মতামত

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব: রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার একটি পরোক্ষ প্রক্রিয়া?

হাবিবুর রহমান
হাবিবুর রহমান
অ্যাডভোকেট, ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশন
২০২৫ জুন ৩০ ২০:৩০:৫৬
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব: রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার একটি পরোক্ষ প্রক্রিয়া?

আধুনিক গণতন্ত্রে ভোট ও প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। বিশেষ করে ‘Proportional Representation’ (PR) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি, যা অনেক দেশে গৃহীত, আবার অনেক দেশে বিতর্কিত, তা নিয়ে বাংলাদেশেও নতুন করে আলোচনার হাওয়া লেগেছে। এই পদ্ধতির একদিকে যেমন কিছু ইতিবাচক দিক আছে, তেমনি এর অনেক সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক ফলাফলও রয়েছে, যা একটি উদীয়মান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে।

জার্মানির উদাহরণ দিয়ে যদি শুরু করি, সেখানে ফ্রি ডেমোক্রেটিক পার্টি (FDP) ১৯৪৯ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত আটবার ক্ষমতার অংশীদার ছিল, অথচ কোনোবারই তাদের ভোটের হার ১২ শতাংশ অতিক্রম করেনি। এটি প্রমাণ করে যে পিআর ব্যবস্থায় ছোট বা মাঝারি আকারের দলগুলো ভোটারের স্পষ্ট অনাস্থা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ক্ষমতার অংশীদার হয়ে থাকতে পারে। এর ফলে ভোটারের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে, তারা চাইলেও নির্দিষ্ট দলকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারে না।

পিআর ব্যবস্থায় কোয়ালিশন সরকার প্রায় অবশ্যম্ভাবী। এর ফলে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া জটিল হয়ে ওঠে, কারণ প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সরকারের প্রতিটি শরিক দলের সম্মতি নেওয়া বাধ্যতামূলক হয়। এতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থবিরতা আসে। বিভিন্ন আদর্শিক দল সরকারে থাকলে, যেমন ডানপন্থী বা বামপন্থী, তাদের নীতিগত অবস্থানের সাথে আপস করে চলতে হয়, যা সরকারের নীতি নির্ধারণকে আপসমূলক ও দুর্বল করে তোলে। এক পক্ষ বলবে, "আমাদের পররাষ্ট্রনীতি এমন না হলে সমর্থন প্রত্যাহার করব", অন্য পক্ষ বলবে, "আমাদের বিশ্বাসে আঘাত করলে আমরা সরকারে থাকব না"। ফলত, রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে, প্রশাসনিক কার্যকারিতা কমে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা আরও গুরুতর। পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ যুক্ত করে ফ্লোর ক্রসিং নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু পিআর পদ্ধতি আবার সেই অস্থিতিশীল কোয়ালিশন সরকারের জন্ম দেবে। সরকার হবে দুর্বল, অকার্যকর, এবং প্রতিনিয়ত চাপের মুখে পরিচালিত, যা আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় স্থিতিশীলতা নষ্ট করবে।

সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো, এই ব্যবস্থায় ৭–৮% ভোট পেলেও একটি ছোট দল হয়ে উঠতে পারে "কিং-মেকার"। তারা বড় দলগুলোর কাছে মুক্তিপণের মতো শর্তে সমর্থন দেবে। এতে জনসমর্থনের তুলনায় ক্ষমতা বহুগুণে বাড়ে। যেমন, জামায়াতে ইসলামী হয়তো সারাদেশে ১০টি আসনও জিততে পারবে না, কিন্তু পিআর ব্যবস্থায় তাদের ৫–১০% ভোটই হয়তো ১৫–৩০টি আসনের সুযোগ এনে দেবে। এটি আনুপাতিক হলেও প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব নয়, বরং পদ্ধতিগত বৈষম্যের নামান্তর।

পিআর ব্যবস্থায় চরমপন্থী দলগুলোও সহজেই সংসদে প্রবেশ করতে পারে, কারণ তারা দেশের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা সাপোর্টারদের ভোট পেয়ে একটি জাতীয় ‘পারসেন্টেজ’ অর্জন করে ফেলে। এতে করে সংসদে চরমপন্থী দল বা মৌলবাদী শক্তির প্রবেশের পথ সুগম হয়ে যায়।

আরও একটি বড় সমস্যা হলো, ভোটার ও সংসদ সদস্যদের মধ্যে সরাসরি সংযোগ ভেঙে যায়। বর্তমানে একটি সংসদীয় আসন থেকে একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হলে তার প্রতি সেই এলাকার জনগণের প্রত্যাশা, যোগাযোগ ও জবাবদিহিতা থাকে। কিন্তু পিআর ব্যবস্থায় পুরো অঞ্চল বা দেশকে বড় কেন্দ্র ধরে নির্বাচন হয়। এতে এমপিদের প্রতি জনগণের কোনো সরাসরি দায়বদ্ধতা থাকে না। যেহেতু প্রার্থী নির্ধারণ করবে দলের হাইকমান্ড, ফলে জনপ্রিয়তা নয়, বরং দলের আনুগত্যই হয়ে ওঠে নির্বাচনের মাপকাঠি। ফলে এমপি হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তি জনগণের চেয়ে দলের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

এছাড়া ভোটাররা ভোট দেয় দলের জন্য, ব্যক্তির জন্য নয়। এর ফলে ব্যক্তির জবাবদিহিতা বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির প্রতি নাগরিকের সরাসরি প্রত্যাশা ভেঙে পড়ে। এমপি নির্বাচন আর গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন নয়, হয়ে ওঠে দলীয় অভিজাত শ্রেণির নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার খেলা।

সবশেষে বলা যায়, পিআর পদ্ধতি হয়তো নির্বাচনী বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত জটিলতা, চরমপন্থার উত্থান, অকার্যকর কোয়ালিশন, এলিটবাদী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার ঘাটতি সব মিলিয়ে এটি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল এবং রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর দেশের জন্য উপযুক্ত নয়। একটি কার্যকর, অংশগ্রহণমূলক ও জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্রের জন্য আমাদের সরাসরি প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা যথেষ্ট এবং তা আরও সংস্কারযোগ্য।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ