মিটফোর্ড সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় ভেজাল ওষুধের সাম্রাজ্য

স্বাস্থ্য ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ আগস্ট ০৭ ০৮:৩৮:৪০
মিটফোর্ড সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় ভেজাল ওষুধের সাম্রাজ্য
ছবি: সংগৃহীত

ভেজাল ও নকল ওষুধ সেবনে শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন— এমন তথ্য সামনে আসার পর দেশজুড়ে শুরু হয়েছে উদ্বেগ ও সমালোচনা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, এসব ওষুধ দীর্ঘমেয়াদে কিডনি বিকল, ক্যানসারসহ নানা রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এমনকি এসব ওষুধ মৃত্যুর কারণও হয়ে উঠছে বলে তারা সতর্ক করেছেন।

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত দুইটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ভেজাল ওষুধ এবং অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহারের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়। এর পর বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসক মহল, ওষুধ ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়।

বিশেষ করে রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড ওষুধ মার্কেটকে ঘিরে এক শক্তিশালী সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব উঠে এসেছে। একাধিক ওষুধ ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন, এই সিন্ডিকেট শতাধিক সদস্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে। এসব ওষুধ সারা দেশের দোকানগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে। গ্রামাঞ্চলে এসব ওষুধের প্রভাব সবচেয়ে বেশি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রাক্তন ব্যবসায়ী জানান, তিনি ২০ বছর মিটফোর্ডে ব্যবসা করেছেন। কিন্তু ভেজাল ওষুধ বিক্রির জন্য সমিতির চাপে পড়ে একপর্যায়ে দোকান গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, অনেক ওষুধ ব্যবসায়ী, এমনকি সমিতির কিছু নেতাও মাসোহারা নিয়ে এই অপরাধে জড়িত। বিশেষ করে ইনসুলিন ও অ্যান্টিবায়োটিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ নকল করে বাজারে ছাড়ছে তারা।

মিটফোর্ড থেকে পরিচালিত এসব কার্যক্রম বন্ধে মাঝে মধ্যে মোবাইল কোর্ট অভিযান চালালেও কার্যকর কোনো পরিবর্তন হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিপুল ভেজাল ওষুধ জব্দ করলেও বাজারজাত বন্ধ হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, কিছু অসাধু ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তারাও এসব সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত।

আশির দশকে ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে ২ হাজারের বেশি শিশু মারা যাওয়ার স্মৃতি এখনো জাতির মনে গাঁথা। কিন্তু সেই ভয়াবহ ঘটনার পরও আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কার্যকর নজরদারি গড়ে ওঠেনি।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি এবং ভেজাল ওষুধ সেবন নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান শাস্তির ব্যবস্থা ছাড়া কোনো স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।

কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ বলেন, হঠাৎ বা দীর্ঘমেয়াদে কিডনি বিকলের অন্যতম কারণ এই ভেজাল ওষুধ। তিনি এসব ওষুধ বিক্রেতার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।

শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. শফি আহমেদ মোয়াজও একই কথা বলেন। তিনি মনে করেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে ভেজাল ওষুধ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

এক ক্যানসার বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রতিদিন কত মানুষ ভেজাল ওষুধ খেয়ে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন, তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রশাসনের কাছে নেই। এ বিষয়ে মনিটরিং ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

ঢাকা শ্যামলীর যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ হাসপাতালের প্রধান উপপরিচালক ডা. আয়েশা বেগম বলেন, এসব ওষুধে রোগীরা জটিলতায় ভুগছেন, অথচ বাজারজাত বন্ধে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেই।

চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এমএন হুদা বলেন, চুলকানি, দাদ ও খোসপাঁচড়ার মতো রোগেও ভেজাল ওষুধের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। আমদানি করা প্রতিটি ওষুধ পরীক্ষার পরই বাজারজাত অনুমতি নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন তিনি।

সাবেক ম্যাজিস্ট্রেট রোকন উদ-দৌলাহ মনে করেন, ভেজাল ওষুধ জব্দের পর তাৎক্ষণিক পরীক্ষার মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এই নৈরাজ্য অনেকটাই ঠেকানো সম্ভব।

/আশিক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ