জুলাইয়ের আড়ালের গল্প

 জুলাই আন্দোলনের 'সিক্রেট কোডিং' চট্টগ্রামের ভাষায়

রাজনীতি ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ০৪ ১০:১৬:০৪
 জুলাই আন্দোলনের 'সিক্রেট কোডিং' চট্টগ্রামের ভাষায়

গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের বৃহৎ আন্দোলন গড়ে ওঠে। ২০১৮ সালের কোটা পুনর্বহালের দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলন দ্রুত দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং অবশেষে একটি গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। সরকার আন্দোলন দমন করতে অতি নিষ্ঠুরতার পথ অবলম্বন করে; নিরস্ত্র অসংখ্য মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে আন্দোলন-প্রধান এলাকা গুলোতে ইন্টারনেট সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র উপায় হয়ে ওঠে অফলাইন এবং সীমিত মোবাইল ফোন ব্যবহার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী আশিকুর রহমান সম্প্রতি তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে জুলাই আন্দোলনের সময়ের আড়াল থেকে উঠে আসা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অনন্য কাহিনি শেয়ার করেছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন, যখন ইন্টারনেট সারাদেশে বন্ধ ছিল, তখন শিক্ষার্থীরা বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থায় নির্ভর করত। বিশেষ করে, কয়েকটি পুরনো ‘বাটন ফোন’ ব্যবহার করে তারা যোগাযোগ রক্ষা করত। এই সময়েই উদ্ভাবিত হয় একটি ‘সিক্রেট কোডিং সিস্টেম’, যার মাধ্যমে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় গোপন বার্তা আদান-প্রদান করা হতো।

আশিকুর বলেন, একদিন ফরহাদ ভাইয়ের মোবাইলে একটি ফোন আসে, যার কলটি তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় দীর্ঘ সময় কথা বলেন। চট্টগ্রামের ভাষা না জানায় প্রথমে তিনি কিছু বুঝতে পারেননি। পরে জানা যায়, ফরহাদ ভাই আসলে সাদিক ভাইয়ের সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলছিলেন। এই ‘কোডেড’ আলাপচারিতার উদ্দেশ্য ছিল মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের হাত থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও আলোচনা রক্ষা করা। কারণ, ইন্টারনেট না থাকায় মোবাইল যোগাযোগ ছিল একমাত্র জীবনরেখা, তাই যোগাযোগের গোপনীয়তা বজায় রাখাটা অত্যন্ত জরুরি ছিল।

এরপর থেকে আন্দোলনের সময় যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণ বা পরিকল্পনা মোবাইলে করার প্রয়োজন হলে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা শুরু হয়। এই ভাষাকে তারা ‘সিক্রেট কোডিং সিস্টেম’ হিসেবে ব্যবহার করত যাতে মোবাইল ব্যবস্থাপনায় নজরদারি করা ব্যক্তিরা কথোপকথনের বিষয়বস্তু বুঝতে না পারে।

এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও সরকারের কঠোর দমন-নিষেধের মধ্যেও আন্দোলনকারীরা অত্যাধুনিক কৌশল ও স্থানীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা এমন এক গোপন মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে, যা যোগাযোগের গোপনতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

এই ‘সিক্রেট কোডিং সিস্টেম’ শুধু ভাষাগত সংরক্ষণের একটি উদাহরণ নয়, বরং এটি আন্দোলনের মধ্যে স্থানীয় ভাষার শক্তি ও ঐক্যের নিদর্শন হিসেবেও দেখা যেতে পারে। এটি প্রমাণ করে, ভাষা ও সংস্কৃতি সংগ্রাম এবং একাত্মতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।

সর্বোপরি, সরকারি কঠোর বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা উদ্ভাবনী পন্থায় একত্রিত হয়ে নিজেদের দাবি আদায়ে সফল হয়েছেন। এই ঘটনা বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক সচেতনতা, সংগঠন দক্ষতা এবং সংকট মোকাবিলার ক্ষমতার এক অনন্য নিদর্শন। এটি প্রমাণ করে যে, সংকটের সময়ে স্থানীয় ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিপ্লবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হয়ে উঠতে পারে।

-ইসরাত, নিজস্ব প্রতিবেদক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ