মোদিকে পুতিনের ফোনেঃ ‘পূর্ণ সমর্থন’ তবে পাকিস্তান প্রশ্নে সতর্ক রাশিয়া

সত্য নিউজ: জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগামে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের লক্ষ্য করে চালানো ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া। সোমবার (৫ মে) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সরাসরি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করে এই সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে তার ‘পূর্ণ সমর্থন’ জানান। তবে একই সঙ্গে ক্রেমলিন পাকিস্তানকে সরাসরি দায়ী করতে বিরত থেকেছে—যা রাশিয়ার ভারসাম্যপূর্ণ কৌশলগত অবস্থানেরই প্রতিফলন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের প্রতি পূর্ণ সমর্থন

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এক্স (সাবেক টুইটার) এ জানান, “প্রেসিডেন্ট পুতিন প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ফোন করে কাশ্মীরের হামলার ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস দেন।” একইসঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হামলাকারী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিচারের আওতায় আনার উপর জোর দিয়েছেন বলেও জানান জয়সওয়াল।

গত ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগামে বন্দুকধারীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে কমপক্ষে ২৬ জন তীর্থযাত্রী নিহত হন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এটিকে “পূর্বপরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক গণহত্যা” বলে উল্লেখ করেছে, যেখানে হামলাকারীরা বেছে বেছে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের নিশানা করেছিল।

দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করার প্রতিশ্রুতি

মোদির সঙ্গে টেলিফোনালাপে পুতিন ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার কৌশলগত অংশীদারত্ব আরও গভীর করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। একইসঙ্গে মোদি বিজয় দিবসের ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষে পুতিনকে শুভেচ্ছা জানান এবং বছরের শেষ দিকে ভারতে অনুষ্ঠেয় দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানান।

তবে পাকিস্তান নিয়ে সতর্ক রাশিয়া?

যদিও নয়াদিল্লি রাশিয়ার এই সমর্থনকে ‘পরিষ্কার বার্তা’ হিসেবে দেখছে, তবে মস্কোর আনুষ্ঠানিক বিবৃতি ছিল অনেক বেশি কূটনৈতিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, “নয়াদিল্লি এবং ইসলামাবাদ উভয়ের সঙ্গেই রাশিয়ার সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পহেলগাম হামলার পর সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনা বাড়ছে, যা রাশিয়ার গভীর উদ্বেগের বিষয়।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মন্তব্য থেকেই বোঝা যায়, রাশিয়া চায় না ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা নতুন করে প্রকট হোক, বিশেষ করে যখন মস্কো ইউক্রেন যুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন সঙ্কটে পড়েছে।

পাকিস্তানের পাল্টা প্রস্তাব: আন্তর্জাতিক তদন্ত চায় ইসলামাবাদ

এদিকে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমরা চাই রাশিয়া, চীন কিংবা পশ্চিমা শক্তিগুলো নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি গঠন হোক, যারা নিরপেক্ষভাবে খতিয়ে দেখবে এই হামলার নেপথ্যে কে রয়েছে।”

তিনি বলেন, “এটি কেবল বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। প্রমাণ ছাড়া পাকিস্তানকে দায়ী করা মানে সত্যকে আড়াল করা।” পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফও এই হামলার ‘আন্তর্জাতিক তদন্তের’ পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

রাশিয়া-ভারত সম্পর্ক: তেল, প্রতিরক্ষা ও কূটনীতির বন্ধনে জোড়ালো সংযোগ

বিশ্লেষকদের মতে, ইউক্রেন যুদ্ধের সময় ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভারত বিপুল হারে রুশ অপরিশোধিত তেল কিনেছে। একইসঙ্গে প্রতিরক্ষা ও পরমাণু প্রযুক্তিতে দীর্ঘস্থায়ী সহযোগিতা রয়েছে দুই দেশের মধ্যে।

গত অক্টোবরে মোদির মস্কো সফরের সময় পুতিন বলেছিলেন, “আপনি কিছু না বললেও আমি আপনার মন বুঝতে পারি”—এ মন্তব্য ছিল সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার নিদর্শন।

সন্ত্রাস দমনে নতুন সমীকরণ?

এই ঘটনার পর আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের প্রতি রাশিয়ার প্রকাশ্য সমর্থন ভারতের কূটনৈতিক শক্তিরও প্রতিফলন। তবে মস্কোর পাকিস্তান প্রসঙ্গে সরাসরি দায়ারোপ এড়িয়ে যাওয়াই দেখিয়ে দেয়, রাশিয়া এখনও চায় দক্ষিণ এশিয়ায় নিজস্ব ভারসাম্য বজায় রাখতে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, “এটি রাশিয়ার 'ব্যালান্সিং অ্যাক্ট'। একদিকে তারা ভারতের সাথে জোট দৃঢ় করছে, অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করে বরং ভবিষ্যৎ প্রভাব ধরে রাখার চেষ্টায় আছে।”

কাশ্মীরে রক্তাক্ত ঘটনার জেরে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। রাশিয়ার অবস্থান স্পষ্টভাবে ভারতের সমর্থনে থাকলেও, পাকিস্তানকে না রাগিয়ে কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টাও স্পষ্ট। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক তদন্ত এবং সন্ত্রাসবিরোধী আন্তর্জাতিক ঐক্য কতটা বাস্তবায়িত হয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়।