সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের জন্য দুঃসংবাদ

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ০১ ০৯:৫০:০৫
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের জন্য দুঃসংবাদ

সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের শুরুতেই সঞ্চয়পত্রের সুদহার হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হচ্ছে। বিভিন্ন স্কিমভিত্তিক এই হ্রাসের মধ্য দিয়ে দেশের লক্ষাধিক ক্ষুদ্র ও মধ্যবিত্ত সঞ্চয়কারীদের আয় কমে আসবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও খাতসংশ্লিষ্টরা। সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ কৌশল এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) কর্তৃক প্রদত্ত শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে। তবে অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও নীতির দৃষ্টিকোণ থেকে এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই ‘বিরুদ্ধমুখী’ বলে অভিহিত করছেন।

সঞ্চয়পত্রের নতুন হারে দুই ধরনের বিনিয়োগকারী বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে: সাড়ে সাত লাখ টাকার নিচে ও ওপরে বিনিয়োগকারীরা। প্রথম পর্যায়ের বিনিয়োগকারীদের জন্য সর্বোচ্চ সুদহার ১২.৫৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১.৮২ শতাংশ এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য ১২.৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১.৭৭ শতাংশ করা হয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পেনশনার সঞ্চয়পত্র, পারিবারিক সঞ্চয়পত্র এবং ডাকঘর ফিক্সড ডিপোজিট স্কিমের হার পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বাধিক হ্রাস পেয়েছে তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক স্কিম, যেখানে প্রথম বছরের সুদ কমে ১১.০৪ শতাংশ থেকে ১০.৬৫ শতাংশে নেমে এসেছে।

২০২২ সালে অনুমোদিত ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণপ্যাকেজের আওতায় আইএমএফ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঋণ কাঠামোকে বাজারঘেঁষা করার শর্ত জুড়ে দেয়। এর অংশ হিসেবে সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরতা কমানো এবং সুদহার ট্রেজারি বিলের হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে বলা হয়। ছয় মাসের গড় ট্রেজারি বিলের হারের ভিত্তিতে এবার সুদহার নির্ধারিত হয়েছে। এর ফলে, ভবিষ্যতে যদি ট্রেজারি হারে পরিবর্তন আসে, সঞ্চয়পত্রের হারও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে বা কমবে।

সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ এই সিদ্ধান্তকে স্ববিরোধী আখ্যা দিয়ে বলেন, “একদিকে সরকার সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও বাজেট বাস্তবায়নের কথা বলছে, অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমিয়ে দেওয়ায় সাধারণ মানুষ আবার ব্যাংকমুখী হতে বাধ্য হবে, যেখানে ফিক্সড ডিপোজিটের হার প্রায় সমান বা বেশি। এতে সরকারের বিকল্প উৎস থেকে অভ্যন্তরীণ ঋণ সংগ্রহ বাধাগ্রস্ত হবে।”

তিনি আরও বলেন, “সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন কিছুটা নিশ্চিত আয় পেতেন, তাদের অনেকে এখন নিরুৎসাহিত হবেন। মূল্যস্ফীতির এই প্রেক্ষাপটে এটি জনস্বার্থবিরোধী।”

বর্তমানে দেশের সাধারণ জনগণ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে নাকাল। খাদ্যপণ্যের দাম, চিকিৎসা, পরিবহন ও শিক্ষাব্যয়ের লাগামছাড়া বৃদ্ধিতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই চলেছে। এমতাবস্থায় সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর ফলে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের আয়ের ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অনেকেই সঞ্চয়ের পরিবর্তে তাৎক্ষণিক খরচ বা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে ঝুঁকতে বাধ্য হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানো হলে সরকারের জন্য অর্থ সংগ্রহের একটি সহজ মাধ্যম সংকুচিত হবে। পাশাপাশি, সঞ্চয়পত্রের প্রতি মানুষের আস্থা হারানোর সম্ভাবনা তৈরি হবে, বিশেষ করে যারা দীর্ঘমেয়াদি নিরাপদ বিনিয়োগে অভ্যস্ত।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ট্রেজারি ও ঋণ অনুবিভাগ ইতোমধ্যে সুদহার হ্রাসের অনুমোদন দিয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগকে আনুষ্ঠানিক আদেশ জারির অনুরোধ করা হয়েছে। সরকার বলছে, এটি একটি ‘বাজারসম্মত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার অংশ’, যেখানে সার্বিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা এবং বাজেট ঘাটতি কমানোর দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো আপাতদৃষ্টিতে একটি আর্থিক সংস্কার পদক্ষেপ হলেও, এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রাজস্ব, বিনিয়োগ এবং জনগণের সঞ্চয়চর্চায় সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হবে। সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে জনগণের আস্থা ধরে রাখা এবং ঋণ ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য বজায় রাখা। নীতিনির্ধারকদের এই সিদ্ধান্তের পিছনে আন্তর্জাতিক চাপ যেমন আছে, তেমনি রয়েছে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে বোঝাপড়ার ঘাটতি। ফলে প্রশ্ন থেকে যায় এই সংস্কার কতটা টেকসই এবং জনবান্ধব হবে?

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ