক কাঠামোর সিদ্ধান্ত নির্ভর করলে, তিনি বিচার বিভাগীয় নিরপেক্ষতা হারাবেন। যদি তিনি সরকারি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন, তবে তাকে দলীয় বলে অভিযুক্ত করা হবে, আর বিরোধী দলের পক্ষে গেলে বলা হবে তিনি বিরোধীপন্থী। এতে করে বিচার বিভাগ রাজনৈতিক বিতর্কে জড়াবে এবং তাদের নিরপেক্ষতা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক বিরোধিতার কেন্দ্রবিন্দুতে এনে দাঁড় করানো হবে একটি ভয়ানক বিপর্যয়।

নির্বাচনে জয়ী রাজনৈতিক দলকে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে যদি এমনভাবে প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে হয়, তবে প্রধানমন্ত্রী কার্যত একটি খোঁড়া অবস্থানে পড়ে যাবেন। এনসিসি যেসব সিদ্ধান্ত নেবে, তা জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে উঠবে—চাই তিনি তা পছন্দ করুন বা না করুন। অথচ, এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়ভার পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীর কাঁধেই পড়বে। এই কাঠামো নির্বাচিত প্রধান নির্বাহীর কার্যকারিতা ও দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা খর্ব করবে।

সবচেয়ে ভয়ংকর দিকটি হলো, এই এনসিসি রাষ্ট্রপতির কাছে অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সেনাবাহিনীর প্রধানদের নিয়োগের জন্য নাম প্রস্তাব করবে। একটি নির্বাচিত সরকারের জন্য এটি স্পষ্টভাবে জাতীয় নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বাধীনতার জন্য হুমকিস্বরূপ। সরকার ও বিরোধী দলের নীতি ও কৌশলে যেহেতু মৌলিক পার্থক্য থাকে, তাই সরকারের অধীনে থাকা প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগে সরকারের মতামতই চূড়ান্ত হওয়া উচিত।

সেনাপ্রধান একজন সরকারি আমলা, আর প্রধান বিচারপতি একজন সাংবিধানিক কর্মকর্তা—এই দুই ভূমিকাকে এক করে দেখা যাবে না। তাদের দায়বদ্ধতা ও কার্যক্রমের ক্ষেত্র আলাদা। সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে যাকে নিয়োগ দেওয়া হবে, তিনি সরকারের কৌশল বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। আর প্রধান বিচারপতির ভূমিকা সংবিধানের ব্যাখ্যাকারী হিসেবে রাষ্ট্রীয় ভারসাম্য রক্ষা করা। কাজেই সেনাপ্রধান নিয়োগে বিরোধী দলের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা একান্তই অগ্রহণযোগ্য।

এছাড়া অ্যাটর্নি জেনারেল সরকারের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন। রিট ও ক্রিমিনাল মামলায় রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হিসেবে সরকারকেই দাঁড় করানো হয়। এই বাস্তবতায়, সরকার তার হয়ে কে মামলা পরিচালনা করবেন, তা বিরোধী দলের পরামর্শে ঠিক করা কতটা যুক্তিযুক্ত? যদি এনসিসিতে সরকার ও বিরোধী দলের সদস্য সংখ্যা সমান হয়, তাহলে কে অ্যাটর্নি জেনারেল হবেন তা নির্ধারণ করবেন প্রধান বিচারপতি। অর্থাৎ, একজন বিচারপতি নিজেই নির্ধারণ করবেন সরকার পক্ষের আইনজীবী কে হবেন। এটি বিচার বিভাগীয় নিরপেক্ষতার গুরুতর লঙ্ঘন।

এনসিসির এই কাঠামো একদিকে যেমন নির্বাচিত সরকারের কর্তৃত্বকে খর্ব করে, অন্যদিকে প্রধান বিচারপতিকে রাজনীতির কাদায় টেনে আনে। এতে করে আমলাতন্ত্র ও সাংবিধানিক পদে প্রফেশনালিজম ও জবাবদিহিতার যে ন্যূনতম ভিত্তি থাকা উচিত, তা ভেঙে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট তার প্রশাসন গঠনে দলীয় ব্যক্তিদের নিয়ে এলেও, যোগ্যতা, মেধা ও পেশাদারিত্ব নিয়ে সেখানে কোনো আপস করা হয় না। আমাদেরও সেই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, যেখানে দক্ষতা ও দায়িত্ববোধের ওপর ভিত্তি করে নিয়োগ হবে—নয় যে, বিরোধী দলের প্রাধান্যে পরিচালিত একটি ছায়া সরকার নির্বাচিত সরকারের কর্তৃত্বের ওপর ছায়া ফেলে রাখবে।

অতএব, একজন কার্যকর ও জনগণের কাছে জবাবদিহিতাপূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর মাথার ওপর বিরোধী দল-নির্ভর একটি সাংবিধানিক কাউন্সিল চাপিয়ে দিয়ে নির্বাচিত সরকারকে পঙ্গু করে তোলার এই ধারণা কোনো সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারক হতে পারে না।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত