মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতন হোন, চিনে নিন লক্ষণ ও প্রকারভেদ

স্বাস্থ্য ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ আগস্ট ০৬ ১১:২৪:৪২
মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতন হোন, চিনে নিন লক্ষণ ও প্রকারভেদ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, মানসিক রোগগুলি হলো এমন অবস্থা যা কোনো ব্যক্তির চিন্তা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ বা আচরণে উল্লেখযোগ্য ব্যাঘাত সৃষ্টি করে এবং সাধারণত জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অসুবিধা বা যন্ত্রণার কারণ হয়। মানসিক রোগ বা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। ২০১৯ সালে বিশ্বের ৯৭০ মিলিয়ন মানুষ বা প্রতি আটজনের মধ্যে একজন মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিল, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল উদ্বেগ ও বিষণ্নতা জনিত সমস্যা। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ২০২০ সালে উদ্বেগ ও বিষণ্নতা জনিত রোগের সংখ্যা যথাক্রমে ২৬% ও ২৮% বেড়ে গিয়েছিল। যদিও মানসিক রোগের জন্য কার্যকর প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা বিদ্যমান, অধিকাংশ রোগী যথাযথ সেবা থেকে বঞ্চিত থাকেন এবং তারা সামাজিক কলঙ্ক, বৈষম্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সম্মুখীন হন।

মানসিক রোগের বিভিন্ন প্রকার

উদ্বেগজনিত রোগসমূহ

২০১৯ সালে প্রায় ৩০১ মিলিয়ন মানুষ উদ্বেগজনিত রোগে ভুগছিলেন, যার মধ্যে ছিল ৫৮ মিলিয়ন শিশু ও কিশোর। উদ্বেগজনিত রোগে অতিরিক্ত ভয়, চিন্তা ও আচরণগত ব্যাঘাত থাকে যা ব্যক্তি জীবনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করে। সাধারণ উদ্বেগ, প্যানিক অ্যাটাক, সামাজিক উদ্বেগ, বিচ্ছেদের উদ্বেগসহ বিভিন্ন ধরণের উদ্বেগজনিত রোগ রয়েছে। এসব রোগের জন্য মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা এবং প্রয়োজনে ঔষধ ব্যবহার করা হয়।

বিষণ্নতা (ডিপ্রেশন)

২০১৯ সালে ২৮০ মিলিয়ন মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছিলেন, যাদের মধ্যে ছিল ২৩ মিলিয়ন শিশু ও কিশোর। বিষণ্নতা সাধারণ মেজাজের ওঠানামার চেয়ে ভিন্ন, এটি দীর্ঘস্থায়ী এবং ব্যক্তি অধিকাংশ সময় দুঃখী, বিরক্ত বা অবসন্ন বোধ করে। অন্য লক্ষণগুলোর মধ্যে মনোযোগের অভাব, অপরাধবোধ, ভবিষ্যতের প্রতি হতাশা, আত্মহত্যার চিন্তা, ঘুম বা খাওয়ার অভ্যাসের পরিবর্তন এবং অতিরিক্ত ক্লান্তি অন্তর্ভুক্ত। বিষণ্নতা আক্রান্তদের আত্মহত্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে চিকিৎসা ও ঔষধের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

বাইপোলার ডিজঅর্ডার

২০১৯ সালে ৪০ মিলিয়ন মানুষ বাইপোলার ডিজঅর্ডারে ভুগছিলেন। এই রোগে রোগী মনের অবস্থা পরিবর্তিত হয়, কখনো বিষণ্নতায় ডুবে যান আবার কখনো অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস বা রেগে যাওয়ার মতো ম্যানিক অবস্থায় চলে যান। ম্যানিক পর্যায়ে অতিরিক্ত কথা বলা, ঘুমের অভাব, আত্মবিশ্বাসের অতিরিক্ত বর্ধন, অস্থিরতা ও বেপরোয়া আচরণ দেখা যায়। বাইপোলার রোগীদেরও আত্মহত্যার ঝুঁকি বেশি থাকে। চিকিৎসায় মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষাদান, চাপ কমানো, সামাজিক কার্যকলাপ বাড়ানো এবং ঔষধ অন্তর্ভুক্ত।

পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি)

যুদ্ধ ও সংঘর্ষ এলাকার মানুষের মধ্যে পিটিএসডি’র প্রাদুর্ভাব বেশি। কোনো ভয়াবহ বা আতঙ্কজনক ঘটনা পরবর্তী সময়ে এটি বিকাশ লাভ করে। এর লক্ষণগুলোর মধ্যে ঘটনার পুনরাবৃত্তি স্মৃতি, মেমরি এড়ানো, এবং বর্তমানেও হঠাৎ আতঙ্ক অনুভব অন্তর্ভুক্ত। দীর্ঘস্থায়ী এই অবস্থায় ব্যক্তি সামাজিক ও শারীরিক জীবনে সমস্যায় পড়ে। কার্যকর মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা রয়েছে।

সিজোফ্রেনিয়া

বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৪ মিলিয়ন মানুষ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত, যার জীবনকাল সাধারণ মানুষের চেয়ে ১০-২০ বছর কম। রোগীদের বোধের ভারসাম্যহীনতা, বিভ্রান্তিকর ধারনা, দৃষ্টিভ্রম, অগোছালো চিন্তা ও আচরণ লক্ষ্য করা যায়। জ্ঞানীয় দক্ষতা হ্রাস পেতে পারে। ঔষধ, পরিবারের সহায়তা ও পুনর্বাসন চিকিৎসায় উন্নতি সম্ভব।

খাদ্যাভাসজনিত রোগ

২০১৯ সালে ১৪ মিলিয়ন মানুষ খাদ্যাভাসজনিত রোগে ভুগছিলেন, যার মধ্যে ছিল প্রায় ৩ মিলিয়ন শিশু ও কিশোর। এগুলো হলো অ্যানোরেক্সিয়া নেরোভসা, বুলিমিয়া নেরোভসা ইত্যাদি। রোগীরা খাবারের প্রতি অস্বাভাবিক দৃষ্টি ও শরীরের ওজন নিয়ে অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন থাকেন। গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও মানসিক যন্ত্রণা সৃষ্টি করে। পারিবারিক ও মনস্তাত্ত্বিক থেরাপি কার্যকর।

বিঘ্নকারী আচরণ ও সামাজিক ব্যাধি

২০১৯ সালে ৪০ মিলিয়ন মানুষ, যার মধ্যে অনেক শিশু ও কিশোর, কনডাক্ট ডিজঅর্ডার বা সামাজিক ব্যাধিতে ভুগছিলেন। এই রোগে ব্যক্তি অন্যের অধিকার বা সামাজিক নিয়ম-কানুন লঙ্ঘন করে চলেন। চিকিৎসায় পারিবারিক ও শিক্ষাগত সহায়তা, সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি ও মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

স্নায়ুবিকাশজনিত রোগ

এই রোগগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক, ভাষাগত, চলাচল ও সামাজিক দক্ষতায় দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি করে। অটিজম, এডিএইচডি, বুদ্ধিমত্তার বিকাশজনিত ব্যাধি এগুলোর অন্তর্ভুক্ত। শিশুকাল থেকেই লক্ষণ দেখা যায়। মনস্তাত্ত্বিক ও চিকিৎসা পদ্ধতি, অকুপেশনাল থেরাপি, ভাষা থেরাপি এবং প্রয়োজনে ঔষধ ব্যবহৃত হয়।

ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিরা

অধিকাংশ মানুষ মানসিক রোগের ঝুঁকি কম হলেও দারিদ্র্য, সহিংসতা, প্রতিবন্ধকতা ও বৈষম্যের মতো বিরূপ পরিবেশে যারা বসবাস করে, তাদের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ব্যক্তিগত ও জেনেটিক কারণও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও সামাজিক সহায়তা

বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম নয়, এবং প্রাপ্ত সেবার মান অনেক ক্ষেত্রে দুর্বল। উদাহরণস্বরূপ, মাত্র ২৯% সিজোফ্রেনিয়া রোগী এবং এক তৃতীয়াংশ বিষণ্নতা রোগীই যথাযথ চিকিৎসা পান। সামাজিক, শিক্ষাগত, কর্মসংস্থান, বাসস্থান ও পারিবারিক সহায়তাও অপরিহার্য।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পদক্ষেপ

ডব্লিউএইচওর মানসিক স্বাস্থ্য কর্মপরিকল্পনা ২০১৩-২০৩০ সালের মধ্যে চারটি প্রধান উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে:১. মানসিক স্বাস্থ্য নীতি ও নেতৃত্ব শক্তিশালীকরণ;২. সমন্বিত, সম্প্রদায়ভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান;৩. মানসিক স্বাস্থ্য প্রচার ও প্রতিরোধ কৌশল বাস্তবায়ন;৪. তথ্য ব্যবস্থা, গবেষণা ও প্রমাণভিত্তিক নীতি উন্নয়ন।

ডব্লিউএইচওর ‘মেন্টাল হেলথ গ্যাপ অ্যাকশন প্রোগ্রাম (mhGAP)’ মূলত দরিদ্র দেশগুলিতে অ-বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম সরবরাহ করে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার বিস্তার ঘটায়। এর মাধ্যমে চিকিৎসা প্রণালী এবং রোগ নির্ণয়ে কার্যকর সমাধান প্রদান করা হয়।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ