শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য

কিশোর-কিশোরীদের যৌন স্বাস্থ্য শিক্ষা কতটা জরুরি? বাস্তবতা, সামাজিক সংকট ও করণীয়

স্বাস্থ্য ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২৩ ১৮:৩৪:২৯
কিশোর-কিশোরীদের যৌন স্বাস্থ্য শিক্ষা কতটা জরুরি? বাস্তবতা, সামাজিক সংকট ও করণীয়

বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও সংস্কারপ্রবণ সমাজে যৌন স্বাস্থ্য শিক্ষা এখনো ট্যাবু বা নিষিদ্ধ আলোচনার বিষয়। অথচ আজকের কিশোর-কিশোরীরা আগামী প্রজন্মের চালিকা শক্তি—তাদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশে যৌনতা বিষয়ক বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান অনিবার্য। কেবল অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ বা যৌনরোগ প্রতিরোধ নয়, যৌন স্বাস্থ্য শিক্ষা মানে একটি প্রজন্মকে আত্মসচেতন, দায়িত্বশীল এবং সম্মাননির্ভর জীবনদর্শনের ভিত গড়ে দেওয়া।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা কী বলছে?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও UNESCO বারবার বলেছে—Comprehensive Sexuality Education (CSE) যদি বয়সভিত্তিক, সাংস্কৃতিকভাবে উপযোগী ও বিজ্ঞানভিত্তিক হয়, তাহলে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে সুরক্ষিত যৌন আচরণ, আত্মবিশ্বাস, সম্মতির ধারণা এবং সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষমতা বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে:

  • যৌন শিক্ষা কিশোর-কিশোরীদের যৌন কর্মকাণ্ডে রক্ষনশীল মনভাব সৃষ্টি করে এবং সুচিন্তিত ও সুরক্ষিত আচরণ বাড়ায়।
  • HIV/STD সংক্রমণ এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক গর্ভধারণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
  • সম্পর্ক, লিঙ্গসমতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা বাড়ে।
  • যৌনতা ও প্রজনন নিয়ে ভুল তথ্য, ভয় এবং কুসংস্কার দূর হয়।
  • মানসিক স্বাস্থ্য এবং আত্মবিশ্বাস উন্নত হয়, সহিংসতা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি হয়।

মনোবিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের মতে, কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক পরিবর্তন, ঋতুচক্র, স্বপ্নদোষ, যৌন উত্তেজনা ইত্যাদি নিয়ে অজ্ঞতা মানসিক উদ্বেগ, লজ্জা ও আত্মগ্লানি তৈরি করে। তথ্যের অভাবে ভুল ধারণা, পর্নোগ্রাফি নির্ভরতা ও বিকৃত আচরণ জন্ম নিতে পারে। যৌন শিক্ষা এসব ঝুঁকি প্রতিরোধে অব্যর্থ হাতিয়ার।

বাংলাদেশে যৌন স্বাস্থ্য শিক্ষার বর্তমান চিত্র

বাংলাদেশে যৌনতা শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দ্বিধা-সংকোচ কাজ করছে। ফলে জাতীয় পাঠ্যক্রমে এখনও "যৌনতা শিক্ষা" নামে একটি পূর্ণাঙ্গ অধ্যায় নেই। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শারীরিক শিক্ষা, কল্যাণ বা বিজ্ঞান বইয়ে আংশিকভাবে প্রজনন স্বাস্থ্য, ঋতুস্রাব বা বয়ঃসন্ধিকাল নিয়ে আলোচনা আছে। তবে এই পাঠ্যবিষয়গুলো অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অনিচ্ছা বা সমাজের চাপের কারণে এড়িয়ে যাওয়া হয় বা তাড়াহুড়ো করে পড়ানো হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০১৭-২০৩০কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্য কৌশলে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিলেও বিদ্যালয়ে CSE বাস্তবায়নে কোনও সুস্পষ্ট রূপরেখা নেই। কিছু এনজিও যেমন ব্র্যাক, মেরী স্টোপস এবং উন্নয়ন সংস্থা যেমন UNFPA যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা নিয়ে কিছু প্রকল্প চালালেও তা শহর-কেন্দ্রিক এবং সীমিত পরিসরের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম বলেন, "যৌনতা শিক্ষা মানে অনৈতিকতা শেখানো নয়, বরং এটি সন্তানদের আত্মরক্ষার পথ শেখায়। যদি তারা না জানে কীভাবে নিজের শরীর ও অধিকার রক্ষা করতে হয়, তাহলে তারা বিপদের মুখোমুখি হবে।"

যৌন স্বাস্থ্য শিক্ষা না থাকলে সম্ভাব্য বিপদ

১. অপ্রাপ্তবয়স্ক গর্ভধারণ: বাংলাদেশে প্রতি চার জন নারীর একজন ১৮ বছরের আগেই মা হন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ২০২৩ সালের জরিপে দেখা গেছে, ১৫-১৯ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে গর্ভধারণের হার বেড়েই চলেছে। এই বয়সে গর্ভধারণ মানেই উচ্চ মাতৃমৃত্যু, অপুষ্টি এবং নবজাতকের ঝুঁকিপূর্ণ জীবন।

২. শিশুবিবাহ: জাতিসংঘের মতে, বাংলাদেশে এখনও ৫১% মেয়ের ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যায়। যৌন শিক্ষা না থাকলে এই প্রবণতা কমানো অসম্ভব। কারণ মেয়েরা জানেই না তাদের অধিকার কী, এবং কীভাবে তারা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে পারে।

৩. যৌন সহিংসতা ও হয়রানি: যৌন শিক্ষা থাকলে কিশোর-কিশোরীরা শিখতে পারে কীভাবে সম্মতির গুরুত্ব বোঝাতে হয়, নিজের সীমানা নির্ধারণ করতে হয় এবং হয়রানির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরির অন্যতম উপায় CSE।

৪. STD ও HIV সংক্রমণ: তরুণদের মধ্যে যৌনরোগ সংক্রমণ রোধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে যৌন স্বাস্থ্য শিক্ষা। কিশোর-কিশোরীরা যদি না জানে কীভাবে রোগ ছড়ায় বা কীভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হয়, তাহলে তাদের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়।

৫. মানসিক চাপ, লজ্জা ও ভ্রান্ত ধারণা:অনেক কিশোর-কিশোরী শারীরিক পরিবর্তনকে অস্বাভাবিক মনে করে আতঙ্কিত হয়। অনেকেই মাসিক, স্বপ্নদোষ বা আকর্ষণজনিত বিষয় নিয়ে কথা বলতে দ্বিধা বোধ করে, যা মানসিক অস্থিরতা তৈরি করে।

কী করা দরকার?

১. পাঠ্যক্রমে যৌনতা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত ধাপে ধাপে যৌনতা বিষয়ক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে বিষয়টি স্বাভাবিক হয় এবং শিক্ষার্থীরা গ্রহণযোগ্য মানসিকতা নিয়ে বড় হয়।

২. শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ চালু করা যৌনতা বিষয়ে পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের আলাদা প্রশিক্ষণ থাকা দরকার। এটি যেন লজ্জার বিষয় না হয়ে যায়, বরং মানবিক ও বৈজ্ঞানিক বিষয়ে পরিণত হয়।

৩. পিতামাতা ও অভিভাবকদের জড়িত করা শিশুরা স্কুলে যা শিখবে, তা যদি পরিবারে মেনে না নেওয়া হয়, তাহলে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। তাই অভিভাবকদেরও যৌন স্বাস্থ্য বিষয়ে সংবেদনশীল ও সচেতন করতে হবে।

৪. কমিউনিটি লিডার ও ধর্মীয় নেতাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যৌনতা বিষয়ে সমাজে যেসব ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, তা দূর করতে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তারা চাইলে সমাজে সচেতনতা বাড়ানো সম্ভব।

৫. বিদ্যালয়েকিশোর-কিশোরী বান্ধব কাউন্সেলিং ও স্বাস্থ্য সেবা চালু করা প্রতিটি বিদ্যালয়ে একজন প্রশিক্ষিত নারী ও পুরুষ কাউন্সেলর থাকতে হবে, যিনি কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিষয়ে সাহায্য করতে পারবেন।

বাংলাদেশে যৌন স্বাস্থ্য শিক্ষা জরুরি বাস্তবতা। এটি কোনো বিলাসিতা নয়, এটি কিশোর-কিশোরীদের মৌলিক অধিকার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার হাতিয়ার। তথ্য না থাকলে ভুল সিদ্ধান্ত, অকাল মাতৃত্ব, যৌন সহিংসতা ও রোগের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। সমাজ যদি সত্যিকার অর্থে কিশোর-কিশোরীদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে চায়, তাহলে এখনই যৌনতা শিক্ষাকে স্বাভাবিক ও সর্বজনগ্রাহ্য করতে হবে। সরকারের নীতিগত পদক্ষেপ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, অভিভাবকদের সহযোগিতা এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমেই একটি সচেতন, স্বাস্থ্যবান এবং মর্যাদাসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব।

সচেতনতা ও জ্ঞানের আলোই পারে অন্ধকার দূর করতে – যৌন শিক্ষা সেই আলোর নাম।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

আমেরযত কাহিনি

আমেরযত কাহিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ ‘আম’ শুধু একটি ফল নয়, বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত এক... বিস্তারিত