প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো দরকার!

রাজনীতি ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ১২ ০৭:৪১:৪৫
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো দরকার!

সত্য নিউজ: বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর ‘অসীম ক্ষমতা’ সীমিত করা ও সাংবিধানিক ভারসাম্য পুনঃস্থাপনের দাবিতে সাত দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছে নাগরিক উদ্যোগভিত্তিক সংগঠন নাগরিক কোয়ালিশন। সংবিধান সংস্কারকে কেন্দ্র করে গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক আলোচনায় এই প্রস্তাবসমূহ উপস্থাপন করা হয়।

প্রস্তাবের মূল ভিত্তি: ক্ষমতার ভারসাম্য ও গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনর্গঠন

নাগরিক কোয়ালিশনের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ সাহান প্রস্তাবিত সাতটি সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত প্রস্তাব ছিল— কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। একইসঙ্গে তারা সংসদে একটি উচ্চকক্ষ গঠন, সাংবিধানিক নিয়োগে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া, তত্ত্বাবধায়কধর্মী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারব্যবস্থা, নারীর অংশগ্রহণে নারীবান্ধব নির্বাচন ব্যবস্থা এবং সংবিধানে ‘জুলাই সনদ’ যুক্ত করা—এই গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো অন্তর্ভুক্ত করে।

প্রধানমন্ত্রীর সীমাহীন ক্ষমতা: একটি কাঠামোগত সমস্যা

অনুষ্ঠানে বক্তারা বারবার উচ্চারণ করেন—বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে এমন একক ও অসীম ক্ষমতার অধিকার দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে কার্যত স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের আবির্ভাব রোধ করা কঠিন।জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, "রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার অবশিষ্টাংশ প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে যে শাসন কাঠামো গড়ে উঠেছে, তা মূলত একনায়কতন্ত্রের জন্য উর্বর ভূমি।"

আইন উপদেষ্টা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, "প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসীমা নির্ধারণ একটি জনপ্রিয় দাবি হলেও একে বাস্তবায়ন করতে হলে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও যুক্তির ভিত্তিতে তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মেয়াদসীমা থাকলেই স্বৈরতন্ত্র বন্ধ হবে না, কারণ পরিবারতন্ত্র কিংবা বিকল্প পথেও একনায়কতন্ত্রের আবির্ভাব হতে পারে।"

নতুন সাংবিধানিক কাঠামোর পথে সম্ভাব্য রূপরেখা

লেখক ও অর্থনীতিবিদ জিয়া হাসান নাগরিক জোটের পক্ষ থেকে সংবিধান সংস্কারের দুটি সম্ভাব্য বাস্তবায়ন পথ তুলে ধরেন—১. সংসদীয় সংশোধনী পদ্ধতি২. গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন

তবে তিনি সতর্ক করে দেন, গণপরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধান তৈরির কাজ সময়সাপেক্ষ হতে পারে—যেখানে দুই থেকে তিন বছর লাগতে পারে।

রাষ্ট্রীয় নিয়োগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আহ্বান

নাগরিক জোটের আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব হলো জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, যাতে রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের প্রতিনিধি থাকবেন। এই কাউন্সিল রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগে ভূমিকা রাখবে। অতীতে রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে নিয়োগের প্রবণতা এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিরুৎসাহিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে আস্থা ফিরবে না

আলোচনায় অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা সংস্কার ব্যতীত নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে দ্বিধান্বিত মনোভাব প্রকাশ করেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, "সংবিধান থাকলেই যথাযথ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। প্রয়োজন কার্যকর সংস্কার এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ।"

এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, "একজন ব্যক্তির খেয়ালেই অতীতে সংবিধান একাধিকবার সংশোধন হয়েছে। জনগণের রক্ত-ঘামে অর্জিত এই রাষ্ট্রে মৌলিক সংস্কারে ঐকমত্যে পৌঁছানো না গেলে আবারও অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।"

গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে এই মুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ

বিশ্লেষকরা একমত হয়েছেন, এই মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে সুস্পষ্ট অবস্থান নেওয়া এবং লিখিত প্রতিশ্রুতি প্রদান। আইরিন খান বলেন, "সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোকে সাত দফা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করতে হবে। আর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উচিত বাস্তবায়নের নির্ভরযোগ্য পথ নির্ধারণে ঐকমত্য গড়ে তোলা।"

শুধুমাত্র ব্যক্তির পরিবর্তন নয়, কাঠামোর সংস্কার জরুরি

সংবিধান কখনোই যেন কারও একচ্ছত্র ক্ষমতার হাতিয়ার না হয়, সে জন্য কাঠামোগত সংস্কার আজ সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। বক্তাদের মতে, শেখ হাসিনা কোনো ট্যাংকে চড়ে ক্ষমতায় আসেননি, তবে সংবিধানের যে অসঙ্গতি ও দুর্বলতাগুলো তাঁকে ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছে—তা দূর না করলে ভবিষ্যতেও যে কোনো নেতা একই পথে হাঁটতে পারেন।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

প্রেস সচিবের বক্তব্যে বাকস্বাধীনতা, মব কালচার ও সাংবাদিকতার দ্বন্দ্ব: পাঠবিশ্লেষণ

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি এক দীর্ঘ বক্তব্যে দেশের সাংবাদিকতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সরকারের অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত... বিস্তারিত