২২ দিন ধরে অদৃশ্য খামেনি: ইরান কি নেতৃত্ব সংকটের মুখে?

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ০৪ ০৯:৪৮:৫২
২২ দিন ধরে অদৃশ্য খামেনি: ইরান কি নেতৃত্ব সংকটের মুখে?

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির জনসমক্ষে দীর্ঘ অনুপস্থিতি ইরানসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নতুন করে উদ্বেগ ও জল্পনার জন্ম দিয়েছে। গত ২২ দিন ধরে তাঁকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। সর্বশেষ, ২ জুলাই (বুধবার) রাতে তেহরানে তাঁর নিজ বাসভবন ইমাম খোমেনি হুসেইনিয়াতে অনুষ্ঠিত মহররম উপলক্ষে উচ্চপর্যায়ের যে বার্ষিক ধর্মীয় আয়োজন হয়েছিল সেখানে খামেনির অনুপস্থিতি ছিল অত্যন্ত ব্যতিক্রমী। সাধারণত এই আয়োজনে তাঁর অংশগ্রহণ রেওয়াজের মতোই ছিল, যা শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং তাঁর জীবিত ও সক্রিয় নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো।

এই অনুপস্থিতিকে ঘিরে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। বরং খবর প্রচারে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যাতে মনে হয় বিষয়টি স্বাভাবিক। তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিশেষ করে বিবিসি পার্সিয়ান সার্ভিস জানিয়েছে, খামেনির এই অনুপস্থিতি ইঙ্গিত দেয় যে, তাঁর জীবন এখনও মারাত্মক নিরাপত্তা হুমকির মুখে রয়েছে। এমনকি স্বাস্থ্যগত সমস্যার বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এরইমধ্যে ইরানের কয়েকজন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা নিহত হলেও, খামেনি কোনো জানাজায় অংশ নেননিযা তাঁর নেতৃত্বের গতানুগতিক রুটিনের বাইরে একটি অস্বাভাবিক ব্যত্যয়।

এই অনুপস্থিতির পেছনে যে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা হুমকি রয়েছে, সেটি সরাসরি স্বীকার করেছেন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ নেতারা। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ সম্প্রতি দেশটির চ্যানেল ১৩-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “আমরা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেই সুযোগ তৈরি হয়নি।” তাঁর এই বক্তব্য ইঙ্গিত করে, খামেনির জীবন যে কেবল রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিতে নয়, বরং বাস্তব অর্থেই টার্গেট করা হচ্ছে।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আরও একধাপ এগিয়ে বলেন, “খামেনিকে হত্যা করলে যুদ্ধ শেষ হয়ে যেতে পারে।” এমন বক্তব্য একটি রাজনৈতিক বার্তা হলেও, এতে অন্তর্নিহিত রয়েছে একটি সুস্পষ্ট গোপন কৌশলগত ঘোষণা যেখানে ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে লক্ষ্য করেই যুদ্ধের গতি নির্ধারণের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, “আমি জানি আয়াতুল্লাহ খামেনি ঠিক কোথায় লুকিয়ে আছেন। তবে এখনই তাঁকে হত্যা করার কোনো পরিকল্পনা আমার নেই।” তাঁর এই বক্তব্যে একদিকে যেমন ইরানের শীর্ষ নেতার অবস্থান সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সক্ষমতা প্রতিফলিত হয়, অন্যদিকে এটি খামেনির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা যে কতটা সংকটাপন্ন, সেটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এর আগে রয়টার্স একটি প্রতিবেদনে জানায়, খামেনিকে হত্যার ইসরায়েলি প্রস্তাবে ট্রাম্প সরাসরি ‘ভেটো’ দেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই মার্কিন কর্মকর্তার বরাতে বলা হয়, ইসরায়েল চেয়েছিল ট্রাম্প প্রশাসনের সহযোগিতায় খামেনিকে নিশানা করতে। কিন্তু সম্ভাব্য কৌশলগত জটিলতা ও যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় ট্রাম্প সে প্রস্তাব নাকচ করে দেন।

আয়াতুল্লাহ খামেনি বর্তমানে ৮৫ বছর বয়সী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ইরানের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামরিক ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তাঁর নেতৃত্বে ইরান জটিল আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, অর্থনৈতিক চাপ, পারমাণবিক কর্মসূচি এবং সিরিয়া-ইয়েমেন-লেবাননসহ বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক যুদ্ধ ও প্রক্সি সংঘাতে যুক্ত থেকেছে। তাঁর অনুপস্থিতি মানে কেবল একজন নেতার অনুপস্থিতি নয়, বরং একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বব্যবস্থার ব্যালেন্সে ধাক্কা।

ইরানের শাসনব্যবস্থায় সর্বোচ্চ নেতার উত্তরসূরি নির্বাচনের বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয় এবং রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল। খামেনি দীর্ঘদিন ধরে নিজের উত্তরসূরি ঘোষণা না করায় এবং এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো বিকল্প নাম প্রকাশ্যে না আসায় তাঁর অনুপস্থিতি ঘিরে এক ধরনের নেতৃত্ব সংকটের আভাস মিলছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, খামেনির শারীরিক অক্ষমতা বা সম্ভাব্য মৃত্যু ইরানে অভ্যন্তরীণ শক্তিসাম্যের ভারসাম্যকে নড়বড়ে করে দিতে পারে।

এই সময়টিতে খামেনির অদৃশ্য থাকা কেবল ইরানের জন্য নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ। ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ এবং হিজবুল্লাহ, হুথি ও অন্যান্য ইরানঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীর সামরিক তৎপরতার ভেতরে খামেনির সামগ্রিক অনুপস্থিতি একদিকে যেমন কৌশলগত হিসাব-নিকাশকে প্রভাবিত করছে, অন্যদিকে আঞ্চলিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি খামেনির অনুপস্থিতির পেছনে গুরুতর স্বাস্থ্যগত কারণ বা হত্যাচেষ্টার হুমকি থেকে থাকে, তবে সেটি ইরানের রাজনৈতিক কাঠামোকে শুধু দুর্বলই করবে না, বরং আন্তর্জাতিক মিত্রতা ও শত্রুতা নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিতে পারে। বিশেষ করে ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষের সম্ভাব্য বিস্তার, পারমাণবিক উত্তেজনা এবং প্রক্সি যুদ্ধে বাড়তি আগ্রাসন সবই এই মুহূর্তে খামেনির উপস্থিতি-অনুপস্থিতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির জনসমক্ষে দীর্ঘ অনুপস্থিতি নিছক ব্যক্তিগত বিষয় নয়। এটি মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে এক জটিল এবং সম্ভবত বিপজ্জনক মোড়ের ইঙ্গিত। ইরানের শীর্ষ নেতৃত্ব এখন কেবল আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নয়, বরং অস্তিত্বগত হুমকির মধ্যে রয়েছে। পরবর্তী সময়ে খামেনির প্রকাশ্যে ফিরে আসা অথবা আরও দীর্ঘ অনুপস্থিতিই নির্ধারণ করবে ইরান নিজেকে কীভাবে গুছিয়ে নেয়, নেতৃত্ব সংকট কতটা এড়াতে পারে এবং ভবিষ্যতের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা কোন পথে এগিয়ে যাবে।

-রফিক, নিজস্ব প্রতিবেদক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ