তেহরান টাইমস-এর প্রতিবেদন

ট্রাম্পের সরাসরি হামলা: আমেরিকাই কি ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রকৃত সূচনাকারী?

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২৩ ১০:৪৩:০৯
ট্রাম্পের সরাসরি হামলা: আমেরিকাই কি ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রকৃত সূচনাকারী?

তেহরান থেকে শুরু করে ওয়াশিংটন পর্যন্ত গোটা দুনিয়ায় যে আশঙ্কার কথা বারবার বলা হচ্ছিল—ডোনাল্ড ট্রাম্প ঠিক সেটাই করলেন। রোববার তিনি আমেরিকার B-2 বোমারু বিমান পাঠিয়ে সরাসরি ইরানে হামলা চালালেন। এই হামলার লক্ষ্য ছিল ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা, যার মধ্যে রয়েছে নাতানজ, ইসফাহান এবং ফোরডো। এই ঘটনাকে অনেকেই বলছেন—এটি আর কূটনীতি নয়, এটি যুদ্ধের সরাসরি ঘোষণা। ট্রাম্প পরে নিজের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে এ হামলাকে “spectacular military success” আখ্যা দেন এবং দাবি করেন, ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক অবকাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই হামলার প্রভাব ছিল অনেকটাই প্রতীকী এবং কৌশলগতভাবে ব্যর্থ। কারণ ইসফাহান ও নাতানজে যেসব স্থাপনায় আঘাত হানা হয়েছে, সেগুলোতে ইসরায়েল আগে থেকেই হামলা চালিয়েছিল। এসব স্থাপনা থেকে আগেই ইউরেনিয়াম এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। শুধু ফোরডো ছিল নতুন লক্ষ্যবস্তু, কিন্তু স্যাটেলাইট ছবি অনুযায়ী সেখানে ক্ষতি খুব সীমিত। মূল স্থাপনাটি, যা বহু মিটার গভীরে এবং পাহাড়ের নিচে অবস্থিত, তা অক্ষতই আছে। আশপাশের স্থানীয় বাসিন্দারাও আগুন বা ধোঁয়া দেখেননি, এমনকি পার্শ্ববর্তী ক্বোম শহরের জনজীবনও ছিল স্বাভাবিক। অর্থাৎ ট্রাম্প যা ধ্বংস করেছেন বলে দাবি করেছেন, বাস্তবে তা ধ্বংস হয়নি।

তবে ইরানের মতে, এই হামলা ধ্বংস করেছে কূটনীতিকে। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর আগে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে একটি পরোক্ষ আলোচনা চলছিল। কিন্তু এই আক্রমণ সেই আলোচনা ও সম্ভাবনার ওপর ছাই চাপিয়ে দিয়েছে। তুরস্কের আঙ্কারায় ওআইসি বৈঠকে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি বলেন—“যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক স্থাপনাগুলো নয়, বরং ধ্বংস করেছে কূটনীতির শেষ অবলম্বন।” তিনি আরও বলেন, এটি ছিল শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বন্ধ করে দেওয়ার মতো একটি প্রভাবশালী পদক্ষেপ।

যদিও প্রথমদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, তারা ইসরায়েলের হামলার বিষয়ে অবগত ছিল কিন্তু সরাসরি অংশ নেয়নি, ট্রাম্পের এই হামলা সে দাবিকে সম্পূর্ণ খণ্ডন করে। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেসকিয়ান নিজেই বলেন, “প্রথমে তারা লুকোচুরি করেছিল, কিন্তু ইসরায়েল চাপে পড়ে গেলে তারা সরাসরি যুদ্ধে নেমে পড়ে—এবং এখন সত্য উন্মোচিত।” এই বক্তব্যের পর স্পষ্ট হয়ে যায়—তেহরান মনে করছে, এই যুদ্ধের প্রকৃত সূচনা যুক্তরাষ্ট্রই করেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল যুদ্ধের সূচনায় যে কৌশল নিয়েছিল—যেমন শীর্ষ জেনারেলদের হত্যা, নেতাদের বাসভবনে আক্রমণ—তা ছিল একটি র‍্যাপিড ফলস থিওরি। তারা ভেবেছিল, এতে ইরানের অভ্যন্তরীণ ভাঙন তৈরি হবে, এবং সরকার পতনের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হবে। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ সম্পূর্ণ উল্টো হয়েছে। ইরানের জনগণ আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এবং সামরিক বাহিনী নতুন নেতৃত্বে আগ্রাসী জবাব দেওয়া শুরু করেছে।

এই পরিস্থিতিতে মার্কিন হস্তক্ষেপ এক ধরনের ‘ইসরায়েলি পরাজয়’ ঢাকার চেষ্টা বলেই মনে করছেন অনেক কূটনৈতিক বিশ্লেষক। কারণ ইসরায়েল এককভাবে এই যুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত সুবিধা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, এবং যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ছাড়া সেটিকে বিজয়ের দিকে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব ছিল না।

রোববার হামলার পর মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ জানান, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বাড়াতে চায় না, বরং তেহরানের সঙ্গে আলোচনায় ফিরতে চায়। কিন্তু তেহরানের তরফ থেকে স্পষ্ট জানানো হয়েছে—যে কোনো সরাসরি হামলার উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে। আয়াতুল্লাহ খামেনি আগেই বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র যদি হামলা চালায়, তার মূল্য তাদের চরমভাবে দিতে হবে।”

এখন প্রশ্ন উঠছে—ইরান কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাবে? সম্ভাব্য বিকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে—মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ১৯টি সামরিক ঘাঁটির যেকোনো একটিতে হামলা, হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা (যা বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ তেলের রপ্তানি পথ), অথবা তাদের পারমাণবিক নীতিতে পরিবর্তন আনা। তবে এখনো ইরান এনপিটি (NPT) চুক্তির আওতায় থাকতে আগ্রহ দেখিয়েছে।

এদিকে ইরান বলছে, তারা ছয় মাস পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত। স্বাস্থ্যমন্ত্রকের হিসেবে, এ পর্যন্ত অন্তত ৪০০ বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ২,০০০-এর বেশি আহত হয়েছেন। এইসব তথ্য মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিবেশকে আরও অস্থির করে তুলছে।

রোববারই এক বিবৃতিতে সৌদি আরব, কাতার, ওমান, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং তুরস্ক পৃথকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলার "স্থায়ী ও বিপজ্জনক প্রভাব" নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, পুরো অঞ্চলে একটি বড় সংঘাতের ছায়া নেমে এসেছে।

এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে আলোচনা চলছে—যুক্তরাষ্ট্র কি সত্যিই কৌশলগত সুবিধা পেল, না কি তারা এক বিপজ্জনক সংঘাতের গভীরে ঢুকে পড়েছে, যার শেষ কোথায় কেউ জানে না।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

জামালপুরে প্রতিদিন মিলবে ৫০ লাখ ঘনফুট গ্যাস

জামালপুরে প্রতিদিন মিলবে ৫০ লাখ ঘনফুট গ্যাস

জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলায় গ্যাস অনুসন্ধান কূপ 'জামালপুর-১'-এ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনযোগ্য গ্যাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড... বিস্তারিত