জাতীয় জাদুঘর

জাদুঘর শুন্য, ইতিহাস নিঃসঙ্গ, সমস্যা কোথায়?

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ১৮ ০৮:১১:৪২
জাদুঘর শুন্য, ইতিহাস নিঃসঙ্গ, সমস্যা কোথায়?

সত্য নিউজ: একসময় ঢাকায় বেড়াতে আসা মানুষদের গন্তব্য তালিকার শীর্ষে থাকত জাতীয় জাদুঘর। এখন আর সেই আগ্রহ দেখা যায় না। দর্শনার্থীর সংখ্যা গত পাঁচ বছরে ধারাবাহিকভাবে কমে এসেছে। এমন প্রেক্ষাপটে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস যার এবারের প্রতিপাদ্য, ‘দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজে জাদুঘরের ভবিষ্যৎ’।

দিনটি উপলক্ষে জাতীয় জাদুঘর আজ আয়োজন করেছে শোভাযাত্রা, সেমিনার, এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তবে এসব আয়োজনে দর্শনার্থীর সরব উপস্থিতি নেই বললেই চলে।

সংখ্যাতত্ত্বে দর্শনার্থীর ধস

২০১৮-১৯ অর্থবছরে জাতীয় জাদুঘরে দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৬ লাখ ৩০ হাজার। এর ঠিক পরের বছর, ২০১৯-২০, সংখ্যাটি নেমে আসে ৪ লাখ ১৪ হাজারে। আর ২০২০-২১ সালে, কোভিড-১৯ মহামারির অভিঘাতে তা ১ লাখ ১৪ হাজারে গিয়ে ঠেকে। পরবর্তী বছর কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দর্শনার্থীর সংখ্যা আবারও নিম্নমুখী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সংকট শুধু করোনার প্রভাব নয়; বরং এটি এক দীর্ঘস্থায়ী অবহেলার ফল।

একই চিত্র, পুরোনো গল্প

জাতীয় জাদুঘরে বর্তমানে ১ লাখ ১৯ হাজারের বেশি নিদর্শন থাকলেও, দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে মাত্র ৫ হাজারটি। বাকিগুলো সংরক্ষণের অজুহাতে গুদামে পড়ে আছে। নিদর্শনগুলো রয়েছে চারটি মূল বিভাগে প্রাকৃতিক ইতিহাস, জাতিতত্ত্ব ও অলংকরণ শিল্পকলা, ইতিহাস ও ধ্রুপদি শিল্প, এবং সমকালীন শিল্প ও বিশ্বসাহিত্য। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, এস. এম. সুলতানদের চিত্রকলা থেকে শুরু করে প্রাচীন মুদ্রা, মূর্তি, ও মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মারক এখানে সংরক্ষিত। তবু দর্শকের চোখে পুরোনো সেই জৌলুস আর নেই।

“বছর দশেক আগে এসেছিলাম, এখনো প্রায় সবই একই রকম আছে। কোনো প্রযুক্তিনির্ভর উপস্থাপনা নেই, এমনকি বসারও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।”-নুরুল মোমেন, দর্শনার্থী, ময়মনসিংহ

বাচ্চারা কোথায় আকৃষ্ট হবে?

জাদুঘরের পরিবেশ শিশু ও কিশোরদের জন্য অনুপ্রেরণামূলক হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিউল ইসলাম জানায়, “মডেলগুলো ভালো লেগেছে, কারণ পাঠ্যবইতে পড়েছিলাম। তবে আরও ইন্টারঅ্যাকটিভ কিছু থাকলে ভালো লাগত।”

অদক্ষতা, দায়সারা পরিকল্পনা ও শূন্য নেতৃত্ব

বর্তমানে জাতীয় জাদুঘরের ছয়টি বিভাগে মাত্র দুটি বিভাগের কিপার নিয়মিতভাবে দায়িত্বে আছেন, বাকি চারটি চলছে চলতি দায়িত্বে। মহাপরিচালক পদেও নেই স্থায়ী নিয়োগ। অতিরিক্ত সচিব ফরহাদ সিদ্দিক অতিরিক্ত দায়িত্বে সময় দিলে তবেই জাদুঘরে উপস্থিত হন। ফলে নিয়মিত কর্মকাণ্ড ও সংস্কার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।

সাবেক কিপার ও আইকম বাংলাদেশের চেয়ারপারসন জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন: “জাদুঘরের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তার আধুনিকায়ন ও দক্ষ জনবল গঠনের ওপর। নিদর্শনের সংরক্ষণ, উপস্থাপনা ও দর্শক ব্যবস্থাপনায় বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন। এখন সব চলছে আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে।”

আধুনিকতা না আনলে হারাবে আরও আকর্ষণ

বিগত এক দশকে ডিজিটাল প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় বিশ্বজুড়ে জাদুঘরের ধারণাই পাল্টে গেছে। ভার্চুয়াল ট্যুর, ইন্টারঅ্যাকটিভ ডিসপ্লে, শিশু ও কিশোর বান্ধব আয়োজন এসব এখন জাদুঘরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু জাতীয় জাদুঘরে এখনো নেই মোবাইল অ্যাপ, নেই অডিও গাইড বা কিউআর কোডের মাধ্যমে তথ্য জানার সুবিধা।

জাদুঘরের জনশিক্ষা বিভাগের কিপার আসমা ফেরদৌসী বলেন, “সম্প্রতি কিছু গ্যালারির পুনর্বিন্যাস হয়েছে। তবে ‘মিউজিয়াম মার্কেটিং’–এ ঘাটতি আছে, যা দর্শক টানতে পারছে না।”

ঢাকার বাইরের জাদুঘরগুলোও অনাদরে

শুধু শাহবাগের জাদুঘর নয়, জাতীয় জাদুঘরের আওতায় থাকা আহসান মঞ্জিল, ওসমানী স্মৃতি জাদুঘর, জসীমউদ্‌দীন সংগ্রহশালা, কুমিল্লার ফয়জুন্নেসা স্মৃতি জাদুঘরসহ প্রায় ১১টি শাখা জাদুঘরও চলছে কেবল রক্ষণাবেক্ষণধর্মী নীতিতে। আধুনিকায়নের কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ সেখানে নেওয়া হয়নি।

ঐতিহ্যের সংরক্ষণ না হলে ভবিষ্যৎ নিঃস্ব

জাতীয় জাদুঘর শুধু নিদর্শনের ভান্ডার নয়, এটি জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতীক। সেই প্রতীকে যখন দর্শনার্থীদের পদচারণা কমে আসে, তখন তা শুধুই সংখ্যাগত ক্ষতি নয় এটি এক সাংস্কৃতিক সংকেত। দিনপঞ্জি দেখে নয়, বরং পরিকল্পিত সংস্কার ও আধুনিক উদ্যোগের মাধ্যমেই জাদুঘরের প্রাণ ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

জাদুঘর বাঁচলে, ইতিহাস বাঁচে। আর ইতিহাস বাঁচলেই জাতি টিকে থাকে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ