ভাষান্তর

শতাব্দীর প্রভাবশালী দলিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র—প্রথম পর্বের শেষাংশ

ইতিহাস ও দর্শন ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ১২ ১৫:৫২:০৮
শতাব্দীর প্রভাবশালী দলিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র—প্রথম পর্বের শেষাংশ

রাজনৈতিক দর্শনের ইতিহাসে এক অনন্য দলিল হলো কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। জার্মান ভাষায় এর মূল নাম “Manifesto der Kommunistischen Partei”, অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার। বিখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালে এই এটি লিখেন, যা প্রথম প্রকাশিত হয় লন্ডনে। ১৮৪৮ সালে যখন এটি ইউরোপে প্রকাশিত হয়, তখনকার বিপ্লবাত্মক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি ছিল এক যুগান্তকারী লেখা। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-কে আজও বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলিলগুলোর অন্যতম বলে বিবেচনা করা হয়।

এই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির চারটি অধ্যায় রয়েছে। গতকাল আমরা প্রথম পর্বের প্রথমাংশের ভাবানুনাদ পাঠকদের কাছে তুলে ধরেছিলাম। আজ আমরা করছি প্রথম পর্বের শেষাংশের ভাবানুবাদ। আশাকরি পাঠকরা সহজভাবে এর মূল ভাবনা ও তাৎপর্য বুঝতে পারবেন।

প্রথম পর্ব: বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত (শেষাংশ)

বুর্জোয়া শ্রেণি গ্রামের উপর শহরের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা বিশাল শহর তৈরি করেছে এবং শহরবাসীর সংখ্যা গ্রামবাসীর তুলনায় বহুগুণে বাড়িয়েছে। এইভাবে তারা গ্রামের সরলতা ও পশ্চাৎপদতা থেকে জনসংখ্যার এক বড় অংশকে মুক্ত করেছে। যেমনটা শহরকে গ্রাম-নির্ভর করেছে, ঠিক তেমনিভাবে সভ্য জাতিগুলোকে অসভ্য ও আধা-সভ্য জাতির উপর নির্ভরশীল করে তুলেছে।চাষাভুষো জাতিকে বুর্জোয়া জাতির উপর এবং পূর্বকে পশ্চিমের উপরনির্ভরশীল করে ফেলেছে।

বুর্জোয়ারা ছড়ানো-ছিটানো উৎপাদন ও সম্পত্তির অবস্থা বিলুপ্ত করে জনসংখ্যা, উৎপাদন এবং সম্পদের কেন্দ্রীকরণ ঘটিয়েছে। এর ফলে হয়েছে রাজনৈতিক কেন্দ্রীকরণ। পূর্বে বিচ্ছিন্ন প্রদেশগুলো—যাদের ছিল আলাদা স্বার্থ, আইন, শাসন ও করব্যবস্থা—এখন এক জাতিতে রূপ নিয়েছে, যেখানে এক সরকার, এক আইন, এক জাতীয় স্বার্থ ও একক শুল্কনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

মাত্র একশ বছরের শাসনামলে বুর্জোয়া শ্রেণি এমন বিশাল উৎপাদনশক্তির সৃষ্টি করেছে, যা বিগত সব যুগ মিলিয়েও করতে পারেনি। প্রকৃতিকে মানুষের বশে আনা, যন্ত্র, শিল্প ও কৃষিতে রসায়নের ব্যবহার, স্টিম ইঞ্জিন, রেলপথ, টেলিগ্রাফ, মহাদেশজুড়ে চাষযোগ্য ভূমির প্রসার, নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি, এমনকি মাটি থেকে জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব—এই সব ছিল অতীতের মানুষের কল্পনার বাইরে। কিন্তু এই সব উৎপাদনশক্তি গড়ে উঠেছে মধ্যযুগীয় সামন্ত সমাজের ভেতরেই। এক পর্যায়ে এসে এসব শক্তির সঙ্গে সামন্ত উৎপাদন এবং বিনিময় পদ্ধতির দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ফলে ফিউডাল মালিকানার সম্পর্কগুলো পরিণত হয় বাধায়, যাকে ছিন্ন করা ছাড়া বিকল্প থাকে না। এই বাধা ছিন্ন হওয়ার পর জায়গা নেয় মুক্ত প্রতিযোগিতা, এবং তার সঙ্গে গড়ে ওঠে বুর্জোয়া শ্রেণির সামাজিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য।

তবে আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের ভেতরে আমরা এক নতুন সংকটও দেখতে পাই—এক জাদুকরের মতো এই শ্রেণি এমন এক শক্তিকে জাগিয়ে তুলেছে, যার নিয়ন্ত্রণ এখন তাদের নিজের হাতেও নেই। আধুনিক উৎপাদনশক্তির বিদ্রোহ আজ বুর্জোয়া সমাজের নিজের বিরুদ্ধেই মুখ তুলেছে। এর প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই নিয়মিত বাণিজ্যিক সংকটে, যার প্রতিটিই সমাজের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এই সংকটে শুধু উৎপন্ন পণ্যই নয়, বরং উৎপাদনের ক্ষমতাও ধ্বংস হয়। এর নাম "অতিরিক্ত উৎপাদনের মহামারী"—যা অতীত যুগে ছিল অকল্পনীয়।

সমস্যা এই নয় যে জোগান নেই, বরং জোগান এত বেশি যে সমাজ এক ধরণের কৃত্রিম সংকটে পড়ে যায়। এই সংকট থেকে বের হতে বুর্জোয়া শ্রেণি যা করে তা হলো—একদিকে উৎপাদনের অংশ ধ্বংস করে, আরেকদিকে নতুন বাজার দখল করে বা পুরোনো বাজারকে আরও নিষ্ঠুরভাবে শোষণ করে। এই ব্যবস্থা ভবিষ্যতের জন্য আরও বড় সংকট তৈরি করে এবং পুরনো সংকট ঠেকানোর পথও সংকুচিত করে ফেলে।

এই সংকটের মধ্যে বুর্জোয়া শ্রেণি নিজের কবর রচনার উপাদানও তৈরি করে। যে অস্ত্র দিয়ে তারা সামন্ততন্ত্রকে ধ্বংস করেছিল, সেই অস্ত্রই আজ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তারা তৈরি করেছে সেই শ্রেণিকেও—আধুনিক শ্রমিক শ্রেণি, প্রলেতারিয়েত—যারা এই অস্ত্র হাতে নেবে।

উৎপাদনের যত উন্নয়ন হয়, প্রলেতারিয়েত শ্রেণির সংখ্যাও তত বাড়ে। এই শ্রমিকরা বাঁচে কাজ পেলে, এবং কাজ পায় যদি তাদের শ্রম মূলধন বাড়ায়। তাদের শ্রম পণ্যের মতোই, প্রতিযোগিতা ও বাজারের ওঠানামার মধ্যে পড়ে যায়। যন্ত্রপাতি ও শ্রমবিভাজনের ফলে শ্রমিকের কাজ নিঃস্বতা লাভ করে, সে হয়ে পড়ে যন্ত্রের অনুষঙ্গমাত্র। কাজের কঠিনতা বাড়ে, অথচ মজুরি কমে। সময় বাড়ে, গতিবেগ বাড়ে, অথচ জীবন কঠিনতর হয়।

এইভাবেই প্রলেতারিয়েতরা ছোট ছোট দোকান কিংবা পরিবারভিত্তিক কারখানার শ্রমিক থেকে রূপান্তরিত হয় বিশাল কারখানায় নিয়োজিত মজুর বাহিনীতে, যেখানে তারা নিয়ন্ত্রিত হয় অফিসার ও ফোরম্যান দ্বারা। এই দাসত্ব শুধু বুর্জোয়া রাষ্ট্র ও শ্রেণির নয়, বরং যন্ত্র ও পুঁজিপতিরও। শ্রমিক তার ন্যূনতম জীবিকার জন্য যতোটা উপযুক্ত, ততোটাই তার মূল্য।

এই শোষণের পরও, যখন শ্রমিক নগদ মজুরি পায়, তখন তার উপর হানা দেয় অন্য বুর্জোয়া শ্রেণিগুলো—জমিদার, দোকানদার, মহাজন প্রভৃতি। মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছোট ব্যবসায়ী ও কুটির শিল্পীরা ধীরে ধীরে প্রলেতারিয়েত হয়ে পড়ে। কারণ, তাদের পুঁজি ক্ষুদ্র এবং প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। তাদের দক্ষতা অচল হয়ে পড়ে নতুন উৎপাদন পদ্ধতির কারণে।

প্রলেতারিয়েতদের মধ্যে প্রথমে একক শ্রমিক, পরে একই কারখানার শ্রমিক, তারপর একই পেশার লোকেরা প্রতিবাদ শুরু করে। তারা যন্ত্র ভাঙে, বিদেশি পণ্য পুড়িয়ে ফেলে, আগুন লাগায়—সবচেয়ে পেছনের পথ বেছে নেয়, মধ্যযুগীয় শ্রমিকের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে।

শিল্পায়নের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রলেতারিয়েতদের শক্তি বাড়ে, ঐক্য গড়ে ওঠে। তখন তারা ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করে, ধর্মঘট করে, এবং রাজনৈতিক দাবি তোলে। এই আন্দোলন ধীরে ধীরে জাতীয় রূপ পায়—একটি শ্রেণির বিরুদ্ধে আরেকটি শ্রেণির সংগ্রামে।

এই সংগঠন বারবার প্রতিযোগিতায় ভাঙে, কিন্তু প্রতিবারই আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে। বুর্জোয়ারা নিজেরাই অনেক সময় প্রলেতারিয়েতের সহায়তা চায়, এবং তাই তাদের শিক্ষিতও করে, যা শেষমেশ বুর্জোয়ার বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হয়।

অবশেষে, যখন শ্রেণিসংগ্রাম চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন শাসক শ্রেণির ভেতরেই ফাটল ধরে—তাদের কেউ কেউ প্রলেতারিয়েতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, যেভাবে আগে কিছু অভিজাত শ্রেণি বুর্জোয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।

আজ বুর্জোয়ার বিপক্ষে একমাত্র সত্যিকারের বিপ্লবী শ্রেণি হলো প্রলেতারিয়েত। মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের নিজস্ব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে লড়াই করলেও, তারা আসলে প্রতিক্রিয়াশীল, ইতিহাসের চাকাকে পেছনে টানার চেষ্টা করে। তাদের বিপ্লবী অবস্থান কেবল তখনই, যখন তারা প্রলেতারিয়েতে পরিণত হচ্ছে।

অবশেষে, প্রলেতারিয়েতের সংগ্রাম যখন খোলামেলা বিপ্লবের দিকে অগ্রসর হয়, তখন সমাজের ভিত্তিই বদলে যায়। ইতিহাসে যত শ্রেণি এসেছে, তারা নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে সমাজকে নিজেদের ছাঁচে গড়ে তুলে। কিন্তু প্রলেতারিয়েতের কোনো কিছু রক্ষার নেই—তাদের একমাত্র কাজ হলো পুরনো শোষণ ও মালিকানার গ্যারান্টি ধ্বংস করা।

এই বিপ্লব শুধু সংখ্যালঘু শ্রেণির জন্য নয়, বরং বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নিজস্ব সচেতন এবং স্বতন্ত্র আন্দোলন। প্রলেতারিয়েত যখন উঠে দাঁড়ায়, তখন উপরের সমস্ত আধিপত্য ভেঙে পড়ে।

এইভাবেই বুর্জোয়া শ্রেণির পতন এবং প্রলেতারিয়েতের বিজয় ইতিহাসের অনিবার্যতা হয়ে দাঁড়ায়।

চলবে...দ্বিতীয় পর্বের প্রথমাংশ নিয়ে আসছি আগামীকাল।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত