ইরান-ইসরাইল সংঘাত বিশ্লেষণ

রাশিয়া কি তাঁর পরীক্ষিত মিত্র ইরানের পাশে থাকবে?

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২১ ১৭:২৮:৫৭
রাশিয়া কি তাঁর পরীক্ষিত মিত্র ইরানের পাশে থাকবে?

এটি এখন আর কল্পনা নয়, ভবিষ্যদ্বাণীও নয়। ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান আঘাত হেনেছে ইরানের পরমাণু স্থাপনার গভীরে, হত্যা করেছে শীর্ষ বিজ্ঞানী ও সেনা জেনারেলদের। এর প্রতিশোধে তেহরানের রাতের আকাশ ছিঁড়ে শত শত ড্রোন ও ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুটে গেছে ইসরায়েলের দিকে। এক সর্বাত্মক যুদ্ধের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আজ মধ্যপ্রাচ্য। তেলআবিব, তেহরান ও ওয়াশিংটনের দিকে যখন বিশ্বের দৃষ্টি নিবদ্ধ, তখন হাজার হাজার মাইল দূরে মস্কোর এক নিঃশব্দ করিডরে বসে আছেন সেই পুরুষ, যিনি এই ভয়াবহ দাবার চাল নির্ধারণ করছেন—ভ্লাদিমির পুতিন।

তার টেবিলের ফোন একদিকে সংযুক্ত নেতানিয়াহুর সঙ্গে, অন্যদিকে ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেসকিয়ানের সঙ্গে। প্রশ্ন উঠছে—এই দ্বন্দ্বে রাশিয়ার ভূমিকাই বা কী? পুতিন কি শুধু একজন মধ্যস্থতাকারী, নাকি একজন সুচতুর কৌশলবিদ, যিনি এই আগুনে তেলের ঢাল ছিটিয়ে নিজের অবস্থান আরও মজবুত করছেন?

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বাশার আল-আসাদের আকস্মিক পতনের মাধ্যমে সিরিয়ায় রাশিয়া ও ইরানের এক দশকের বিনিয়োগ ধুলোয় মিশে যায়। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক বিপর্যয় নয়, বরং মস্কো-তেহরান সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাওয়া এক যৌথ অপমান। এরপরই ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ‘কম্প্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ’ চুক্তি সাক্ষর করে দুই দেশ—যা আর শুধু স্বার্থনির্ভর নয়, বরং অস্তিত্ব রক্ষার জোটে পরিণত হয়।

ইউক্রেন যুদ্ধ এই বন্ধুত্বের দ্বিতীয় স্তম্ভ। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত রাশিয়ার জন্য ইরান হয়ে ওঠে ড্রোন সরবরাহের লাইফলাইন। ‘শাহেদ-১৩৬’ ড্রোন রাশিয়ার যুদ্ধ কৌশলে এখন অপরিহার্য, আর এই প্রযুক্তি রাশিয়া নিজেও এখন ব্যবহার করছে।

ইসরায়েলের সঙ্গে রাশিয়ার যে এক সময়কার কার্যকর বোঝাপড়া ছিল—বিশেষ করে সিরিয়ার আকাশে ‘ডিকনফ্লিকশন মেকানিজম’ ও নেতানিয়াহু-পুতিন রসায়ন—তা আসাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়ে। সিরিয়ার আকাশ আর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে নেই, ফলে ইসরায়েল আর মস্কোর অনুমতির অপেক্ষায় নেই। অন্যদিকে, ইউক্রেন যুদ্ধে ইরানের সরাসরি সহায়তার কারণে রাশিয়া-ইসরায়েল সম্পর্কেও ঠাণ্ডা পরেছে।

তবে সম্পর্ক সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েনি। ইসরায়েল এখনো ইউক্রেনকে সরাসরি অস্ত্র দেয়নি, আর রাশিয়া তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করেছে। এই সূক্ষ্ম ভারসাম্যই পুতিনকে একইসঙ্গে ইরানের মিত্র ও ইসরায়েলের মধ্যস্থতাকারী হওয়ার সুযোগ দিয়েছে।

রাশিয়া একদিকে ইসরায়েলি হামলার তীব্র নিন্দা করছে, আবার অন্যদিকে নেতানিয়াহুকে শান্তি আলোচনায় টানছে। এটি কেবল কূটনৈতিক কৌশল নয়—এটি ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর কাছে এক বার্তা: শান্তির টেবিলে রাশিয়া অপরিহার্য। একইসঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে বিশ্বের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার জন্য এই সংঘাত এক অপূর্ব উপহার।

ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও কূটনীতিকমহল ইউক্রেন ইস্যুতে আগ্রহ হারাতে শুরু করে। আমেরিকা এখন ইসরায়েলকে রক্ষায় ব্যস্ত, ফলে কিয়েভের জন্য পশ্চিমা সহায়তা কমার বাস্তব সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। একইসঙ্গে, তেলের দাম বেড়ে গেছে—যা রাশিয়ার যুদ্ধ বাজেট চালাতে সহায়ক।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—রাশিয়া কি ইরানকে তার বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত অস্ত্র, যেমন সুখই সু-৩৫ যুদ্ধবিমান ও এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, সরবরাহ করবে? এখনো না করলেও, পরিস্থিতি যদি বাড়ে, যদি আমেরিকা সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তবে এই নিষেধাজ্ঞা ভেঙে দিতে পুতিন প্রস্তুত। এটি হবে তার চূড়ান্ত চাল—যা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক চিরতরে শেষ করবে এবং আমেরিকাকে মধ্যপ্রাচ্যে টেনে এনে ইউক্রেনে রাশিয়ার জন্য সুবিধা তৈরি করবে।

পুতিনের লক্ষ্য ইরান বা ইসরায়েল নয়—তার আসল টার্গেট আমেরিকা-নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা। ইউক্রেন যুদ্ধ ছিল তার প্রথম পর্ব, ইরান-ইসরায়েল সংঘাত দ্বিতীয়। তিনি একটি ‘মাল্টিপোলার ওয়ার্ল্ড’-এর স্বপ্ন দেখছেন, যেখানে রাশিয়া-চীন-ইরান একসঙ্গে পশ্চিমা আধিপত্যের বিকল্প তৈরি করবে।

পুতিন জানেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতে ‘উভয় সংকটে’ পড়ে গেছে—যুদ্ধে জড়ালে এক অন্তহীন ফাঁদে, আর না জড়ালে মিত্রদের আস্থা হারাবে। এই দ্বিধায় পড়েই পুতিন এগোচ্ছেন, সাবধানে, নিরবধি।

শেষ প্রশ্নটি আপনার:রাশিয়ার এই পর্দার আড়ালের ভূমিকা কি মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছে? পুতিন কি এই আগুনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন, নাকি একসময় তা তার নিজের দিকেই ছুটে আসবে?

আপনার বিশ্লেষণ, ভাবনা ও মতামত জানান আমাদের কমেন্ট সেকশনে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত